হোসাইন আনোয়ার
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় মোহাম্মদী বেগেরা বাংলাদেশের নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর যে বর্বর গণহত্যা চালিয়ে ছিল আজ তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি উঠেছে খোদ মার্কিন মুল্লুক থেকেই।
অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পালার্মেন্ট হাউজ অব রিপ্রেজনটিটিভ-এ ১৯৭১ সালের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে চালানো গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে। প্রস্তাবটিতে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিকস্তান সরকারকে বাংলাদেশ সরকার তথা বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার আহŸান জানিয়ে এই প্রস্তাবটি এনেছেন রিপাবলিকান দলের দ্ইু আইন প্রণেতা রোখান্না ও স্টিভ চ্যাপেট।
এর মধ্যে যে কান্ডটি ঘটে গেল তা হচ্ছেÑবেশ কিছুদিন আগের একটি ঘটনা। লস এঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত ডেমেক্রেটিভ পার্টির এক সমাবেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পাকিস্তানকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে একটি দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। কেন তিনি পাকিস্তানকে এ কথা বলেছেন তা তিনিই বলতে পারবেন। হয়তো এর পেছনে অনেক অন্যান্য সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে যা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। তবে একথা ঠিক, পাকিস্তানকে চিনতে অনেকটাই দেরি করে ফেলেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার পূর্বসুরীরা। একটি কথা এখানে বলে রাখছি, মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তথা বাংলার মানুষ কিন্তু এখনো মনে রেখেছে। মনে রেখেছে রেডিও অস্ট্রেলিয়ার কথা। আকাশবাণী, বিবিসি বাংলা ও সায়মন ড্রিং এর কথা।
এডওয়ার্ড কেনেডি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করার উপর ভিডিও করে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিভিউনে ১৭ আগস্ট ১৯৭১ সালে ‘আফটার ভিজিটিং রিভিউ ক্যাম্প ইন্ডিয়া কেনেডি হিটস পাকিস্তান জেনোসাইড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে মি. কেনেডি উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ না করে কোনো উপায় নেই। তিনি আরও মন্তব্য করেন, মানুষের মস্তিষ্কে এ ধরনের বর্বরতার চিন্তা আসতে পারে এ কথা ভাবতেও কষ্ট হয়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্বিচারে ঢাকা সহ সমগ্র বাংলাদেশের সর্বত্র গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে প্রথম তুলে ধরেন রেডিও অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে এ খবর সংগ্রহ করে বিবিসি বাংলা। এরপর সংবাদটি প্রচার করে আকাশবাণী ও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম।
২৫ মার্চ ১৯৭১-এ মধ্য রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করার পূর্বে ঢাকায় অবস্থানকারী সকল বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টার কন্টিলেন্টেলে বর্তমান রূপসী বাংলা আটকে ফেলে। পরের দিন তাদেরকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেয়া হয় একটি বিমানে। ঢাকাকে বিদেশি সাংবাদিক শূন্য করার কৌশল ছিল এটি। কিন্তু না, সামরিক আইনের নির্দেশ অমান্য করে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ২৫ বছরের এক বিলেতি সাংবাদিক সায়মন ড্রিং লুকিয়ে ছিলেন হোটেল ইন্টার কন্টিলেন্টেলের একটি বাথরুমে। ২৭ মার্চ কার্ফিউ উঠে গেলে হোটেল কর্মচারীদের সহায়তায় একটি পুরানো মোটরভেন যোগার করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাত হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শাঁখারী বাজারসহ পুরানো ঢাকার অলিগলি। দখলদার বাহিনীর প্রথম দফায় চালানো গণহত্যা ধর্ষণ লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের প্রত্যক্ষ চিত্র তিনি তার প্রতিবেদনে যার শিরোনাম ছিল ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ড ইন পাকিস্তান’-এ তুলে ধরেন বিশ্ববাসির কাছে। এই প্রতিবেদনটি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৩০ মার্চ ১৯৭১। নিন্দায় মুখরিত হলো বিশ্ব বিবেক। আর প্রতিরোধ গড়ার অদম্য সাহস পেল বাঙালি।
এবিসির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং রেডিও অস্ট্রেলিয়ার মাধ্যমে খবরগুলো শুনেছিলেন হার্ড কিথ ও তাঁর বন্ধুরা। বাংলাদেশের গণহত্যার খবরগুলো তাঁদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। কিথকে প্রধান করে তাঁর বন্ধুরা গঠন করলেন ‘ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ’। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কাজ করা। হার্ব কিথ তখন মোনান বিশ্ববিদ্যালয়ে (অস্ট্রেলিয়া) ফ্যাকালেটি অব আটর্স এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন তরুণ শিক্ষক। তাঁর কমিটির সদস্যরা তখন বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য, লিফলেট, পোস্টার ও সেমিনারের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।
একাত্তুরের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার বিল্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Asian’s Flash Point 1971’ Bangladesh’ শিরোনামে এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে হার্ব কিথ ২৫ মার্চের রাতের গণহত্যাকে ১৫৭২ সালের সেন্ট বার্তোলোসিড গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেন। এছাড়াও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণ ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের জয়লাভ এবং কেন এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ন্যায় যুদ্ধ তা স্পষ্ট যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন।
৭১ এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল তা যে কত ভয়াবহ ছিল নিউজ উইক পত্রিকার ২০ জুন সংখ্যায় সাংবাদিক টনি ক্লিপটন তার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবেÑ‘আমার কোনো সন্দেহ নেই যে পূর্ব পাকিস্তানের শত শত জায়গায় মাইলাই ও লিভিয়ের মতো ঘটনা ঘটেছে এবং আরও ঘটবে বলে আমার ধারণা।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদকপ্রাপ্ত অফিসার গ্যালাখর আমাকে বলেছেনÑআমি ফ্রান্সের যুদ্ধের সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা নরম্যান্ডিং হননকেন্দ্রে দেখেছি, কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যার কাছে সেগুলো কিছুই নয়। কান্না চোখে আমাকে আত্মসংবরণ করতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল।
আইজিএম কার্গিলের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হেনডিক ভ্যান্ডার হেজিডন হত্যাকাÐের স্বরূপ বোঝানোর জন্য কুষ্টিয়া শহরের বর্ণনা দিয়ে তার আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট লেখেন, শহরটি দেখছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর বোমার আঘাতে বিধ্বস্থ জার্মান শহরগুলোর মত। শহরের শতকরা ৯০ ভাগ বাড়ি দোকান, ব্যাংক অফিস, আদালত, পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমরা যখন ঘুরছিলাম সবাই তখন পালাচ্ছিল। অবস্থাটা ছিল পারমানবিক বোমা হামলার পরের দিনের সকালের মত। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ খান্ট এ হত্যাকাÐকে ইতিহাসের জঘন্যতম করুণ ঘটনা এবং মানব ইতিহাসের একটি কলংকজনক অধ্যায় বলে আখ্যাতি করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দও বুদ্ধিজীবীরা ষোল ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে অকল্পনীয় নির্যাতনের চিহ্ন সহ অজ¯্র বিকৃত মরদেহ এবং হাড় কংকালের স্তুপ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। আন্তর্জাতিক রেডক্রস বিশ্ব শান্তি কমিশন, অ্যামেনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি মানবাধিকার সংস্থা এদেশে এসেছিলেন যাতে করে যুদ্ধপরাধীরা জেনেভা কনভেনশনের সুবিধাসমূহ ভোগ করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারকে সে বিষয়ে অনুরোধ করার জন্য। কিন্তু দেশজুড়ে অসংখ্য বধ্যভূমিতে হত্যাকাÐের ভয়াবহতা দেখে তারা নিজেরাই এদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিনিদিধি দলের নেত্রী মাদাম ইসাবেলা বøুম শিয়ালবাড়ীর বধ্যভূমির হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক নিশৃংসতা দেখে মন্তব্য করেছিলেনÑএ হত্যাকাÐ নাৎসি বাহিনীর গ্যাস চেম্বারের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও অনেক বেশি বীভৎস। (২১ জানুয়ারী ১৯৭২, দৈনিক আজাদ, ঢাকা)।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থক মার্কিন সিনেটর ডেমেক্রেট দলীয় সদস্য অ্যাডলাই স্টিভেন কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বধ্যভূমিগুলো দেখে এসে মন্তব্য করেছিলেনÑবাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী ও দোসরদের নৃশংসতা ও ভয়াবহ এবং মানবজাতির ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। এই বর্বরতা মানুষের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। (২৩ জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক আজাদ, ঢাকা)।
মার্কিন সিনেটের সদস্য এ্যাডওয়ার্ড কেনেডির মন্তব্য ছিল, মানুষের মস্তিষ্কে এ ধরণের বর্বরতার চিন্তা আসতে পারে একথা ভাবতেও কষ্ট হয়। (১৭ জানুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ, ঢাকা)।
ফরাসী কথাসাহিত্যিক আঁদ্রে মালবো বলেছিলেনÑদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের নৃশংসতার নিদর্শন আমি দেখেছি, কিন্তু এখনকার নৃশংসতা তার চেয়েও অনেক ভয়াবহ। (২৩ জানুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ, ঢাকা)।
২০১৭ সালের নভেম্বরে (২৫-২৬) বাংলা একাডেমীর আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ১৯৭১, গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐ সেমিনারে বক্তারা একাত্তরের গণহত্যাকে বিশ্বস্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন। এই সেমিনারটির আয়োজক ছিল গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা নিয়ে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, মিশর ও কম্বোডিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে আসা জুলিয়ান ট্রান্সিস বলেন, বাংলাদেশে একাত্তর সালে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যা এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডার গণহত্যার আন্তজার্তিক স্বীকৃতি মিলেছে।
এবার আসছি শুরুর কথায়। লস এঞ্জেলেসে ডেমোক্রেটিভ পার্টির সমাবেশে পাকিস্তানকে নিয়ে যে মন্তব্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন করেছেন তা হয়তো আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু আমরা সেই আলোচনা যাব না। আমরা ভাবছি মার্কিন যুক্তরাষ্টের পার্লামেন্টের হাউজ অব রিপ্রেজনটিটিভ-এ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে রিপাবলিকান সিনেটর রোখান্না এব স্টিভ চ্যাবট যে প্রস্তাবটি এনেছেন এ বিসয়ে প্রেসিডেন্ট কী ভূমিকা গ্রহণ করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
হাউজ অব রিপ্রেজনটিভসে যদি প্রস্তাবটি পাশ হয় তাহলে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন সরকারের নীতি যে ভুল ছিল শুধু তাই প্রমাণিত হবে না, গণহত্যায় পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন, সামরিক সহযোগিতা এবং সপ্তম নৌবহরকে ভারত মহাসাগরে পাঠিয়ে তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সংঘটিত গণহত্যায় নিজিদেরকেও সম্পৃক্ত করেছিল। সে অপরাধ বোধের প্রাশ্চিত্ত করার একটি সুবর্ণ সুযোগও হাতের কাছে পাওয়া যাবে। এমন সুযোগ কী জো বাইডেন হাতছাড়া করবেন? বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
হোসাইন আনোয়ার, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক