প্রবীর বিকাশ সরকার
“আন্দরকিল্লা” ম্যাগাজিনটি ২৭ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে, আদৌ কম কথা নয়! সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজবিষয়ক একটি সাময়িকী বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহর থেকে সম্ভবত মাসিক হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে, যা আমার জানা ছিল না। অভিবাদন জানাতেই হয় উদ্যোগীদেরকে।
আন্দরকিল্লার সম্পাদক প্রথিতযশা লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক নুরুল আবসার আমাকে অনুরোধ করেছিলেন লেখার জন্য। লিখেছি দুটি সংখ্যায়। তিনি আমাকে তিনটি সৌজন্য সংখ্যা পাঠিয়ে সম্মানিত করেছেন। একই সঙ্গে স্মৃতিকাতরও করে তুলেছেন ভীষণভাবে! তাকে সাধুবাদ জানাই।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিক্ষা ও স্বদেশি আন্দোলনের ক্ষেত্রে বহু আগে থেকেই অগ্রসরমান এবং নমস্য। আমার সঙ্গে চট্টগ্রামের সম্পর্ক উচ্চশিক্ষা ও সাহিত্য বিষয়ে যা অত্যন্ত গভীর ও স্মৃতিকাতর।
আমি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলাম। কাজেই চট্টগ্রাম শহরের অনেক জায়গাই আমার সুপরিচিত। আন্দরকিল্লা অন্যতম। সবচেয়ে বেশি স্মৃতিকাতর “চিম্বুক” রেস্টুরেন্টটি। প্রতি সপ্তাহে বিকেলবেলা নিউমার্কেটের একতলার পত্রিকা বিক্রির দোকান থেকে প্রিয় “দেশ” কাগজ সংগ্রহ করে, চিম্বুকে চা পান শেষে রেল স্টেশনসংলগ্ন ঝুপড়ি থেকে বিশেষ সিগারেট “ভুইল্যা”র প্যাকেট কিনে একটি ধরিয়ে শাটল ট্রেনে চড়ে “দেশ” পড়তে পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলে ফিরতাম।
আন্দরকিল্লা খুবই স্মৃতিকাতর জায়গা। এখানে ছাপা ও প্রকাশনার কাজ হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। ছাত্রজীবনে অনেকবার ঢু দিয়েছি। পুরনো কোর্ট বিল্ডিং ছিল বাবার স্বল্পকালীন কর্মস্থল পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে, আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কতবার পাহাড় ডিঙিয়ে উপরে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করেছি হিসেব নেই। নাজির আহমেদ চৌধুরী রোডও ভীষণ স্মৃতিজাগানিয়া, কারণ অকাল প্রয়াত বন্ধু কবি, গল্পকার, চিত্রশিল্পী, গ্রাফিক ডিজাইনার, সম্পাদক এবং নাট্যশিল্পী সাফায়াত খানের অফিস ছিল এখানে, “সাফা’স স্টুডিও” নামে, ১৯৯২ সালে সস্ত্রীক ওর অফিসে আড্ডা দিয়েছি।
সাফার সঙ্গে জাপানে পরিচয় হয়েছিল চট্টগ্রামেরই ছেলে কবি, গল্পকার, সাংবাদিক সজল বড়ুয়ার মাধ্যমে। সজল তখন জাপান প্রবাসী। সাফার সঙ্গে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিনও আমি প্রকাশ করেছিলাম “প্রাচী” নামে। সাফা ছিল নির্বাহী সম্পাদক। কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে জাপানে আমি “মানচিত্র” নামে একটি নিউজ ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিলাম। সেটারও কিছু সংখ্যা সাফার মাধ্যমে ছাপা হয়ে জাপানে আসত। “অন্যচিত্র” নামে আরেকটি মিনি ম্যাগাজিন, সম্পূর্ণ রঙিন ও গ্লুসি পেপারে প্রকাশ করেছিলাম, সেটাও সাফা ছাপিয়ে জাপানে পাঠিয়েছিল। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা “অন্যচিত্র” কাগজের প্রশংসা করেছিল। সাফার সঙ্গে অনেক স্মৃতি আমার!
চট্টগ্রাম নগর আসলে সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী সৃজনশীল নগর। অধিবাসীরাও আন্তরিক। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিলাম, তখন দেখেছি বিস্তর লিটল ম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকা এবং শিল্পকলার প্রকাশনা! কি বিচিত্র ডিজাইন, মুক্তহাতের লেটারিং, আঙ্গিক, কালার যা তখনই আমার কাছে বিস্ময়কর লাগত! বৈচিত্র্যময় রুচির প্রদর্শনী ছিল সেসব প্রকাশনা। যা রাজধানী ঢাকায় চিন্তাও করা যেত না! এখনো ঢাকা অনেক পিছিয়ে।
কাজেই ঐতিহ্য অনুসারে “আন্দরকিল্লা” রুচিশীল কাগজ হবে প্রচ্ছদ, কাগজ ও লেখায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অসাধারণ শৈল্পিক প্রচ্ছদ এবং ইনার দামি মেট কাগজে মুদ্রিত আন্দরকিল্লা দৃষ্টিনন্দন সাময়িকী নিঃসন্দেহে। তবে অঙ্গসজ্জা খুবই গতানুগতিক। ফ্রিহ্যান্ড লেটারিং করা যেতেই পারে অনায়াসে। এবং সাদাকালো হলেও আকর্ষণীয় হবে। ছবির ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ফিচার, নিবন্ধ, প্রবন্ধ বেশ ভালো এবং চিন্তার খোরাক জোগায়। তবে সাক্ষাৎকার, গ্রন্থালোচনা, গ্রন্থপরিচয়, কে কী লিখছেন আগাম সংবাদ, দেশ-বিদেশের সাহিত্য, শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদি বিষয় থাকা জরুরি।
যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে নগর জুড়ে সেখানেই উত্তম লেখা ও তথ্য খুঁজতে হবে। তারুণ্যকে সৃজনশীল আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ আন্দরকিল্লার জন্য অপরিহার্য। একটি উন্নত প্রকাশনা একটি শহরের পরিবেশকেই পাল্টে দিতে পারে। কাগজটিতে একটি ধারাবাহিক গবেষণাকৃত দীর্ঘ প্রবন্ধ বা উপন্যাস থাকতেই পারে। আরও বৈচিত্র্য সময়ের দাবিমাত্র!
মনে রাখা জরুরি যে, অ্যাপল কম্পিউটার বাজারে আসার পর আশি দশকের শেষ দিক থেকে উন্নত দেশগুলোতে ছাপা ও প্রকাশনার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই সময় থেকে “ম্যাগাজিন কালচার” নামে একটি নতুন উন্মাদনা বিশ্বকে আলোড়িত করে চলেছে। মুদ্রিত হোক বা অনলাইন হোক ম্যাগাজিন কালচারের অনুসরণ অনিবার্য। আমরাই বা পিছিয়ে থাকব কেন?
আন্দরকিল্লার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক প্রার্থনা করি।
প্রবীর বিকাশ সরকার, জাপান প্রবাসী, বহুমাত্রিক লেখক