রাজ কুমার শেখ : আজ তার মাথার ভেতর শুধু একটি কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। শান্তি কী? এ কথার উত্তর দিতে পারেনি আসগর আলি। নাদিরা তার মুখেই শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু তার জবাবে সে কিছু বলে না। নাদিরার চোখে কেমন এক ঝিল টলটল করছিল। ও যেন তলিয়ে যেত। ও নাদিরার চোখে চোখ রেখে ও বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি। নাদিরা তাকিয়ে যেন কী খুঁজছিল। আজ ওর টাঙা নিয়ে যেতে মন করছে না। ওর যৌবন রক্ত ছোটাছুটি করছে। নাদিরার রুপ ওকে ঘুমোতে দিচ্ছে না। ওর এমন হচ্ছে কেন? ও নিজেই জানে না। নাদিরা রাস্তা আলাদা। ও সামান্য টাঙাওয়ালা। তবু মন যেন অন্য কথা বলছে। নাদিরার কথার ধরন আলাদা মনে হয়েছে। এত লোককে নিয়ে সে সওয়ারী করে। কত রকমের মানুষের সাথে মিশে। কিন্তু আজ অবধি ওর মনে কোনো রেখাপাত করেনি। কিন্তু এই নাদিরা ওর মনে কেমন এক লুকোচুরি খেলছে। এ খেলা কোথায় থামবে কেউ বলতে পারে না। ওর ঠুমরির গলা দারুণ। সকালে ওর ডাক পড়লে যায়।কে যেন টেনে নিয়ে যায়। নাদিরা কখনো কখনো ফুল কিনতে যায় ওর টাঙাতে চেপে। বেল ফুল ওর খুব পছন্দ। গুচ্ছ ফুল কিনে নিয়ে এসে বলে, আলি, এ গুলো কেমন?
খুব সুন্দর।
শুধু সুন্দর?
না— মানে।
কী?
ফুলের মতো আপনিও।
তাই?
আপনি খুব সুন্দর।
সাহস করে বলে আসগর আলি।
সুন্দর নিয়ে কী করবো! কোনো কাজে এলো না আলি! ঠুমরি শুনতে ভালো। কিন্তু যে গায় তার যে অনেক জ্বালা। সে আগুন লুকিয়ে অন্যের মুখে হাসি ফোটানো।
কথাগুলো বলতে বলতে কেমন অন্য মনস্ক হয়ে যায় নাদিরা। হাতে তার বেল ফুল। বেল ফুলগুলো যেন হাসছে। রুপের বাহারে যেন টলটল করছে সকাল। আসগর আলি ওর চমক ভাঙিয়ে বলে, আপনি ফিরবেন না?
আলি চলো না কোথাও গিয়ে একটু বসি। বাইরে তো তেমন করে আমার যাওয়া হয় না। খোলা আকাশে গিয়ে একটু নিঃশ্বাস নেব।
ও যেন একটা ছোট্ট প্রজাপতি। উড়ে যাবে যেন। ফুলগুলো আসগর আলিকে ধরতে বলে। তারপর টাঙাতে উঠে বসে। টাঙা ছুটে চলে মতিঝিলের রাস্তা ধরে। দু’ধারে ঘন আমবাগান। কোনো লোক বসতি নেই। টাঙা ছুটে চলে। নাদিরা একটা কী গান যেন আপন মনে গুনগুন করছে। সুরটা বড়োই মিঠে। ভাঙা রাস্তা। বনজ গন্ধ। মতিঝিলের জলজ গন্ধ। সবুজের সমাহার। যেন একটা পরি বসে আছে তার টাঙাতে। নাদিরা সত্যিই সুন্দর। বাতাসে ওর রেশমঘন চুল উড়ছে। ও হাত দিয়ে ঠিক করছে না। আলি বার বার পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। ও চোখ ফেরাতে পারছে না। কেমন এক নেশাতে পেয়েছে। আজ ওর গান গাইতে ইচ্ছে করছে। এমন সময় মতিঝিল এসে গেল। কেমন সব চুপচাপ। একটা কি পাখি ডাকছে। আলি ওর নাম জানে না। পাখিও তেমন ভাবে চেনে না। পাখির ডাক ওর ভালো লাগে। ভোরে নবাব আমবাগানে এমন পাখি ডাকে। ওর ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে ও পাখির ডাক শুনতে শুনতে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। আজ যেন ওরও বুকে পাখি ডাকছে। টাঙা থামিয়ে দিল ও। নাদিরা যেন উড়ে উড়ে নামলো টাঙা থেকে। নেমে ও বলে, আলি, চলো দুজনে একটু হেঁটে যাই। কতদিন এখানে আসবো আসবো করে আসা হয় না।
নাদিরা এগিয়ে চলে। আলি টাঙা রেখে হাঁটতে থাকে। দু একটা কাঠবেড়ালি ওদের দেখে পালিয়ে গেল। এখনো এখানে ভিজে ঘাস। রোদ এসে পড়েনি। শিশির লেপ্টে ঘাসে। নাদিরার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে। সে দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। এখানে এখন কোনো লোকজন নেই। সব কেমন যেন ফাঁকা।
আলি, আমার খুব বদনাম না?
বদনাম! এমন কথা কেন বলছেন?
আমি নুরশাবানুর কোঠিতে থাকি। নবাবরা আসা যাওয়া করেন। আমি গান গেয়ে আনন্দ দিই। আরও কত রহিস আদমি আসে কোঠিতে। বদনাম তো থাকবেই।
নাদিরার চোখ ছলছল করে ওঠে। নদী থেকে একটা শীতল বাতাস ওঠে আসে। নাদিরা আলিকে ডাকে ওর সঙ্গে যেতে। আম বাগানের পথ ধরে। আম গাঋের পাতা থেকে কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে। আলি বুক ভরে গন্ধ নেয়। ওরা এক সময় নদীর ধারে এসে সবুজ ঘাসের বিছানায় এসে বসে। একটু দূরে সিরাজ দৌলার ভালোবাসার হীরাঝিল। কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। কত ভালো বেসে হীরাঝিল বানিয়ে ছিলেন। এখন তার অবশিষ্ট কিছুই নেই। এই নদীর বুকে বিলীন হয়ে গেছে। আসগর আলির মনটা কেমন যেন করে ওঠে।
আলি, কিছু বলছো না?
কী বলবো?
তোমার কথা বলোা। আমাকে নিয়ে যাবে তোমার বাড়ি?
আমার বাড়ি! আপনি যাবেন?
কেন যাবো না। তুমি বললেই যাবো। যদি তোমার বাড়ির লোকজনের আপত্তি না থাকে।
আপত্তি নেই। যখন খুশি যেতে পারেন।
এ কথা শুনে নাদিরা হাসতে থাকে। ওর হাসির শব্দ মিশে যায় নদীর জলের ঢেউ এ। বড়োই পবিত্র হাসি। এই সুন্দর সকালে মনে হল একটা পরি নেমে এসেছে।
আলি, আমাদের কোনো ঘর নেই। সংসার পাতা হয়না কোনো দিনই। আমরা এভাবেই বাঁচি। আমরা যে আগরবাতি। লোকজনদের খুশবু দেওয়ায় কাজ। একটু আকাশের মতো মুক্ত হতে চাই। তুমি আমাকে নিয়ে এসো। আমার আর ভালো লাগে না।
আলি অবাক হয়ে তাকায় নাদিরার দিকে। নাদিরার চোখে জল।
আপনি কাঁদছেন?
কই না তো।
নাদিরা নিজেকে আড়াল করে। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। তারপর ও একটু আলতো করে হাসে। অবাক হয়ে যায় আলি। মানুষটি ঠিকমতো কাঁদতেও পারে না। সব যেন মাপা। বাগানবাড়ির সব ফুলের কাঁটা যেন ওর বুকে ফুটে আছে। নাদিরার জন্য ওর কেমন মায়া হয়। এত টাকা পয়সা, রূপ, ঝলমলে কোঠি। ঝাড়বাতি, নানান ফুলের গন্ধ, সারেংছির মাদকতা, পানের সুগন্ধি খুশবু, নবাবের নজরানা, এ সব থেকেও নাদিরা যেন ভীষণ একা। সে আর নিতে পারছে না। তার মন এখন মুক্ত হাওয়ায় মিশে গেছে।
আলি, কোঠিওয়ালী আমি। মানুষ আমাকে দিনের আলোতে চায় না। রাত হলে তাদের প্রিয় হয়ে উঠি। কত মিঠি বুলি। কত আদর। টাকা লুটাই পায়ের কাছে আমার একটু ছোঁয়ার জন্য। বিশ্বাস করো আলি আমি নষ্ট হয়ে যাইনি। এখনো এই নদীর পানির মতো পবিত্র। নাদিরা কোঠিওয়ালী হতে পারে। কিন্তু আমি কাউকে চৌকাঠের এ পারে ডাকিনি। আমার মুঠো মুঠো টাকা, সোনা, এ সব আমার কোনো কাজের নয়। আলি, আমি একটা সহজ জীবন চাই। সন্তান চাই। যার মুখ দেখে দিন কেটে যাবে।
নাদিরা আপনমনে বলে চলে কথা। আলি চুপ করে বসে শোনে সে কথা। নদী বয়ে চলে। কত যুগ থেকে সে বয়ে চলেছে। কত কিছুর সাক্ষী। বাংলার মসনদের সে রবরবা দেখেছে। সিরাজদৌলার রক্ত এ মাটিতে ঝরেছে তাও সে দেখেছে। সে থেমে থাকেনি। বয়ছে। সে বয়বে। নাদিরার কথাও সে শুনছে। আরও কত কথার বুনন তার বুকে এঁকে যাবে। চলতেই থাকবে। মানুষ আসবে যাবে। নদী থাকবে। জল থাকবে। হীরাঝিলের কান্না মিশে থাকবে। ইতিহাস শুধুই মাটির লেপন ছাড়া কিছু নয়। কি হবে এত জেনে। ও যা দেখছে তাই সত্যি। বাকি আর কী আছে? ভাবে আসগর আলি।
নাদিরার মতো একটি মেয়ে সেও তো ঘর বাঁধতে চায়। তারও তো একটা সরল জীবন আছে। নাদিরা তার খুব কাছে। ও চাইলে ওকে ছুঁতে পারে। কিন্তু ও যে সামান্য টাঙাওয়ালা। ওর কি মানাবে পরিকে ছুঁতে? ও কোন ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছে। আলি চুপ করে বসে থাকে। নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা ভেসে যাচ্ছে। মাঝিদের গুনগুনানি। জলের ঢেউ। তোলপাড় করছে ওর মন। আজ কি কোনো ফাগুনের বেলা? যে কোনো সময় মনে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। আলি আর বসে থাকে না। ঘোড়াকে খেতে দেয়। কাছেই আম বাগান। পাখি ডাকছে। ওর মন মাতাল হয়ে উঠছে। নাদিরা ওকে হাতের ইসারায় ডাকে। আলি এগিয়ে যায়।
আলি, আমার খিদে পেয়েছে। সকালে কিছু খাইনি।
কী খাবেন?
বিরিয়ানি।
খান হোটেল থেকে আনবো?
টাকা নাও।
কী যে বলেন!
আলি চলে যায়।
নাদিরা বসে থাকে। আপনমনে গুন গুন করে, মনকা পিয়া বড়ি নাদান হ্যায়।
গানটা শেষ না করেই ও হাসতে থাকে। কেউ দেখলে বলবে পাগলি। বাতাসে ওর রেশমঘন চুল উড়ছে। গায়ের শাড়ি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সেই কবে পা রেখেছিল এ শহরে। তখন বয়স বা কত হবে? ওর নানিজান এখানে দিয়ে গেছেন। আর তার নানিজান ফিরে আসেনি। সে আর ফিরতেও চায়লেও আর ফিরতে পারবে না। এখন এ শহর তার। মনে পড়ে তার বাপকে। সংসার চলতো না। মা কত কষ্টে তাকে মানুষ করেছে। তার বাপ মা এখন কোথায় তার জানা নেই। মনে পড়লে বুকটা চিনচিন করে ওঠে। এমন সময় টাঙা ছুটির আলি আসে। মুখে তার হাসি। যেন সে রাজ্য জয় করে ফিরছে। টাঙা থেকে লাফিয়ে নামে। সেও যেন উড়ছে। হাতে দু পেকেট বিরিয়ানি। নাদিরার কাছে এসে বিরিয়ানির পেকেট বাড়িয়ে দেয়।
আলি মনে হচ্ছে খুব খুশবুদার বিরিয়ানি।
খান হোটেল খুব ভালো বানায়।
এখানে কোথায় কী পাওয়া যায় আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে।।
নাদিরা চটপট বিরিয়ানির পেকেট খুলে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নেয়। তারপর খেতে থাকে। যেন একটা অষ্টাদশী। আলি ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ও খেতে ভুলে যায়।
না, আজ ওর কিছু ভালো লাগছে না। মাথার ভেতর নাদিরা ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ আর সওয়ারি করতে ভালো লাগছে না। আজ তার আর কোথাও মন লাগবে না। আম গাছের নিচে টাঙা গাড়িটা রেখে ও ঘুমিয়ে পড়ে। বেলা বয়ে যায়। তার আজ বাড়ি ফিরতে মন করছে না। তার এমন হচ্ছে কেন? ও মনকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কোনো উত্তর পায়না। বিকেল হয়ে আসে। পাখিদের ডাকে ওর ঘুম ভেঙে যায়। রাস্তা ফাঁকা। সে এক সময় টাঙা নিয়ে ফিরতে থাকে।
(ক্রমশ)
রাজ কুমার শেখ, কথাসাহিত্যিক, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ