বাবুল সিদ্দিক
খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে গ্রীক দেশে এক অন্ধ কবি ছিলেন, তার নাম ছিল হোমার। কারো কারো মতে তার জন্ম বর্তমান তুরস্কের ইজমিরে। ভিক্ষাবৃত্তি ছিল তার পেশা। গ্রীক দেশের হিবস নামক এক নগর ছিল। সেই নগরের তোরণে এই অন্ধ চারণ কবি গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করতেন। রাজ-রাজাদের কাহিনী নিয়ে তিনি গান বাঁধতেন। কাহিনীগুলো এমনই চিত্তাকর্ষক ছিল যে, হাজার হাজার বৎসর পরেও লোকে তা ভুলেনি। ভোলেনি সেই অন্ধ চারণ কবির নামটিও , তিনিই হচ্ছেন হোমার। অবিস্মরণীয় স্মৃতিশক্তি, কাব্যিক রস আর তাৎক্ষণিক ছন্দ মিলিয়ে কবিতা বলার ক্ষেত্রে তাহার ছিল অনন্য প্রতিভা। এই অন্ধ কবি হোমারই হচ্ছেন বিখ্যাত গ্রীক মহাকাব্য ‘ইলিয়াট’ ও ‘ওডিসি’র রচয়িতা।
খ্রিষ্টপূর্ব ১২ শতকের দিকে গ্রীক রানী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমণী হেলেনের কারণে সংঘটিত যুদ্ধে ট্রয় নগরী ধ্বংস নিয়ে তার মুখে মুখে বলা ঘটনা, গ্রীক লিপিতে চামড়া, প্যাপিরাস প্রভৃতিতে লিখে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সেই মহাকাব্যের নাম ‘ইলিয়াড,যাতে প্রায় ১৬ হাজার পংক্তি আছে।
পরবর্তীতে আজ পর্যন্ত ৩০০০ বৎসর ধরে প্রেম, ভালবাসা, যুদ্ধবিগ্রহ, মানবিকতার, রাজনীতি অন্য আরও অনেক ক্ষেত্রে পাশ্চত্য লেখক সহ বিশ্বের অনেক কবি, সাহিত্যিকের রচনায় ইলিয়াডের ছায়া রয়েছে। ইলিয়াডের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী কতো মুভি, নাটক, চলচ্চিত্র যে করা হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। ট্রয় যুদ্ধ শেষে বিজয়ীরা সমুদ্র পথে গ্রীক ফেরার সময় এক নাবিক দিক হারিয়ে তার সঙ্গীসহ সাগরে বারংবার দুর্বিসহ বিপদে পতিত হয়েছিল। সে কাহিনী নিয়ে মহাকবি হোমারের আরেক সৃষ্টি ‘ওডিসি’। ওডিসি নিয়েও নাটক, সিনেমা কম হয় নাই।
আমদের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে যেমন রামায়ণ আর মহাভারত, তেমনি গ্রীক ভাষাতেও অনুরুপ দু’খানি মহাকাব্য হচ্ছে ইলিয়াড ও ওডিসি। ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যসম্পন্ন দেশগুলির মধ্যে একটি গ্রীক। এই ইলিয়াড ও ওডিসি আমাদের রামায়ণ ও মহাভারতের মতই বই দু’খানি ওই দেশের মানুষের কাছে তিন হাজার বৎসর যাবত জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। শুধু জনপ্রিয়তার পায় নি, যুগে যুগে কতো কবি, সাহিত্যকে প্রেরণা জুগিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে লোকেরা সেই বিস্ময়কর কাহিনী শুনতে শুনতে কৌতুহলে, বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়েছে। হরষে, বিষাদে ভরে গেছে তাদের মন। পৃথিবীর কত ভাষায় যে এই মহাকাব্য দুইটি অনূদিত হয়েছে তার কোন ঠিক নাই। রামায়ণ, মহাভারতের মত বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসে এ’দুটি সমকক্ষ বই খুব কমই আছে। হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্য ও হোমারিয় ত্রোস্তাবলির রচয়িতা হোমারের মহাকাব্যগুলো থেকেই পাশ্চাত্যের সাহিত্যধারাটির সূচনা হয়েছিল। কথাসাহিত্য ও সাহিত্যের সাধারণ ইতিহাসেও এই দুইটি মহাকাব্যের প্রভাব অপরিসীম।
হোমারের সময়কাল; হোমারের সময়কাল নিয়ে প্রাচীন কালেই যথেষ্ট বিতর্ক ছিল; আজও আছে। হেরোডোটাসের মতে, হোমার হেরোডোটাসের জন্মের চারশত বছর আগে অর্থাৎ ৮৭০ খ্রিষ্টপূর্বে বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য প্রাচীন সূত্রে তাকে ট্রয় যুদ্ধের অনেক নিকটবর্তী সময়ের (১১৯৪-১১৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মানুষ বলে মনে করা হয়েছে।
আধুনিক গবেষকরা হোমারের সময়কাল বলতে তার কাব্য-রচনা ও ব্যক্তিগত জীবনকাল উভয়কেই একযোগে বুঝিয়েছেন। তারা এই বিষয় একমত যে, ইলিয়াড ও ওডিসি খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দির একেবারে শেষকালে অথবা অষ্টম খ্রিষ্টপূর্বব্দের রচনা এবং ইলিয়ড ও ওডিসি সম্ভবত একই দশকে রচিত হয়েছিল। ইলিয়াড পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনা। বিগত কয়েক শতাব্দির ধরে কোন কোন গবেষক খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দিকে হোমারের রচনাকাল বলে মনে করেছেন। যারা মনে করেন, হোমারীয় কাব্যধারাটি এক দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছিল, তারা এই কাব্যের রচনাকাল আরও পরে হয়েছিল বলে মত প্রকাশ করেছেন। গ্রেগরী ন্যাগির মতে, ‘এই রচনাগুলো সুসংহত আকার নেয় খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ট শতাব্দিতে।’ হোমার ঐতিহাসিক ব্যাক্তি কি না এই প্রশ্নেটি আজও ঘুরে ফিরে আসে। প্রাচীনযুগে রচিত হোমারের কোন বিশ্বাসযাগ্য জীবনী পাওয়া যায় না। তার কবিতাগুলোও বহু শতাব্দীর মৌখিক গল্পকথন ও একটি সুসংগঠিত কাব্যরচনা ব্যবস্হার মিশ্রণ। মার্টিন ওয়েষ্টারের মতে, ‘হোমার কোন ঐতিহাসিক কবির নাম নয়, বরং কাল্পনিকভাবে সৃষ্ট একটি নাম।’ আলফ্রেড হউবেক বলেছেন, ‘হোমারের রচনা গঠন-সংক্রান্ত প্রভাব সমগ্র গ্রীক সংস্কৃতি বিকাশে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেক গ্রীক তাকে জাতীয় সংগঠক মনে করেন।
ইলিয়াডের কাহিনী (সংক্ষিপ্ত) : গ্রীসদের দেবতা স্বর্গের রাজা জিউস। একদিন এক ভোজসভায় সমস্ত দেবদেবীকে তিনি নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু বাদ পড়লেন একজন, তিনি হচ্ছেন ‘অশান্তির দেবী’। অশান্তির দেবী ক্ষুণ্ন হলেন। আড়ালে থেকে দেবতাদের সভায় তিনি একটি সোনার আপেল ফেলে দিলেন, আর আপেলের গায়ে লিখে দিলেন, ‘সবার চেয়ে যে সুন্দরী এ আপেলটি তার জন্য।
দেবীদের মধ্যে তিনজন ছিলেন পরম সুন্দরী; তারা হলেন হীরা, এথিনা আর আলফ্রেডাইট। তিনজনই দাবী করলেন আপেলটি। শেষে যখন নিজেদের মধ্যে মীমাংসা হলো না তখন তারা নেমে এলেন পৃথিবীতে। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস, পরম সুন্দর এক পুরুষ বলে তার অসম্ভব খ্যাতি। পাহারের উপর বসে তিনি পিতার মেষ-পাল পাহারা দিচ্ছিলেন। তিন দেবী এসে বিচারের ভার দিলেন তারই কাছে।
সেই সঙ্গে তিনজনই নানারকম লোভ দেখাতেও ছাড়লেন না। হীরা দেবরাজ জিউসের পত্নী, তিনি লোভ দেখালেন ক্ষমতার। এথেনা লোভ দেখালেন জ্ঞান ও বিদ্যার। আর আলফ্রেড, তিনি দেখালেন ভালবাসার। বললেন, ‘ক্ষমতা আর বিদ্যা দিয়ে কি হবে প্যারিস? আমাকে যদি তুমি সর্বসেরা মেনে নিয়ে আপেলটি আমাকে দাও তাহলে আমি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবো।’
প্যারিস কোনকিছু চিন্তা না করে আফ্রোডাইসকে দিয়ে দিলেন আপেলটি। ফলে একজন যেমন খুশি হলেন আর বাকি দুইজন গেলেন ভীষণ চটে। তারা ঠিক করলেন প্যারিসকে এর শাস্তি পেতেই হবে। তারা ঠিক করলেন গ্রীক দেশের স্পাটা রাজ্য, তারই রাজা মেনেলাস। তার পত্নী হেলেন ছিলেন তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুন্দরী। আফ্রোডাইসের চক্রান্তে প্যারিস স্পাটা রাজ্যের অতিথি হলেন। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন নিজ দেশ ট্রয়ে।
গ্রীকের জনগণ এই অপমান সহ্য করতে রাজি হলো না। মেনেলেসের দাদা এগামেনল ছিলেন গ্রীকের সম্রাট। তিনি গ্রীকের সমস্ত রাজাদের একত্রিত করলেন। সদলবলে ট্রয় আক্রমন করলেন গ্রীসরা। অবরোধ করে রাখলো প্রাচীর ঘেরা শহর।
শুরু হলো যুদ্ধ, ট্রয় যুদ্ধ নামে বিখ্যাত। এ নিয়ে লেখা হোমারের ইলিয়াড। ট্রয়ের আর এক নাম ইলিয়াম।তাই থেকে বইয়ের ওই নাম। অধিবাসিদের বলা হতো ট্রোজান। ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চললো। হাজার হাজার বীর নিহত হলেন। তাদের মধ্যে ট্রোজানদের বীর সেনাপতি হেক্টর এবং গ্রীকদের শ্রেষ্ঠ বীর আকিলিসও ছিলেন। কিন্তু জয় পরাজয় নিস্পত্তি হলো না। তারপর হঠাৎ একদিন গ্রীকরা লড়াই ছেড়ে দিয়ে দেশে ফেরার জন্য জাহাজে গিয়ে উঠলো। নগরের বাইরে যুদ্ধের মাঠে পরে রইলো একটি প্রকান্ড কাঠের ঘোড়া। ট্রজানরা ভাবলো, গ্রীকরা বুঝি ঘোড়াটি ফেলে পালিয়েছে। বিজয়ের চিহ্ন হিসাবে মহাসমারোহে তারা ঘোড়াটিকে টেনে নিয়ে এলো শহরের মধ্যে।
আসলে সেটা ছিল গ্রীকদের একটা কৌশল। ওই বিরাট কাঠের ঘোড়া এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, তার পেটটা ছিল ফাঁপা আর তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল বাছাই করা যত গ্রীক সৈন্য। রাত দুপুরে যখন সমস্ত ট্রোজানরা উৎসব ও কোলাহলে মত্ত তখন ওই গ্রীক সৈন্যরা কাঠের ঘোড়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে নগরের ফটক খুলে দিল, অন্যদিকে গ্রীক সৈন্যরা সত্যি সত্যিই জাহাজে চড়ে পালায় নি। তারা কাছেই লুকিয়ে ছিল। ফটক খুলতেই তারা দলে দলে নগরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
তারপর ? তারপর আর কি ? শুরু হলো হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, আগুন জ্বালিয়ে সমস্ত শহর পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিল তারা।
এভাবেই শেষ হলো ১০ বৎসরের ট্রয় যুদ্ধ। হেলেনকে উদ্ধার করে গ্রীকরা ফিরে এলো নিজ দেশে।
ওডিসির গল্প (সংক্ষিপ্ত) : হোমারের অপর মহাকাব্য হচ্ছে ওডিসি। ট্রয় যুদ্ধের অন্যতম গ্রীক বীর নায়ক ওডিসি বা ওডিসিউসকে নিয়ে লেখা। ঠিক ইলিয়াডের পরবর্তী ঘটনা নিয়ে রচিত এই মহাকাব্য।
ট্রয় যুদ্ধের পর ফেরার পথে একখানা জাহাজ ঝড়ের মুখে পরে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই জাহাজে ছিল ইথাকার রাজা ওডিসি বা ওডিসউস। পথভ্রম হয়ে তার জাহাজ সাগরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলেন। জাহাজটি আজ এ দ্বীপে গিয়ে লাগে তো কাল অন্য দ্বীপে।
এক এক দ্বীপে এক এক রকমের বিপদ দেখা দেয়। বুদ্ধি, সাহস আর শক্তি দিয়ে ওডিসিউস সে বিপদ কাটিয়ে ওঠেন। এভাবে কেটে যায় কয়েক বছর।
এক দ্বীপে বড় বড় পদ্ম ফোটে, সেই পদ্মের মধু খেলে মানুষ মাতালের মত শুধু পড়ে পড়ে ঘুমায়। জাহাজের লোকজন দ্বীপে নেমে সেই পদ্ম-মধু খেয়ে অসাড় হয়ে পড়ে রইল। বহু কষ্টে ওডিসিউস তাদের আবার জাহাজে নিয়ে তুললেন।
এক দ্বীপে থাকে সাইক্লোপস নামে এক চক্ষুওয়ালা এক দানব। মানুষ পেলে সে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখে, তারপর এক একটিকে ধরে আগুনে ঝলসিয়ে খেয়ে ফেলে। ওডিসিউসের দলকেও সে বন্দি করল। তার চোখ থাকতে তার নজরকে ফাঁকি দেয়া যাবে না বুঝে ওডিসিয়াস এক মতলব আটলেন। দানব যখন ঘুমোচ্ছিল তখন একটি জ্বলন্ত ছুঁচালো লাঠি তার চোখে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে অন্ধ করে দিলেন। দানব কিন্তু তাতে দমল না, সে গুহার মুখে বসে পাহাড়া দিতে লাগল। দানবের ছিল অনেক ছাগল, তাদের চড়ানোর জন্য গুহার বাইরে ছেড়ে দেওয়া দরকার। পাছে কেউ ছাগলের পিঠে চেপে পালিয়ে যায় তাই সে ছাগলের হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করে তাদেরকে ছাড়তে লাগলো। আর ওদিকে ছাগলের পেটের তলায় ঝুলতে ঝুলতে ওডিসিউস দলবল নিয়ে বেরিয়ে এলেন গুহা থেকে। দানব টের পেল না যে, ছাগলগুলোর পেটের নিচে মানুষ ঝুলছে। জাহাজে উঠে ওডিসিউস দানবকে উপহাস করলে দানব তার আত্মীয়দের নিয়ে ছুটে এলো, আর তীর থেকে বড় বড় পাথর ছুঁড়তে লাগল। কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে তারা জাহাজে উঠে জাহাজ ছেড়ে দিল।
মাঝ সমুদ্রে রাতের অন্ধকারে মায়াবিনী মৎস্য কন্যারা গান গায়। পাগল করা সেই গান শুনলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মুগ্ধ হয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়তে চায় জলে পাগলের মত। ওডিসিউস সঙ্গীদের কান আগে থাকতেই মোম দিয়ে বন্ধ করে দেন, যাতে কেউ সে গান শুনতে না পায়। কিন্তু নিজে তিনি গান শোনার লোভ দমন করতে পারেন না। তিনি আত্মরক্ষার জন্য নিজেকে বেধে রাখেন মাস্তুলের সঙ্গে। তবুও গান শুনে আত্মহারা হয়ে ছটফট্ করতে থাকেন তিনি। কিন্তু সঙ্গীরা কেউই বাঁধন খুলে দিতে রাজি না কারণ সেই রকমই নির্দেশ দেওয়া ছিল তাদের। আর অন্যেদের কানে মোমের ছিপি আটকানো থাকায় তারা তো গান শুনতে পাচ্ছিল না।
আর এক দ্বীপে থাকে এক জাদুকর, তার নাম সারসি। মানুষ পেলেই ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে তাদের শুয়োর বানিয়ে রাখে। ওডিসিয়াসের সাথীদের সে শুয়োর বানিয়ে খোয়ারে পুরে রাখল। তারপর ওডিসিয়াস স্বয়ং গিয়ে বুদ্ধির জোরে তাকে জব্দ তো করলেনই, শেষ পর্যন্ত তার এমন ভক্ত হয়ে পড়লো যে, সঙ্গীদের এবং আরও যে সব লোকদেরকে সে জানোয়ার বানিয়ে রেখেছিল তাদের সবাইকে সে মুক্তি তো দিলই, উপরন্তু ওডিসিয়াসকে কিছুতেই ছাড়তে রাজি হল না। বাধ্য হয়ে ওডিসিয়াসকে বেশ কিছুকাল সেই জাদুকরের অতিথি হয়ে কাটিয়ে ফের সমুদ্রে ভাসলেন। সারসি চোখের জলে তাকে বিদায় জানালো, সেই সঙ্গে পথে তাদের যাতে কোন বিপদ না হয় তাই প্রতিকুল বাতাসগুলোকে সে জাদুবলে একটি থলের মধ্যে আটকে সঙ্গে দিয়ে দিল যাতে সেগুলো কোন উপদ্রব করতে না পারে। কিন্তু ওডিসিয়াসের সঙ্গীদের কারো কারো হলো কুবুদ্ধি, কি আছে থলির ভেতর তা জানার জন্য থলি খুলতেই হু হু করে সমস্ত বাতাস বের হয়ে গেল আর জাহাজ ফের ঝড়ের কবলে পরে হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে চললো বিপথে।
যাই হোক, এভাবে আরও নানান বিপদ-আপদ কাটিয়ে সঙ্গীদের অনেককেই পথে হারিয়ে অবশেষে একদিন ওডিসিয়াস তার রাজ্য ইথাকায় এসে পৌঁছালেন। এদিকে প্রায় ২০ বছর ওডিসিয়াস দেশ ছাড়া। এই সুযোগে নানা জায়গা থেকে একদল যুবক (তাদের মধ্যে অনেকেই রাজপুত্র আছেন) এসে জুটেছিল রাজবাড়িতে। তারা বলছে, রাজা ওডিসিয়াস মারা গেছেন। এখন বিধবা রানী পেনেলোপীর তাদের কাউকে বিয়ে করুন, সেই হবেন রাজা। রানী পেনেলোপীর কিন্তু আর বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তার পুত্র টেলিমেকাস ও বড় হয়ে উঠেছে। তিনি এক কৌশল অবলম্বন করলেন। রানী একখানা কাপড় বুনতে শুরু করলেন। বললেন, ‘এটা হবে আমার বিয়ের পোষাক। কাপড় বোনা শেষ হলে তিনি স্বয়ম্বর সভা ডাকবেন।’
এদিকে দিনের বেলা রানী যেটুকু বোনেন রাতে আবার চুপি চুপি তা খুলে ফেলেন। কিন্তু যুবকের দল আর থাকতে না পেরে হইচই শুরু করে দিল।
ওডিসিয়াস ভিখারির বেশে রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। সমস্ত ঘটনা শুনলেন ও দেখলেন। তারপর হলো তান্ডব। প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো ওই বিবাহ ইচ্ছুক যুবকদের সঙ্গে। তাদের মেরে ধরে তাড়িয়ে দিলেন। আবার ইথাকার সিংহাসনে বসলেন ওডিসিয়াস। তারপর স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখে রাজত্ব করতে লাগলেন।
বাবুল সিদ্দিক, নিউ ইয়র্ক প্রবাসী লেখক