সুলতানা কাজী:
গ্রামীণ পরিবেশে কাটানো দুরন্ত ছোটবেলা আমার! গাছে চড়া থেকে শুরু করে খালে-বিলে মাছ ধরাও বাদ নেই তাতে। মনে পড়ে, সেই মধুর দিনের কথা। সেই খেলা! পুতুল বানানো, পুতুলের বিয়ে দেয়া, সব আজ ধূসর ফিতেয় বাক্সবন্দি। আমার দুরন্তপনা, শৈশব মধুরতা, মায়াময় সুখস্মৃতির সবই যেন ঐ বাক্সে বন্দি হয়ে আছে।
খড়ের স্তূপে দলবেঁধে অকারণ হাসি-তামাশায় কেটে যেতো সময়গুলো। শীতের সময় পাড়ার ছেলে-মেয়েদের খড়কুটো পুড়িয়ে আগুন পোহানো ছিল অন্য রকম আনন্দের বিষয়। কখনো আবার এই আগুনেই পোড়ানো হতো মিষ্টি আলু। আহা! কত মজার ছিল সেসব! মোরগযুদ্ধে পা চালাতে চালাতে ব্যথা হলেও গায়ে মাখাতাম না তা।
আমার মেয়েদের জন্য আমার বড্ড কষ্ট হয়। কেন? তারা ঘুম থেকে ওঠেই স্কুলে যায়। বাসায় এসে হুজুর, টিচারের কাছে পড়তে অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। বিকেলে একটু খেলতে বসে। কী খেলা? গেমস্!! আইপ্যাডে বুঁদ হয়ে থাকা। তারপর আবার পড়তে বসা। মেয়েদের প্রশ্ন: মাম্মা, তুমি ছোটবেলায় কী খেলতে? মনে পড়ে গেলো, কী কী খেলা আমরা খেলতাম সেগুলোর কথা।
অনেক ধরনের খেলায়ই খেলেছি আমরা। যেমন: হা-ডু-ডু, চাকা খেলা, ওপেন্টি বায়স্কোপ, এক্কাদোক্কা, কানামাছি, ইচিংবিচিং, দড়ি খেলা, মার্বেল, ডাঙ্গুলি, বৌছি, ঘুড়ি ওড়ানো, গুটি খেলা, শিম বিচির দানা দিয়ে, দাড়িয়াবান্ধা, লাটিম, গোল্লাছুট, লুকোচুরি, কাবাডি, কড়ি খেলা, মোরগের লড়াইসহ আরো কত নাম না জানা খেলা!!
আমাদের জীবনের একটা রঙিন অধ্যায় হলো শৈশব। খুব ইচ্ছে করছে সেইসব দিনগুলো ফিরে পেতে। শৈশব যেনো আজো আমায় ডাকে! বলে, আয়.. ফিরে আয়!
সোঁদা মাটির ঘ্রাণ। গাছের সাথে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা দোলনা। “কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ।”…. আমার মতো অনেকের মনে আছে হয়তো বা!
আমি মাটি, কাঠ, কিংবা কাপড় দিয়ে মানুষের আদলে পুতুল বানাতাম। পুতুল খেলার মধ্যে পুরো সংসারের একটা আদল ফুটে ওঠতো। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো, একজনের পুতুলের সাথে আরেকজনের পুতুলের বিয়ে দেয়া। ভাঙা মাটির হাঁড়ি বা ভাঙা কলসির টুকরোকে চাঁড়া বা গুটি বানিয়ে বাড়ির উঠানে অথবা খোলা জায়গায় আয়তকার দাগ কেটে খেলা হতো এক্কাদোক্কা। বেশ সহজ এই খেলাটা একা একাও খেলা যেতো।
“ওপেন্টি বায়স্কোপ
নাইন টেন টুইস্কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বিবির বৈঠক খানা।
রাজবাড়িতে যেতে
পানসুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিংয়ের চাবি আঁটা।”
এই মজার ছড়াটা কাটতে হয় ওপেন্টি বায়াস্কোপ খেলায়।
আমাদের গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোই হলো স্বকীয়তা প্রকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ। অন্তত বাঙালি হিসেবে। শৈশবে এই খেলাগুলোর মাধ্যমেই আমাদের মানসিক বিকাশ হওয়ার সাথে সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি পেতো। এসব খেলাধুলার উপর ২০১৩ সালে গবেষণা করে ইংল্যান্ডের একটি বেসরকারি এনজিও। রিপোর্টে বেরিয়ে আসে এসব খেলাধুলার উপকারী নানা দিকের কথা। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধনে এসব খেলার বিকল্প কিছু খুঁজে পায়নি প্রতিষ্ঠানটি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফাঁকা জায়গা সংকুচিত হয়ে যাওয়া, স্মার্টফোনে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে গ্রামীণ খেলাগুলো আজ বিলুপ্ত প্রায়। এসব খেলাধুলা সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা আছে এমন শিশু-কিশোরের খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। শুনলেও শুনেছে তারা দাদা-দাদি বা বাবা-মার কাছে গল্পের ছলে। গ্রামীণ এ খেলাগুলো তাদের কাছে হারানো ঐতিহ্যের সামিল। অথচ এসব খেলাগুলোর উপকারিতা জানলে অবাক না হওয়ার উপায় নেই।
নগর সংস্কৃতির জীবনচর্চায় আমার মেয়েরাও এসব খেলাগুলোর নাম হয়তো আমার থেকে টুকটাক শোনা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে শুনেইনি! তারা বায়না ধরে…. আইপ্যাডে গেমস্ দেখার, টিভিতে কার্টুন দেখার!!!
কালের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাণের খেলাগুলো। নতুন প্রজন্ম শিখছে কৃত্রিমতার প্রেম! গ্রামীণ জীবনকে পথের বাঁকে ফেলে শহুরে জীবনের সাথে যতই খাপ খাওয়াই ততই ফিরে যাই আমার শেকড়ে। আমার শৈশব, কৈশোর,…. আমার কাছে পরম আদরের। প্রকৃতির কোলে বাধাহীন ছুটে বেড়ানোর দিনগুলোতে জমে আছে, কত স্মৃতি!!
বর্ণ থেকে শব্দ হওয়ার মতোই যেন হুট করে বড়বেলায় এসে পড়লাম! শৈশব, তুমি চলে যাওয়ার আগে যদি জানতাম, তবে তোমায় ছাড়তাম না! যদি বলে যেতে যে তুমি চলে যাচ্ছো, তাহলে পাঁজাকোলা করে তোমায় নিয়ে জীবন পার করতাম! ইশ, যদি কিছুদিন তোমার সাথে খেলতে পারতাম! তোমার সাথে খোলা আকাশের নিচে তারা গুনতাম! কী সুন্দর স্মৃতি থাকতো তোমায় নিয়ে!!?
চার দেয়ালের ভেতর বন্দি এখন শিশুরা। টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক আর গেমস্ রীতিমতো ভূতের ওঝা হয়ে চেপেছে শিশুদের মনে। আমরা শিশুদের বায়না মিটাচ্ছি কৃত্রিম আয়োজনে। আমাদের পরের প্রজন্মকে গ্রামীণ খেলাগুলো শেখানোর দায়িত্ব আমাদের। আমরা এই নির্ভেজাল আনন্দের খেলাগুলো হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে প্রজন্ম যেন সুরক্ষিত করি। সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খেলাগুলো বাঁচানোর তাগিদে আলাদা কোনো সংগঠনের বিকল্প নেই। আকাশের তারাদের মতো আমরা যেন আমাদের খেলাগুলো দূরে চলে যেতে না দিই।
সুলতানা কাজী, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক