রুদ্র সুশান্ত
মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক, নির্দেশক, অ্যানিমেটর, কাহিনীকার এবং নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী ওয়াল্ট ডিজনি (ডধষঃবৎ ঊষরধং উরংহবু) বলেছেনÑ “যদি স্বপ্ন দেখতে পারো, তবে তা বাস্তবায়নও করতে পারবে” স্বপ্নই হুমায়ূন কবির সাধুকে বাড়ি যেতে বাধ্য করেছিল এবং তিনি তাঁর জীবনের অল্প সময়ে স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় এনে বাস্তবে পরিণত করেছেন। ঘর ছেড়ে বের হয়ে দেখেন পুরো পৃথিবীটাই তার ঘর। তাই তিনি বাসস্টেশনে, রেলস্টেশনে জীবনের ঠিকানাবিহীন এবং উদ্বাস্তু সময় কাটান। পরে তিনি বুঝতে পারেন এভাবে তো জীবন কাটে না। তার স্থির লক্ষ্যের প্রতি তিনি ধীরে ধীরে ধাবিত হন। চলচ্চিত্র বানাতে হবে, নাট্যকার হতে হবে, অভিনয় করতে হবে, লেখালেখির সাথে যুক্ত হতে হবে, এই ছিল তার মোটামুটি লক্ষ্য। কিছুদিন পর ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাথে পরিচয় হয়। পরে তার সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে হুমায়ূন সাধু অভিনয় জগতে কাজ শুরু করেন। আমাদের প্রচলিত সমাজে এবং সমাজ ব্যবস্থায় শারীরিকভাবে অপূর্ণাঙ্গ মানুষগুলোকে যে মানসিক নির্যাতন, অপমান, নিন্দা, ভর্ৎসনা, তিরস্কার, গঞ্জনা- লাঞ্ছনা এবং অবহেলার শিকার হতে হয় সেটা হুমায়ূন সাধু অন্তরের অন্তস্থলে অনুধাবন করেছেন। নিজে সে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাই নির্মাণ করেছিলেন “ঊন-মানুষ” নামে টেলিফিল্মটি। এই টেলিফিল্মে হুমায়ূন সাধুর আকারের মানুষদের নিয়েই সাজানো হয় মূল গল্প। ঊন মানুষে অভিনয় করে বেশ পরিচিতি পান তিনি। এই টেলিফিল্মটিতে হুমায়ূন সাধু নিজে অভিনয় করেন এবং তিনি সেখানে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন আমাদের প্রচলিত সমাজের লোকজন অর্থাৎ সাধারণ মানুষজনের মনোভাব, মনোবৃত্তি। একজন মানুষ আরেকজন খর্বাকৃতি মানুষকে স্বাভাবিকভাবে মেনে না নেওয়ার যে প্রবণতা সেটা তিনি এই টেলিফিল্মটিতে তুলে ধরেন । “বাংলাদেশের সমকালীন চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ভিডিও কাজগুলোয় উনার প্রায় সব অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। ফারুকীর টিভি ফিকশন কিংবা সিনেমায় সকলের অংশ নেয়ার মধ্যে যুথবদ্ধতার একটি ব্যাপার ফুটে উঠতো। সবমিলিয়ে একটা ‘ভাই-ব্রাদার’ কালচার! ভাই-ব্রাদারদের হাতে নির্মিত ‘ঊন-মানুষ’ টেলিছবিতে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন সাধু। তীব্র আঘাত আর অন্তক্ষরা ছিলো সেই অভিনয়। সমাজের পদে-পদে একজন বামন মানুষকে হেয় করা, তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-তিরস্কার। এমন বৈরিতার সমাজে টিকে থাকার অদম্য সেলুলয়েড গল্প ঊন-মানুষ। বলা বাহুল্য, এই অভিনয় ছিলো তাঁর অন্তর্জাত। সেই অভিনয় ছিলো তাঁর অব্যক্ত বোবাকান্নার স্যালুলয়েড যন্ত্রণা। সেই অভিনয় ছিলো তাঁর হাহাকারের প্রতিধ্বনি” (২)। অভিনয় জগতে হুমায়ূন সাধুকে অন্যভাবে দেখা হয় তার উচ্চতার কারণে। তার উচ্চতা একজন সাধারণ বাঙালি মানুষের মতো পাঁচ থেকে ছয় ফুটের মধ্যে ছিল না । তিনি ছিলেন চার ফুটের কাছাকাছি উচ্চতার একজন লোক, একজন নাট্য প্রযোজক, একজন লেখক, একজন প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পী। উচ্চতার কারণে মানুষ তাকে যেভাবেই দেখুক না কেন, মেধাশক্তি আর অভিনয় দিয়ে তিনি দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছিলেন অসাধারণভাবে। অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন। হুট করে ঢাকায় এসে চলচ্চিত্র টিমের সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশে যাওয়া এবং সবকিছুকে মানিয়ে নেওয়ার যে সমান্তরাল প্রবণতা তিনি “ঊন মানুষ” টেলিফিল্মটিতে চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন সেটাই ছিল বাস্তবে তার চরিত্র। মেনে নেওয়ার এবং মানিয়ে নেওয়ার একটা অসামান্য ও অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল তার মস্তিষ্কে। হুমায়ূন সাধু অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো হলো
১. মেড ইন বাংলাদেশ ২. সাপলুডু ৩. বিউটি সার্কাস ৪. সাত ভাই চম্পা ৪. চোরাবালি (১)।
এই চারটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করলেও বিউটি সার্কাস চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে আলাদাভাবে কিছু কথা বলতেই হয়। বিউটি সার্কাস চলচ্চিত্রটি হলো মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দাঁড়িয়ে মৌলবাদী শক্তি এবং মৌলবাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে একটি চমৎকার চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চেয়েছে এবং যারা সংস্কৃতি চর্চা করে তাদের বিরুদ্ধে সমাজে কুৎসা রটনা করেছে।
“সার্কাসের আড়ালে মনেপ্রাণে মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাওয়ার এক সিনেমা ‘বিউটি সার্কাস’। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় সটান দাঁড়িয়ে মৌলবাদের অন্ধকার জগত থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক নারীর একাকী সংগ্রামের গল্প বিউটি সার্কাস। যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, ধর্মের মুখোশ পরে এখনও যে তারা বাউল গান কিংবা সার্কাসের বিপক্ষে, সেটা জানানোর গল্প বিউটি সার্কাস। স্বাধীনতার পর সার্কাস ও এর পেছনের স্মৃতিময় গল্পের প্রথম কোন সিনেমা বিউটি সার্কাস। মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারানো এক নারীর বয়ানে ঘোরলাগা এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিশোধের সিনেমা বিউটি সার্কাস” (৩)। বিউটি সার্কাস চলচ্চিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন হুমায়ূন সাধু, এই সার্কাসে থাকতে থাকতে তিনি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র জয়া আহসানের প্রেমে পড়ে যায়। হুমায়ূন সাধুর এই চলচ্চিত্রে অভিনয় মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো চলচ্চিত্রটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার,আল বদর বাহিনী বেঙ্গল সার্কাসের প্রধান ওসমান শহীদ পাকিস্তান জিন্দাবাদ না বলায় নাদের মোল্লার নেতৃত্বে তাকে হত্যা করা হয়। বেঙ্গল সার্কাসের সকল কাজ ধর্ম বিরোধী এই তকমা দিয়ে তাদের প্যান্ডেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে মর্মাহত হন ওসমান শহীদের শিশু কন্যা বিউটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিউটির নামেই গড়ে উঠে “বিউটি সার্কাস”। এভাবেই গল্পের কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে।
আরেকটা কথা বলে রাখি, মূলত সিনেমা বানানোর স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীকে পেয়ে সেই কাজে তিনি এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। হুমায়ূন সাধু প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘হোমো-সেপিয়েন্স’। পরে তিনি আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যেটির নাম ‘গুঞ্জন’। ২০১০ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলে ক্যাথরিন মাসুদের অধীনে একটা কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘গড ভার্সেস গড’ নামে একটি শর্টফিল্ম তৈরি করেন। হুমায়ূন সাধু “চিকন পিনের চার্জার” নামে একটি নাটক লিখেন ।সেই নাটকটি তিনি পরিচালনা করেন এবং এতে তিনি অভিনয়ও করেন। “চিকন পিনের চার্জার” কথাটি বন্ধুমহলে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে মানুষের আড্ডায় অনায়াসে এই কথাটা উঠে আসতো। হাসি ঠাট্টা তামাশা আর রসেকষে ভরপুর এই নাটকের সংলাপ। অভিনেত্রী শাহতাজ এই নাটকটিতে হুমায়ূন সাধুর বিপরীতে অভিনয় করেন। নাটকটির কাহিনী ছিলো- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমায়ূন সাধুর সাথে একটি মেয়ের প্রেম হয়ে যায়। পরে তারা দেখা করতে গেলে মেয়েটি হুমায়ূন সাধুকে অস্বীকার করে। এতে সে অত্যন্ত দুঃখ পায় এবং এই সত্যটি মেনে নেন যে প্রেম ভালোবাসা যতোই হোক না কেন মেয়েরা স্মার্ট এবং হ্যান্ডসাম ছেলেকে প্রত্যাশা করে। সর্বশেষ তাকে অভিনেতা হিসেবে দেখা গেছে মাবরুর রশিদ বান্নাহর ‘ভিউ বাবা’ নামক নাটকটিতে। তার অভিনীত নাটকের মধ্যে অন্যতম – পাখি পাঁকা পেঁপে খায়, বেঁচে থাকার জন্য আমি। সিজোফ্রেনিয়া ও অমানুষ নামে দুটি টেলিফিল্মও তিনি অভিনয় করেন। হুমায়ূন সাধুর লেখা গল্প নিয়ে বেশ কয়েকটা নাটক এবং টেলিফিল্ম তৈরি করা হয়েছে। “আমার ঘরে বিরাজ করে লালনগীতি” নামে একটি সঙ্গীত অ্যালবাম অ্যামাজনে প্রকাশ হয়েছে। ১৩ টি গল্প নিয়ে বইমেলায় তার একটি গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। হুমায়ূন সাধুর মৃত্যুর পর অনেকেই এই তেরোটি গল্পকে আনলাকি থার্টিন বা অপয়া তেরো বলেছেন। ২০১৮ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ’র প্রচ্ছদ করা “নানাই” নামে গল্প গ্রন্থটি বইমেলায় এনেছিলেন “বৈভব” প্রকাশনী। বইটি পাঠক মহলে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত অনেক নায়ক নায়িকা এই বইটি নিয়ে রিভিউ লিখেছেন।
একদিন হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হুমায়ূন সাধু চট্টগ্রাম শহরের পার্ক ভিউ হসপিটালে ভর্তি হন। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় স্পেশালাইজড হসপিটালে আনা হয়। সেখানে তিনি ব্রেন স্ট্রোক করেন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত নিয়ে যাওয়া পরিকল্পনা করে তার পরিবার। এর মধ্যে তিনি আবার স্ট্রোক করেন, পরে তাকে স্কয়ার হসপিটাল ভর্তি করানো হয়। সেখানে তার ক্রিটিক্যাল অবস্থা দেখে আইসিইউতে নেওয়া হলে ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর (শুক্রবার) রাত দেড়টার দিকে তিনি পরলোক গমন করেন (৪)। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মতোন হাসি দিয়ে বেদনা লুকিয়ে গেলেন হুমায়ূন সাধু-
“হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা/
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিন কেঁদো না।” (৫)।
চলচ্চিত্র জগতে আশ্বিনের উজ্জ্বলতম চাঁদের ন্যায় আবির্ভাব ঘটেছিল হুমায়ূন কবির সাধুর। যমুনায় জল আনতে যাওয়া রাধার মতো একবুক বিরহ দিয়ে চলে গেলেন তিনি। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায় বলতে চাই- “চলে যাওয়া মানে প্রস্তাব নয়”। হুমায়ূন সাধুরা চলে গেলে চলে যাওয়ার অধিক রয়ে যায় তাদের না থাকা জুড়ে। সাধারণ মানুষের মনে রয়ে যাবেন তিনি, তার মেধাসত্তা, অভিনয় এবং লেখকসত্তা।
তথ্য সূত্র :
১. উইকিপিডিয়া
২. হুমায়ূন সাধু ‘বড়’দের পৃথিবী ছেড়ে ‘ঊনমানুষ’র মুক্তি, রাজীব নন্দী, সারা বাংলা, ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ইংরেজি।
৩. বিউটি সার্কাস এক ঘোর, গুরুত্বপূর্ণও, আহসান কবির, নফহবংি২৪.পড়স, ৮ অক্টোবর ২০২২ ইংরেজি।
৪. না ফেরার দেশে চট্টগ্রামের ছেলে অভিনেতা হুমায়ূন সাধু, চট্টগ্রাম প্রতিদিন, ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ইংরেজি।
৫. কবিতা- বিদায় বেলায়, কাজী নজরুল ইসলাম, কাব্যগ্রন্থ- সঞ্চিতা, প্রকাশনী- মাওলা ব্রাদার্স।
রুদ্র সুশান্ত, কবি ও প্রাবন্ধিক