এখন সময়:বিকাল ৫:২৫- আজ: শুক্রবার-২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৫:২৫- আজ: শুক্রবার
২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

দুষ্প্রাপ্য স্মরণের সাঁকো’

ড. ইসরাইল খান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত বাংলাদেশ মহিলা অওয়ামী লীগের একক প্রচেষ্টায় প্রকাশিত ঐতিহাসিক শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘স্মরণের সাঁকো’ ছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিবাদী সাহিত্য-সাময়িকীগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। হত্যার শুধু  প্রতিবাদই করা হয়নি, জনগণের কাছে হত্যার ঐতিহাসিক পটভূমিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে যুক্তি সহকারে। বাংলাদেশের ন্যায় একটি শিশুরাষ্ট্রের জন্মকালীন সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কোনো মোটিভেশনাল প্রোপাগান্ডা স্বাধীনতার পরে পরে চালানো হয়নি, একথাগুলো তাঁরাই স্পষ্ট কওে বলেছিলেন, ঐ সময়ের অন্যকোনো সংকলনে যা বলা হয়নি। কিন্তু ঐতিহাসিক আকর-স্মরণিকাটি সম্ভবত কোথাও সংরক্ষিত নেই।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতালাভের পূর্বে এই অঞ্চলের মানুষ যে হাজার হাজার বছর ধরে বিভাষী-বিজাতি ঔপনিবেশিক শাসকের শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পিস্ট হতে-হতে তাদেও যে স্বাধীনতার উপলব্ধি ঘটতে সময় লাগবে, শিশুটি জন্মগ্রহণ করেই যে কারো প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে না, সে বিষয়ে  দেশের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজের কেউ কোনো চিন্তা ও তদনুযায়ি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। চারা গাছটি রাতারাতিই কেনো সুফল দিচ্ছে না, তার জন্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করা হয়েছিলোÑজনগণের ভোগের আকাক্সক্ষাকে উস্কে দিয়ে অসন্তোষ বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক শত্রু, ষড়যন্ত্রকারীদেরকে

 

সাহায্য করা হয়েছিল। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের কথায় শুনিÑ

‘একটি নিষ্পাপ কচি শিশুর মতই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ তত্ত্বাবধান কামনা করে। সৃষ্টি রহস্যের অবগুন্ঠন শিশুর কচি মনকে ঘিরে জাগায় বিচিত্র প্রশ্নÑকখনো নেতিবাচক, কখনো ইতিবাচক। পথ চলা, কথা বলাÑএ দুটিতেই নিয়মের বন্ধন অপরিহার্য। শিশু এ নিয়মে অনভিজ্ঞ। তাই চলার পথে হোঁচট খায় বারবার। উচ্চারণে বিভ্রান্তি ঘটে। কিন্তু তত্বাবধানে কালান্তরে সেই শিশুর প্রতিভাই হয়তো একদিন বিস্ময়ের সৃষ্টি করে অবিশ্বাস্যরূপে। একটি নতুন দেশের জীবনেও অনুরূপ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।.. এই নবীন রাষ্ট্রকে বুকে জড়িয়ে সমস্যার অথৈ সমূদ্রে পাড়ি জমানোর দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু আর তাঁর নিকটতম সহকর্মীবৃন্দ। নবতর জটিল পরিবেশে অনভিজ্ঞতাজনিত কারণে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পাশে ব্যর্থতার সমাচারও হয়ে উঠে প্রকটÑতীব্রতর। নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতি এর জন্য কম দায়ী ছিলো না।…এই নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আভ্যন্তরীণ অনৈক্য, চিন্তার পার্থক্য। অনৈক্যের ফাটল দিয়ে যুদ্ধোত্তর অপরিহার্য উপসর্গের ঘাড়ে চড়ে অলক্ষ্যে প্রবেশ করে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। সুযোগ বুঝে ঘরের শত্রুরা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতির জনকের ওপরÑমুহূর্তে ভুলুন্ঠিত করে বাঙালি জাতির মর্যাদা। ভাবতেও  কষ্ট হয় আজ বঙ্গবন্ধু নেই, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী আর কামারুজ্জামান নেই। এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড ইতিহাসে নজীরবিহিন। যে অভিযোগের মূলে বঙ্গবন্ধু আর ৪ জন জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে সেই অভিযোগেই বর্তমান সরকার অভিযুক্ত। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার দুর্নীতি আর ব্যর্থতায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।…

বঙ্গবন্ধু ৪৪ হাজার কিউসেক পানির বিনিময়ে ভারতের সঙ্গে ফারাক্ক চুক্তি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ১০ হাজার কিউসেক কম নিয়েই ‘অকল্পনীয়’ মঙ্গল সাধন করে চলেছেন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাঙলার মানুষকে বাঁচাবার নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু  সরকার ভারত থেকে এক লক্ষ টন চাউল অনুদান হিসেবে গ্রহণ করায় সমালোচকরা চিৎকার করেছিলÑ’বাংলাদেশ ভারতের অংশ হয়ে গেল।’ কিন্তু বর্তমান সরকারও ভারত থেকে চাউল সাহায্য নিচ্ছেন। কিন্তু এখন সেই সমালোচকরা রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ। পাকিস্তানের সময় আওয়ামী লীগ কোন কথা বললেই তদানীন্তন সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি ‘ইসলাম গেল’ বলে শ্লোগান তুলেছিল। ঠিক বাংলাদেশেও একটি চক্র অনুরূপভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশ গেল’ বলে শ্লোগান শুরু করেছে। উদ্দেশ্য একইÑশধুমাত্র লেবেলের পার্থক্য!

রাজনৈতিক দলের নিকট দেশ ও জনগণের সার্বিক ক্রমবিকাশই কাম্য। এই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই কঠিন ত্যাগ ও আপোষহীন মনোভাব নিয়ে সকল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। ক্ষমতা নয়, বাংলার জনগণের মুক্তিÑএটাই ছিল আওয়ামী লীগের প্রচার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সেই মানসিকতার চূড়ান্ত পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করেছে।

‘আজ বঙ্গবন্ধু মজিব ভাই আমাদের মাঝে শশরীরে উপস্থিত নেই। তাঁর মত মহান ব্যক্তিত্বের অভাব পূরণ কোরবার মত পরাক্রমশালী জননায়ক কবে জন্মাবে জানি না।’

কিন্তু তিনি আশাবাদী, এই শূন্যতা পূরণের জন্যে কেউ অচিরেই আত্মপ্রকাশ করবেন বাংলার জাতীয়-জীবনে, আহ্বানভরা তাঁর কথাÑ

‘কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধুর সেই ডাক গোটা দেশবাসীর হৃদয় কন্দরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছেÑরক্তের আখরে লিখা হয়ে যাচ্ছে প্রতি মূহর্তে দৃপ্ত শপথের অগ্নিবাণী। গোটা জাতির জীবনে আলোর মশাল জালাতে ঐ তিনি ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ দৃপ্তপদভারে পথ দেখিয়ে চলেছেন। কার সাধ্য! কার ক্ষমতা,Ñপারে এই জাতির আত্মিক চেতনাকে স্তব্ধ কোরতে ? ঐ চেতনার বুকে জন্ম নেবে লক্ষ কোটি বঙ্গবন্ধু। আদর্শ বেঁচে থাকলে সংগ্রাম থাকবে, যুগ যুগ ধরে থাকবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ, থাকবে এর পলি প্রান্তর শিশির ভেজা দুর্বা ঘাসের দিগন্ত রেখা। সেই বাংলাদেশে হেসে খেলে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যাবে সেই জনতা,..’

এই স্মরণিকাটি দেশের নারী সমাজের মাধ্যমে সকলকে অবহিত করতে বঙ্গবন্ধু-হত্যার মতো অভাবিত ঘটনাটি কেনো ঘটলো তার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলো। বিভিন্ন লেখকের রচনায় সেসব কারণ-সন্ধানের নিবিড় পরিচয় পাওয়া যায়। আর সকলেই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সকলকে আহবান জানিয়ে শেষ করেছেন তাঁদের লেখা। তাই সামগ্রিকতাবোধের বিবেচনায় সংকলনটি তাৎপর্যপূর্ণ।

এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুরই সৃষ্ট বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের বিদূষী নেত্রীবৃন্দের। সম্পাদনা করেছিলেন যুগ্মভাবে আই ভি রহমান ও সাহারা খাতুন। তখনকার আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছাবাণীও ছিল। কিন্ত অগ্নিক্ষরা রচনাগুলোর লেখক সাহসিকা নারীরাই। সংখ্যায় বেশি নন তাঁরা। সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীম, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, সাজেদা চৌধুরী, আই ভি রহমান, মতিয়া চৌধুরী, সায়েমা চৌধুরী ও পান্না কায়সারের কটিমাত্র লেখা। আর আছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের শহীদদের আট পৃষ্ঠার ছবি, যা এতোদিন প্রকাশ করা যেতো না। আর প্রতিটি রচনার নিচে উদ্ধৃত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি ঐতিহাসিক উক্তি। যেমনÑ

‘আমার অবস্থা যদি চিলির আলেন্দের মতও হয় তবুও আমি জনগণের সাথে থাকবো’; ‘গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করে বাঙলার মানুষ স্বাধীন জাতির পূর্ণ মর্যাদায় বাঁচতে চায়’; ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’; ‘সারা বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত শোষক- আর শোষিত- আমি শোষিতের পক্ষে’; ‘আত্মসমালোচনা করুন, আত্মশুদ্ধি করুন, তাহলেই হবেন মানুষ।’ প্রভৃতি।

ডাবল ডিমাই সাইজের স্মরণের সাঁকোর প্রচ্ছদ প্রভৃতি সমগ্র উপস্থাপনা সারাদেশে বঙ্গবন্ধু-হত্যার জন্যে তীব্র ক্ষোভ-ঘৃণা সৃষ্টিতে সফলতো হয়ই, উপরন্তু এই হত্যাকান্ডের বিচারের পটভূমি তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশের খ্যাতনামা বিদূষীদের বলিষ্ঠ ভাষার তেজোদীপ্ত উপস্থাপনা বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিবাদী স্মরণিকা হিসাবে সে-সময়ের দুর্বলচিত্ত-হতোদ্যম সমাজকে জীবনরস জুগিয়ে জাগিয়ে তোলার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারী সমাজকে সাহসী হবার উদ্দীপনা দেয় এর সকল লেখা। বঙ্গবন্ধু-হত্যা যে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখারই ষড়যন্ত্র, তা চমৎকারভাবেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন সাঁকোর লেখকেরা। ‘আমাদের কথা’য় আই ভি রহমান কণ্ঠে বিষ্ময় ও আবেগ মেখে জিজ্ঞাসা করেনÑ

‘আজ থেকে চার বছর আগে ১৫ই আগস্টের এই দিনটিতে ঘাতকের নিক্ষিপ্ত গুলীতে এক রাশ রক্ত ছড়িয়ে পড়লো, সে রক্ত চাপচাপ বেঁধে কালো হয়ে গেল। বাংলাদেশ বেতার থেকে এক দুর্বিনীত কন্ঠে ঘোষিত হলো : শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। হঠাৎ যেন প্রচন্ড ধাক্কায় বোবা হয়ে গেলো বাঙলার মানুষ। স্তম্ভিত হয়ে গেল সারা বিশ্বের জনগণ। বাংলাদেশের মাটিতে কাকে হত্যা করা হয়েছে ?… ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ যে আজন্ম বিদ্রোহী বিপ্লবী বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, যাঁর মহান নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার মানুষ এক অমর ইতিহাস রচনা করেছিলেনÑসেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে ? যিনি তাঁর বিপ্লবী নেতৃত্বে বাঙলার মানুষকে দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, একটি জাতীয় সংগীত, একটি জাতীয় পতাকা– সেই মহানায়ক শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে ?

হ্যাঁ হতবাক, ক্ষুব্ধ স্তম্ভিত বিশ্ব জানলো তৃতীয় বিশ্বের অগ্নিপুরুষ, বাঙলার প্রাণ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে চক্রান্তকারী ঘাতকের দল। বাঙলার হৃদপিন্ডকে উপড়ে দিয়েছে। হত্যা করেছে তাঁর স্ত্রীকে, পুত্রদের, পুত্রবধূদের, এমনকি শিশুপুত্র রাসেলকে। বাংলার স্বর্ণোজ্জল ইতিহাসে যে কালি মাখালো ঘাতকের দল তা আর কোনদিন মুছবে না।’

অতপর তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেনÑ

‘মুখর ইতিহাস মূক হয়ে দিন গুনছে বাংলার মানুষ ইতিহাসের এই ঘৃণ্যতম কাজের জবাব করে দেবে তারই জন্য। ১৯৭৯ সালের ১৫ই আগষ্টে এদেশের কোটি কোটি মানুষের অশ্রর সঙ্গে অশ্রু মিলিয়ে আমরা মহিলারা ঘোষণা করছিÑআমরা বাঙলার আট কোটি মানুষ এর সমুচিত জবাব দেবো। এদেশে শোষণহীন সমাজ কায়েম করে আমরা এর জবাব দেবো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আরব্দ্ধ কাজকে আমরা সম্পূর্ণ করবো।’

শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন ড.নীলিমা ইব্রাহীম-তারপর তিনিও দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেনÑ ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ‘সোনার বাংলা’ গড়ে যেতে পারতেন কিনা জানি না, ‘সোনার মানুষ’ সেখানে জন্ম নিতো কিনা তাও আমাদের অজ্ঞাত ; কিন্তু আমাদের অপূর্ণ প্রত্যাশা আজও আমাদের পথ দেখাচেছ।’ তারপর স্পষ্টতই অনাগত দিনের মুজিব সেনাদের বৈপ্লবিক আত্মপ্রকাশের লাল সূর্যকে সাক্ষি মেনে বলছেনÑ’সোনার বাংলা’ দেখো,Ñঐ দেখ,Ñ’সোনার মানুষেরা আসছে।’

‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্যেই নারী সমাজের মুক্তি নিহিত’ শিরোনামের রচনায় সাজেদা চৌধুরী বলেন, এশিয়া ও উপমহাদেশের মহিলা সমাজ নানা সামাজিক রাজনৈতিক কারণে অবহেলিত। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল সমাজবাদী রাজনীতির ধারায় নারীদের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রদানের কথা ঘোষণা করেছিলেন। যে সকল ক্ষেত্রে নারীরা কর্মক্ষম হবে, সেখানে তাদের অবশ্যই উপযোগী কাজ দিতে হবে।…

‘আজ ১৫ই আগস্ট। চার বছর আগে বাংলার দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়িত হওয়ার শুরুতেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রে তিনি সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। আজ মহিলা সমাজকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পটভূমিতে একতাবদ্ধ হয়ে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামে দুর্জয় শপথে উদ্দীপ্ত হতে হবে। আমার বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তাবায়িত হলেই কেবল দেশের জনগণের সাথে নারী সমাজেরও যথার্থ মুক্তি আসবে।’

 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ‘সেই পথ লক্ষ্য করে’ মতিয়া চৌধুরী সার্বিক রাজনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করে বলেনÑ

‘শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু  সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য বাকশালের যে কর্মসূচী নিয়েছিলেন তা দেশের মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারতো। কিন্তু পরিবর্তনের এই বাণী জনতার কাছে পৌঁছাবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির সংকট, দুর্ভিক্ষ, অরাজকতার ফলে সৃষ্ট জনমনের হতাশা, নিষ্পৃহতা ও বিভ্রান্তিকে পুঁজি করে প্রতিক্রিয়াশীলরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আজ প্রগতির স্রোতধারা শুধুমাত্র  রুদ্ধ নয়, একে উল্টোদিকে প্রবাহিত করানো হচ্ছে। পাকিস্তানী আমলের দ্বি-জাতি তত্তকে সুকৌশলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে চালানো হচেছ। মাতৃভাষা বাংলা আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে দুয়োরাণীর ম্লান মূর্তিতে উপস্থিত। আবহমানকালের বাঙালী সংস্কৃতিকে কলুষিত করে তোলার জন্য শিল্প সাহিত্যে অপসংস্কৃতির বেনোজল ঢোকানো হচ্ছে। বিকৃত প্রমোদ উপকরণের মাধ্যমে জনতার প্রতিবাদী চেতনাকে আচছন্ন ও বিবশ করে ফেলার চেষ্টা চলছে। সংবিধান হতে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে কেটে বাদ দেবার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানো হচ্ছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পুরানো বিতর্ক নতুন করে চাঙ্গা করে তোলা হচ্ছে। বিদ্রোহী কবি নজরুলকে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিৎ প্রতিযোগিতা চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা জেলে পচছে। রাজাকার আলবদররা মন্ত্রীত্ব চালাচেছ। পঙ্গু মুক্তি যোদ্ধাদের খেয়ে বাঁচার তহবিলে ডাকাত পড়েছে। শহীদের রক্তে পূত জাতীয় পতাকা জাতীয় সংগীত বদলের দাবী উঠছে। সামরিক ফরমানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের গায়ে সাদা পোষাক পরানো হচেছ। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর কম্বুকন্ঠের ঘোষণা ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জালেম আর মজলুম। জালেমের পাশে ধনতন্ত্রের মোড়ল সাম্রাজ্যবাদ, মজলুমের পক্ষে সমাজতন্ত্র’ আজ অনুপস্থিত। বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের হাঙর কুমীররা ঢুকছে।  স্বনির্ভর অর্থনীতির বাগাড়ম্বরের আড়ালে আমরা বৈদেশিক ঋণের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ছি। পেট্রোডলার আজ আর দক্ষ জনশক্তি নয়, আমাদের মা বোনদেরও প্রমোদের উপকরণ হিসাবে কিনে নিজে যাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প কল-কারখানা ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে  দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদনের রাজনীতির নামে সার কীটনাশক ঔষধ সেচ পাম্পসহ উৎপাদনের সমস্ত উপকরণের দাম বাড়িয়ে মাঝারি ও ছোট কৃষককে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত চলছে। একদিকে স্বল্প সংখ্যক ধনী কৃষকের হাতে গ্রামের অধিকাংশ জমি চলে যাচ্ছে অন্যদিকে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভিটেমাটি হতে এই সব ছিন্নমূল মানুষ নগর বন্দরে কাজের আশায় ভীড় জমাচেছ। সতত উর্ধমুখী দ্রব্যমূলের চাপে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। অর্থনৈতিক সংকটের ফলে প্রাইমারী ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ছাত্র সংখ্যা কমে যাচ্ছে। চুরি ডাকাতি ও অন্যান্য সামাজিক অনাচার ভয়াবহ হারে বৃদ্ধি পাচেছ। গুটিকতক শহরকে জাতির জীবনের ঘোর আলোর টায়রায় সাজিয়ে সমগ্র দেশ ও জাতির জীবনের ঘোর তমসাকে ঢাকা দেবার অপপ্রয়াস চলছে। দগদগে ঘাকে সিল্কের ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা হচ্ছে। এহেন নিমজ্জমান অর্থনীতি নিয়ে সরকার দেশবাসীকে উন্নয়নের স্তোকবাক্য শুনাচেছন। লিল্লাহর টাকায় ‘বিগ পুশের’ খোয়াব দেখছেন। ধনবাদের দর্গন্ধময় গলিত শব এদেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতী জনতার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ সবই হচ্ছে পনেরই আগষ্টের হত্যাকান্ডের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি শাষকগোষ্ঠীর যৎকিঞ্চিত ‘সওগাত’।

বাংলার রাজনীতির অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সাহসের উত্তরাধিরের স¦ত্ব নিয়ে তারপর বলেন,Ñ

‘এ অবস্থা  চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। জনগণ প্রতিকার চায়, প্রতিবাদের মিছিলে সামিল হতে চায়। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার সাথে পাঞ্জা ধরে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ব্যুহ ভেদ করে জনতার মুক্তির মহাসড়কটি তৈরী করতে পারে এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনও জনতার চোখের সামনে ফুটে উঠছে না। সমাজ প্রগতির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যগুলোকে রক্ষা করার পক্ষের শক্তি এখনও ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারছে না। সংকট এখানেই। (কিন্তুÑ) এই সংকটকে কাটিয়ে উঠে জনতার সামনে আজ আমরা যদি কোন ভরসার কেন্দ্রবিন্দু গড়ে তুলতে না পারি তাহলে প্রতিক্রিয়া তার সুড়ঙ্গ কেটে আরও এগিয়ে যাবে। প্রগতি আরও পিছু হটবে। সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নামকে একেবারে মুছে ফেলতে না পারলেও তাঁর নির্দেশিত পথ থেকে দেশকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সফল হবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। আমরা কি প্রতিক্রিয়ার এই চেষ্টাকে ফলবতী হতে দেব ?  আমাদের অনৈক্যের ফলে বঙ্গবন্ধুর নাম কি ইতিহাসের বিবর্ণ পাতায় নির্বাসিত হবে ? বঙ্গবন্ধু  আজ আমাদের মধ্যে নেই।

কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর আদর্শ, তাঁর কর্মসূচী। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাস হতে দেব না। তাঁর প্রদর্শিত পথে তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে, ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামে এগিয়ে যাব। শোষণমুক্ত সোনার বাংলা কায়েম করে বঙ্গবন্ধুর ‘দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানার’ স্বপ্ন সফল করবো।’

পান্না কায়সারও দৃপ্তকণ্ঠÑতাঁর আবেদন: ‘এই মহান নেতাকে স্মরণ করে সারা দেশবাসী আজকে শোকে মুহ্যমান এবং সঙ্গে সঙ্গে কঠিন শপথে দীপ্তÑ‘বঙ্গবন্ধু, তোমার স্বপ্নকে বৃথা যেতে দেব না। হে নেতা তুমি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকো আমাদের সত্তায়, আমাদের স্বপ্নে। আমাদের বার বার প্রদীপ্ত করো ; দেশকে, দেশের মানুষকে যেন তোমার মত ভালবাসতে পারি।’

আবেগ ও ক্ষেভে ভরা দুটি কবিতা লিখেছিলেন সায়েমা চৌধুরী ও আই ভি রহমান। তাঁরা কবি ছিলেন না, কিন্ত শোক তাঁদেরকে ‘বারমাস্যার’ ক্রন্দন লিপিবদ্ধ করিয়েছিল। ‘বত্রিশ নম্বরের বাড়িকে’ নিয়ে এপিটাফ লেখেন আই ভি রহমান। সায়েমা চৌধুরী রচনা করেনÑ‘কোনো এক বিদেহী আত্মার উক্তি’: যে-কোনো ছন্দেই পড়া যায়। কথাগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়Ñ

‘ভালবাসা যদি অপরাধ হয়

সে ভালবাসার জন্য অপরাধী আমি

কেননা সে ভালবাসার ব্যাপ্তি ছিল সর্বস্তরগামী

বিশ্বাস যদি বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয়স্থল হয়

সেই অন্ধ বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল আমি

সেখানে যে ঘাতকের নিভৃত আবাস

তাইতো বন্ধুবান্ধব আর আত্মজনের ছদ্মবেশ

 

মহাত্মাকে ভ্রুকুটি করে

মনুষ্যত্বকে প্রবঞ্চিত করে

আসে মৃত্যু, ক্রুর হত্যা দুঃখ, বিপর্যয়।

হে আমার দেশ।

হে আমার দুঃখ জর্জরিত,

মেরুদন্ডহীন, অভিশপ্ত স্বদেশ আমার।

দুর্ভাগা এ জাতি-নির্বিশেষে।’

কবি সুফিয়া কামালের স্মরণীয় কবিতা ‘হে অবিচল বীর’

সম্ভবত সাঁকোতেই প্রথম ছাপা হয়েছিলÑ

হৃদয় রক্তে রাঙানো ওজল, মকুট বিহীন রাজা

নিত্য বিকাশো মানবের মনে, ফুলের মতোন তাজা।

সাধ্বী সাথী ও সন্তানসহ মহৎ মরণ তব

সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এই স্মৃতি অভিনব।

মমতায় ভরা তোমার হৃদয়, মানুষেরে ভালোবেসে

কাছে টেনে নিতে যত অভাজনে স্নিগ্ধ মধুর হেসে।

সেই অপরাধ! যত অপবাদ সহিয়া হাস্য মুখে

ক্রুর ঘাতকের কঠোর আঘাত লইয়া আপন বুকে

করনি গোপন আপনারে তুমি হে অবিচল বীর

তাইত তোমারে স্মরিয়া মানুষ নত করে নিজ শির

তোমারে আঘাত হেনেছে যাহারা তাহারা ঘৃণ্য ক্লীব,

তোমার মৃত্যু তোমারে করেছে অমর! চিরঞ্জীব।

 

(বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু হত্যার চতুর্থ বার্ষিকীতে প্রকাশিত স্মরণিকা)

 

ড. ইসরাইল খান, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ভাষার যতো মান অপমান

অজয় দাশগুপ্ত : বাংলাদেশ আমাদের দেশ। আমাদের মাতৃভাষার নাম বাংলা ভাষা। আপনি আশ্চর্য হবেন জেনে প্রবাসের বাঙালিরা প্রাণপণ চেষ্টা করে তাদের সন্তানদের বাংলা শেখায়। এ

চাঁদপুর চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির কবিতা উৎসবে ১০ গুণী ব্যক্তির পুরস্কার লাভ

আন্দরকিল্লা ডেক্স : নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির কবিতা উৎসব-২০২৫। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় চাঁদপুর শহরের ইউরেশিয়া চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সবুজ

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্কুলের শতবর্ষ উদযাপন

আন্দরকিল্লা ডেক্স : শতবর্ষ পূর্ণ হওয়া চট্টগ্রামের হাতেগোনা কয়েকটি স্কুলের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পাহাড়তলী অন্যতম একটি। ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল ২০২৪

কেনো ইহুদিরা জাতি হিসেবে এত বুদ্ধিমান?

মূল লেখক: ডঃ স্টিফেন কার লিওন অনুবাদক— আসিফ ইকবাল তারেক   ইসরাইলের কয়েকটি হাসপাতালে তিন বছর মধ্যবর্তীকালীন কাজ করার কারণেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার চিন্তা

আগমনী এবং দুর্দান্ত দুপুর

দীপক বড়ুয়া ঋষিতার মুখে খই ফুটে। কালো মেঘে ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ার সময়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পরে। আনন্দে বৃষ্টি ফোটা ছুঁয়ে হাসে। মাঝেমধ্যে