বাবুল সিদ্দিক : তিনি জালালউদ্দিন মুহাম্মদ বালখী অথবা মাওলানা রুমি নামেও পরিচিত। ১৩ শ শতাব্দির একজন ফার্সি (সুন্নি) মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ধর্মতত্ত্বিক, অতীন্দ্রিবাদী এবং সুফি ছিলেন। রুমির প্রভাব দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমন্ডল ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে পরে। ফার্সি, তাজাকিস্তান, তুর্কি, গ্রীক, পাশতুন, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিন এশিয়ার মুসলমানরা বিগত আট শতক ধরে বেশ ভালভাবেই তার উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবেই সমাদৃত করে আসছে।
তার কবিতা সারা বিশ্বে ব্যপকভাবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রুমিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রিয় কবি হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এবং তার বই যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশী বিক্রি হয়।
রুমির সাহিত্য কর্ম বেশীর ভাগই ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও তিনি অনেক স্তবক তুর্কি, আরবি, এবং গ্রীক ভাষায় রচনা করেছেন।
জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমি খোরাসানের বলখ শহরে (বর্তমান আফগানিস্তান) ৬০৪ হিজরি ৬ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ১০ সেপ্টেম্বর,১২০৭ খ্রিস্টাব্দ জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম বাহাউদ্দিন ওয়ালদ্দের ছিলেন তৎকালীন সময়ে সুলতানুল ওলামা ( আলেম সমাজের প্রধান )। সেই মহান আলেম মাওলানা বাহাউদ্দিন – এর ঘরেই জন্ম নেন ইতিহাসের বিখ্যাত আলেম ও সুফি সম্রাট হজরত মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি।
রাস্তার সামান্য ফকির থেকে রাজা বাদশাহ সকলে রুমির বাবাকে সন্মান করত।
জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমি যে যুগে জন্মগ্রহন করেন সে সময় মধ্যএশিয়ায় ভয়াবহ এর রাজনৈতিক, সামাজিক তোলপার চলছিল। সাম্রাজ্যের ভিতরে যেমন রাজনৈতিক গোলযোগ চলছিল তেমনি চলছিল বহি: শত্রু চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল বাহিনীর আক্রমণ। এই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা রুমির তরুনকাল আতঙ্ক ও অরাজকতায় দহন করছিল।ধর্মীয় বিরূদ্ধবাদীদের এবং সম্ভাব্য মঙ্গল আক্রমণের আশংকায় মাত্র বারো বৎসর বয়সে জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমি ও তার পিতা বলখ ত্যাগ করেন।
তারা ১০ বছর ধরে এশিয়া মাইনর ও আরব দেশ সমূহ ভ্রমন করেন। মক্কার পথে রুমি এবং তার পরিবার নিশাপুরে অবস্থান করেন। সেখানে তাদের সাথে বিখ্যাত সুফি কবি আত্তারের সাক্ষাত হয়। আত্তার জালালউদ্দন রুমি সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, “এই বালকটি ভালবাসার অন্তরের একটি দ্বার উদঘাট করবে।” জালালউদ্দন রুমি কখনই আত্তারকে ভুলতে পারেন নি। রুমি আত্তার সম্পর্কে বলেছিলেন, “আত্তার ভালোবাসার সাতটি নগরই ভ্রমণ করেছে আর আমি এখনও একটি গলির প্রান্তে অবস্হান করছি ।” তার পিতার সাথে ভ্রমনের আর এক পর্যায় জালালউদ্দন রুমি দামাস্কাস যান। সেখানে তার সাথে যুগের শ্রেস্ট দাশনিক ইবনুল আরাবীর সাথে দেখা হয়। শোনা যায়, ইবনুল আরাবি যখন জালালউদ্দন রুমিকে তার পিতার পিছনে হাঁটতে দেখেন তখন তিনি বলেছিলেন, “ আল্লাহ্ র কি মহিমা, একটি হ্রদের পিছনে এক সমুদ্র যাচ্ছে ।”
আঠারো বৎসর বয়সে রুমি সমরখন্দের এক আমিত্যের কন্যা গওহর খাতুনকে বিবাহ করেন এবং দুই পুত্র সুলতান ওয়ালদ ও আলাউদ্দিনে পিতা হন।
লারান্দ এবং আরমেনির আজারজান কিছুদিন অবস্থানের পর রুমির পিতা কোনিয়ার সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ দ্বারা আমন্ত্রিত হন।কোনিয়ায় বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ্দেরের জন্য বিশেষভাবে এক বিদ্যাপিঠ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই শিক্ষা দান করেন।পরবর্তীকালে চব্বিশ বৎসর বয়সে রুমি সেই বিদ্যাপিঠে তার পিতার উত্তরসূরি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। জালালউদ্দিন মোহাম্মদ রুমি তার পিতা ছাড়াও অনেক বিখ্যাত শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই কোনিয়াতেই ছিলেন।
অসাধারন জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং আকর্ষণীয় গল্প ও কাব্যরসে সমৃদ্ধ তার ভাষন ও ক্লাসগুলো বিপুল সংখ্যক জ্ঞান পিপাসুকে আকৃষ্ট করত।’ মসনবী ‘ ও ‘দেওয়ানে শামস ‘ তার দুটি অমর কীর্তি। তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন তার অমর কাব্য ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও আদর্শের অক্ষয় কীর্তির মধ্যে।
১৭ ডিসেম্বর, ১২৭৩ সালে কোনিয়াতে (বর্তমান তুরস্ক) জালালউদ্দন মুহাম্মদ রুমির মৃত্যু হয়। রুমির মৃত্যুতে সকল ধর্মের মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহন করেন। রুমি যেদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যান সেদিন তুরস্কের ইহুদি, খৃস্টান,মুসলমান.খিরিস্তানসহ সকল ধর্মের মানুষ রুমির মৃত্যুদেহের সামনে তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা শুরু করেন শুধু তাই নয় , তারা একসাথে কাতারবন্দী হয়ে নামাজ আদায় করেন। কত বড় মাপের মানুষ হলে তাকে এমন শ্রদ্ধা মানুষ জানায়,এটা রীতিমত ভাবনার বিষয়।
মুসলমান, হিন্দু , ইহুদি, খ্রিস্টান,খালিস্তান সকল ধর্মের মানুষ মাওলানা রুমির কিতাব নিজস্ব আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পাঠ করে থাকেন। এ যেন মাওলানা রুমির জন্য সারা বিশ্ব জয়ের এক বিজয় কাহিনি। এক কথায় বলতে গেলে, রুমির তুলনা রুমি নিজেই। রুমি সেই নক্ষত্র যা দিনের বেলায়ও স্তিমিত হয় না।
মাওলানা রুমির কালজয়ী, অন্তরস্পরশী কিছু উক্তি :
* জীবন হলো ধরে রাখা ও যেতে দেওয়ার মধ্যকার ভারসাম্য।
* গতকাল আমি চালাক ছিলাম তাই দুনিয়া পাল্টাতে
চেয়েছিলাম। আজ আমি জ্ঞানী তাই নিজেকে পাল্টাচ্ছি।
* নিজেকে একা ভেবো না। পুরো জগতটা তোমার ভেতর স্থির।
* তুমি আমার মধ্যে যে সৌন্দর্য্য দেখো তা তোমারই প্রতিচ্ছব।
* তুমি একবিন্দু জল নও। একবিন্দু জলের ভেতর গোটা সাগর।
* তুমি যদি কোন কিছু খুব কাছ থেকে দেখো, তবে তুমি তার
আসল স্বরূপটাই ধরতে পারবে না।
* একমাত্র হৃদয় দিয়েই আঁকাশ ছোয়া সম্ভব।
* বৃক্ষের মত হও এবং মরা পাতা ঝরে যেতে দাও।
* আমরা প্রেমের সন্তান, প্রেম আমাদের জননী।
* যদি তুমি দিনের মত আলোকিত হতে চাও, তবে তুমি
অহমের রাত্রিকে পুঁড়িয়ে ফেলো।
* প্রদীপগুলো আলাদা কিন্তু আলো একই।
* ঘষা খেতে যদি ভয় পাও তাহলে চকচক করবে কিভাবে?
* মোমবাতি হওয়া সহজ নয়। আলো দেওয়ার জন্য প্রথম
নিজেকে পুড়তে হয়।
* তোমার হৃদয়ে যদি আলো থাকে, তাহলে ঘরে ফেরার পথ
তুমি অবশ্যই খুঁজে পাবে।
* আমাদের চারপাশে সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এটা
বুঝতে হলে বাগানে হাঁটতে হবে।
* প্রত্যেকটি মানুষকে একটি নিদিস্ট কাজের জন্য তৈরী করা
হয়েছে এবং সেই কাজটি তার হৃদয়ে গ্রন্থিত আছে।
প্রত্যেকটি মানুষ ভেতর থেকে ঠিক সেই কাজটি করার
তাড়ন অনুভব করে।
* যা কিছু হাড়িয়েছ তার জন্য দু:খ করো না। তুমি তা আবার
ফিরে পাবে, আরেক ভাবে,আরেক রূপে।
* প্রদীপ হও, কিংবা জীবন তরী অথবা সিঁড়ি। কারো ক্ষত
পুরনে সাহায্য কর।
* কেউ যখন কম্বলকে পিটাতে থাকে, সেটা কম্বলের বিরুদ্ধে
নয়, ধুলোর বিরূদ্ধে।
* সুন্দর এবং উত্তম দিন তোমার কাছে আসবে না, বরং
তোমাকেই এমন দিনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত।
* স্রষ্টার কাছে পৌছার অজস্র পথ আছে। তার মাঝে আমি
প্রেমকে বেছে নিলাম।
* যে কোন দিন বাড়ি ছাড়ে নি তার কাছ থেকে যাত্রার উপদেশ
নিও না।
* তুমি বিশ্বব্রাম্মান্ডে গুপ্তধন খোঁজ করছ, কিন্তু প্রকৃত গুপ্তধন
তো তুমি নিজে।
* সিংহকে তখনই সুদর্শন দেখায় যখন সে খাবারের খোঁজে
শিকারে বেরোয়।
* শুধু তৃষ্ণার্ত পানি খুঁজে না, পানিও তৃষ্ণার্তকে খোঁজে।
* নতুন কিছু তৈরী করো, নতুন কিছু বলো তাহলে পৃথিবীটাও
হবে নতুন।
* যে বাতাস গাছ উপড়ে ফেলে, সেই বাতাসেই ঘাসেরা
দোলে। বড় হওয়ার দম্ভ কখনও করোনা।
* যদি তুমি চাঁদ প্রত্যাশা করো, তবে তুমি রাত থেকে লুকিয়ো
না, যদি তুমি একটি গোলাপ আশা করো, তবে তার কাঁটা
থেকে পালিয়ো না, যদি তুমি প্রেম প্রত্যাশা করো, তবে
আপন সত্তা হারিও না।
* সবকিছু জেনে ফেলাই জ্ঞান নয়, জ্ঞান হলো কি কি এড়িয়ে
যেতে হবে বা বর্জন করতে হবে তা জানা।
* ভাষাকে থামাও এখন, খুলে দাও তোমার বুকের মাঝখানের
জানালা, আত্ম উড়ে বেড়াক সর্বত্র ।
* আমি কেন তাকে খুঁজবো ? সে আর আমি তো একই, তার
অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে, আমি নিজেকে খুঁজছি।
আজ মাওলানা জালালউদ্দন মুহাম্মদ রুমির ৭৪৯ তম মৃত্যু বার্ষিকী। মহান আল্লাহ্ এই মহামানবকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন ।
বাবুল সিদ্দিক, প্রাবন্ধিক, নিউইয়র্ক প্রবাসী