মহি মুহাম্মদ :
নদী এখানে বাঁক নিয়েছে মেয়েদের কোমরের মতো। তারপর উপচে উঠেছে তার নধর দেহ। তার আগ পর্যন্ত তাকে লাস্যনটী চঞ্চলা, ধেয়ে আসা কামিনী আর থির দৃষ্টিতে তাকালে মাথার সিঁথির মতো মনে হয়। কখনো কখনো তাকে সিলভার কালারের ফিতের মতো মনে হয়েছে। কারো কারো কাছে এই নদী সখা। আর কারো কাছে প্রাণেশ্বরী। শীতকালে এর বুক শুকালেও বর্ষায় থৈ থৈ করে। আর বর্ষার ছলাৎ ছল পানিতে প্রায় দু কূল প্লাবিত হয়। বহুদূর থেকে এঁকেবেঁকে এসে মদুনাঘাটের কাছে কর্ণফুলির সঙ্গে মিলিত হয়েছে নদী। কর্ণফুলির বুক ঘেঁষে যে জেলেপাড়া তার নাম ইছাপুর। এই পাড়ার মানুষগুলো খালে বিলে মাছ ধরে। কেউ কেউ খেত খামারি করে। তবে খেত খামারি করলেও তারাও সময় সুযোগ পেলে মাছ ধরতে লেগে যায়। মাছ ধরা এদের কাছে নেশার মতো। কারো কারো পেশা। আর কারো কিছুই করার নেই দেখে মাছ ধরা। বড় হতে হতে কেমন করে যেন এই পেশায় ওদের হাতে খড়ি হয়ে যায়।
‘অডা জাইল্যার পোয়া, এত দেমাগ ত ভালা নঅ। কলা পাতাত খানা দিই খাইয়ারে উডিবি। হুদা হুদা কইজ্জা – কেলেংকার কিল্লাই গইরত চঅর। নঅ খাইলে উডি যাগই। আর হেডম থাইলে বাসন আনিয়ারে খাগই।’
এই কথাগুলো সেদিন বলেছিল বিজনবিহারী বহদ্দার। অতিথিদের বাসনে খেতে দিলেও ঢুলিদের জন্য কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করা হয়।
এ বিষয়টি নিয়েই বিনয়ের মাথা গরম হয়ে ওঠে। তাই সে কলা পাতায় খেতে বসতে অনীহা প্রকাশ করে। আর তখন বিজনবিহারি এসে তাকে কথা শোনায়। কথা শোনানোর আর কোনো কারণ আছে কিনা কেউ না জানলেও বিনয় জানে। অনিতার বাবা তাকে সবার চোখে ছোট করতে পারলে সুখ পায়। সমাজে বিনয়রা যে মানুষ, তা আর কেউ মনে করলেও বিজন মনে করে না।
তার মেয়ের বিয়েতে অনেক বড় আয়োজন ছিল। সেই আয়োজনে ঢোল বাদনের দায়িত্ব পড়েছিল বিনয়ের ওপর। বিনয় নিয়েছিল সেই দায়িত্ব। প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে। গ্রামে এত বড় আয়োজন আর কেউ কখনো দেখেনি। মানুষ খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরছে ফিরছে আরো কত কী! আর ওরা একের পর এক ঢোলে বোল তুলেই চলেছে। পেটের খিদে বাঁধ মানছে না। সেদিকে কারো দৃষ্টি নেই। বিজনবাবু কতক্ষণ পর পর এসে বলছেÑ ঢুইল্যাঅল বাজাছনা, জোরে জোরে বাজা। বেয়াকগুণে নাচি, কুদি, পাদি দক।
সবার খাওয়া হয়ে যাচ্ছে তাদের খাওয়ার কথা কেউ বলছে না। মানুষজন আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। তারপরেও কারো মনে হচ্ছে না যে ঢুলিরা এখনো খায়নি। কিন্তু ঢোল বাজালেই ওদের প্রতি এমন আচরণ করতে হবেÑএ বিষয়টি সে মেনে নিতে পারে না। সমাজের উঁচু নিচু প্রভেদ তার ভাল লাগে না। সবাইকে সমান করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু বিনয় কিভাবে করবে? সমাজ ভাঙা গড়া চাট্টিখানি কথা নয়! সে ত ঢোল বাজায়। বাঁশি বাজায়। গান করে, গান লেখার কাজ করে। মাছ ধরতে ভাল লাগে না।
বিনয়ের স্বভাবটা একরোখা। লোকে বলে গোয়াইরগা। যা বলে বলুক লোকে, অতসব ভাবলে দিন যাবে না। তাই সে কারো সাথেও নেই, পাছেও নেই। নিজের মনে যা চায়, তাই করে। মাছ ধরতে ভাল না লাগলে কী করা! আট ক্লাস পড়েছে, ঢের হয়েছে। পাড়ার জেলেদের অত্যাচারে আর বেশি দূর পড়া সম্ভব হলো না। সবাই এসে তার বাবাকে বলল, কিরে জগমোহন পুয়ারে বেরিস্টার বানাইবা ফাল্লার!
কিয়া অদা কি অইয়্যে?
না, কইদ্দে লেয়া পড়া গড়াইত লাই¹ আর তুই এডে অডে মাছ ধরি মইরতা লাই¹।
ত, কিত্তাম অদা?
কামত লাগাই দ। ইতার মতো কতো পোয়া, কাম গরের।
অদা ইতে পইড়তো চাআঁর।
ধূরো দা, আইলসা ফানলার।
কথাগুলো জগমোহনকে জ্বালা ধরায়।
পিতার অশ্রাব্য গালিতে টিকতে না পেরে দিল সে লেখাপড়া ছেড়ে। এখন ঢোল তাকে পেয়ে বসেছে। ঢোলের ওপর সারাক্ষণ আঙুলের ছোঁয়া না লাগালে তার যেন ঘুম আসে না। পকেটে পেন্সিল আর কাগজ থাকে। ভাব এলে লিখতে লেগে যায়। ছন্দে ছন্দে গান রচিত হয়। বিনয় গান পছন্দ করে। ঢোলের বোল নিয়ে নানা নিরীক্ষা করেছে সে। হাত দুটো জাদুর কাঠির মতো লেগে থাকে। বাজাবার সময় অদ্ভুত এক অঙ্গভঙ্গি বিনয়কে কাৎ করে রাখে। একটা পা আগে বাড়ে। তালে তালে পা ঠোকে। ছেলে বুড়ো কান পেতে ঢোলের বাদন শোনে। সেই বিনয়ের জীবনে একটা হিস্টোরি আছে। বহদ্দার বিজনবিহারির মেয়ে অনিতা বালা। জেলেপাড়ায় এই মেয়েটি হয়েছে অন্যরকম। চোখ টানে। কি কারণে যেন অনিতা বিনয়কে খুব দেখতে পারে। বাবার সঞ্চয় থেকে এটা ওটা তাই সে বিনয়কে দেয়। কখনো খাবার কখনো টাকা। বিনয় না নিলে খুব রাগ করে অনিতা। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। অনিতার গায়ের রং কালো হলেও চেহারায় ধার আছে। বাঁধভাঙা যৌবনের আভাস। চোখে মুখে বুনোভাব ফুটে আছে। হালদার পাড়ে পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রজাপতি ধরার বয়স নেই এখন। ছেলে বুড়োর চোখ আটকে যায়। গড়ন গাড়ন নিয়ে ছোট্ট পাড়ায় খোশ গল্প মাতে অনেকেই। আর ছাগলের বাচ্চার পেছনে ছুটতে গিয়ে হালদার তীরে দেখা হয়ে যায় শুধু বিনয়ের সঙ্গে। ঠাকুরমা কুঁজো বুড়ি তাই ঘ্যানর ঘ্যানর করতেই থাকে। ‘অডি দুন্নাইৎ আর কিয়াও নাই ঘুরি ফিরি ক্যাল ঐতার লয় দেয়া অইজারগই দেনা?
‘আঁই ক্যান গইত্তাম!’
‘তুই আর ক্যাং গরিবি, লাং ধরি ফেলাবিদে আরি!’
কপটরাগে তেড়ে ওঠে অনিতা। তবে ঠাকুরমার কথা তার খারাপ লাগে না। ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করে দেহ মন। শিমূল তুলোর মত বাতাসে উড়তে থাকে সে। কল্পনার ফানুস লাগামহীন ভাসতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ পাড়ার লোকের কথায় এভাবে সে ভূপাতিত হবে, ভাবতে পারেনি। সে বেদিশা হয়ে পড়ে। বহদ্দার পিতা বিয়ের সকল আয়োজন করে ফেলেছে।
২.
টংঘর খালি। শূন্যতা জমাট বেঁধেছে। পাকুড় গাছটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মেয়েটিকে ছাগলের বাচ্চার পেছনে আর ছুটতে দেখা
যায় না। বিয়ের কথা-বার্তা পাকা হওয়ায় সে অনেক বড় হয়ে গেছে। হালদার ঘাটের সেই টংঘরে এখন তাকে খুব একটা দেখা যায় না। জেলেপাড়া থেকে আসা রাস্তার ধারের লজ্জাবতীর পাতাগুলো লজ্জা পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। সে মেয়ের আলতো হাতের ছোঁয়া তারা আর পায় না। এই পথ কোনো একদিন তার চঞ্চল চরণের স্পর্শ পেয়েছিল। পথ খোঁজে না তাকে। সে-ই পথ খোঁজে। বহদ্দার মেয়ের বিয়ের ঢুলি নির্বাচন করলেন বিনয়কে। বিনয় কিছুতেই অনিতার বিয়েতে ঢোল বাজাবে না। বহদ্দার টাকার লোভ দেখাল তাতেও সে না বলল। যখন কিছুতেই বিনয়কে বাজানোর জন্য রাজি করানো যাচ্ছিল না। তখন ঠাকুর মা কুঁজো বুড়ি এসে এমন কী বলল যে বিনয় বাজাতে রাজি হয়ে গেল। বিজন কিংবা আর কেউ সে কারণ খুঁজে পেল না। সবাই শুধু অবাক হলো গোঁয়ার বিনয় ঢোল বাজাতে রাজি হয়েছে। বিয়ের দিন যখন সে খাবার নিয়ে হাঙ্গামা বাঁধাল তখন নিঃশব্দে বারান্দার পালা ধরে এসে অনিতা দাঁড়াল। শুধু একবার যখন অনিতার চোখে চোখ পড়ল তখন বিনয় কেঁচোর মত হয়ে গেল। তার সকল রাগ কর্পুরের মত কোথায় উবে গেল- তা কেউ টের পেল না। সবাই দেখল বিনয় শত অপমান হজম করে চুপচাপ কলা পাতায় দু গ্রাস খেয়ে নিচ্ছে। তখন কেউ যদি অনিতার দিকে তাকাত, তাহলে দেখত অনিতার চোখের কোল বেয়ে হালদার মত দুটো নদী বয়ে চলেছে।
৩.
আকাশ গুমড়ামুখো। হাওয়া নেই। গত কয়েকদিন যাবৎ বৃষ্টি। বিজলির ছটা। একটু পর পর আকাশের বুক চিরে দেয়। হালদার বুকে নৌকার ভিড়। পাহাড়ি ঢলে হালদা ভর ভর। মেঘ-বিজলি-বৃষ্টিতে মা মাছ ছুটে আসবে ডিম ছাড়তে। তাই ডিম সংগ্রহকারীর দল ছুটে এসেছে। ডিম নিয়ে তারা পোনা ফোটাবে।
বিনয় শুনেছে, অনিতা বাপের বাড়ি এসেছে। বছর দুয়েক হল। এখনো মা হয়নি অনিতা। তার সঙ্গে দেখা হয়নি। বিনয় এখন অনেক বড় ঢুলি। আজ এখানে বাজায় তো কাল ওখানে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক আসে। কত শত মানুষের সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় হয়। শুধু সেই কালো মেয়েটির সঙ্গে তার দেখা হয় না। গাভীন গরুর চোখের মত যার চোখ দুটো মায়াময়। সে মায়াময় দৃষ্টিতে যেন বট পাকুরের কোমল ছায়া। ঐ দৃষ্টিতেই বিনয় তার গাঁয়ের মায়া খুঁজে পায়। বুকের ভেতরে যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিনয়। কারো কথা বার্তা ভালো লাগে না। শূন্যের থেকে শূন্যের ভেতর তার গন্তব্য যেন স্থির হয়ে আছে। হালদার কূলে তাই বিনয়ের বাঁশি কাঁদে।
ঝড়ের আভাস। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি মাথার ওপর বাজ পড়ল। মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা হয়। মা একা একা। বাপটা মায়ের ধার ধারে না। বিনয়ের বোনটা কত দিন আসে না। জামাইটা অমানুষ। যখন তখন গায়ে হাত তোলে। তাদের বাড়ি থেকে এটা সেটা না পাঠালে কথা শুনতে হয়। বিনয় গতমাসে গিয়েছিল। বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সে গিয়েছিল বোনের শ্বশুর বাড়ি। উঠানে পা দিতেই চিৎকার করে উঠলো তার বোনের শ্বাশড়ি, ও গোয়াইল্যা কডে গেলি? চাই যা চোরাইয়ার পোয়া আইসসে।
বিনয় কাছে গিয়ে নমস্কার করতে চাইলে মহিলা সরোষে পা টেনে নিয়েছিল। তারপর তার মুখ দিয়ে খৈয়ের মতো গালি বের হতে লাগল। তার বাবা মেয়েটাকে এমনি এমনি গছিয়েছে তার ছেলেকে। তার ছেলে এখানে বিয়ে করে কিছুই পায়নি। অন্যত্র বিয়ে করলে অনেক জিনিস পেত ইত্যাদি ইত্যাদি। বোনটা কাদা হাতে ছুটে এলো। ঘর লেপছিল। শীর্ণদেহে অপুষ্টির অভাব। হয়ত ঠিকমতো খাওন দাওনও করে না। নাকি খেতে দেয় না? বিনয়কে দেখে জ্বলে উঠল, কিল্লাই আইসস্যু? য গই। আর মরনের খবর হুনিলেও নঅ আইবা। আই ভালা আছি। বহুত ভালা আছি। সুখ্খত আছি। হাতের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রেখে বিনয় চোখ মুছে চলে এসেছিল সেদিন। পেছনে বোনের ত্রাহি চিৎকার তার কানে এসেছিল। শ্বাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করছে বোনটি।
রাত অনেক গভীর হয়েছে। নৌকার সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা বন্ধ হয়নি। একটু পর পর বিজলি চমকাচ্ছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। টংঘরে চুপচাপ বসে আছে বিনয়। এমন সময় আলতো করে কে যেন পিঠে হাত রাখল।
কন? আস্তে করে বিনয় জিজ্ঞেস করল।
আঁই
বিনয় চমকে উঠলো অনিতা! এতরাতে অনিতা এখানে কেন? বহদ্দার জানতে পারলে খারাপ হবে।
কিল্লাই আইস্যুজ?
এনে।
যাগই। কেলেংকার নঅ গরিছ।
চুপচাপ। মেয়েলি চাপা কান্নার শব্দ।
তোর পোয়াছা নঅ হরদে বলে!
নঅ জানো কিল্লাই নঅ অর?
নঅ জানি।
তোঞারলাই!
চমকে উঠলো বিনয়। তার জন্য অনিতার ছেলে পুলে হচ্ছে না। এটা কী কথা! সে কেন দায়ি হতে যাবে?
নঅ বুঝিলাম।
বুঝিবা ক্যানে? ঢোল ছাড়া আর কিছু বুঝ না?
কথার রহস্যের জটিল আবর্তে বিনয়ের মাথা ঘুরতে থাকে।
ঢং নঅ গর অনিতা। খোলসা করি কঅ। কিল্লাই তোর পোয়া ছা ন অর।
তোঞারলাই। দিবা না আরে উয়া পুয়া!
অনিতার মুখ দিয়ে কাঁকুতি ঝড়ে পড়ে। বিজলির আলোয় স্বাস্থ্যবতী অনিতাকে বিনয়ের বড্ড অচেনা মনে হয়। এদিকে কারো শব্দ নেই। নিঃসঙ্গ টংঘর বদ্বীপের মত একা। অনিতার খুশবু ভরা দেহের ঘ্রাণ নাকে ঝামটা মারে। বুনোলতার মতো পরম মমতায় হাত দুটো পেঁচিয়ে ধরে বিনয়কে। বিনয়ের কোন আপত্তি ধোপে টেকে না। সর্পিল গতিতে রাত বাড়ে। ডিম সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে। ডিম থেকে পোনামাছ হবে। আকাশে আবারও আলোর ফুলঝুরি। সেই আলোতে টংঘরে দুটো তৃষ্ণার্ত নরনারীকে আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না। বৃষ্টির বেগ বাড়ে সেই সঙ্গে মেঘের গর্জন।
মহি মুহাম্মদ, গল্পকার