আ.ম.ম. মামুন
কাব্যভুবনে আ.ফ.ম. সিরাজউদ্দউলা চৌধুরীর (১৯৪৩-১৯৯৯) আত্মপ্রকাশ পঞ্চাশ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। দৈনিক ইত্তেফাকের ছোটদের আসরে কচিকাঁচার মেলায় তাঁর একাধিক পদ্য-কবিতা প্রকাশিত হলেও ‘সন্ধ্যা’ কবিতার মধ্যদিয়ে তাঁর পুরোপুরি কাব্যযাত্রা শুরু হয় ‘মাহেনাও’ পত্রিকায়। উল্লেখ্য, কবি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র।
‘পাতা ঝরে যায় ক্রন্দন শুনি নিশাচর ডেকে মরে
ঝরিছে শিশির ফোঁটায় ফোঁটায় ফুল বনে মর্মরে
তটিনীর তটে নিঝুম রাতের সুগভীর নীরবতা
মর্মে আমার কি জানি সেকালে বলে অজানার কথা।’
প্রথম প্রকাশিত এই ‘সন্ধ্যা’ কবিতার মধ্যদিয়ে তাঁর যে কবি-প্রতিভা, ছন্দদোলা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতো জেগে ওঠে সময়ের বিবর্তনে তা অনেক বেশি পরিণত, শানিত। কাব্যচর্চার সূচনায় তার মধ্যে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জসীমউদ্দীন, আ.ন.ম. বজলুর রশীদ, আহসান হাবীব প্রমুখ কবির প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও নিরন্তর এবং আর একনিষ্ঠতায় তিনি অর্জন করেন নিজস্ব কন্ঠস্বর স্বকীয় স্টাইল। তাঁর কবিতায় আমাদের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝাঁজ অক্ষমতা, অসঙ্গতি আর আনন্দবিরহ সমানভাবে পরিবেশিত। আলোচ্য কবি মৃত্যুবরণ করেছেন আজ প্রায় আড়াই দশক। তাঁর বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতার রচনাকাল পাঁচ থেকে ছয় দশক পেরিয়েছে।
কিন্তু কবিতাগুলোর বিষয় বক্তব্য এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। সত্যিকার মহৎ কবিরা সময়কে অতিক্রম করার প্রতিভা নিয়েই জন্ম গ্রহণ করেন। ছন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগে কবি যতটা আগ্রহী ছিলেন, ততটাই অনাগ্রহী ছিলেন গ্রন্থপ্রকাশে। পাঁচ দশকের কাব্যরচর্চায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার। কখনো কান্না (১৩৭৫), রূপরঙ্গ (সম্পাদিত ১৩৭৫), বিশন্নতা প্রতিদিন (১৪০৩) এবং একগুচ্ছ ভালোবাসা ও পিকনিক(১৪০৩)।
কবিতার বিষয় নির্বাচনে আ.ফ.ম. সিরাজউদ্দউলা বৈচিত্র্যপ্রিয়। কবিতায় তিনি ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ একই কথা বলেননি। প্রেম, নারী, প্রকৃতি, স্বদেশ এবং ছাড়াও ইতিহাস, ভূগোল আর দর্শনকে বিষয় করে তিনি রচনা করেছেন অভিনব সব কবিতা, যা তাঁর কবিতাকে এক ঘেঁয়েমির সুরে বন্দি করেনি। এক একটি কবিতা আমাদের চেতনাকে, অভিজ্ঞতাকে পুষ্ট করে। কোনো কবিই বিষয়বিহীন নন, নয় কোনো কবিতাও। আলোচ্য কবির প্রিয় বিষয় কী? এর তাৎক্ষণিক জবাব নারী ও প্রেম, যা সব যুগের রোমান্টিক কবিদের মূল বিষয়।
প্রেম ও নারী এই চিরন্তন মানবিক বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই আলোচ্য কবির কবি- কল্পনার অভিসার। প্রেমের কবিতায় কবি সহজ সাবলীলভাবে, কখনো কথা বলার ঢঙে প্রকাশ করেন তাঁর হৃদয়ের আর্তি।
যৌবনে প্রকাশিত কবিতাগুলোতে প্রেম আর প্রেমিকার জন্য কবির একধরনের অভিমান, কোমল অনুযোগ লক্ষ্যযোগ্য। কবি ঈপ্সিতাকে জোর করে অধিকার করতে চাননি। দয়িতার কাছে কবির চাওয়া সামান্যই। কখনো মুখের সামান্য অথচ উজ্জ্বল হাসিতেই তিনি মুগ্ধতা মেনেছেন, কখনো সেই মুখ খুঁজে বেড়িয়েছেন নির্জনতায়, কখনো দুদন্ড আলাপেই তার মন ভরে উঠেছে জ্যোৎস্নায়।
১. সেই মুখ আমি খুঁজে বেড়াই নির্জনতার প্রেমে
হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে প্রথম অভিমানে (ইচ্ছে করে,
কখনো কান্না)
২. ভালো লাগে তাই যদি কাছে আসো দুদ- আলাপে
এবং তোমার চোখে যদি চোখ রাখি- (দুদ- আলাপে তুমি,ঐ)
৩. সুখে দুঃখে তুমিও স্বজন হতে পারো,
দিতে পারো আধিকার গোপন কথাটি বলবার। (প্রিয়তমাসু, ঐ)
কখনো কবি সনেট, কবিতা কিংবা আধুনিক গান লিখে মন পেতে চেয়েছেন। ঈপ্সিতা তবু ছিলো বিমুখ। অবশেষে কবি গল্পে বলতে চয়েছেন হৃদয়ের সকল কথকতা। তাও এক সময় বেদনার নীলে ভেসে যায়। কারণ ’গল্পটি ভালো হয়নি বলেই ছাপাতে পারেন নাই’ সম্পাদক। যে কাঙ্ক্ষিতার জন্য ঝড়ের রাতে কেটেছে কষ্টের প্রহর, যার কাছে গোপন কথাটি বলবার অধিকার চেয়েছেন সেই কবি-দয়িতা সোনালি আজ পথের মোড়ে অন্য কারো সন্নিধানে । কবি আজ জেনে গেছেন-
সোনালী: আমি তো জানি আমার বাহুতে ধরা দিয়ে
ঘুম ঘুম চোখ তুলে আর কোনোদিন
বলবেনা- ‘আ-মরণ আমি আছি এবং আমার প্রেম
সবই যে তোমার ………….. ।
(সোনালী তোমার প্রেম, ক.কা)
তারপর আরও বহুদিন গিয়াছে। ততদিনে কবি নিশ্চিত জেনে গিয়েছেন ‘তুমি ঠিকই একদিন ভুলে গেছো এই আমাকেই।’ হারানোর ব্যথায় কবি আজ কাতর নন।তার শোক শক্তির শ্লোকে পরিণত হয়েছে। আজ কবি অর্জন করেছেন নতুন অভিজ্ঞান। প্রেমিক প্রেমিকা হারলেও প্রেম কভু হারাবে না। তাই সকল শূন্যতাকে তিনি সূর্যালোকে শুকিয়ে নিয়েছেন।
আমার সকল শূন্যতাকে সূর্যালোকে পূর্ণতা দেই
কান্নাতে তাই সজল দুচোখ সূর্যতাপে শুকিয়ে নেই।
(তখন, ক-কা)
অভিমানী প্রেমিক হিসেবে কোমল কন্ঠ নিয়ে একদিন যে কবির আবির্ভাব, তাঁর কন্ঠস্বর আজ অভিজ্ঞতার গান গায়। এখন আর অনুনয় বিনয় নয়। এখন কবি অধিকার আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কথা বলেন। ‘যতোই লুকোতে চাও অন্তরালে, অন্তর্গত হবে রাত্রিদিন।’ আজ তিনি গভীরে প্রবেশ করতে চান। কেননা ‘অগভীরে সন্তরন হয় না সফল।’
‘অস্থির চিওতা ছেড়ে স্বস্তির বাগান করো সুরভিত, বর্ণগন্ধময়
প্রেমের থাবা ছিন্ন ভিন্ন করে দেব হৃদয়ের সকল সংশয়।’
(কোথায় ফেরাবে মুখ, বিপন্নতা প্রতিদিন)
আজ কবি কাঙ্ক্ষিতাকে স্পষ্টতই জানিয়ে দিচ্ছেন, যুক্তি তর্ক ছেড়ে প্রেমের সবক নিতে। আর কোনো ছল চাতুরি নয়। কেননা, ছলনায় তিক্ততা বাড়ে কখনোও বা শ্বাসকষ্ট।’
তাই কবির সতর্ক উচ্চারণ-
সেই অভিধান খুঁজতেই যদি হতে হয় যোগ-ভ্রষ্ট
যৌবনবতী! মৌ বনে ঘুরে সময় করো না নষ্ট।
(মৌ বনে ঘুরে সময় করো না নষ্ট (একগুচ্ছ ভালোবাসা ও পিকনিক)
একদিন যার জন্য কবি ছিলেন উজাড়-উড়াল, যার একটু নির্দোষে উষ্ণতার জন্য ছিলেন উন্মুখ, সেই সোনালি, কবি-দয়িতা, কবিকে অগ্রাহ্য করে জানিয়েছিলেন ‘প্রেম- সম্মুখে চলিতে চালাতে নাহি জানে,’ কখনো মধুমিতা সেন রূপী কবি-দয়িতা এই বলে ব্যঙ্গ করেছেন যে, সে ‘কোনো একজনের নয়, অনেকের..।’ প্রেম যার কাছে ছিলো রাজার রাজ্য জয়ের মতো সেই রমণী জীবনের অনেক পথ হেঁটে এসে কবির কাছে নতজানু। আজ তার সত্যোচ্চারণ
কবিতাকে ভয় পাই, কবিতা ভীষণ কষ্টকর
কবিতায় দুঃখ বাড়ে, বড় বেশি শক্তিধর দুঃখের অনল
কামানল অতি তুচ্ছ তার তুলনায়।
(কামার্ত রমণীর আত্মদর্শন, একগুচ্ছ ভালোবাসা ও পিকনিক)
সমাজ বা রাষ্ট্র একজন কবির ওপর নির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব অর্পণ করে না। যেমন করে একজন আমলা বা অধ্যাপক বা প্রকৌশলী বা কৃষকের ওপর। সমাজে তার কোনো স্থান নির্দিষ্ট নেই, যেমন রয়েছে অন্য ব্যক্তিমানুষের। তবুও কবিরা পালন করেন সময়ের গুরু দায়িত্ব। সমাজে অপ্রয়োজনীয় মনে করে কবিদের আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নির্বাসনদ- দিয়েছিলেন অ্যারিস্টোটল। কিন্তু কবির মনোলোকে যে আদর্শ রাষ্ট্রের মডেল অঙ্কিত তা বাস্তবের যেকোন আদর্শ রাষ্ট্র থেকে অধিক সত্য। কবি কাজ সেই সত্যোদ্ঘাটনে সৌন্দর্য সৃর্ষ্টিতে। কবি তাই সর্বদা বিবেচিত হন জাতির বিবেক হিসেবে। সমাজ রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক এমন অনেক বিষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে আ.ফ.ম. সিরাজউদ্দউলা’র কবিতায়। ‘একটি বালকও তিনটি ইঁদুর’ এবং ’শিকারী কুকুর গুলো’ তেমনই দুটো কবিতা। প্রথমোক্ত কবিতায় তৎকালীন পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচারী শাসকের ঘৃণ্য চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। কবিতায় মুদ্রিত ‘একটি বালক’
নির্যাতিত মানুষের প্রতীক, আর তিনটি ইঁদুর ‘সরকারের লেলিয়ে দেয়া পেটোয়া বাহিনী। এমনই দুঃসহ কাল ছিলো সেটা। যখন প্রাণ খুলে কথা বলা কিংবা গান গাইবার অধিকার হারিয়েছিলো মানুষ ।
………………………গানের সময
নেই যে তোরা নিকটেই দেখ চেয়ে
তিনটি ইদুর
গর্তের গভীরে বসে শোনে তোর গান
অভিজ্ঞ নিয়মে।
সমাজ রাষ্ট্র নিয়ে কবির এই জাগ্রত শচেতনতা সময়ের বিবর্তনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতাউত্তর কালে প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার দুস্তর ব্যবধান, / সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য আঘাত/ মূল্যবোধের অবক্ষয় কবিকে পীড়িত করেছে। ‘তোমাকে’ কবিতায় তিনি যাবতীয় বিনষ্টিকে চিহ্নিত করেছেন-
পুরাতন পিরামিড ভেঙে গেলে কে কখন
গড়েছে নগর এক / প্রাচুর্যের বিলাসের
এ জীবন তবু মরুভূমি। (মরুভূমি, বি.পূ.)
স্বপ্ন আর সম্ভাবনার সময় এই ‘অবক্ষয়’ লুকিয়ে থাকলেও একসময় সে ঠিকই তার হিং¯্রতা নিয়ে হাজির হয়। তার নখরাঘাতে রক্তাক্ত হয় সবুজ মানচিত্র, মানুষের মানসচিত্র ও কবি তখন ক্ষুন্ন হতে থাকেন। পাখিদের সাম্যবোধ তখন কবিকে মুগ্ধ করে —
পাখিদের ঠোঁট জুড়ে আছে এক সুরের জগৎ
সে জগতে পাপ নেই, ঘৃণা নেই, নেই কোনো হিংসা বিদ্বেষ।
(পাখির ঠিকানা, বি.প্র.)
ধর্ম কিংবা জাতিসত্তা কিংবা কোনো আঞ্চলিকতার
ভেদ নেই পাখিদের মাঝে,
অথচ পাখিরা আছে আমাদের খুব কাছে, আমাদের নিকট সমাজে।
(পাখির ঠিকানা, বি.প্র.)
কবি শুধু স্বদেশ ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন নি। কবি বৈশ্বিক চেতনায় বিশ্বাসী। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রেম প্রকৃতিনির্ভর ব্যক্তি জীবনকে বিশ্ব নাগরিক চেতনা থেকে বিচ্যুত মনে করেননি তিনি। ব্যুরোক্রেসি’ কবিতায় তিনি বিশ্বময় ছড়িয়ে যাওয়া এক ব্যাধির কথা বলেছেন। হৃদরোগ, ক্যান্সার এমনকি এইডস থেকেও মারাত্মক রোগ এই ব্যুরোক্র্যাসি। এ রোগে আক্লান্ত হয়ে সমাজ প্রায় বিপন্ন। তবুও এ রোগের বিনাশ নেই, আছে বিপুল বিস্তার।
নির্ভয়ে কলঙ্ক নিয়ে নেচে ওঠে চতুর শেয়াল,
রক্তে ও মজ্জায় তার রয়েছে এমন এক এন্টিবডি
বাড়ায় যা তার আয়ুঙ্কাল।
(ব্যুরোক্রেসি, বি. প্র.)
বর্তমান বিশ্বের যে অস্থিরতা ও অশান্তি শান্তিকামী মানুষকে বিপন্ন করে তুলছে, তা ভেবেও কবি চিন্তিত। আনবিক বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন মানুষ ও সভ্যতা। সর্বত্র ক্ষেপনাস্ত্র ছুঁড়ে মারার কার দূরভিসন্ধি। ব্যর্থ গণতন্ত্র। সাধের সমাজতন্ত্র বিলুপ্তপ্রায়। শান্তিকামী কবি শাস্ত্রকারের ভাষ্যে বলছেন-
যুদ্ধ ছেড়ে মিত্রতা চায় শাস্ত্রকারের ভাষা
স্বস্তিবোধের উজ্জীবনে জাগ্রত হোক হাস্য।
(শাস্ত্রকারের ভাষ্য, বি. প্র.)
যাবতীয় হতাশা আর অসংগতির মধ্যেও কবি আশাবাদী। তার স্বদেশপ্রেম সব কিছু ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কবির দৃঢ় প্রত্যয়, স্বাধীনতাকামী মানুষের পরাজয় নেই। তার বিজয়োৎসব আসন্ন। রক্তের উৎসব থেকে শিগগির জন্ম নেবে বিশুদ্ধ গোলাপ। ক্রমাগত আতœাহুতি দিতে দিতে একদিন আত্মার বিস্ফোরণ ঘটবে। এই বিস্ফোরণের জন্য চাই আত্মার জাগরণ, স্বদেশ প্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এই বিস্ফোরণ সূর্যোদয়ের মতো অব্যর্থ।
কেননা– সূর্যোদয় মানে না কখনো কোনো প্রতিরোধ
প্রতিহিংসা অথবা হতাশা। (পিতামহ বলেছেন, বি.প্র.)
জীবনের এক পর্যায়ে এসে প্রতিটি মানুষই পিছনে ফিরে তাকান। শৈশব কৈশোরের স্বপ্ন জাগানিয়া দৃশ্যাবলি চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। সে এক সোনালি অতীত। যুগের যন্ত্রনায় তা আজ কেবলই স্মৃতি। ধূলিমলিন। ‘পিছুটান’ কবিতায় কবি নিজেকে আবিষ্কার করেছেন স্মৃতির দর্পণে। মনে পড়ে শৈশবে গায়ে রোদ মেখে ঘুরে বেড়ানোর কথা, দু’আঙুলের ফাঁকে ফড়িঙের ডানা ঝাপটানো আজ ধূসর মেঘের ছায়ায় ঢাকা। আহ্! সেই সোনালি শিশুকাল।
বানের অথৈ জলে নিমগ্ন বৃক্ষের মতো
লুকিয়ে রয়েছে শিশুকাল
বয়সী রোদ্দুরে তবু কৈশোর যৌবন এসে
সদম্ভে চালায় দস্যিপনা। (পিছুটান, বি.প্র.)
জীবনের বহুপথ ঘুরে এসে কবি এক পা এগুতে দু’পা পিছিয়ে যান। পিছুটান বড় বেশি তার। মানুষেরা মরে পিছুটান কভু মরে না।
আমরা আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম কবি- বিষয় নির্বাচনে বৈচিত্র্যপ্রিয়। কাব্যসূচনায় তার কবিতা সহজ কথকতায় দুলে ওঠলেও ধীরে ধীরে তিনি প্রবেশ করেন দর্শনের জটিল পথে। বিড়ালহীন অন্ধকার ঘরে বিড়াল অনুসন্ধানই হয়ে ওঠে তাঁর লক্ষ্য। আপাত দুরূহ জেনেও মানুষের মনস্তাত্ত্বিকতার জটিল গ্রন্থি উন্মোচনে অধিক সচেষ্ট হয়ে ওঠেন।
’অধ্যয়ন’ তেমনই একটি কবিতা। অভিজ্ঞতার সূর্য আমাদের জীবনকে আলোকিত করলেও বিতর্কিত চিন্তার প্রলাপে রাত্রিগুলো হয় বিনষ্ট। মানুষের বিবেক সত্যের সন্ধান দিলেও মিথ্যার ধূসরতায় সত্যকে চিহ্নিত করতে বিচলিত হয়। আমাদের সম্মুখে চিরন্তন সত্য সামাজিক সত্য। অর্ধসত্যের রহস্যজালে আমরা কোন সত্যে উপনীত হবো ?
প্রেম সত্য যতদিন প্রেম থাকে; বিরহ চিরন্তন সত্য,
বিচ্ছেদ নিদারুন সত্য
সবচেয়ে বড় সত্য: মিথ্যার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা
সামাজিক সত্য। (অধ্যয়ণ, বি.প্র.)
এই সত্যমিথ্যার সামাজিক সত্যই আমাদের বিবেককে প্রতিরোধ করে কাছে। আমরা তাই সত্য মিথ্যার সহজ শিকার।
আ. ফ. ম. সিরাজউদ্দউলা চৌধুরী কবিতার গঠন পরিকল্পনায় তিরিশি কবিতার বৈশিষ্ট্যকে অবলম্বন করেছেন। কবিতার গঠনের চেয়ে তিনি ছন্দ আর শব্দের সুষ্ঠু সুপ্রযুক্ত প্রয়োগেই অধিক মনোযোগী। আর কবিতার মধ্যে সর্বনিম্ন চার পঙক্তির কবিতা (প্রম) যেমন রয়েছে, তেমনি সর্বোচ্চ একষট্টি পঙক্তির কবিতাও (প্রবীণ দরবেশ ও বিপ্লবী যুবক) আছে ।তবে অধিকাংশ কবিতায় তিনি মিতায়তনিক, যা তার কবিতাকে সাংগীতিক করে তুলেছে। ছন্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কবি অধিক সচেতন। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষর বৃত্ত বাংলা কবিতার এই প্রধান তিন ছন্দেই তিনি কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দেই তার অধিক কবিতা রচিত। কবিতায় তিনি উদাহরণ শেষ পৃষ্টার মিলেরই কবিতা লিখেছেন। ছন্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কবি অধিক সচেত তেমনি আছে।
১. অনর্ন্তর – সর্বনাশা প্রেমের খেলায় মত্ত তুমি বিশাল নদী
তোমার গানই গাচ্ছি আমি জন্মাবধি নিরবধি।
(অন্বেষণা) এক গুচ্ছ
২. সান্তর-তুমি তো রয়েছো পাশে শব্দিত প্রহরে,
স্বগত সংলাপে আর দুপুরের আলেস্যে তন্ত্রায়,
বৈজ্ঞানিক কলপনে, রাত্রির শাখার অপোচারে
স্বপ্নের হরিণী তুমি ছুটে আলো কিসের শাখায়
ভাষা, ( বি. প্র )
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি তিরিশি কবিদের উত্তর সাধক। বাক্যের মধ্যে তিনি অহেতুক জটিলতা তৈরী করেন না। কোনো কোনো কবিতায় তিনি মুখের কথাকে কথোপকথনের ভঙিতে প্রকাশ করেন। এই সংলাপ ধর্মিতার ফলে তার কবিতা হয়ে ওঠে অনেকটা নাটকীয়-
ক. পতন। পতন চাই বলে কেউ উঠলো চেঁচিয়ে
আমার কানের কাছে; আমি তাকে শুধালাম, কিসের পতন?
‘নির্বোধ! বোঝোনা কিছু? বলে সে আমার দিকে
তাকালো ভ্রুকুটি করে;
(পতন কাহিনী, বি.প্র.)
খ. বর্ষণমুখর দিনে বলেছিলো, বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে তুমি আছ কতক্ষণ?
যানবাহনের খোঁজ নেই? আমার রিক্সায় তবে উঠে এসো!
সাহস হয়না বুঝি?
(কামার্ত রমণীর আত্মদর্শন, একগুচ্ছ ভালোবাসা ও পিকনিক)
শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিরাজউদ্দউলা চৌধুরী শুচিবায়ু মুক্ত। তিনি গ্রামীণ জীবন, নগরজীবন, এমন কি প্রাচ্য-প্রতীচ্য থেকেও কবিতার শব্দ আমদানি করেছেন। একদিকে যেমন ব্যবহার করেছেন ডবল লেন্স, ট্রাফিক, বিল্ডিং, কিডনি, মাইক্রোস্কোপ, এন্টিবডি, এইডস, ব্যুরোক্রেসির মতো ইংরেজি শব্দ তেমনি দৃষ্টান্ত পুঞ্জিভূত, আত্মগ্লানি, আত্মদর্শন. কৌলিন্য, শাস্ত্রকার অধ্যয়ন এর মতো গভীরও গম্ভীর শব্দ। অপরদিকে অবলীলাক্রমে ব্যবহার করেছেন রূপচান্দা, যুগল শ্রীফল, নাভিমূল, উরু, উদর, নিতম্বিনীর মতো ইন্দ্রিয়জ শব্দ।
চিত্রকল্প নির্মাণে কবি তাঁর অভিজ্ঞতাকে মুদ্রিত করেছেন। তাঁর এক একটি চিত্রকল্প বহির্বাস্তবের দৃশ্যকে শুধু পরিস্ফুট করে না, তা দৃশ্যকেও ছাড়িয়ে যায়।
ক. কনের অথৈ জলে নিমগ্ন বৃক্ষের মত
লুকিয়ে আছে শিশুকাল (পিছুটান, বি.প্র.)
খ. বয়সী রোদ্দুরে তবু কৈশোর যৌবন এসে
সদম্ভে চালায় দস্যিপনা (ঐ)
গ. শীতের প্রবল হাওয়া হামাগুড়ি দিয়ে
থাকে শিশুর মতোন
(শীত, বি.প্র.)
ঘ. পানের পাতার মত মুখে তার লাবণ্য ছড়িয়ে আছে
শেষ বিকেলের সোনা-রোদ।
(সোনাইমুড়িতে ট্রেন থামলেই)
উপমা, উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টিতেও কবি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যঙ্গ রসাত্মক কবিতায় তার সরস উপমা আমাদের আনন্দ দেয়।
ক. সে এক রূপসী নারী রূপচান্দা মাছের মতন (রূপসী)
খ. বাঘিনীর মত এক রমণী রমণ কর্মে বড়ই
নিপুণ শোনা যায়।
(কামার্ত রাণীর আত্নর্দশন )
এই উপমাদ্বয়ে দর্শন ও শ্রুতির মধ্যে ইন্দ্রিয়াজ বিনিময় (Inter Exchange) লক্ষ্যযোগ্য।
আলোচনা শেষে আমাদের সিদ্ধান্ত আ.ফ.ম. সিরাজউদ্দউলা চৌধুরী মননপ্রধান কবি। রোমান্টিক এই একটি শব্দ দিয়েই আমরা চিনতে পারি। তবে তার রোমান্টিকতা হৃদয় আর মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবেগের স্রোতে ভেসে যায় না। তাঁর আবেগ তাঁর বুদ্ধি দ্বারা পরিগ্রুত। কাব্যচর্চার শুরুতে প্রেমজ কবিতায় তাঁর অভিমানী কন্ঠ উচ্চকিত হয়ে ওঠলেও সময়ের বিবর্তনে তা পরিণত ও অভিজ্ঞ হয়েছে। প্রেম, নারী ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় দর্শনের জটিল চিন্তা ও জিজ্ঞাসা জুড়ে দিয়ে জীবনোপলব্ধির এক নতুন দিকের উন্মোচন ঘটাতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতা জীবনের কোনো একটি বিশেষ দিকের নয় অখন্ড জীবনেরই শিল্পিত ভাষ্য।
মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা কবি- সিরাজউদ্দউলা চৌধুরীর ও অধ্যাপক আ.ফ.ম. সিরাজউদ্দউলা চৌধুরীর মধ্য পঞ্চাশে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া আমাদের কাব্যভুবনের জন্য আপূরণীয় ক্ষতি।
আ.ম.ম. মামুন
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, হাটহাজারী সরকারি কলেজ