নাজমুল টিটো:
ইদানিং ভূমিকম্প আতংকে গোটা বিশ্বের নির্ঘুম রাত কাটে। এই দুশ্চিন্তার দৌড়ে আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। তবে সবচেয়ে বেশি আতংকে থাকে ঢাকাবাসী। সর্বশেষ গত ০৫ মে ২০২৩ খ্রিঃ ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায়ৎ মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৪.৩। এর উৎপত্তিস্থল ঢাকার দোহার থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্বে। ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল। এবারও কম্পনের মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকায় এ যাত্রাও রক্ষা পেল ঢাকা ও তার আশপাশবাসী।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রিঃ সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত হলো তুরস্ক ও সিরিয়া। একই দিনে ভোর ও দুপুরের দুই দফা ভূমিকম্পে প্রায় তিন হাজার লোক নিহত হয়। আহত হয় আরো কয়েক হাজার। রিখটার স্কেলে প্রথম দফায় আঘাত হানা ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮ ও দ্বিতীয় দফায় ৭.৫।
ঘটনাটাস্থলের পাশে অসহায় এক প্রবীণ তুরস্ক নাগরিকের পাউরুটি হাতে নিয়ে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকার একটি দৃশ্য নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়।
কিছুক্ষণ আগেও এই ব্যক্তি যেখানে তিনটি বাড়ির মালিক ছিল এখন তার সবকিছু ভূমির সাথে মিশে আছে। সে দাঁড়িয়ে আছে সহায় সম্বলহীন অন্যের দেয়া তিনটি পাউরুটি হাতে। ভূমিকম্পের ধাক্কায় পৃথিবী কেঁপে ওঠে। তছনছ হয়ে যায় শহর, নগর, বন্দর ও জনপদ। চোখের পলকে মাটির সঙ্গে মিশে যায় স্বপ্ন, সাধনা ও শ্রমে গড়ে তোলা ভবন ভুবন সবকিছু।
বিজ্ঞান ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞের মতে ভূমিকম্প হচ্ছে,”ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে”। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, শিলাচ্যুতি, ভূপাত, তাপ বিকিরণ, ভূগর্ভস্থ বাষ্প, হিমবাহের প্রভাব প্রভৃতি কারণে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মত এখনো বিজ্ঞান ভূমিকম্পের পূর্বাভাস সম্পর্কে কোন কিছু আবিষ্কার করতে পারেনি।
বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্প নিয়ে নানা ধরনের লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে…
(১) গ্রিক জাতির ধারণা অনুযায়ী তাবৎ ভূমিকম্পের জন্য দায়ী ভূমিকম্পের দেবতা পোসাইডন। পোসাইডন যখন খারাপ মেজাজে থাকেন, তখন ভূমিতে ত্রিশূল দিয়ে প্রচ- শক্তিতে আঘাত করেন। ফলে ভূমিকম্প হয়। মানুষের পাপকাজে রাগন্বিত হয়েও তিনি এরকম করেন বলে প্রচলিত আছে।
(২) পশ্চিম আফ্রিকান সংস্কৃতির কিছু মানুষ মনে করত, জীবন টিকে আছে এক দৈত্যের মাথার মধ্যে। গাছপালা সেই দৈত্যের চুল। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী হচ্ছে পরজীবীর মতো, যারা দৈত্যের ত্বকজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে দৈত্যটি মাথা এদিক-ওদিক ঘোরায়। তখনই ভূমিকম্প হয়।
(৩) নর্স পুরাণ অনুসারে দেবতা বলডারকে হত্যার কারণে দেবতা লকিকে গুহায় শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে। লকির মাথায় এক বিষধর সাপ। সেই সাপ একটু পরপর লকির মাথা লক্ষ্য করে বিষ ঢালে। বিষের হাত থেকে লকিকে বাঁচাতে পাশে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী সেজিন (ঝরমুহ) তা একটা পাত্রে সংগ্রহ করে। পাত্রটা ভরে এলে সেজিন বিষটুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে পাত্র খালি করে। পাত্রটা খালি করার সময় বিষের হাত থেকে নিজের মুখমন্ডলকে বাঁচাতে লকি ভয়ানকভাবে নড়াচড়া করে। ফলে শিকলের টানাটানির কারণে পৃথিবীতে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
(৪) জাপানি উপকথা অনুসারে নামাজু (ঘধসধুঁ) নামের বিশাল মাগুর মাছ মাটির গভীরে কাদার ভেতর বাস করে। নামাজুকে পাহারা দিয়ে রেখেছে দেবতা কাসিমা। কাসিমা যখন কাজে ফাঁকি দেয় তখন নামাজু পালাবার জন্য ঝাপটাঝাপটি করে। নামাজুর ঝাপটাঝাপটির ফলাফলে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়।
কোরআনের বিশিষ্ট তাফসীরকারক, হাদিস বিশারদ ও ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে ভূমিকম্প হচ্ছে মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা।
পবিত্র কোরআনে ভূমিকম্প বিষয়ে ‘যিলযাল’ এবং ‘দাক্কা’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘যিলযাল’-এর অর্থ একটি বস্তুর নড়াচড়ায় আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা। ‘দাক্কা’ এর অর্থ প্রচ- কোনো শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোনো কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া। কেয়ামতের দিন ফেরেশতা হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুৎকারের কারণে চূড়ান্ত ভূমিকম্পে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ধূলিকণায় পরিণত হবে এবং তা হবে ‘দাক্কা’। যা এক প্রচন্ড আওয়াজ।
বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞামতে পৃথিবীতে মাঝে মাঝে কঠিন শিলাস্তরের স্থানান্তরের কারণে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প এ কথার প্রতি ইংগিত করে, একদিন ওই ‘দাক্কা’ সংঘটিত হবে, যার নাম কেয়ামত। তখন এই চাকচিক্যময় দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। মানুষ যেন কেয়ামতকে ভুলে না যায়, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে তার আসল ঠিকানা মনে না করে, সেই লক্ষ্যে মহান আল্লাহ ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেন।
পবিত্র কোরআনে “আয-যিলযাল” নামক একটি সূরা রয়েছে। যিলযালের বাংলা অর্থ “ভূমিকম্প”। এই সূরার মাধ্যমে মহান
আল্লাহ মানুষকে এভাবে সতর্ক করেছেন:
ভূমিকম্প
“পৃথিবীকে যখন তার প্রচন্ড কম্পনে কাঁপিয়ে দেয়া হবে।
পৃথিবী তার (ভেতরের যাবতীয়) বোঝা বাইরে নিক্ষেপ করবে।
এবং মানুষ বলবে ‘এর কী হয়েছে?
সে দিন পৃথিবী তার (নিজের উপর সংঘটিত) বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে।
কারণ তোমার প্রতিপালক তাকে আদেশ করবেন।
সেদিন মানুষ বের হবে ভিন্ন ভিন্ন দলে যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো যায়।
অতএব কেউ অণু পরিমাণও সৎ কাজ করলে সে তা দেখবে।
আর কেউ অণু পরিমাণও অসৎ কাজ করলে সেও তা দেখবে”।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সময়ে সময়ে সংঘটিত ভূমিকম্পের কম্পনের মাত্রাভেদে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
ভূমিকম্প এমনই একটা দুর্যোগ, যা নিবারণ, প্রতিকার বা প্রতিরোধ করা এমনকি পূর্বাভাস পাওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি বিজ্ঞানীরা অদ্যাবধি আবিষ্কার করতে পারেননি।
সুতরাং এর ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে সর্ব শক্তিমান মহান দয়াবান সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা ও আশ্রয় চাওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।
নাজমুল টিটো, প্রাবন্ধিক