বাংলা বর্ণমালার প্রথম স্বরবর্ণ ‘অ’ প্রধানতঃ না—বোধক উপসর্গ বিশেষ। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে ‘অ’ দিয়ে শুরু অর্থবোধক শব্দগুলোর একটি বড় অংশই নেতিবাচক অর্থের প্রকাশরূপ; এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারি ও অতলস্পর্শী ‘অবক্ষয়’ শব্দটি। বিশেষ করে সামাজিক অবস্থানের একটি ক্রমক্ষয়িষ্ণু ও নিপতিত পর্যায় ও স্তরকে ‘অবক্ষয়’ হিসেবে দেখা হয়। এর অর্থটি দাঁড়ায়—বিদ্যমান সামাজিক মানের স্থিত অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে ক্রম অবনমনের মধ্য দিয়ে অবক্ষয়ের স্তরটি স্থিত হয়; এতে সমাজচিত্রের পতনশীল বলিরেখা গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজচিত্র বা এর সামাজিক স্তর ও রূপ কোন্ অবস্থানে স্থিত তা নিরূপন করতে গেলে আৎকে উঠতে হয়। কারণ, কেন জানি মনে হতে পারে—কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াহীন উদ্দেশ্যহীন নিরন্তর এক অনন্ত যাত্রায় শুধু বেঁচে-বর্তে সময় হনন ছাড়া সমাজের প্রাণ প্রবাহের অন্য কোনো সৃষ্টিশীল স্পন্দন নেই; বলা চলে সময় বুঝি বা প্রজনন ক্ষমতা শূন্য। আরও গভীরভাবে অনুভূত হয় পৃথিবী যখন প্রতি পলে পলে এগুচ্ছে এবং খুব দ্রুতই ছুটছে পরিবর্তনের দিকে, নতুন নতুন অনুসন্ধানের উৎসবের আয়োজন চলছে তখন আমরা অন্যরকম। কেননা বোধহয় আমাদের এই সমাজ যেন এক জায়গায় থেমে আছে এবং গতিহীন নিশ্চল হয়ে আছে—এভাবে কোথায় ডুবে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল করার বোধ হারিয়ে বুদ্ হয়ে বসে আছে। কারণ সমাজটাতো ঘুণপোকাদের বাসা!
সমাজ যদিওবা প্রবহমান নদীর স্রোতধারা থেকে উৎসারিত উর্বর পলল ভূমি। এতে স্বপ্নের বুনন হয়। সৃজনের চাষাবাদ হয়। বীজ রোপিত হয়। অংকুরোদ্গম হয়, চারা হয়, বৃক্ষ হয় এবং ফল ও ফুল ফোঁটে। এভাবে জীবন ও প্রাণপ্রকৃতি জেগে ওঠে। সমাজ হাঁটে ও ছুটতে থাকে সামনের দিকে। প্রবহমান নদীর বুকে চর জাগলে বা মাঝখানে মানুষ বাঁধ দিয়ে বাধা দিলে মুক্তধারা আর এগোয় না। রবীন্দ্রনাথ এভাবেই তাঁর মুক্তধারা নাটকে সমাজের অচলায়তনের বাধাটি ভাঙতে বলেছিলেন সমাজ জাগৃতির চিরন্তন উল্লাসে। কিন্তু আমাদের সমাজ ঘুমিয়ে আছে। আজকের সমাজ এক অন্ধ মৌল বিবরে হাবুডাবু খাচ্ছে। ঘাতক কাঁটা চামড়ায় ঘা দিলেও যন্ত্রণার কোনো আর্তি নেই। সমাজ দেহটাই যেনবা অচল। এই অচল ও নিশ্চল সমাজ এতই বাদ-প্রতিবাদহীন, অনুভূতিহীন যে কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, স্মৃতি ও সত্তা লুপ্তপ্রায়।
এমন একটি নপুংসক সময় বিবেচনায় শুধু সমাজকে দোষ দিই কীভাবে? মানুষের ভেতরের শক্তি যদি নিষ্প্রাণ থাকে তাহলে পুরো সমাজটাই একটি শবদেহ ছাড়া আর কিছু নয়। এই নিশ্চল ও ঘুণেধরা সমাজের সৎকার সাধন ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।