শাকিল আহমদ
বিশ শতকের চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সাময়িকপত্র গুলোরদিকে খানিকটা মনোযোগী হলে প্রতিয়মান হবে যে, আমাদের নানামুখী সাহিত্যচর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে এবং সৃজনশীল ও মননশীল লেখক তৈরীর ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রেখেছে এই সাময়িক পত্রসমূহ। বস্তু সাময়িকপত্রকে বেষ্টন করেই আমাদের দুই বাংলার বাংলা সাহিত্য পল্লবীত হয়ে ওঠে, ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ অপরাপর স্থান থেকে প্রকাশিত গত এক শতাব্দীর (বিশ শতক) সাময়িকপত্রকে নিয়ে ইতোমধ্যে কম গবেষণা আলোচনা-পর্যালোচনা হয়নি। সাময়িকপত্র সমূহ আলোচনার প্রথমদিকে মুসলমান সম্পাদিত সাময়িকপত্রগুলো অনেকটা অনালোচিতই ছিল। মূলত মুসলমান সম্পাদিত সাময়িকপত্রগুলোকে অলোচনায় আনতে শুরু করে পঞ্চাশ-ষাটের দশকৈর দিকে। আলোচিত এই অধ্যায়টি নিয়ে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা করেন প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান তাঁর মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র গ্রন্থে। আনিসুজ্জামানের এই আকড়গ্রন্থটির ওপর নির্ভর করে অনেকেই মুসলিম সাময়িকপত্রকে ব্যষ্ঠন করে অনেক অনুসন্ধান, আলোচনা-পর্যালোচনা চালিয়েছেন। মুসলমান সম্পাদিত সাময়িকপত্র সমূহের গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখিয়েছেন কবি আবদুল কাদির।
শিল্প-সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে গত শতকের চট্টগ্রামের সাময়িকপত্রসমূহ বিশেষ করে সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ও অনিয়মিত সামিয়কী গুলোর অবদানও কিন্তু অকিঞ্চিৎকর নয়। অবশ্য চট্টগ্রামের সাময়িকপত্র নিয়েও ইতোমধ্যে কম আলোচনা-পর্যালোচনা হয়নি। তবে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যর জন্য গত শতকের পঞ্চাশের দশকটি এক উল্লেখযোগ্য দশকও বটে। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে মূলত এটি একটি বিশেষ বাঁক বদলের দশক। এই পঞ্চাশের দশকটিকে আমরা নানা মাত্রায়, নানা আঙ্গিকে তুলে ধরতে পারি। আর সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই চট্টগ্রাম থেকে মোহাম্মদ আবদুল খালেক সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কোহিনুর’ পত্রিকার (১৯৫২-১৯৬০) আত্মপ্রকাশক। একই বছর বাঙালির অবিস্মরণীয় ঘটনাÑভাষার জন্য লড়ায়-রক্তপাত ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে মুখের ভাষাকে বরগীর হাত থেকে রক্ষা করা। আর এই অসামান্য ঘটনার অংশিদার হয়ে যান সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেক। তিনি একুশে ফেব্রæয়ারির বর্বরোচিত ঘটনা নিয়ে তৎক্ষনাত কোহিনুর পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন করেন ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জের’ শিরোনামে এবং সম্পাদকীয় লেখেনÑ‘নিরপেক্ষ বিচার দাবী করিতেছি’।
কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনিÑফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’, চট্টগ্রাম থেকে একুশের প্রথম কবিতা প্রকাশের ঘটনাবলি নিয়ে মোহাম্মদ আবদুল খালেকের কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস ও সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা ঘিরে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে বটে; কিন্তু সাপ্তাহিক কোহিনুর পত্রিকা (১৯৫২-১৯৬০) পঞ্চাশের দশকের সেই টালমাটাল সময়ে শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি ও আর্তসামাজিক ভাবে কতটা ভূমিকা রেখেছে তা নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়েছে এমনটি মনে করিনা বিধায় বর্তমান প্রজন্মের জন্য এই লেখাটির অবতারনা।
সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে সাপ্তাহিক কোহিনুর পত্রিকাটি সম্পাদক সাহেব সাজিয়ে তুলেছেন নবীন-প্রবীন ও প্রতিষ্ঠিত লেখকের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ,নাটিকা, গান ও সাহিত্যের নানা আনুষাঙ্গিক ঘটনা এবং বিশেষ দিনে থাকতো সম্পাদকীয়। যেমন খুশির ঈদ, আজাদী দিবস, আমাদের শিক্ষা, কাল বৈশাখী, মক্কা ও মদীনা মোকারমা, অধ্যয়নং তপঃ ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য সংবাদের শিরোনাম নি¤œরূপÑ পাক-ভারত প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের সম্মেলন, কাশ্মীর সমস্যা, কাপ্তাই হাইড্রো ইলেট্রিক স্কীম, উদ্বাস্তু সমস্যা, চট্টগ্রামে প্রবল বন্যা, স্বায়ত্ব শাসনের নমুনা, চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য, ভিক্ষুক সমস্যা, দূর্গতির মূলে কি? মোসলেম হল, সিলেটে তেল সন্ধান, চট্টগ্রামের গভর্নর জেনারেল, মশার উপদ্রব, আনবিক ধ্বংস শক্তি ধ্বংস হোক ইত্যাদি। খালের পানি সংবাদটির বিবরণ তুলে ধরলে এই প্রজন্মের কাছে প্রতিয়মান হবে আজ থেকে সত্তর বছর পূর্বের পত্রিকা সমূহে সংবাদ পরিবেশনের ধরণ ও ভাষা শৈলির স্বরূপ।
“ভারত সরকার খালের পানি লইয়া যে গোঁয়ার্তুমী শুরু করিয়াছে তাহাতে ভারত কিংবা পাকিস্তান কাহারও লাভে আসিবে না। কাশ্মীর ও উত্তর ভারত হইয়া যে সব নদী পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবেশ করিয়াছে, সেইসব নদীর পানি সেচ করিয়াই পশ্চিম পাকিস্তানে চাষাবাদ করা হয়। নতুবা পানির অভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে আদৌ শস্যফলাও সম্ভব হইত না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিতে যেসব রাষ্ট্র ঈর্ষ্যান্বিত হয়, সেই সব রাষ্ট্র কখনো ন্যায়নীতির পথে চলিতে পারে না। পানি লইয়া এইভাবে কোন্দল করিলে ভারতের সংগে প্রতিবেশী সুলভ সম্প্রীতি রক্ষা করিয়া বেশিদিন চলা যাইবেনা। পৃথিবীর এই অঞ্চলে শান্তি ও স্বাধীনতা রচনা করিতে হইলে দুই রাষ্টের মিলিয়া মিশিয়া থাকা উচিতÑঅশান্তি সৃষ্টি হইলে উভয় রাষ্ট্রের ধ্বংস হইবে ভারত বৃহত্তর বলিয়া রক্ষা পাইবেনা। কাজেই খালের পানি নিয়ে কোন্দল করা নেহেরু সরকারের পক্ষে খুব অবিবেচনাপ্রসূত।” (সাপ্তাহিক কোহিনুর : ৩য় বর্ষ, ১৯-২০ সংখ্যা)।
এই সংবাদ পাঠে প্রতিয়মান হয় অভিন্ন নদীর পানি বন্টন সমস্যা সেই নেহেরু সরকারের আমলেও বিদ্যমান ছিল, এখনো আছে। তবেব সংবাদ পরিবেশনের ধরণটি পাল্টিয়েছে বটে।
কোহিনুরের বিভিন্ন সংখ্যার শেষাংশে ছোট ছোট কিছু বিজ্ঞাপনও চোখে পরে। বিজ্ঞাপনের বিষয় ‘শরিফ ফার্মেসি’, ন্যাশনেল কার্বন মিলস লি: সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হেলাল’ বলিষ্ঠ কণ্ঠ সৈনিক কবি, ‘ধুমকেতু’ ধূম ও বহ্নি, সাপ্তাহিক ‘কাফেলা’ চোখে পরে কিছু নতুন গল্পের বই। ১। জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প-২টাকা, ২। পিঁজরা পোল-২ টাকা, ঢাকা ও চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত পুস্তকালয়ে পাওয়া যায়।
কবি অহিদুল আলমের সম্পূর্ণ অভিনব গল্প সঞ্চয় ‘জোহরার প্রতীক্ষা’, দাম ২ টাকা, মিস নুর বেগম ‘নারীর চোখে নারী’ শীঘ্রই প্রকাশিত হইতেছে। কবি শফিউল ইসলামের সব্বর্জন প্রশংসিত কাব্যগ্রন্থ ১। ফরিয়াদ-২ টাকা, ২। মাটির কন্যা-২ টাকা, ৩। কায়েদে আজম তোমার জন্য-১ টাকা, মাটির কন্যা ৪। দিবা ও রাতিÑ১ টাকা ইত্যাদি। তবে এসব সাময়িকীতে বিজ্ঞাপন পাওয়াটা যে কঠিন কর্ম ছিল তা সহজেই অনুমাান করা যায়।
মোহাম্মদ আবদুল খালেক সম্পাদিত সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সাহিত্য পর্বটি। সেই পঞ্চাশের দশকে এই সাময়িকীকে ঘিরে একটি সাহিত্য পরিমÐল গড়ে ওঠে চট্টগ্রামে। এখানে যেমন প্রবীন ও প্রতিষ্ঠিতদের লেখা ছাপা হতো, তেমনি যতœসহকারে ছাপাতেন অপেক্ষাকৃত নবীন লেখকদের লেখাও। এই সাময়িক পত্রকে বেষ্টন করে তৈরী হয়েছিল পরবর্তীকালে অনেক গুণী লেখকও। যাদের লেখায় কোহিনুর সমৃদ্ধ হয়েছে এদের মধ্যে রয়েছেÑআবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, বেগম রোকেয়া, মাহবুব উল আলম, শওকত ওসমান, ওহীদুল আলম, শবনম খানম শেরওয়ানী প্রমুখ। যাদের লেখা অধিকাংশ সংখ্যায় ছাপানো হয়েছে এদের মধ্যে রয়েছে আলাদীন আলী নুর (কবিতা), মোতাসিম বিল্লাহ্ (কবিতা), চৌধুরী আহমদ ছফা (কবিতা ও গল্প) অশোক বড়–য়া (কবিতা), শবনম খানম শেরওয়ানী (কবিতা), ওহীদুল আলম (নাটিকা, গল্প, কবিতা) জালালুদ্দিন আহমদ (প্রবন্ধ), মনিরুল আলম (কবিতা), কুমারী সৈয়দা, রওশন আরা বেগম (কবিতা), নুরুন নাহার বেগম (কবিতা), শ্রীমহিনী মোহন দত্ত বি.এ (প্রবন্ধ), সৈয়দ মোহাম্মদ হাশেম (গল্প), আইনুন নাহার বেগম (কবিতা)।
সেই পঞ্চাশের দশকের কোহিনূর সাময়িকী থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সেই সময়কালেও কিন্তু চট্টগ্রামে অসংখ্য নারী লেখকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যদিও আমরা মনে করি সেই পশ্চাৎপদ সমাজে নারীরা ছিল অন্তরমুখী। কিন্তু এই কোহিনুর থেকে আমাদের উপলব্ধি জাগে সেই সময়ও অনেক নারী শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রগামি ছিল এবং আমাদের মধ্যে মুসলিম নারী সমাজও কম ছিল নাল। সাপ্তাহিক কোহিনূরে যাঁরা লিখতেন তাদের একটি তালিকা উপস্থানে তা প্রতিয়মান হবে। এদের মধ্যে ছিলেন উসরাতুল (ফজল), শবনম খানম শেরওয়ানী, আইনুন নাহার বেগম, শামসুন নাহার বেগম, সৈয়দা আসিয়া খাতুন, নুরুন নাহার রামু, বেগম আজীজ ও এন. মোহাম্মদ সাহিত্য সরাস্বতী, ফিরোজা বেগম (শেফালী), সুলতানা রহমান, বেগম নুরুন নাহার বসির, জোৎ¯œা রায় চৌধুরী (বি.এ.বিটি) জেব-উন্-নেসা আহমদ, তহমিনা খাতুন, সাদত আরা বেগম, চেমন আরা, ডা. মিস নুর বেগম, দিলদার রফিক প্রমুখ। এদের মধ্যে অধিকাংশই কবিতা লিখলেও কেউ কেউ লিখেছেন প্রবন্ধ ও গল্প। সেই সময়ে পশ্চাৎপদ মুসলিম নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলবার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সম্পাদিত কোহিনুর এর ভূমিকা কোন অংশে গৌন করে দেখবার সযোগ নেই কিন্তু।
সাপ্তাহিক কোহিনুরকে ঘিরে চট্টগ্রামে যে লেখক তৈরী হয়েছিল এদের মধ্যে বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া আরো অনেকের নাম উল্লেখ করা যায়। শ্রী সতিশ চন্দ্র পালিত, মনীন্দ্র লাল দে, আলতাফ আল খালীদ, অধ্যাপক মুহাম্মদ হাসান আলী এম.এ. মোহাম্মদ আবুল ফজল হাজারী, কবিরাজ শ্রী শ্যাম শঙ্কর ঘোষ, আবদুল হক, এস.এম. ফয়জুল হক, এম.এন. মোস্তফা (প্রবন্ধ), নূর আহমদ এস.পি এ (প্রবন্ধ), মনিরুল আলম ফকির, কবির আহমদ, শ্রী প্রশান্ত রঞ্জন দাশ, সিরাজুদ্দীন, মহম্মদ লইসউদ্দিন, শ্রী মোহিনী মোহন দত্ত, বি.এ (প্রবন্ধ), মনোতোষ বিকাশ গুহ, বি.কম এম.এ (প্রবন্ধ), নুর আহমদ শাহ, মতিউল ইসলাম, আনওয়ার উল আলম (আনু), মুহম্মদ হাফিজুর রহমান, বি.টি (প্রবন্ধ), এস.এম. আবদুল্লাহ, এম.এ. ছোবহান, এম. হাসান বি.এ. কোরাম) আলী আকবর কাদেরী (প্রবন্ধ), কবিরাজ বদরুল আলম (প্রবন্ধ), মোহাম্মদ ইউছুফ, আজিজুর রহমান (প্রবন্ধ), ইউছুফ আলী, ফকির আহমদ, এস.এমম. আবদুল্লাহ, এ.কে.এম নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলতাফ আলী, চৌধুরী মোতালিব বিন হায়দার, মোহাম্মদ সোলায়মান (গল্প), শ্রী সতিশ চন্দ্র পালিত, নুর মোহাম্মদ।
সাহিত্যে ছদ্ধ নামব্যবহারের প্রচলনটি সেই মধ্যযুগ থেকেই চলে আসছে। যার ধারাবাহিকতা আমরা বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকেও দেখতে পাই। কোহিনুরের ছদ্ধ নাম গুলির মধ্যে ‘ভাস্কর’ ছদ্ধনামে কয়েকটি গল্প লিখেছেন চৌধুরী আহমদ ছফা। অবশ্য কোহিনুরে তার প্রকৃত নামেও কয়েকটি গল্প দেখতে পাই। অপরাপর ছদ্ধনামগুলো হলোÑধুমকেতু, মোহসেন, পি, প্রোনিন, কবিশের পরিভ্রাজক ইত্যাদি। কিছু কিছু লেখকের সে সময়ে নামের সাথে নিজের জন্মস্থানের নামও জুড়ে দেওয়ার রেওয়াজ থাকতো। যেমনÑমনিরুল আলম বৈলছড়ি, নুরুন নাহার রামু, মফজল আহমদ (চরতী), মনির আহমদ (খরুলিয়া), মোহাম্মদ ফরিদুল ফজল (হাজারী), জালালুদ্দিন আহমদ (কুতুবদিয়া), এস.এম. আবদুল্লাহ (নোয়াপাড়া) ইত্যাদি। কিছু কিছু গানও মাঝে মধ্যে সংকলিত হতে দেখা যায়Ñ মোহাম্মদ আলতাফ আলীর (আধুনিক বাংলা গান), মনিরুল আলমের গান (শঙ্খ নদীর দেশ), কবিরাজ শ্রী শ্যামশঙ্কর ঘোষ রচিত (সংগীত), এম. হাসান বি.এ রচিত কোরান (কাশ্মীর চলো), নুরুন নাহার রামুর (গান), ছোটদের জন্য একটি বিভাগ ছিল ‘কচি মজলিশ’। এই মজলিশের পাতায় কচি খোকাখুকিদের উপযোগী শিক্ষামূলক রচনাদি প্রকাশ করা হতো। মফজল আহমদ (চরতী) এর প্রাত:কাল ছড়ার অংশ বিশেষ:
পূর্ব দিকে চেয়ে দেখ ভানুর উদয়!
পাখি যত গান গায় কুহু কুহু স্বরে
মোরগ ডাকিছে, আল্লা মানবের ঘরে।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকের সেই সাপ্তাহিক কোহিনুর সাময়িকীটি চট্টগ্রামের তরুণ ও নবীন লেখকদের জন্য অনুপ্রেরণা ও সাহিত্যাড্ডার কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
লেখক ও গবেষক চৌধুরী আহমদ ছফা (১৯৩০-২০০৮) ছিলেন কোহিনুর এর নিয়মিত তরুণ লেখক। তাঁর ব্যক্তিগত ডায়রিতে প্রথম সাপ্তাহিক কোহিনুর পত্রিকার অফিসে যাওয়ার ঘটনাটি লিখেন এভাবেÑ “তখন আমি ফতেয়াবাদ স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন দুপুর বেলা কাজীর দেউরীর আলম বাগ থেকে কবি ওহীদুল আলম আমাকে হাত ধরে হেঁটে হেঁটে নিয়ে গেলেন আন্দরকিল্লা মোড় সাপ্তাহিক কোহিনুর অফিসে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সাথে পরিচয় পর্ব শেষে আমার কয়েকটি কবিতা ওহীদুল আলম নিজ হাতে তুলে দিলেন। এর পর থেকে আমার গল্প, কবিতা নিয়মিত ছাপা হতে থাকে কোহিনূরে।” উল্লেখ্য ডায়রির এই অংশটি লিখেছিলেন কবি ওহীদুল আলমের মৃত্যু সংবাদটি শুনার পর অনেকটা আবেগ তাড়িত হয়ে। আরো লিখেনÑ কবি ওহীদুল আলমের মতো বড় মানের মানুষের হাতধরেই এই শহরে অনেকেই লেখালেখির অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। চৌধুরী আহমদ ছফার পারিবারিক লাইব্রেরিতে সাপ্তাহিক কোহিনুরের সংখ্যাগুলো এখনো অতি যতেœ শোভা পাচ্ছে। হাতের কাছে পেলাম বলেই এই লেখাটিরও সূত্রপাত হলো। চৌধুরী আহমদ ছফার প্রথম কবিতা কিন্তু কোহিনুরে নয়; দেশ ভাগের বছরেই (১৯৪৭) ১৭ বছর বয়সে ‘নতুন কাকা’ প্রকাশিত হয় কলকাতার আশতোষ লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত ‘শিশু সাথী’ পত্রিকায়।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক যেহেতু পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, সেহেতু বিশেষ বিশেষ দিনে কোহিনূরে তাঁর অনেক বস্তুনিষ্ঠ সম্পাদকী প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরেও তাঁর আর একটা সৃজনী প্রতিভা ছিল যা আজ অনেকেরই অজানা। পঞ্চাশের দশকে এই কোহিনুর পত্রিকাকে ঘিরে বিশেষ বিশেষ কোন সংখ্যায় তিনি লিখেছেন মোহাম্মদ আবদুল খালেক নামে কিছু কবিতাও। এর মধ্যে ‘বৃথা করিতেছ কলরব’ অংশ বিশেষÑ
আমি আসিয়াছি, তুমি আসিয়াছ
এসেছিল বহুজন…।
তাহারা কোথায়-আিজ কেন নাই?
তুমি আমি বেঁচে রব?
নিত্য সত্যে অস্বীকার করে ভাই
বৃথা করিতেছ কলরব।
(সাপ্তাহিক কোনিনূর, ৩য়, বর্ষ, ২৫-২৬ সংখ্যা)
চট্টগ্রামের আর এক বিশাল ব্যক্তিত্ব অধ্যক্ষ রেজাউল করিমের কোহিনুরের একই সংখ্যায় পরপর চারটি কবিতা রয়েছে। পাশাপাশি ছবি সহ ছাপানো হয়েছে কৃতিছাত্র রেজাউল করিমের ইংরেজী সাহিত্যে এম.এ পরীক্ষায় ফাস্টক্লাস হবার গৌরব অর্জনকারী সংবাদটি পুর্ণাঙ্গ পরিচিতি দিয়ে গুরুত্ব সহকারে।
‘স্বাধীনতা’ কবিতায় তার নাম ছিল এ.এ. রেজাউল করিম:
১নংÑ
স্বাধীনতা এলো দেশে এলোনাকো সুখ আর শান্তি
প্রভাত হয়েছে বটে মেঘাবৃত তবু আসমান
জনগণ পেলো আজ, আলো নয় আলোয়ার ভ্রান্তি
শাসনের নামে আজ শোষণের রাঙা অভিযান।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের হাতে কোহিনুর লাইব্রেররির প্রতিষ্ঠা পায় ১৯২৬ সালে। কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস ১৯২৮ সালে। এই কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে সাপ্তাহিক কোহিনূর সাময়িকী প্রকাশিত হয় ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সম্পাদনায় ১৯৫২ সালেই। তাঁরই সম্পাদনায় একই প্রতিষ্ঠান থেকে দৈনিক আজাদী পত্রিকার সূচনা হয় ১৯৬০ সালে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় চট্টগ্রামের সাহিত্য প্রকাশ ও সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রয়েছে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের। চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ইসলামিয়া লাইব্রেরীটি ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠা পায় চট্টগ্রামের মুদ্রণযন্ত্র আর্টপ্রেস। এদিকে আধুনিক প্রকাশনা শিল্প ‘বইঘর’ এর আত্মপ্রকাশ ১৯৪৭ সালে। তবে কোহিনুর লাইব্রেরি ১৯৩২ সালে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও ড. মুহম্মদ এনামুল হকের ‘আরাকান রাজসভার বাঙলা সাহিত্য’ বইটি প্রকাশ করে। উল্লেখ্য : নানা তত্ত¡-উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণা করে জানা যায় বই আকারে চট্টগ্রাম থেকে কোন প্রকাশকের এটিই উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এর প্রায় অর্ধশত বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮১ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ছিল ‘Poetical Reader’। তবে এতে কোন প্রকাশকের নাম উল্লেখ নেই। ১৯৪৭ সালের পরে মূলত সৈয়দ মোহাম্মদ সফির ‘বইঘর’ থেকে উন্নত মানের সৃজনশীল বই প্রকাশ করে চট্টগ্রাম সমগ্র দেশের সামনে প্রকাশনা শিল্পকে তুলে ধরে। বই ঘরের প্রথম গ্রন্থ ‘সুরাইয়া চৌধুরীর সেরা গল্প’ (সুচরিত চৌধুরী) প্রকাশকাল ১৯৫১। বøুমহার্ট ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ইন্ডিয়া অফিসে বাংলা গ্রন্থের যে তালিকা সংরক্ষিত আছে তার মধ্যে চট্টগ্রামের প্রকাশানর এসব তথ্যও সন্বিবেশিত রয়েছে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে গড়ে ওঠা চট্টগ্রামের প্রাচীনতম প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে নাম উল্লেখ করা যায়Ñকোহিনুর লাইব্রেরি, ইসলামিয়া লাইব্রেরি, বইঘর, প্রজ্ঞা প্রকাশনী, তাজ লাইব্রেরি এবং বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মূলত বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের সতন্ত্র ধরণ ছিল। বইঘর ও প্রজ্ঞা প্রকাশনী প্রকাশ করতো সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্য গ্রন্থসমূহ। ইসলামিয়া লাইব্রেরি প্রধানত ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থাদি প্রকাশ করতো। শিক্ষনীয় বা শিক্ষামূলক গ্রন্থ প্রকাশ করতে দেখা যায় কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটিকে। আর কোহিনুর লাইব্রেরি বিভিন্ন শ্রেণীর বই প্রকাশ করতে দেখা গেছে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের আগ পর্যন্ত মূলত লাইব্রেরি কেন্দ্রিক প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠে এই চট্টগ্রামে। সম্ভবত বই বিপননের সুবিধার্থে লাইব্রেরির পাশাপাশি এই প্রকাশনা শিল্পের কার্যটি চালিয়ে যাওয়া ছিল সহজতর।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক কোহিনুর ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চট্টগ্রামের সাহিত্যচর্চাকে গতিশীল রেখেছিল। তবে ১৯৫৪ সালে সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘জমানা’ পত্রিকারও বিশেষ ভূমিকা ছিল। কারণ ‘জমানা’ সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, পরে ১৯৫৯ সালে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। তখন জমানা পত্রিকাকে ঘিরেও চট্টগ্রামে একটি সাহিত্য পরিমÐল গড়ে ওঠে সেই পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে। তবে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত আরো কিছু সল্পায়ু সাপ্তাহিক পত্রিকার ভূমিকাও কম ছিল না। এদের মধ্যে সত্যবার্তা, কাফেলা, সমাজ, প্রতিরোধ, ইংগিত, স্বদেশী হরুফউল-কোরান, আধুনিক জগৎ, সাম্য, হেলাল, ডাক ইত্যাদি। এসব সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য কিছু মাসিক, দ্বি-মাসিক, ত্রৈমাসিক ও কিছু অনিয়মিত সল্পায়ু সাময়িকী প্রকাশের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের সাহিত্যের বিচিত্র ধারা সমৃদ্ধ হয়েছে। এতে নি:সন্দেহে সাপ্তাহিক কোহিনূর পঞ্চাশের দশকে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
তথ্যনির্দেশ :
১। ড. সফিউদ্দিন আহমদÑসাময়িকপত্রে সাহিত্য ও শিক্ষাচিন্তা।
২। মোহাম্মদ আবদুল খালেকÑসম্পাদক-সাপ্তাহিক কোহিনূর।
৩। আনিসুজ্জামানÑমুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র।
৪। আবুল কালাম মঞ্জুর মোরশেদÑ প্রকাশনা শিল্পে চট্টগ্রাম, কালধারা, চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা, সংখ্যা সেপ্টেম্বর ২০০৬।
৫। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : চট্টগ্রাম মুসলমান ছাত্র সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষন, আল এসলাম, ৫ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, আষাঢ়-১৩২৬।
৬। ইসমাইল হোসেন সিরাজী : বাঙালী মুসলমানের আত্মপরিচয়, আল এসলাম, ৫ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ১৩২৬।
৭। আবুল ফজল : তরুণ আন্দোলনের গতি, শিখা, ৩য় বর্ষ, ১৩৩৬
৮। মোতাহের হোসেন চৌধুরী: বাঙালি মুসলমানের দৈন্য, সওগাত, ৮ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা মাঘ ১৩৩৭ বাংলা।
৯। সাপ্তাহিক কোহিনুর, ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ ইং, ১৬ই ফালগুন ১৩৫৮ বাং।
১০। সাপ্তাহিক কোহিনুর, আজাদী সংখ্যা ১৪ই আগস্ট ১৯৫৩ ইং।
১১। সাপ্তাহিক কোহিনুর, ১১ই জানুয়ারী ১৮৫২ ইং, ২৬শে পৌষ ১৩৫৮ বাং।
১২। চৌধুরী জহুরুল হক-প্রসঙ্গ : একুশের প্রথম কবিতা, কোহিনুর প্রকাশন, এপ্রিল ২০০২।
১৩। শাকিল আহমদ : চৌধুরী আহমদ ছফাÑ শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা ও মুক্তিসংগ্রামের শুদ্ধতম মানুষ। গ্রন্থ : বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে একুশ ও একাত্তর, আবির প্রকাশন-২০২০।
শাকিল আহমদ, প্রাবন্ধিক