মোশতাক আহমদ
রাজরোগ ও বিদ্রোহ
অনেক অনেকদিন আগের কথা। সে সময়ে ভূ- ভারতে বর্ষার জলবেষ্টিত এক পাহাড়ঘেরা রাজ্য ছিল নাম তার কৃষ্ণপৌর। রাজ্যের সকল মানুষই বাদামী বর্ণের, যেন মালাকারের হাতে গড়া কাদামাটির টেপা পুতুল। এই রাজ্যে বংশপরম্পরায় শাসন করত বর্মন বংশ। তাঁরা পরম শৌর্যবান, বিদ্যোৎসাহী এবং কিছুটা বিবাহ বাতিকগ্রস্ত। রাজ্যে নিয়ম ছিল, রাজকুমারেরা যত খুশি তত প্রজাকন্যাকে বিবাহ করতে পারবে।
রাজবাড়ির অন্দরমহলে কেবল বিয়ে আর পুত্রসন্তান জন্মানোর হুল্লোড়। কারণ বর্মনদের রাজকুমার একশো জন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে, যতবারই কোনো রাজপুত্র পুত্রসন্তান লাভ করতেন, সেই সন্তান আক্রান্ত হতো রাজ রোগে রক্ত থামত না। কেউ আহত হলে ছিঁড়ে যেত শিরা, গলগলিয়ে গড়াত রক্ত, আর কদিনের মধ্যেই নিথর হয়ে থাকত সে। রাজরোগে কোনো চিকিৎসা কাজ করত না। তখনকার বৈদ্যরা রোগের অন্য কোনো নাম জানতেন না, শুধু বলতেন রাজরক্তের অভিশাপ।
প্রজারা মুখে কিছু বলতো না, কিন্তু চোখে ছিল ভয়, আর অন্তরে ছিল ক্রোধ। তাদের এত কন্যা রাজকুমারদের স্ত্রী হয়ে প্রাসাদে গেছে, কিন্তু সন্তানগুলো আর বেঁচে থাকছে না। বংশ বলতেও আর কিছু রইল না। তাদের ভবিষ্যতের আশা কোনো রাজপুত্রও তো আর বেঁচে থাকে না। পুরো কৃষ্ণ পৌর রাজ্য যে রাজরোগ নামের অসুখে ভুগছে, সে বিষয়ে রাজা কৃষ্ণবর্মনের কোনো হেলদোল নাই। এইভাবে চললে একদিন প্রজাদের বংশ লোপ পেয়ে যাবার সম্ভাবনা ষোলআনা। বর্মনদের মন্ত্রী বা সান্ত্রীপ্রধান- কারু মনে এ নিয়ে চিন্তা নেই। রাজা দিনরাত তাম্বুল চিবিয়ে, সোনার গরগরায় টান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
এই সুযোগে সংগঠিত হয়ে উঠে এলো ত্রিপুরা বংশ। তারা ছিল বর্মনদের দূরসম্পর্কের জ্ঞাতি, এক হাজার বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে অপেক্ষমাণ। তারা প্রজাদের কানে কানে এই কথাগুলো ফিসফিসিয়ে ছড়িয়ে দিল বর্মনরা অভিশপ্ত। ওদের রক্তে গলদ আছে। আমাদের বংশে তো এই রোগ নেই। ত্রিপুরা বংশ নিজেদেরকে মুক্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করলো।
কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যতিক্রম ছিল কামরূপ কামাখ্যা রাজ্যের রাজকন্যারা। রাজপুত্রদের মধ্য থেকে যদি কেউ কামরূপ কামাখ্যা রাজ্যের কোনো রাজকন্যাকে বিয়ে করতেন, তবে তাঁদের সন্তান বেঁচে থাকত। কেন? কারণ কামাখ্যা থেকে আসতেন এক রহস্যময় ত্রিকালদর্শী মুনি। তিনি এসে সন্তানদের নাভিতে ফুঁ দিয়ে বলতেন, “হে রক্তের দেবতা, স্থির হও।” আর আশ্চর্য! সেই সন্তানদের রাজরোগ হতো না। ওরা বেঁচে যেত। ওরাই হতো বর্মন রাজবংশের উত্তরাধিকারী।
চারদিকে ত্রিপুরাদের ষড়যন্ত্র, তবে রাজ্যের গোয়েন্দারা কিচ্ছুটি টের পেল না। মহারাজ কৃষ্ণবর্মনের ঘুমও ভাঙল না।
এক রাত্রে, চাঁদের কিরণ ছিল মিটমিটে, ঝড়ের গর্জন ছিল দক্ষিণের রাজ্যে ঠিক সেই রাতে প্রজারা মশাল হাতে জড়ো হল প্রাসাদের চারপাশে। কিছুই না বলে, একে একে মশাল ছুঁড়ে দিলো প্রাসাদের দেয়ালে, ছাদে, জলসাঘরের পর্দার ভাঁজে। আগুন লেগে গেলো চারদিকে। বুড়ো রাজা-রানি, যাঁরা তখনো রাজ্যের সুশাসনের প্রতীক ছিলেন, পুড়ে গেলেন সেই লেলিহান আগুনে। কারা যেন শঙ্খ বাজাতে লাগলো।
কিন্তু তখনও প্রাসাদে ছিলেন একশ জন রাজকুমার, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানেরা। তাঁরা কি পুড়ে গেলেন?
শ্বেতপৌর রাজ্য থেকে এই রাজ্যে এসেছিলেন এক অদ্ভুত গুণী ব্যক্তি। শাদা চামড়ার, ধবধবে দাঁড়ি, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। নাম ছিল তার গবেষক গবচন্দ্র জ্ঞানাম্বুধি চ্যবন। কেউ বলতো তিনি জাদুকর, কেউ বলতো তিনি কূটনীতিবিদ, কেউ বলতো মহাকবি, কেউবা বলতো শিল্পাচার্য। তিনি রাজকুমারদের গান, ছবি আঁকা, কাব্যকলা থেকে শুরু করে যুদ্ধবিদ্যা, নৈতিকতা সব শেখাতেন।
চ্যবন বুঝে গিয়েছিলেন, বেশি সময় নাই। আগুনের ঝলকানি দেখে এক জাদু মানচিত্র বের করলেন। সে মানচিত্র ছিল তিন ভাগে বিভক্ত স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল।
তিনি রাজকুমারদের বললেন, “আমার পেছন পেছন এসো। এই রাতে, এই আগুনের আলোর মাঝে, আমি তোমাদের কালাপানি পেরিয়ে রাজ্যান্তর করিয়ে দেব।”
তারা সবাই একটা ছোট গুহার মুখে সমবেত হলেন। জ্ঞানাচার্য চ্যবন সেই মানচিত্র মাটিতে বিছিয়ে দিলেন। হঠাৎ মানচিত্রে আলো জ্বলে উঠল, আর একে একে খুলে গেল গোপন দরজা। এক এক করে একশো রাজকুমার সেই দরজা পেরিয়ে গেলেন। কেউ গেলেন হিমালয়ের গহীনে, কেউ পাড়ি দিলেন সমুদ্রের তলদেশে, কেউ রইলেন বেদান্তদের আশ্রমে, কেউবা আকাশে ঘুমিয়ে পড়লেন ভবিষ্যতের কোনো কালপুরুষ হয়ে।
তখন থেকেই কৃষ্ণপৌরে শুরু হলো ত্রিপুরা বংশের রাজত্ব। রাজরোগ দূর হলো কি না কেউ জানে না। কিন্তু এই গল্প রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। বলা হয়, একশো রাজকুমার আজও জীবিত, ছদ্মবেশে, অন্য রাজ্যে, অন্য পরিচয়ে। কারো ঘরে আজও জন্ম নেয় বাদামী চামড়ার এক শিশু, যার চোখে থাকে অনন্ত স্মৃতির দীপ্তি। যার নাভিতে থাকে অভিজ্ঞানের জলছাপ।
বাতিওয়ালা
নীলপৌর রাজ্য যেন রঙিন কাঁচের হর্ম্যসারি এখানে বাতাসে নীল আভা, গাছের পাতাও যেন নীলাভ সবুজ। এখানকার মানুষের গায়ের রং আসমানী, চোখগুলো নীল। বর্মন রাজের বড় রাজকুমার বাদামী চামড়ার রাহুল এখানে এক দৃষ্টিতে ভিনদেশী। কুমারের গায়ের রং বাদামী বলে সে যে বিদেশী একথা লুকাতে পারে না, কিন্তু সে যে রাজার কুমার এই পরিচয়টি লুকিয়ে রাখে। এই রাজ্যে সে কীভাবে খেয়ে পরে বাঁচবে! এখানে সোনার খনিতে শ্রমিকের কাজ আছে, রাজপথ বাঁধানোর কাজ আছে। এর বাইরে একজন বাদামী চামড়ার মানুষের পক্ষে অন্য কোনো কাজ জোগাড় করা সম্ভব না। রাজপথের ধারে এক চৌবাচ্চা থেকে সে জলপান করে পিপাসা ও ক্ষুধা মিটানোর চেষ্টা করছিল। এক বুঝদার বাতিওয়ালা তখন সদর রাস্তার বাতিগুলো জ্বেলে যাচ্ছিল। বাতিওয়ালাকে সে বলল,
– আমি এক দূর দ্বীপ থেকে এসেছি, যুদ্ধের সময় কালাপানিতে ভেসে গিয়েছিলাম।
– তোমার নাম কি? রাজ্যের নাম কি হে বাছা?
– আমি রাহুল। রাজ্যের নাম মনে পড়ে না।
এইসব শুনে বাতিওয়ালা হাঁ করে চেয়ে থাকলেও বুঝে ফেলে, কিছু একটা রহস্য আছে।
বাতিওয়ালার নাম আলোকময় মহাপাত্র। সে নিজের বাড়িতে এই ছদ্মবেশী রাজকুমারকে নিয়ে গিয়ে কিছু শুকনো রুটি আর পনির খেতে দেয়, এক পেয়ালা সোমরস ঢেলে দেয় আর বললো
“পান করো, যুবক। এটা নীলপৌরে রাজ্যের দ্রাক্ষা রস। এক চুমুকেই দুদিনের ক্লান্তি যায়।”
কুমার বলল, আমাকে একটি বুদ্ধি খাটিয়ে করার মতো কাজ জোগাড় করে দাও। আমিতো কায়িক পরিশ্রম করতে পারি না, কারণ বাদামী চামড়ার মানুষের গায়ে শক্তি কম। বাতিওয়ালা এই মিথ্যা ধরতে পেরে মনে মনে হাসলো।
রাজকুমার দ্বিধা নিয়ে সোমরস পান করল। চোখে কিছুক্ষণের জন্য তার প্রাসাদ, পিতা মাতা, সহোদরদের মুখগুলো ভেসে উঠলৃ তারপর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
বাতিওয়ালার চোখ পড়ল তার ডান হাতের অনামিকায় গাঢ় নীল ছাপের দিকে, যেখানে সূর্য ও সমুদ্র মিলে এক রহস্যময় চিহ্ন খোদাই করা। সে বুঝল এই ছোকরার বংশধারা রাজকীয়। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
পরদিন সকালে আলোকময় এক বুদ্ধি আঁটল। রাজপ্রাসাদের সংস্কৃতি মন্ত্রীর দরবারে হাজির হয়ে বলল
“মান্যবর, এমন বিদ্বান যুবক আমি কখনো সারা রাজধানীতে বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে কোথাও দেখি নাই। আমাদের রাজকুমারী তো বিদেশী ভাষায় বই পড়তে চান, শুনতেও চান এই বহুভাষী যুবক সে কাজে সিদ্ধহস্ত।”
মন্ত্রী চোখ মেলে চেয়ে বললেন, “তবে কি রাজা-রানী যে শিক্ষক খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাঁকে দিয়ে সেই কাজ হবে?”
বাতিওয়ালা শুধু মুচকি হেসে বলল, “আমি তো সব ঘরে বাতি জ্বালাই, সবার বিদ্যার দৌড় তো জানা।”
নীল প্রাসাদে
নীল প্রাসাদটি বিশাল। দেয়ালে সাদা মুক্তার অলংকরণ, জানালার কাঁচে নীল পরীদের ছবি। রাজা নীলাদ্রি বাহাদুর আর রাণী নীলাম্বরীর চেহারায় প্রাজ্ঞতা।
রাহুল মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। রাজা- রাণী দুজন মিলেই রাহুলের জ্ঞানের পরীক্ষা নিলেন। রাজা বলেন
“ তুমি যেরকম নানা ভাষা আর বিদ্যায় চৌকষ, ঠিক সেই রকম চৌকষ হতে চায় আমাদের রাজকুমারী নীলা। তবে মনে রেখো, আমাদের কুমারী অতীব গম্ভীর। সে যেমন কাউকে সহজে পছন্দ করতে পারে না, তেমনি তাকেও কেউ পছন্দ করে না।”
রাহুল মাথা নাড়ে
“আমি তাকে পছন্দ করানোর জন্য আসিনি, হুজুর। আমি তাকে বোঝাতে এসেছি নীলের বাইরে যেমন অনেক রং, এই নীল দেশের বাইরেও অনেক দেশ, অনেক দেশে অনেক ধরণের জ্ঞানের বই আছে। আর জ্ঞানই শক্তি।”
এই বাক্যে রাজা মুগ্ধ হন। সঙ্গে সঙ্গে রাজ আদেশ হয়
“রাহুল, তুমি আজ থেকে আমাদের কুমারীর ‘পাঠসঙ্গী’। তাঁর কক্ষে বসে তাকে বই পড়ে শোনাবে, প্রশ্নের উত্তর দেবে।” তুমি থাকবে প্রাসাদের উদ্যানের খাস গৃহে।
রাজকুমারী নীলা ছিল পড়ুয়া, কিন্তু একরোখা কুমারী। দেখতে খুব একটা ভালো না। সে দেখে, বাদামী চামড়ার এই যুবক তো তার চেয়ে বুদ্ধিতে কম নয়।
“তুমি কোন দেশে পড়েছো?”
রাহুল বলে, “পাহাড়ে নদীর পাড়ে বনের ভেতর, যেখানে পাতা পড়লে শব্দ হয় না।”
নীলা চমকে ওঠে—
“তোমার কথা শুনে মনে হয় তুমি কবি!”
রাহুল হেসে বলে,
“কবিতার জন্যে রাজ্য হারাতে হয়। আমি এসেছি নতুন দেশে।”
নীলা চুপ করে যায়।
প্রতি সন্ধ্যায় রাজপ্রাসাদের এক নিভৃত ঘরে বসে রাহুল তাকে হোমার, কালিদাস, বৌদ্ধ সূত্র, বেদ বেদান্ত, এমনকি কামরূপ কামাখ্যার লিপিরও পাঠ দিতে থাকে। নীলা মেধাবী। দেশ বিদেশের বই পড়ে এবং শুনে নীলা অনেক জ্ঞানী হয়ে ওঠে।
নীলার হৃদয়েও সাড়া পড়ে, কিন্তু সে মুখে কিছু জানায় না।
রাহুল জানে, তার কাঁধে যে শুধু নিজের বাঁচা নয়, তার শত ভাইয়ের ভবিষ্যৎও জড়িত। সে ভাবে,
“আমি যদি এ প্রাসাদের হৃদয় জয় করতে পারি, তবে হয়তো কৃষ্ণপৌর রাজ্যের জন্য কিছু করতে পারবো।”
রাজকুমারীর বিয়ে তো রাজপুত্রের সাথেই হতে হয় এটাই তো রীতি, এই কথা সবাই জানে।
কিন্তু রাজকুমারী নীলা আইবুড়ো হয়ে আছেন, কারণ তিনি মেধাবী ও প্রজ্ঞার অধিকারী হলেও দেখতে যে তেমন ভালো না। বিবাহের প্রস্তাব আসে না। গত বসন্তকালের স্বয়ংবর সভাতে কোনো দেশের রাজপুত্রই আসে নাই। রাজপুত্রেরা জানে কোন রাজ্যে, কোন দ্বীপে কোন সুন্দরী রাজকুমারী আছে। নীলাকে কেন বিবাহ করবে তারা? জ্ঞানী রাজকন্যা বিবাহে এক ধরনের ভয়ও কাজ করে তাদের মনে।
রানী নীলাম্বরী কন্যার বিবাহ নিয়ে তেমন চিন্তিত ছিলেন না, ততদিন পর্যন্ত যতদিন না প্রাসাদে এক চোর এসে রাজার উদ্যানের বিরল প্রজাতির আম্রপালি আম পেড়ে পালিয়ে গেলেও কেউ কিছু বলল না, কিন্তু রাজ্যে গুঞ্জন শুরু হলো।
জগাই- “রাজপ্রাসাদের আম চুরি করেও ধড়ে কারো মাথা থাকে বুঝি!”
মাধাই- “রাজকুমারী তো আর রাজপুত্র খুঁজে বেড়ায় না! বুঝলে?”
সেই থেকেই রানীর ঘুম কমে গেল, চুলে রূপোর রেখা ফুটে উঠল, আর ঠিক করলেন এবার নীলাকুমারীর বিয়ে দেবেনই দেবেন।
দিক-দিগন্তে রাজদূত পাঠানো হলো। জাহাজ, বায়ু রথ, মৃচ্ছকটিক যার যা আছে তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দূতেরা। কেউ কুয়াশা দ্বীপে গেল, কেউ রৌদ্র রাজ্যে, কেউ বালি পাথরের দেশে।
শেষমেশ এক রাজপুত্রের সন্ধান পাওয়া গেল। বয়স পঞ্চাশ। নাম সবুজকুমার। থাকেন সবুজ দ্বীপে।
কিন্তু এই যুবক এতই রহস্যময় যে তাঁকে রাজদরবারেও কেউ দেখেনি। প্রাসাদে সঙ্গী বলতে একটিই বন্ধু চশমা পরা, পাতলা গোঁফ, নাম অজ্ঞাত। দুজনে মিলে গবেষণায় ডুবে থাকেন রসায়ন, গণিত, আর পদার্থবিদ্যা।
সবুজকুমার কোনো নারীর মুখ দেখেননি বলেই জনশ্রুতি। রাজ্যের প্রজারা সাপ্তাহিক বেতন পাওয়ার দিন মেলায় গিয়ে হেসে বললো—
জগাই : “এই কুমার তাঁর বন্ধুকেই বিয়ে করুক না কেন। সমস্যা মিটে যাক।”
মাধাই : “সে তো ভালো কথা, কিন্তু রাজ্যের আইন তো বলে কুমার এভাবে বিয়ে করতে পারেন না!”
রাজকুমারী নীলার বিবাহ
রানী নীলাম্বরী সব খবর পেলেন। তিনি তীক্ষ্ম চিবুক উঁচিয়ে বললেন, “এই ছেলেটার সাথেই আমি নীলার বিয়ে দেব। যা লাগবে আমি দেবো। যত গণ্ডা যৌতুক লাগুক!”
এই সময় তাঁর দূর সম্পর্কের বোন, শ্বেত দ্বীপের রাণী মাধবী প্রাসাদে এসে কানে কানে বললেন,
“সবুজকুমার সরাসরি বিয়েতে রাজী হবেন না। তাঁকে খুশি করতে হলে সবুজ দ্বীপে একজন আইন পরামর্শক পাঠাতে হবে, যারা রাজ্যের আইনের সংস্কার করবে।”
রানী নীলাম্বরীর চোখ ঝলমল করে উঠল।
“এক ঢিলে দুই পাখি! আমাদের রাজকন্যা নীলার পাঠসঙ্গী রাহুলকে পাঠানো যাক। ছেলেটি সব বিষয়ে জ্ঞানী। সে যেমনই হোক, জ্ঞানের নাড়ি তো টনটনা!”
রাহুল একটা নীল কাঁচের চশমা পরে আর থলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাজগ্রন্থ নিয়ে চশমায় ঝিলিক দিয়ে ঘোরে। সেই রাহুলকে নীল রঙে সাজিয়ে-গুজিয়ে পাঠানো হলো সবুজ দ্বীপে।
এদিকে কামরূপ কামাখ্যার পাহাড় থেকে সেই মুনিও এসে হাজির।
তিনি হস্তরেখা দেখে সবুজ পৌরের সম্রাটকে বললেন, “কুমারের আয়ু আর মাত্র এক বছর।”
সবুজ সম্রাট ধাক্কা খেলেন। একমাত্র পুত্রের ভবিষ্যত অন্ধকার!
তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়েটা হয়ে যাক। সন্তান হলে, রাজ্য অন্তত রক্ষা পাবে।
তিনি কুমারের বন্ধুকে ডেকে বললেন সব কথা। বন্ধু মুখ গম্ভীর করে বললেন, “ মৃত্যুর আগে সে নারীসঙ্গ লাভ করুক, আমি তাই চাই। সবুজ রাজবংশের বংশধরও প্রয়োজন।“
বন্ধুর কথায় সবুজকুমার বিবাহে রাজি হয়ে গেলেন।
এরপর মহা ধূমধামে ঘটলো এক রাজকীয় আয়োজন!
সাতটি দ্বীপ থেকে সাতটি শঙ্খ এনে বাজানো হলো, চন্দনপুকুরে একশো একটা নীলপদ্ম ফোটানো হলো, আর রাজকুমারী নীলার বিয়ে হয়ে গেল সবুজকুমারের সঙ্গে এক রহস্যময়, বয়স্ক রাজপুত্রের সঙ্গে।
রাহুল তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যাওয়াতে ফিরে গেলো, বেকার হয়ে।
নীলা সবুজ দ্বীপের ছোট রানী হয়ে গেলেন। দিনের পর দিন সবুজকুমারের সঙ্গে গবেষণাগারে কাজ করেন ।
বিয়ের নয় মাস পর, এক অপূর্ব রূপসী কন্যা জন্ম নিল। তার চোখ সবুজ, কপালে জ্যোৎস্নার মতো আলো। কন্যার নাভিতে এক বাদামী জলছাপ। কন্যার এই বাদামী রঙের ছাপ এমন নিখুঁত এক গোল দাগ, যা নিয়ে দরবারে বহু গবেষণা। কেউ বলে, এটি ঈশ্বরের ছোঁয়া, কেউ বলে, এটি এক অতীত রাজবংশের চিহ্ন। কামরূপের মুনি এসে বললেন, এটি বিজয়ের নিশানা। রাজ্য আনন্দে ফেটে পড়ল।
এক মাস ধরে চলল উৎসব।
কারণ সবুজ সম্রাট তো ভেবেই বসেছিলেন, তাঁর বংশের বাতি নিভে গেছে! এখন দেখলেন, ছোট্ট একটা জ্যোতিষ্ক জ্বলছে।
কিন্তু মানুষ যা ভুলে যায়, নিয়তি তা ভুলে না। ত্রিকালদর্শী মুনি তো ভুল করে না, সে তো চুপচাপ বসে ভবিষ্যতের দরজা খুলে দেখে ফেলে কোন বাঁকে কে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক দশ মাসের মাথায়, যখন কন্যার নামকরণ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, যখন রাজপ্রাসাদে গোলাপজল আর কস্তুরীর গন্ধে বাতাস ভারী ঠিক তখনই সবুজ কুমারের শরীরটা একেবারে ভেঙে পড়ে। তিনদিন ধরে মারি জ্বর আসে যায়, আসে যায়, আর চতুর্থ রাতেই, সবুজ দ্বীপের আকাশে এক বিশাল সবুজ তারা খসে পড়ে, আর কুমার নিঃশব্দে বিদায় নেন। রাজপ্রাসাদের প্রতিটি বাতি তখন আপনাআপনি নিভে যায় সে এক অতিলৌকিক দৃশ্য।
কুমারের বিছানার পাশে পড়ে ছিল সোনার কালিতে লেখা একটি চিরকুট: “জীবনটাকে দেখে গেলাম।”
রাণী নীলাম্বরী দূর থেকে সংবাদ পেয়ে বিলাপ করতে থাকেন, “আমি যে মেয়েটাকে বিদায় করেছিলাম সোনার পালক দিয়ে, সে ফিরে আসবে একা, এক শিশুকে বুকে নিয়ে?”
শ্বেত দ্বীপের রানী মাধবী শান্ত করেন, “না দিদি, সবুজকুমার প্রস্থানের আগে তাঁর সন্তানকে রাজ্যের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে গেছেন। আর নীলা এখন সবুজ দ্বীপের রাণী। তুমি কেঁদো না।”
দু বছর পার হয়। রাহুল অর্থাৎ বর্মনদের রাজকুমার বাতিওয়ালার ঘরে বসে এক অদ্ভুত চিঠি পান। চিঠিটা আসে নীলা রাণীর কাছ থেকে। সিল করা মোমে একটি গোলাপফুলের ছাপ, আর ভিতরে লেখা:
“প্রিয় পঠনের সাথী,
সবুজ দ্বীপের আকাশ বেদনায় নীল হয়ে আছে। কন্যাটি তোমার মতো করেই বই আঁকড়ে ধরে কান পেতে শুনতে চায়, যেন শব্দগুলো তোমার রেখে যাওয়া শঙ্খ।
তোমার পাঠ থেকে যা শিখেছিলাম, সেই জ্ঞান দিয়েই এখন রাজ্য চালাই। আমার কন্যা তোমার মতো একজন শিক্ষক পাবে কি না জানি না।
তুমি কি ওর দায়িত্ব নিতে আসবে?
আমি এখন রানী বৈজয়ন্তী উপাধি ধারণ করেছি।
রঙিন স্বপ্নে,
রানী বৈজয়ন্তী নীলা।”
রাহুলের কোলে কোলে মানুষ হওয়া এই কন্যা রূপে অপূর্ব, বিদ্যায় নিপুণ, বাকচাতুর্যে তীক্ষ্ম। তার চুল কালো, কোমর ছোঁয়া; তার চোখ দুটো যেন জলজ নীলা; আর তার নাভিটি বাদামী যেন গীতিকার শালিকের বুকের ছোপ।
সময় চলে গেছে। বহু ঢেউ বয়ে গেছে সবুজ দ্বীপের তীরে। রাহুলের হাতেই হাতে খড়ি হওয়া মহারানী বৈজয়ন্তীর কন্যা রাজকুমারী নীলাঞ্জনা এখন আর শিশুটি নন। তিনি তরুণী হয়েছেন। মায়ের গর্ভফুল আর পিতার রহস্যময়তা নিয়ে গড়া নীলামণি যেন এক আলো-ছায়ার মিশ্র প্রতিমা। চোখে দূরদৃষ্টি, ঠোঁটে সংযম, আর মননে সবুজ বাতি। প্রজাকুলে তাঁর রূপের যেমন প্রশংসা, তেমনি আছে সমীহ। কারণ নীলাঞ্জনা শুধু সুন্দরী নন, তিনি বুদ্ধিমতী যেনবা দস্তানার নিচে লুকনো তীক্ষ্ম ছুরির ঝিলিক।
রাহুল, যিনি একদিন পাঠসঙ্গী ছিলেন, আজ উপদেষ্টা রূপে মহারানীর ছায়ায় কাজ করেন। তাঁর মনে গভীর পরিকল্পনার বীজ। তিনি জানেন, রাজ্য শাসন শুধু প্রজ্ঞা দিয়ে চলে নাচলে জবরদখল, আঁতাত, আর কখনও-কখনও ধ্বংস। তিনি ভাবেন, “রাজকুমারী নীলাঞ্জনাকে যদি সঠিক জায়গায় স্থাপন করা যায়, তবে শুধু একটি বিয়ে নয়, হারানো রাজ্যও জয় করা সম্ভব।”
তিনি কৃষ্ণ পৌরের ত্রিপুরা রাজবংশের কথাই ভাবছিলেন। এক সময় সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী এই রাজ্য এখন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জর্জরিত। বর্তমান রাজা বয়োবৃদ্ধ, এবং তাঁর একমাত্র পুত্র বিভাসকুমার একজন কবি অথচ রাজনীতি-কূটনীতি বিষয়ে অসচেতন রাজপুরুষ। আশেপাশের রাজাদের চোখ পড়েছে এই রাজ্যে।
রাহুল ভাবে, “এ রাজপুত্রকে বিয়ে করিয়ে যদি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়, তবে কৃষ্ণ পৌরের হারানো প্রাসাদ ফিরে পাবো। নীলাঞ্জনা হবেন রাজরানী, আমি হব তার ছায়া-রাজা। আমার একশো ভাই ফিরে আসবে!”
কিন্তু সরাসরি প্রস্তাব গেলে ওরা সন্দেহ করতে পারে। তাই রাহুল তলব করেন কামরূপের সেই ত্রিকালদর্শী মুনিকে যিনি কেবল ভাগ্যই দেখেন না, প্রয়োজনে রূপান্তরও করেন। এইবার তিনি যাবেন ঘুঘু পাখি ভাই নামের এক ঘটকের ছদ্মবেশে। তাঁর কাজ ত্রিপুরা রাজ্যের ভিতরে গিয়ে রাজপরিবারের ভেতরের অবস্থা বুঝে আসা, বিভাসকুমার ত্রিপুরা কেমন মানুষ, এবং কিভাবে বিয়ের পটভূমি তৈরি করা যায় তা খতিয়ে দেখা।
রাহুল মুনিকে বলেন, “তুমি তাঁর কাছে যাবে ঘটকের সাজে। তোমার খাতায় এক সহস্ত্র রাজকন্যার ঠিকুজি থাকবে। রাজপরিবারে ছড়িয়ে দেবে বিবাহের বার্তা। বলবে, পশ্চিমের সবুজরাজ্যের রাণী তাঁর অপূর্ব সুন্দরী ও বিদুষী একমাত্র কন্যাকে বিয়ে দিতে চায়। তার দেহে আছে বিজয়ের অভিজ্ঞান। তুমি বিভাসের মনের সূক্ষ্ম পর্দা ভেদ করবে। ”
কিন্তু একে মহা পরিকল্পনা বললে কম বলা হয়। রাহুলের চূড়ান্ত পরিকল্পনা বিয়ের মাধ্যমে ত্রিপুরা রাজ্য জয় করা। কারণ তিনি জানেন, বিভাস দুর্বল। সে রাজ্য চালাতে পারবে না। আর রাজার আশেপাশে কোনো যোগ্য মন্ত্রী নেই।
“বিয়ের পর বিভাস রাজত্ব চালাবে না, চালাবে নীলঞ্জনা। আর তাঁকে চালাবো আমি। ক্রমে ওই রাজবংশকে করব ইতিহাস। শুধু থাকবে এক নতুন রাণীর মুকুট, যার নেপথ্যে থাকবে আমার ছায়া।”
এদিকে মুনি, ঘুঘুপাখি ভাই সেজে, কৃষ্ণ পৌরের দিকে রওনা দিলেন। তাঁর রূপ এখন এক প্রাজ্ঞ অথচ সরলগোছের ঘটকের। পথে যেতে যেতে তিনি কণ্ঠে সহজিয়া সুরের গান ধরেন।
নীলঞ্জনার বিবাহ ও অতঃপর
নীলাঞ্জনা একদিন হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়েন। রাজমহলে ছুটোছুটি পড়ে যায়। কামরূপ কামাখ্যার মুনি এসে তাকে বাঁচান। রোগের দমন হয়, কিন্তু বংশের ইতিহাস অপ্রতিরোধ্য।
সান্ধ্য ভোগের টেবিলে বসে মুনি গলার স্বর নিচু করেন। রানী বৈজয়ন্তী আর রাহুলকে জানান, কৃষ্ণ পৌরের ত্রিপুরা রাজ এই বিয়েতে সম্মত হয়েছেন। তারা সবুজদ্বীপ আর নীলদ্বীপের সাথে আত্মীয়তা করে নিজেদের সম্ভ্রম ও শৌর্য বাড়াবার স্বপ্ন দেখছে।
সেই সন্ধ্যায়, সন্ধ্যা প্রদীপের আলোয় রাহুল অতীতের সমস্ত গোপন ইতিহাস খুলে বলেন ত্রিপুরা রাজবংশের পতনের পরিকল্পনা, কৃষ্ণ পৌর রাজ্যে তাঁর ছায়ার শাসন, সব।
বৈজয়ন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তারপর বলেন, “আমি যদি কোনো সাহায্য করতে পারি, পাশে থাকব।”
এরপর মহা ধূমধামে রাজকীয় বিয়ের তারিখ ঠিক হলো শ্রাবণমাসের সাত তারিখে।
নীলামণি ও বিভাস কুমারের বিয়ে হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবেস্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল থেকে অতিথিরা আসেন। এসেছিল সোনালি কচ্ছপের পিঠে রাজা পাইন, আগুনের পাখায় চড়ে অলকানন্দা নদীর দেবতা, চন্দ্রভানুর মৃচ্ছ্বকটিকায় চড়ে এসেছে অতলনগরীর কিশোর রাজপুত্ররা।
সেই বংশে জন্ম নেয় এক পুত্র, যার নাভিতে আবার জেগে ওঠে সেই রাজরোগের দাগ। মুনি আবার তাঁকে রক্ষা করেন। পরের বছর জন্ম নেয় এক কন্যা, যার গায়ে কোনো দাগ নেই। মুনি বলেন, “এই কন্যা বংশ রক্ষা করবে।”
ঠিক তখনই দক্ষিণ সীমান্তে শুরু হয় যুদ্ধ। দক্ষিণের এক সুপ্ত প্রতাপ রাজ্য আগে থেকেই রোষ পোষণ করছিল। কামরূপ কামাখ্যার কাছ থেকে দক্ষিণের রাজা সমর্থন পেল। কারণ কামাখ্যার রাজা চেয়েছিলেন তাঁর রাজকুমারীদের সাথে কৃষ্ণ পৌর রাজ্যের কুমারদের বিবাহের ধারা চলমান থাকুক। এখন তিনি কৃষ্ণ পৌরের ত্রিপুরাদের আসন্ন পতনে নিস্পৃহ থাকেন। বরং নিজের রাজ্যের এক দক্ষ অমাত্যকে পাঠান দক্ষিণের রাজ্যে যুদ্ধ কৌশল শেখাতে।
সেই স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের বিয়ের অতিথিরাও, যাঁরা আপাতত অদৃশ্য হয়ে ছিলেন, এখন এক এক করে দক্ষিণে জড়ো হন। তাঁদের হাতে ছিল আগুনের তীর, বাতাসের তরবারি, আর পাথরের শিরস্ত্রাণ।
বিভাস কুমার বাধ্য হন প্রাসাদ ছেড়ে রাজ্যরক্ষায় যুদ্ধের মাঠে চলে যেতে। রাজ্যের ভার পড়ে নীলাঞ্জনার হাতে।
এবার মুনি ও রাহুল এই দুই বিপরীত মেরুর মানুষ তাঁকে দুটি ভিন্ন উপদেশ দেন।
মুনি বলেন,
“শান্তির বাণী ছড়াও, মা।
দ্বন্দ্বে কেন ঝাঁপ দেবে?
প্রেমই তো পারে রাজ্য রক্ষা করতে।”
তিনি কামরূপ রাজার পরামর্শে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নতুন সৈন্য না পাঠাতে বলেন।
অন্যদিকে, রাহুল বলেন, “এই বছর ভালো ফসল হয়নি। দুর্ভিক্ষ হবে। আর রসদ পাঠিও না। তুমি রাজ্য বাঁচাও।”
দুটো যুক্তি শুনে নীলাঞ্জনা যুদ্ধক্ষেত্রে আর কোনো সাহায্য পাঠান না।
ফলাফল ভয়াবহ।
যুদ্ধে কৃষ্ণ পৌর হেরে যায়। বিভাসকুমার নিহত হন।
শোকে মুহ্যমান রাজ্য, যেন এক প্রাচীন কাহিনির পৃষ্ঠা ছিঁড়ে গেছে হঠাৎ।
অতঃপর
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল থেকে একশত রাজপুত্র ফের ফিরে আসেন।
তাঁদের প্রত্যেকের হাতে এক একটি অগ্নি মশাল। রাজধানীতে যে প্রবীণ ও কূটনীতি সচেতন প্রজারা ছিল, তারা যেনবা ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়া এই মশালগুলো দেখল !
নীলাঞ্জনা শোকগাথা থেকে উঠে দাঁড়ান।
তিনি সোনার ঝরোকায় দাঁড়িয়ে প্রজাদেরকে বলেন, আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি, রাজা চলে গেছেন, কিন্তু এই রাজ্য আমরা হারাইনি। এই রাজবংশের জ্ঞাতি বর্মনদের বীরত্বে আমরা এই রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছি। ফিরে পেয়েছি এক হারানো রাজবংশ।
কামরূপের রাজার এই বর্মন বংশের প্রতি সমর্থন আছে। কিন্তু কামরূপের রাজকন্যা কামিনী মুনীকে ক্ষমা করেনি। কৃষ্ণ পৌর রাজ্যের সাথে কামরূপের আত্মীয়তার সম্পর্কের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে দেয়ার জন্য কামিনী এক গুপ্তঘাতক পাঠায়। গুপ্তঘাতক মুনিকে হত্যা করে কৃষ্ণ সমুদ্রে ফেলে দেয়।
রাহুলের নেতৃত্বে আবার বর্মন রাজবংশের পুনরাবির্ভাব ঘটে। যুদ্ধশেষে দক্ষিণ ও কামরূপের সাথে শান্তি চুক্তি হয়। সমুদ্রসীমার অদূরে একটি নীল ও আরেকটি সবুজ জাহাজের বহর নিরাপত্তা বলয় রচনা করে রাখে।
নীল অপরাজিতা
হাজার বছর পর। রাহুল হাজার বছরের আয়ু পেয়ে এখনো কৃষ্ণ পৌরের রাজা। অমর বুদ্ধিজীবী চ্যবন এখন তাঁর উপদেষ্টা। এই চ্যবনই পাঁচশ বছর ধরে নীল পৌরের বাতিওয়ালা সেজে ছিলেন!
প্রাসাদের বাগানের মাঝখানে একটি নীল অপরাজিতা ফুল হয়ে ফুটে আছেন রাণী নীলাঞ্জনা।
মহারাণি বৈজয়ন্তীও অমরত্বের বটিকা খেয়েছিলেন। এখন আর রাজ্যশাসনের ব্যস্ততায় নেই। অনেক বছর আগেই তিনি নীল পৌরের শাসনভার তুলে দিয়েছেন তাঁর জ্ঞানী ও সাহসী উত্তরসূরিদের হাতে। তবে তাঁর রাজসিকতা একটুও ম্লান হয়নি বরং তা রূপ নিয়েছে নিঃশব্দ ভালোবাসার নিখুঁত চর্চায়।
প্রাসাদের পেছনের বাগানে, যেখানে বাতাসে শিশিরে মেশে নীল অপরাজিতার সুবাস, তিনি প্রতিদিন সকাল-বিকাল নিজের হাতে পানি দেন সেই গাছে। গাছটি যেন তাঁর আত্মারই রূপান্তর, নীলাঞ্জনার শোক আর সংকল্পের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাতার ছায়ায়।
আর সন্ধ্যার আলো নেমে এলে গোল হয়ে বসে পড়ে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে আসা কিশোর-কিশোরীরা
নাতি-পুতি, যারা জানেই না হয়তো যে, তাদের দাদি ছিলেন এক সময়ের এক বিচক্ষণ রাণী।
তখন বৈজয়ন্তীর চোখের কোণে হাসির রেখা, কণ্ঠে এক গোপন বিষণ্নতা।
তিনি বলেন, “শোনো, নীল রঙের এক দেশ ছিল, বরফে ঢাকা। সেখানে স্বপ্ন জমতো গাছে ফলের মতো, আর গান ঝরে পড়ত পাতা হয়ে।
সেই দেশেরই এক কন্যা ছিল, যে নিজের দুঃখ গায়ে মেখে ফুল হয়ে গিয়েছিল একদিন”
তাঁর গল্পের মাঝে, নীল অপরাজিতার গা বেয়ে নামে হালকা শিশির।
আর বুঝে না বুঝে শিশুরা তখন তাকিয়ে থাকে এক ফুলের স্মৃতিঘেরা অপার রূপকথার দিকে।
সন্ধ্যায় মহারাজ রাহুল আর মহারাণী বৈজয়ন্তী হ্যাজাক লণ্ঠনের আলোয় আরেক নতুন দেশের ইতিহাস গ্রন্থ খুলে বসেন। তাঁরা এখনো পরস্পরের পাঠসঙ্গী।
প্রাচীনা রাজ্যের এই দুই মহাজ্ঞানী আর কখনোই কৃষ্ণ পৌর রাজ্যের আইনকানুন সংশোধন করেন নাই। প্রাসাদ আনন্দের খনি, কিন্তু রাজ্য শ্মশান প্রায়।
মোশতাক আহমদ, কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও জনস্বাস্থ্যবিদ