এখন সময়:বিকাল ৩:০৮- আজ: মঙ্গলবার-২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৩:০৮- আজ: মঙ্গলবার
২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

আসিফের কবিতাসংগ্রহ : পর্যালোচনা ও অন্বেষণ

আলম তৌহিদ

বাংলা কবিতার আধুনিক যাত্রাকে সহজভাবে শনাক্ত করেছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। তিনি বলেন—‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী, এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত, অন্তত মুক্তি প্রয়াসী কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ [আবু সয়ীদ আইয়ুব/হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-আধুনিক বাংলা কবিতা-পৃ: ১৪]। আসিফ নূর বাংলা কবিতার এই ধারার কৌশলী কবি। তবে আসিফের সময়কালে অর্থাৎ আশি-নব্বই দশকের কবিরা তিরিশের স্রোতে শেওলার মতো ভেসে যাননি। তিরিশের কবিদের অনেকটা উপেক্ষা করেছেন। কারণ এই দুই দশকের কবিরা যে বিশ্বের সাথে পরিচিত হন, তা তিরিশের দশকের সাথে মিলে না। আশির দশক থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটে গেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং নানান ঘটনাপ্রবাহ, যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন কবিরা। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ, সোভিয়েতের পতন, তৃতীয় বিশ্বে পুঁজিবাদী আগ্রাসন, কর্পোরেট বাণিজ্যের উত্থান, বর্ণবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বিধ্বস্ত অর্থনীতি, নষ্ট রাজনীতি, ফ্যাসিবাদ, মানবতাবাদ, সামাজিক অবক্ষয়, অবাধ যৌনতা এবং বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার কবিমানসে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। ফলত তারা কবিতায় এক নতুন পথের সন্ধানে প্রয়াসী হলেন। আশি-নব্বই দশকের কবিরা যে স্বাতন্ত্র্য অবস্থান সৃষ্টি করলেন, তা আবার শুন্য দশকের কবিদের সাথে শতভাগ মেলানো যায় না।

তবে তাদের মধ্যে একটা দূরতম যোগাযোগ লক্ষণীয়। মূলত এই পটভূমিতে বেড়ে ওঠে আসিফ নূরের সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম।

চেনা পৃথিবীই হলো আসিফের অনুভবের ভিত্তিভূমি। স্বীয় প্রজ্ঞায় অর্জিত অভিজ্ঞতাকে অনুভবের জাদুর পরশে রঞ্জিত করে যে পরিপক্ব সঞ্চয়—তাই কবিতা সৃষ্টিতে আসিফের সহায়ক শক্তি। কল্পনাকে স্বপ্নে রূপায়িত করার কৌশল রপ্ত বলে তার কবিতা ভাব-প্রকরণ-বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট। তিনি সমকাল অস্বীকার করেন না, অস্তিত্বের ভিত্তিভূমি হিসেবে একে মান্য করেন। তাই যুগযন্ত্রণা থেকেও মুক্ত নন।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আসিফ নূরের প্রকাশিত কাব্যগুলো নিয়ে বের হয় ‘কবিতাসংগ্রহ’। এতে গ্রন্থিত কাব্যগুলো হলো ‘মৃগয়াসুন্দরী’ (২০০১), ‘বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে’ (২০০৭), ‘শরবিদ্ধ স্বরের শহর’ (২০১১), ‘খেয়ালি খেয়া’ (২০১৭) ও ‘অপার অপেরা’ (২০২০)। এই পঞ্চকাব্য ছাড়াও বইয়ের শেষের দিকে স্থান লাভ করে আরও ৯৩টি অগ্রন্থিত কবিতা—যেগুলোকে ‘নীলযাপনের নকশিকথা’ শিরোনামে ফ্রেমবন্দি করা হয়।

আশির দশক আসিফের যৌবনকাল। ঘনিষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন দীর্ঘ স্বৈরশাসন ও বিক্ষুদ্ধ রাজনৈতিক বাস্তবতা। নাগরিক যান্ত্রিক জীবনযন্ত্রণা থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতাকে তুলে আনলেন ‘মৃগয়াসুন্দরী’-তে। শুধু তাই নয়, এই কাব্যে তিনি ইতিহাস-ঐতিহ্য মনস্কও এবং ইমেজের ব্যবহারে তার দক্ষতা বরাবরই প্রশংসনীয়।‘মৃগয়াসুন্দরী’ প্রতীকের আড়ালে আসিফ বাংলাদেশকেই উপস্থাপন করেছেন। একদা ধন-সম্পদ এবং শিল্প-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই বাংলার ওপর বারবার আগ্রাসন চালিয়েছে বহিরাগত শক্তি। বর্গি-হার্মাদদের লুণ্ঠন ও ভয়াবহ নিপীড়নের কথা এদেশের মানুষ তো ভুলে যায়নি। আসিফ অসাধারণ রূপকের আশ্রয়ে সেই দুর্দশাগ্রস্ত বাংলার চিত্র আঁকলেন এভাবে—

‘বাঘ খাবে মাংস আর

শিকারি বণিক নেবে অমূল্য কস্তুরী,

তুই বড় অসহায় বঙ্গবনে মৃগয়াসুন্দরী।’

[কবিতা—মৃগয়াসুন্দরী/কবিতাসংগ্রহ—পৃ: ২১]

 

‘বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে’-তে (২০০৭) আসিফ খানিকটা ঘুরে দাঁড়ালেন। এর জন্য তার প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘ ছয় বছরের। জীবনজিজ্ঞাসা, জ্ঞান অণে¦ষা, স্বদেশভাবনা এবং সময়কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে একজন কবির জন্য অবশ্যই যথেষ্ট সময়। অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে স্বদেশের অবক্ষয়ের সত্যবদ্ধ চিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইতিহাসের অংশ করে তুললেন। অসম্ভব রূপকের আশ্রয়ে চিত্রিত করলেন সমকালীন বাংলাদেশকে। লুটেপুটে খাওয়া শাসকগোষ্ঠীকে তুলনা করলেন শেয়াল-কুকুরের সাথে, আর জনগণকে চিত্রিত করলেন মোরগপ্রজাতির প্রতীকে। সমগ্র দেশজুড়ে এক ঘন অমানিশাকাল। এমন এক দুঃসহ ক্রান্তিকাল আসিফের কাছে বিষকন্যার মতোই। তিনি লিখেন—

‘লালঝুঁটি মোরগেরা একে একে হয়েছে সাবাড়,

‘কুক্কুরুকু’ ডাক ভুলে বোবা কষ্টে কেউ কেউ হয়তো-বা বাঁচে….

মুরগির পাখার ভাঁজে অসহায় ছানাগুলো কাঁপে থরথর,

রাতে নয়—শিয়ালেরা প্রকাশ্যেই হানা দেয় দিনের আলোয়।

 

কিন্তু বিষকন্যা বেহুলায় শেষ হয়নি ক্রান্তিকাল। ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে চারটি বছর। মানুষের মুক্তি কই ? ‘শরবিদ্ধ স্বরের শহর’-এ (২০১১) চলে প্রেম ও প্রকৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন—আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় জীবনের টানাপোড়েন। এরই ভেতর চলে আসিফের দার্শনিক নিরীক্ষণ। আবহমান পাহাড় ও সমুদ্রের সম্পর্ক নিরূপণ, সূর্যকে নিজের সহোদর ভাবা, ফুটপাতে বেওয়ারিশ জীবন, পুলিশি তৎপরতা, পতিতার পলায়ন, জিন্দালাশের মতো বেঁচে থাকা কবি, অর্থনীতিবিদ, সুফি-বাউল, বইমেলা, বাঘের হিংস্রতা, শেয়ালের ধূর্ততা, যমুনার মেয়ে, বুড়িগঙ্গার আলোছায়ার ফাঁদ, মুক্তি ও স্বাধীনতা, জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষুদ্র জীব প্লাঙ্কটনের সাথে এক শ্রেণির মানুষের তুলনা এবং আরো বহুবিধ পার্থিব-অপার্থিব বিষয়ে আসিফের গভীর পার্যবেক্ষণিক সৃষ্টিশীলতার  সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে ‘শরবিদ্ধ স্বরের শহর’ কাব্যে।

কবিদের নিয়ে প্লেটোর বিরূপতার তোয়াক্কা না করে এ কাব্যে আসিফ কবিচরিত্র নিয়ে এক চমৎকার দর্শনের অবতারণা করেছেন। তার দৃষ্টিতে কবিজীবন হলো জিন্দালাশের জীবন। কবি কেন জিন্দালাশ তার একটা অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ দরকার বলে মনে করি। তার আগে আসিফের ‘জিন্দালাশ’ কবিতাটি একবার পাঠ করে নিতে হয়।

 

মাথা নিয়ে উঁচু-নিচু দ্বন্দ্বের ঝাপটায়

ঘাড় থেকে ছুটে এক রক্তঝরা মার্বেলের মতো

কবির মস্তক ধায় অবিরাম গড়াতে গড়াতে…

উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের পিপাসার্ত পর্যটন শেষ;

তবু হায়, মাপতে পারে না কবি নিজেকে সঠিক।

 

মাথা ফেললে মাটি, মাথা তুললেই আকাশ—

মাঝখানে ঝুলে থাকে কবি জিন্দালাশ।’

[কবিতা—জিন্দালাশ/কবিতাসংগ্রহ—পৃ: ৯৮]

 

কবিতাটিতে একজন কবির আত্মমর্যাদার অবস্থান ও তা নির্ণয়ে মনোজগতে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, এর একটা চমৎকার পরিণতির অবতারণা করা হয়েছে। এখানে কবি আবির্ভূত হন দ্বৈতসত্তায়। প্রথম সত্তাটি কবি স্বয়ং এবং সত্তাটি সক্রিয়। তাই অনুভব করতে পারেন তার মর্যাদার পরিধি এবং অন্তরে লুকিয়ে থাকা অহংবোধ। প্রথম সত্তার অনুভূতির ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় দ্বিতীয় সত্তা ‘জিন্দালাশ’। দ্বিতীয় সত্তার অনুভূতি থাকলেও এটি অক্রিয়। এটিকে বলা যায় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ। বিষয়টিকে দর্শনের কোয়ালিয়া (ছঁধষরধ) তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়।

কোয়ালিয়া হল বিষয়গত অভিজ্ঞতা (ঝঁনলবপঃরাব বীঢ়বৎরবহপব) বা অনুভূতি। কবিতাটিতে কবির সেই উপলব্ধি দৃশ্যমান। কবি বুঝতে পারেন তার সীমানার কাঁটাতার অর্থাৎ মর্যাদার গণ্ডি। আবার তা পরিত্যাগ করতেও তিনি নারাজ। কেননা তিনি উপলব্ধি করেন তার ভেতরের অহংবোধ। কবির এই উপলব্ধির মূলে রয়েছে মস্তিষ্কের সক্রিয়তা। আর এই অনুভূতিগুলোই হলো কোয়ালিয়া।

অপর দিকে ‘জিন্দালাশ’ কবির বিশেষ একটি রূপের প্রকাশ। এই স্তরে প্রাণ আছে বটে, তবে অনুভূতি অক্রিয়। বস্তু বা গধঃঃবৎ নয় বস্তুর অতিরিক্ত কিছু (ঊীঃৎধ-সধঃবৎরধষ) এই স্তরে উপলব্ধিযোগ্য নয়। বর্তমান বাস্তবতায় কবি সম্পর্কে আসিফের এই উপলব্ধি অমূলক নয়।

 

‘খেয়ালি খেয়া’ (২০১৭) কাব্যে আসিফ পরিপূর্ণ ভাবুক হিসেবে আবির্ভূত হন। দোঁহাগুলোর ইংরেজি অনুবাদও দেয়া আছে। অনুবাদ করেছেন কবি জ্যোতির্ময় নন্দী। চর্যার সান্ধ্যভাষার মতো এ কাব্যের দ্বিপদী দোঁহাগুলোতে আসিফকে দেখা যায় ভাবের আলো-আঁধারি খেলায় মশগুল থাকতে। ইহজাগতিক জীবনবোধ চেতনায় মানবজীবন-মানববৈশিষ্ট্য-সম্পর্ক-বন্ধুত্ব-মৃত্যু-প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয় আসিফ ভাব-ঐশ্বর্যে নিজস্ব স্বকীয়তায় নবরূপে উপস্থাপন করেন। সুখ-দুঃখ ঘেরা মানবজীবন। সুখ-দুঃখ কি তা আসিফের বয়ানেই শুনি—

‘সুখ এক জাদুবৃক্ষ, দুঃখ যার ডালপালা-পাতা;

সুখের সমস্ত অঙ্ক দুখ-নামতা গাঁথা।’

[খেয়ালি খেয়া—১/কবিতাসংগ্রহ—পৃ: ১২৫]

‘খেয়ালি খেয়া’ কাব্যকে ঈশপের নীতিকথা কিংবা খনার জীবনবাদী বচনের সাথে তুলনা করা যায়।

আসিফের ‘অপার অপেরা’ (২০২০) মহাকালের এক বিশাল নাট্যমঞ্চ। এ মঞ্চে এসে মিলিত হয়েছে বহুপথ। লক্ষ্য তাদের অভিন্ন। ইহজাগতিক ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে এক মহাকালিক জগতের অণে¦ষা। এখানে আসিফ স্বীয় সৃষ্টিশীলতায় পাহাড় ও নদীকে জীবন দেন, সে জীবন অবিকল মানুষের। নির্মাণ করেন মানব সংস্কৃতিতে বর্ষার প্রভাব। আকাশ তার কাছে কড়াই সদৃশ, মেঘ হলো তেল, সূর্য হলো পরোটা আর চাঁদ ডিমপোচ। কিন্তু পরোটার সাথে ডিমপোচ তার কোনোদিন খাওয়া হয় না। কেননা তাদের মধ্যে রয়েছে দিনরাত্রির ব্যবধান। এখনও যে সাধারণ দরিদ্র বাঙালি পরিবারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোই’ অবস্থা বিরাজমান—এ যেনো তারই সার্থক প্রতীকী প্রকাশ।

 

এই দুঃখবোধ আবেষ্টন করে থাকে আসিফকে। দুঃখবাদী মন নিয়ে নিজের জীবনকে কিভাবে উপলব্ধি করেন তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘আত্মজীবনী’ কবিতায়। আসিফের ভিতরে বাস করে প্রকৃতির বিভিন্ন অনুসঙ্গ, কিংবা তিনি নিজেই প্রাকৃতিক-পুরুষ। এই অনুভুতিতে আসিফ ও প্রকৃতি সমার্থক হয়ে উপস্থিত হয় পাঠকের সামনে। আসিফ লিখেন—

 

‘নদীরা সাঁতার কাটে আমার ভিতর দাঁড় টানে

মাঝিদের আশা, চলে চঞ্চল মাছের জলকেলি।

 

বাইরের যে জগৎ অর্থাৎ আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কবিহৃদয়ে দারুণ প্রভাব ফেলে এবং ইন্দ্রিয়চেতনাকে জাগ্রত করে। এই অজ্ঞিতায় আসিফ দেখতে পান অযোগ্যরাই সবকিছু দখল করে আছে। মনিষী হুমায়ুন আজাদের অসাধারণ উপলব্ধির কথা আমরা সকলে জানি। তিনি বলেছিলেন—‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। আসিফ তার সময়কালে এ সত্যই উপলব্ধি করলেন। তিনি দেখলেন, সবকিছু উল্টোভাবে চলছে। এখানে যোগ্যদের মূল্যায়ন নেই, অযোগ্যরাই দখল করে আছে মাঠ। সামাজিক এই অবক্ষয়ের চিত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে আসিফ আমাদের উপহার দিয়েছেন কতিপয় সংরাগময় পংক্তি—

 

‘বধিরও শুনবে জানি বোবাদের গান,

ঘ্রাণপ্রতিবন্ধী গন্ধ চিনে বলে দেবে পৃথক ফুলের নাম,

অন্ধেরা দেখবে রাতে অমাবস্যার চাঁদ ও সাপের পাঁচ-পা;

হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে খঞ্জ ওড়াবে নিশান।

 

‘নীলযাপনের নকশিকথা’ শিরোনামে অগ্রন্থিত কবিতাগুলোতে আসিফের প্রেম ও প্রকৃতি মনস্কতার পরিচয় মেলে। আবার আত্মপরিচয় প্রকাশের তীব্র ব্যাকুলতায় লিখেন—

‘মুই দরিয়ার পুত, বাপেরই লাহান;

টানটান সিনার সাহসখান আসমানের সমান।’

[কবিতা—মুই দরিয়ার পুত/কবিতাসংগ্রহ—পৃ: ১৯৮]

 

যুগে যুগে কবি-দার্শনিকগণ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আমি-আমিত্ব বা অহংবোধ আসলে কী ? আসিফের ‘আমি’ কবিতা পাঠ করতে করতে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘জন্মকথা’ কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথের মনেও প্রশ্ন ছিল—‘এলেম আমি কোথা থেকে ?’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য শিশুর মুখেই প্রশ্নটি জুড়ে দিলেন। আর জবাবটি তুলে দিলেন শিশুটির মায়ের মুখে। মা বলছেন—

‘যৌবনেতে যখন হিয়া

উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া,

তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে,

আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে

জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে

তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে।’

[কবিতা—জন্মকথা/রবীন্দ্র রচনাবলী ২/পৃ: ৫]

আসিফ কিন্তু নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। কারণ আমিত্বের মালিকানা নিয়ে তার রয়েছে সন্দেহ। আসলে আমিত্বের প্রকৃত মালিকানা কার ? ‘আমি’ কবিতার শেষ স্তবকে আসিফ রবীন্দ্রনাথের মতো একটা সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেন—

 

‘এত যে আমি আমি করি, আমি কি আসলেই আমার!

নাকি পূর্ব কারও কমনার ফুল, প্রিয় উত্তরাধিকার ?

এখানে অধমের আগমন একা খুব নিজেরই অজান্তে।’

[কবিতা—আমি/কবিতাসংগ্রহ—পৃ: ১৯৪]

 

সৃষ্টির মধ্যে যদি শিল্পের সুরভি না থাকে তবে তা পাঠক গ্রাহ্য হয় না। আর বস্তুর বিবরণ কিংবা রূপ বর্ণনা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে না। কেননা এর মধ্যে কোনো সৃষ্টি নেই, শিল্পবোধও নেই। তাই বৈশাখের ‘খেরোখাতা’-‘হালখাতা’ সাহিত্য নয়, শিল্পও নয়। কবিতায় আসিফ বস্তুর বাহ্যিক বিবরণ দেন না। তিনি বস্তুকে নতুনভাবে আবিস্কার করেন এবং তার সৃষ্টিকে দেন উৎকৃষ্ট শৈলী। তাই পাথরকে নিরেট পাথর হিসেবে দেখেন না। তিনি মনে করেন একদিন পাথরের ধর্ম বদলে যাবে। পাথর আর শুধু পাথর থাকবে না। আসিফ পাথরকে নতুন রূপে আবিষ্কার করেন। পাথরের মধ্যে প্রয়োগ করেন মানব চরিত্র ও গুণাবলী। আসিফের সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পবোধ তার কবিতাকে দিয়েছে গভীরতা, নান্দনিকতা এবং মৌলিকতার শৈল্পিক মাত্রা।

 

‘পাথরে পাথর মজে একদিন প্রেমালাপ হবে,

শরীর ও মন, পরস্পর কথা দেয়ানেয়া….

 

পাথরে পাথরে এক অনিবার্য প্রবল সঙ্গমে

ঝটকায় জন্ম নেবে লক্ষকোটি আগুনের শিশু।

এই সব পাথরের মর্মে একদিন এক বিপ্লব হাসবে।’

[কবিতা—পাথরের গান/কবিতাসংগ্রহ-পৃ: ২৩]

 

কবিতাকে একটা আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উপনীত করবার প্রবণতা আসিফের কাব্যের মধ্যে প্রায়শ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যা পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাবার মতো নয়। আসিফ অবশ্যই রোম্যান্টিক এবং তার রসবোধও চমৎকার। তার কবিতায় সুফিতত্ত্বের মরমী ব্যাঞ্জনাও দুর্লক্ষ্য নয়। আসিফের মনোলোকে বাংলার ভাবধারা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, পুরাণ, মিথ যথেষ্ট প্রশ্রয় পেয়েছে বলে তাকে বলা যায় ঐতিহ্যবাদী। কিন্তু তিনি এখানেই স্থিত নন ; বরং সম্পর্ক গড়ে তুলেন মহাপৃথিবী ছাড়িয়ে মহাবিশ্বের সাথেও। কল্পনাকে স্বপ্নের ডানা পরিয়ে ওড়িয়ে দেন মহাকাশে। তার স্বপ্ন উড়ে যাচ্ছে অনন্তলোকে। তাই আকাশকে দেখেন থিয়েটার-স্বরূপ, আর দিঘিকে মঞ্চ। কিন্তু এই ছোট্ট দিঘিতে আকাশ কীভাবে পারফর্ম করবে! তার ‘আকাশথিয়েটার’ বিশাল এক নাটকের পটভূমি—আয়োজনও আড়ম্বরপূর্ণ, আর মহাসমারোহে চলছে শো। তাই আকাশথিয়েটারের মঞ্চও হবে বিশাল। আসিফ তার এই অভিনব কল্পনাশক্তিকে শব্দের আলপনায় চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন—

‘দিঘিমঞ্চে ভাসছে না আর আকাশথিয়েটার।

নীল-সাদা শামিয়ানা আশ্চর্য উধাও,

চাঁদসূর্যের স্পটলাইট জ্বলে না তো জলে;

সমস্ত রেখেছে ঢেকে শ্যাওলার পর্দা।

…….      …….     …….   ……..

…….      …….     …….   ……..

 

আকাশের অনেক শো, বায়নাও অশেষ—

ঝরনার চঞ্চল নৃত্যাঞ্চলে চলে তার ধুমনাট্য,

তার শো’তে বাজিমাত পৃথিবীর সব নদী-অডিটরিয়াম;

মেগা শো’তে জমজমাট হরদম ঢেউসাগর নাট্যমঞ্চ।

 

পূর্বেই বলেছি আসিফ বস্তুকে স্বাভাবিক বস্তু হিসেবে অবলোকন করেন না। বস্তুকে আবিষ্কার করেন নবরূপে। এখানেই আসিফ সৃষ্টির কারিগর। পাঠকেরও পরিচয় ঘটে তার সৃষ্টিশীল মন ও মেধার সাথে। আর তার ভাবশক্তিকে স্বপ্নঘুড়ি হয়ে নিরন্তর ওড়তে দেখি মহাকালের পথে।

 

আলম তৌহিদ

গবেষক-সমালোচক-গল্পকার

 

লাহোর প্রস্তাব বিকৃতির কারণে একাত্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে

হোসাইন আনোয়ার ২৩ মার্চ ১৯৪০। পাকিস্তানিরা ভুলে গেছে ২৩ মার্চের ইতিহাস। একটি ভুল ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালিত হয় সমগ্র পাকিস্তানে।

ইফতার পার্টি নয়, সেদিন যেন তারার হাট বসেছিল পিটস্টপে

রুহু রুহেল সমাজ ও সংস্কৃতির বড় পরিচয় সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে সামনের পথে অবিরাম এগিয়ে চলা। সাম্য সুন্দর স্বদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন বিবিধ মত ও পথকে

নভোচারী সুনিতা মহাকাশে ফুল ফোটায় পৃথিবীতে নারীর পায়ে শেকল পরায় কে?

প্রদীপ খাস্তগীর চমৎকার একটি সফল মহাকাশ সফর শেষ হয়েছে গত ১৮ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে। গত বছরের ৬ জুন মাত্র ৮ দিনের

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ: দর্শনের বিজ্ঞান

রাজেশ কান্তি দাশ দর্শনের ক্ষেত্রে বস্তু ও ভাবের দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের। বস্তুবাদী দার্শনিকেরা মনে করেন বস্তু থেকে জাগতিক সব কিছুর উৎপত্তি। গ্রীক দার্শনিক

মানুষ ও মঙ্গল মানব

সরকার হুমায়ুন দুজন মহাকাশচারী- একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা মঙ্গল গ্রহ অভিযানে গেলেন। তারা নিরাপদে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেন। সেখানে তাদেরকে অতিথি হিসেবে মঙ্গলবাসীরা সাদরে