আলম খোরশেদ:
কোনো বিশেষ জাতির উন্নয়নে ব্যক্তিবিশেষের অবদানের গুরুত্ব বা মূল্য আমরা কম বেশি নির্ধারণ করতে পারি। কিন্তু একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি কীভাবে নিশ্চিত করে নির্ণয় করা যেতে পারে তা ভাববার বিষয়। তাই সেরা বাঙালি, বাঙালিশ্রেষ্ঠ কিংবা এক নম্বর বাঙালি এরকম কোনো বিচারে না গিয়ে বাঙালি বলতে ঠিক যে-মানসমূর্তিটি ভেসে ওঠে আমাদের চোখে, তার সঙ্গে বাস্তবের রক্তমাংসের বাঙালিকে মিলিয়ে দেখাটাকে বরং অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত মনে করি। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আমার যাঁকে চোখে পড়ে তিনি নজরুল, আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমার জানামতে বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে এমন আর কাউকে দেখি না, যার মধ্যে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহের এরকম পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ ও সুষম সম্মিলন ঘটেছে।
কথাটা ব্যাখ্যা করে বলা উচিত। তবে তার আগে বাঙালি বলতে কাকে বুঝি, সেটা বলে নেওয়া ভালো। ভৌগোলিকভাবে তাকে-যে ভগীরথী, পদ্মা বিধৌত এই বদ্বীপের সমতলের বাসিন্দা, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরি হতে হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে সেই মানুষ কোনো একক জাতির বিশুদ্ধ প্রতিনিধি নয়। তার রক্তে মিশেছে আর্য-অনার্যের সম্মিলিত স্রোতধারা, আর ধর্মে মিলেছে বৌদ্ধ, হিন্দু, ইসলাম ধর্মের ত্রিধারা ভাবরস। ফলে প্রকৃত অর্থেই বাঙালি শঙ্কর জাতি, মিশ্র সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট প্রতিভূ।
বাঙালির এ-ই মোদ্দা পরিচয়। এর বাইরে আর যেসব মানসবৈশিষ্ট্য তার অন্যতম চরিত্রলক্ষণ তাদের মধ্যে পড়ে আবেগপ্রবণতা; প্রতিবাদী, বিদ্রোহী ও লড়াকু মেজাজ; সাম্যচেতনা; অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সমন্বয়বাদী মনোকাঠামো; সারল্য, সৌন্দর্যবোধ এবং সর্বোপরি প্রেমিক ও কবিস্বভাব।
নজরুলের মধ্যে আমরা উল্লিখিত সবকটা বৈশিষ্ট্যেরই পরিপূর্ণ উপস্থিতি লক্ষ করি। তিনি, একেবারে যাকে বলে ‘ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি’, যার স্ফূরণ ঘটেছে তাঁর অজগ্র কবিতা আর অগুনতি গানে। কবিতা ও গানে তাঁর এমন উচ্চকিত আবেগের নির্লজ্জ প্রকাশে আমরা তথাকথিত আধুনিকেরা তো রীতিমতো বিব্রতই বোধ করি। ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়/ সে কি মোর অপরাধ’, এমন গান যিনি বাঁধতে পারেন তাঁর সারল্য আর সৌন্দর্যপ্রিয় মন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। আর প্রেম? নজরুলের গোটা জীবনটাই তো বেপরোয়া, বেহিসেবি উদ্দাম প্রেমের ইতিহাস। ভালোবেসে আনন্দ যেমন পেয়েছেন তেমনি হয়েছেন বেদনায় বিদীর্ণ। নার্গিস, রানু সোম, ফজিলতুন্নেসা এরকম কত না বিচিত্র প্রেমের পুষ্প ফুটেছিল তাঁর জীবন-উদ্যানে। এর কোনোটায় ছিল অমৃতের সুবাস, কোনোটাতে বা কাঁটার কামড়। নীলকণ্ঠের মতো সব গরল গলায় ধারণ করে নজরুল অবশেষে এমন একজনকে বেছে নিয়েছিলেন জীবনসঙ্গী হিসেবে, যার কারণে তাঁকে প্রায় ব্রাত্য হতে হয়েছিল স্বসমাজে ও স্বধর্মের পরিসরে। এমন প্রেমিক সহজে মেলে না।
নজরুল জন্ম-বিদ্রোহী। কোনো নিয়মের নিগড়েই বাঁধা যায়নি তাঁকে কখনও। ঘরের বন্ধন ভেঙ্গে পথে নেমেছেন কৈশোরেই। স্কুল পালিয়েছেন অনবরত। ভালো ছাত্র হবার মোহ উপেক্ষা করে ছুটে গেছেন রণক্ষেত্রে। সংবাদপত্রে জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লিখেছেন। তাঁর বই নিষিদ্ধ হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতার দায়ে জেল খেটেছেন। স্বরাজ পার্টির হয়ে জাতীয় নির্বাচন করেছেন। নির্বাচনে গোহারা হেরেছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই দমানো যায়নি তাঁকে। একের পর এক বিদ্রোহের বহ্নিতে তিনি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছেন আমাদের বদ্ধ সমাজের যাবতীয় জাড্য ও জীর্ণতাকে। যৌবনের বান ডাকিয়েছেন সারা বাংলা জুড়ে। বস্তুত এই শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে প্রায় একক ব্যক্তিত্বের দাপটে যিনি গোটা বাংলার মানসভুবন দখল করে রেখেছিলেন তিনি এই বিদ্রোহী নজরুল, একমাত্র যাঁর মুখেই সাজে এমন সাহসী উচ্চারণ – ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’।
কিন্তু তাই বলে তিনি নিছক আবেগসর্বস্ব ছিলেন না, তাঁরই সমসাময়িক ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র অনেকের মতো ‘গজদন্ত মিনারবাসী’ হয়েও থাকেননি। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বরাবরই তিনি একাত্মতা অনুভব করেছেন। পক্ষ নিয়েছেন শোষিতের। যুদ্ধের ফ্রন্টে থাকাকালীন রুশ বিপ্লবের খবর কানে এসেছিল তাঁর। শোষিতের এমন বিজয়ের সংবাদে উল্লসিত নজরুল কলকাতায় ফিরে এসে তাই গাঁটছড়া বাঁধেন ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সকলের প্রিয় কাকাবাবু কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে। দেশে-দেশে সর্বহারার প্রেরণা, বিপ্লবের সামগান ইংরেজি ইন্টারন্যাশনালকে ভেঙে বাংলায় রূপ দেন ‘অন্তর-ন্যাশনাল সংগীত’রূপে, লেখেন ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠো রে যত/জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত, জাগো’। তিনি তাঁর পুত্রদের নাম পর্যন্ত রেখেছিলেন দুই বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী নেতা যথাক্রমে, লেনিন ও সান ইয়াত সেনের নামে।
শুধু গান লিখেই ক্ষান্ত হননি, ‘সাম্যবাদী’ পত্রিকায় অনলবর্ষী প্রবন্ধ লিখেছেন, মিছিল করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। গেয়েছেন সাম্যের গান, প্রতিজ্ঞা করেছেন ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল’ না-থামা অবধি শান্ত হবেন না। বস্তুত, নজরুলই বাংলাসাহিত্যের প্রথম পুরুষ যিনি খোলাখুলিভাবে সাম্যবাদের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এ আমাদের অনেক বড় পাওয়া সন্দেহ নেই।
তবে নজরুলের সবচেয়ে বড়ো মাহাত্ম্য তাঁর গভীর অসাম্প্রদায়িক, সমন্বয়বাদী, উদার মানবতন্ত্রী মন। তিনি তাঁর নিজের মতো করে ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণীতে আস্থাশীল থেকেও ধর্মের অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, প্রতিক্রিয়াশীল দিকগুলোর তীব্র সমালোচনা করেছেন, কথার চাবুক চালিয়েছেন অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ মোল্লা-পুরুত শ্রেণির ওপর, এমনকি খোদ ‘ভগবানের বুকে পদচিহ্ন’ এঁকে দেবার দুঃসাহসও দেখিয়েছেন কবিতার ছত্রে।
নজরুলই অদ্যাবধি একমাত্র বাঙালি, যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির প্রকৃত সমন্বিত রূপে। তাই একদিকে যেমন পারস্যের গজল লিখেছেন, অন্যদিকে বেঁধেছেন কালীকীর্তন আর শ্যামাসংগীত। একদিকে যেমন অকৃপণভাবে ব্যবহার করেছেন আরবি, ফারসি শব্দ; মধ্যপ্রাচ্যের ছন্দ ও রাগিণী, অন্যদিকে ভারতীয় পুরাণ ও রামায়ণ-মহাভারতের অজ¯্র অনুষঙ্গে ভরে তুলেছেন তাঁর কবিতা ও গানের শরীর। এ ব্যপারে তাঁর মধ্যে আজকের অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকের মতো হীনম্মন্যতা ও কপটতার লেশমাত্রও যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না মুসলিম মৌলবাদী শ্রেণির রক্ষণশীলতা ও স্বাতন্ত্র্যের মিথ্যে অহমিকা। তিনি জানতেন হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতার উভয়বিধ সাংস্কৃতিক উপাদানেই গঠিত বাঙালির মানসভুবন। এই সত্যটিকে অস্বীকার করার কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁসের এমন খ-িত ও আত্মঘাতী রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমরা। নজরুল এই ঐতিহাসিক ভুলটুকু শুধরাতে চেয়েছিলেন তাঁর সমগ্র জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে।
তাই অসাম্প্রদায়িকতার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। হিন্দু-মুসলিম মিলনের অনলস সাধনা ছিল তাঁর জীবনব্যাপী। সেই সঙ্গে নারীর অধিকার নিয়েও সেই তখনই সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি। মানবসভ্যতার সমস্ত সুকৃতির সমান অংশীদারিত্ব দিয়েছিলেন তিনি নারীকে সসম্মানে। তাইতো লিখতে পেরেছিলেন এমন অজর পঙ্ক্তিমালা, ”আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। ”, কিংবা “চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায়ে মল,/ মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল ও শিকল!/ যে-ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ!/ দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন, ঐ যত আভরণ!” এমন আধুনিক, সংস্কারমুক্ত চিন্তা আজকের দিনেও নিতান্ত দুর্লভ বইকি।
বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড়ো স্থপতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত মাহাত্ম্য নিয়েও নজরুলের কাছে দুটো বিষয়ে হেরে থাকবেন চিরদিনই। শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের লড়াইয়ে তিনি যেমন নজরুলের মতো একেবারে খাস ময়দানে হাজির থাকতে পারেননি, তেমনি তাত্ত্বিকভাবে উপলব্ধি করলেও ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি হিন্দু-মুসলিমের যুক্ত সাধনায় সৃষ্ট বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বিত রূপটিকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ ও চর্চা করা। অথচ আমাদের বুধম-লী ও রাষ্ট্রনায়কদের এই দুটি বৈশিষ্ট্যই বর্তমান লেখকের মতে বাঙালির সার্বিক সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষের জন্য সবচেয়ে জরুরি। কেননা, এই পথেই নিহিত তার আর্থিক ও আত্মিক মুক্তির মূলমন্ত্র, নজরুল যাকে সর্বশক্তি দিয়ে তুলে ধরেছিলেন স্বীয় জীবনে, সমুন্নত রেখেছিলে শেষ পর্যন্ত। শেষ বিচারে তাই নজরুলই পেরেছিলেন যথার্থ বাঙালির এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিমূর্তি হয়ে উঠতে।
আলম খোরশেদ, অনুবাদক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক