শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক
নদীপ্রধান দেশ হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নানাভাবে নদীর প্রভাব। স্রোতের বাঁকেবাঁকে গড়ে উঠেছে নদীতীরের মানুষগুলোর নিজস্ব হাসিকান্নার জীবনব্যবস্থা। তবে বঙ্গোপসাগরের মোহনা ধরে যে জনপদ গড়ে উঠেছে তাদের একেকটি রাত্রিদিন এবং পরিণামে সামগ্রিক জীবনালেখ্য তারচেয়েও স্বতন্ত্র, চ্যালেঞ্জিং আর আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো ভঙ্গুর বৈকি। কবি-সাহিত্যিকগণ এসবের প্রাকৃতিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভাণ্ডার থেকে দুহাতে সাহিত্যের রসদ কুড়িয়েছেন। যেমনঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়- পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়- কালিন্দী (১৯৪০), প্রমথনাথ বিশী- কোপবতী (১৯৪১), অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ- চরকাশেম (১৯৪৯), অদ্বৈত মল্লবর্মণ- তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬), শহীদুল্লাহ কায়সার- সারেং বৌ (১৯৬২), আলাউদ্দিন আল আজাদ- কর্ণফুলী (১৯৬২), সৈয়দ ওয়ালীউল্লা-কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮), আবু ইসহাক- পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬), দেবেশ রায়- তিস্তাপারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), হুমায়ূন আহমেদ- ময়ূরাক্ষী (১৯৯০), শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়- গঙ্গা একটি নদীর নাম (২০০১), সিরাজুল ইসলাম মুনির- পদ্মা উপাখ্যান (২০০৬), ইত্যাদি।
ফেরদৌস হাসান প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার ও পরিচালক। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে অলৌকিক বাতাসের গান (২০২২) বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় জেলে-মাঝি শ্রেণির জীবন-সংগ্রাম, আশা-হতাশা-দ্বন্দ্ব আর
এসবের মাঝে নারী-পুরুষের চিরায়ত নিবিড় প্রেমের উপন্যাস। নদীতীরের জীবন-সংগ্রাম এমনকি হতদরিদ্র, স্নেহশীল, এতিম, সুবোধ, অথচ কঠিন পরিশ্রমী একজন অতিসাধারণ যুবক জেলে-মাঝিকে আমূল বদলে যেতে বাধ্য করে প্রতিশোধ পরায়ণ ও হিংস্র করে তুলতে পারে! তথাপি সেই হিংস্রতার মাঝে স্নেহ-প্রেম-দায়িত্ববোধ-অসহায়ত্ব একই সমাজের রক্তচোষা-লোভী এবং প্রকৃত হিংস্রতার চিত্র মানুষ-অমানুষের পার্থক্য নির্ণয় করে। অলৌকিক বাতাসের গানে ফেরদৌস হাসানের কলম মনা মাঝির কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে ঘনিষ্ঠ বাস্তবতায় বিছিয়ে দিয়েছে উপকূলীয় জীবনের কঠিন সংগ্রাম, সূদ-দাঁদনের অবিচ্ছেদ্য শোষণবৃক্ষ, প্রাকৃতিক-আর্থ-সামাজিক নিষ্ঠুরতা, ফসল আর চরদখলের ভয়ঙ্কর থাবা, পেশীশক্তির অবিচার, কুসংস্কার-কুপ্রবৃত্তি, ইত্যাদি। আর এসব যাবতীয় সামাজিক হতাশামূলক বাস্তবতার পরোক্ষে রয়েছে অগাধ স্নেহ,
মানবিক আবেগ, অন্তরালের ঘাঁইমারা প্রেম, দুরন্ত সাহস আর উজ্জ্বীবীত আত্মদানের বিজয়গাথা।
এ উপন্যাসের একেকটি চরিত্র উপকূলীয় জনপদের একেকটি ডাইমেনশন আর মানুষের বিচিত্র সব মনঃভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে। বিল্লাল-সিদ্দিক-রহমত যে সমাজের জীবনযুদ্ধে অসহায় সাধারণ মানুষ সে সমজেরই নেতা, নিষ্ঠুর শোষক, ভূমিদস্যু, জলদস্যু হচ্ছে বরকত চেয়ারম্যান-রমজান-জলিল সর্দার গং। অন্যদিকে আর্থিক-সামাজিক কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও সেতারার মা, সিদ্দিকের মা মায়াবতী জননী। রাহেলা-মধু সে সমাজের কৈশোর প্রেম যা আবছায়ার খণ্ড আলোতে পাঠকের মনে নিভৃত অনুরণন তৈরি করে। শাহেদ স্বার্থপর চতুর এনজিওকর্মী। তারই সহকর্মী বিভা শহর থেকে আসা একজন কৌতুহলী সাহসী তরুণী যার মধ্যে কেবল মানবিকতা আর সৃজনশীলতাই নয় বরং এক ধরণের স্বতন্ত্র জীবনবোধ বিদ্যমান। সৃজনশীল ও সাহসী- সুন্দরের অন্বেষণ যার চোখেমুখে, প্রেমিক হৃদয়ে। উপকূলীয় ভাগ্যাহত অসহায় যুবনারীদের প্রতীক সেতারা। যৌতুক আর সামাজিক লালসার শিকার হয়ে এমন অসংখ্য নারী প্রতিনিয়ত শুধু যে নিষ্ঠুর শারিরীক নির্যাতনের সম্মুখীন হয় তা নয় তাদের জীবনের বাস্তবতায় না তারা স্বামীর সংসারে না বাবামার ঘরে সম্মান কিংবা স্বস্তির দেখা পায়। নিয়তির কঠোর পরিস্থিতিতে মনা-সেতারার মানসিক অনুরাগ তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তা কূলে না ভিড়ে অকূলে হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
অলৌকিক বাতাসের গানে ফেরদৌস হাসান উপকূলীয় জীবন সংগ্রামের বহুমাত্রিক গল্পের পাশাপাশি মানব মনের চিরন্তন অনুভূতি তথা প্রেমের গল্পের কথাও বলে গেছেন। প্রচ্ছন্ন এ প্রেমের গল্পে তিনি সন্তপর্নে এক ধরনের রোমান্টিক আচ্ছন্নতা প্রবাহিত করতে চেয়েছেন। সেতারা-মানু-বিভার ত্রিমাত্রিক প্রেমের গল্পে যাকিছু প্রকাশিত তারও বেশি অপ্রকাশিত। এ প্রেমে মনঃব্যাকুলতা আছে, এমনকি দেহ সংযোগও আছে। অথচ প্রকাশভঙ্গিমা সাবলীল, স্বাভাবিক এবং পরিমিত সরব বা উচ্ছ্বসিত নয়। ঘটনাক্রম বা পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা না দিয়ে তিনি পাঠকহৃদয়ের ভাবনাকে বিস্তীর্ণ করার অবকাশ তৈরি করেছেন। অপ্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রকাশের অনন্য কথাশিল্প দ্বারা তিনি পাঠককে মিস্টিসিজম এবং রোমান্টিসিজমের দ্বৈত স্বাদ দিতে তিনি কথাশিল্পে সৃজনশীল থেকেছেন।
নদী এবং চরনির্ভর মানুষের সরলতা-শোষণ-সংঘাত-অসহায়ত্ব ইত্যাদি আমাদের পরিচিত ক্যানভাসেরই সাধারণ দৃশ্যপট। তবে অলৌকিক বাতাসের গানের বিশেষত্ব হলো উপরিস্তরের এসব দৃশ্যপটের মধ্য দিয়ে ঐ জনপদের গভীর স্তরের মনস্তত্ত্ব, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক যোগসূত্রগুলোর পর্যবেক্ষণ এবং সে পর্যবেক্ষণের প্রাঞ্জল উপস্থাপন। “ওরা লেখাপড়া বলতে বোঝে আলিফ বা তা ছা। ওষুধ বলতে পিরের পানি পড়া। বিয়ে বলতে যৌতুক। শশুরবাড়ি মানে কালাপনি। স্বামী মানে নির্যাতন। সংসার মানে গঞ্জনা। জীবন মানে তিন তালাক। যৌবন মানে অভিশাপ”। উপকূলীয় অসহায় নারীজীবনের এ পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে তীক্ষ্ণ এবং গভীর। তেমনি পুরুষের জীবন-সংগ্রামের নিরেট উপলব্ধি পরিবেশিত হয়েছে এ উপন্যাসে- “সে পুরুষ মানুষ। সাগর পাড়ের মানুষ। তার উদাসী হওয়া চলবে না। এখানে যেদিন জন্ম সেদিন থেকে লড়াই। সে লড়াই কখনো সাগরের সাথে। কখনো তুফানের সাথে। জোয়ারের সাথে। জোতদারের সাথে। ডাকাতের সাথে। মহাজনের সাথে। ফড়িয়ার সাথে”।
তুলনা না করে কেবলমাত্র সূত্র হিসেবে উল্লেখ করছি, নদীপাড়ের জীবনোপলব্ধি আর গভীর পর্যবেক্ষণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি-তে আমরা লক্ষ্য করি। “ওদিকে প্রকৃতির কালবৈশাখী তাহাদের ধ্বংস করিতে চায়, বর্ষার জল ঘরে ঢোকে, শীতের আঘাত হাড়ে গিয়া বাজে কনকন। আসে রোগ, আসে শোক। টিকিয়া থাকার নির্মম অনমনীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকাড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সঙ্কীর্ণতায়”। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস পাড়ের মানুষ। তিনি সেখানকার জীবনপ্রণালীতে বেড়ে উঠেছেন। নিজ অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটকে ছেঁকে ছেঁকে তিনি সে জীবনপ্রণালীর স্বভাব, সমীকরণ, সংস্কার আর বৈচিত্রকে তুলে এনেছেন তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। ফেরদৌস হাসান সে পরিবেশ থেকে উঠে আসেননি, পেশাগত কিংবা অন্য কারণে তিনি উপকূলীয় এলাকায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন কিনা জানা নেই। তথাপি তিনি কোন্ অলৌকিক দৃষ্টিশক্তির বলে অলৌকিক বাতাসের গান-এর চরিত্র নির্মাণ, গল্প নির্মাণ, আবহ নির্মাণ, বর্ণনা এবং উপস্থাপনকে এমন বাস্তবমুখী আর প্রাণবন্ত করেছেন! এমনকি অধুনা উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে উপকূলে এনজিও ডাইমেনশন তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। দীর্ঘ না করেই তিনি এ উন্নয়নপ্রবাহের মূল সমস্যাকে চিত্রিত করেছেন কটাক্ষ ইঙ্গিতে। এ উপন্যাসের একেকটি ভাঁজে অভীষ্ঠ জনপদ, প্রকৃতি, মানুষ, সংস্কৃতি, ও সময়ের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের রুপ-রস-গন্ধ তিনি স্বল্প পরিসরের মধ্যে তোলে আনতে সক্ষম হয়েছেন বৈকি।
কথাশিল্পে ফেরদৌস হাসানের প্রধান শক্তি তাঁর বক্তব্যভঙ্গি। কথা বলতে গিয়ে তিনি যেন ছবি আঁকছেন। ছোট ছোট তুলির আঁচড়ে। খুব সহজ আর সরল সে ভঙ্গি। সাবলীল সে গতি। এসব বক্তব্যে যেমন রুপ আছে, তেমনি রস আছে; কোথাও কোথাও গন্ধ আছে। আর এসব মিলিয়ে ঝরঝরে প্রাঞ্জল। একটানা পড়ে ফেলায় পাঠককে ক্লান্ত করে না; আগ্রহান্বিত করে। চরিত্রের কথোপকথনে স্থানীয় ভাষার নির্মেদ প্রয়োগের পাশপাশি উপন্যাসের বক্তব্যের কোথাও কোথাও অপ্রচিলত শব্দের ব্যবহার (যেমন: ছ্যামা, কানি মারা, মুত ইত্যাদি) ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে।
সামাজিক বাস্তবতার অসামঞ্জ্যস্যে সেতারা-মনার অন্তর্বোধে অব্যক্ত ভালোবাসার দৈব প্রবাহকেই কি ঔপন্যাসিক অলৌকিক বাতাসের গান বলতে চেয়েছেন? নাকি উপকূলীয় আর্থ-সামাজিক অত্যচার-নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা, শোষণবঞ্চনার প্রেক্ষাপটে হতদরিদ্র, পরিশ্রমী একজন অতিসাধারণ যুবক জেলে-মাঝির আমূল বদলে যাওয়ার নিয়তিকে ইঙ্গিত করেছেন? অলৌকিক বাতাসের গান উপন্যাসে এ দুটি প্রতিপাদ্য সমানভাবে এগিয়েছে। একটি প্রচ্ছন্নতায় আরেকটি স্পষ্টতায়। উপকূলীয় জনপদের জীবন-সংগ্রাম আর অন্তরাল মিষ্টি প্রেমের দুটি ভিন্ন উপখ্যানের সুপাঠ্য একটি অভিন্ন মালা অলৌকিক বাতাসের গান।
ধ্রুব এষ-এর প্রচ্ছদে জিনিয়াস পাবলিকেশন কর্তৃক প্রকাশিত সাড়ে এগারো ফর্মার উপন্যাস অলৌকিক বাতাসের গান। বিষয়, চরিত্র, ঘটনাপ্রবাহ এবং রচনাশৈলী মিলিয়ে উপন্যাসটি নিরবচ্ছিন্নভাবে পাঠকের মনযোগ ধরে রাখতে সক্ষম। এছাড়া এ দেশের উপকূলীয় এলাকা সম্পর্কে ধারণাসম্পন্ন যে কোনো পাঠক নিজের বাস্তব পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার সাথে উপন্যাসটিকে মিলিয়ে নিতে পারবেন।
শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক, কবি ও প্রাবন্ধিক