আলী তারেক পারভেজ
কড়া নাড়ার শব্দে সচকিত দৃষ্টি আধ ভেজানো দরোজায় চলে যায়। একটি যুবক ছায়া সঠান দাড়িয়ে।
‘ভিতরে এসো’, বই থেকে চোখটা তুলে বললাম।
‘সুযোগ নেই’, জড় কন্ঠ আওয়াজ করে। ‘আমি যে অনেক দূর ভুবনের বাসিন্দা, তোমাদের মাঝে আমার আসা আর হবে না’।
চমকে উঠি। ‘কে তুমি’?
‘সোনাকান্দার সম্মুখ যুদ্ধের প্রথম নিহত বাঙ্গালী’।
স্বয়ংক্রিয় দাঁড়িয়ে যায় আমার সমস্ত দেহ, সব ক’টা কেশাগ্র, শুধু মাথাটা নত হয়ে আসে অস্তগামী সূর্যের মতো। এতো বিশাল গৌরবের জীবন আমার দরোজায় দাঁড়িয়ে! বললাম, ‘কি মনে করে ভাই তুমি এখানে’?
নির্বিকার ভাবে বললো, ‘তোমার মা বুঝি পিঠা বানাচ্ছে? সুঘ্রাণ আমাকে টেনে এনেছে’।
অবাক হয়ে বললাম, ‘হাঁ ভাপা, চিতুই আর পাটিসপ্টা, খাবে তুমি, ভেতরে আসো’।
একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো। ‘আমার প্রবেশাধিকার নেই, ভেতরে আসবো কি করে’?
আমার ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা। ‘কেন, কেন। তোমাদের জন্য আমাদের দরোজা কখনো বন্ধ ছিলো না। আসো ভাই শীতল পাটি বিছিয়ে দিচ্ছি, তাল পাখার বাতাস দিবো, আরাম করে বসো।’ দেখি যুবক ছায়া নড়ে চড়ে উঠছে। এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকলাম, ‘আজ মাঘের ভরা পূর্ণিমার রাতে উঠোনে পুঁথি পাঠের আসর বসবে। দুজনে নকশী কাঁথা
গায়ে মুড়িয়ে ভীড়ে যাবো মানুষের ভেতর। বালিগুড়ের চা খাবো কন কনে শীতের প্রহরে’।
‘আহ আফসোস।’ প্রথমবারের মতো কেঁপে উঠলো জড় কন্ঠ। ‘প্লীজ আর লোভ দেখিও না ভাই। এমনিতে বারেবারে এ সবুজ আর মাটি আমাকে টেনে আনে। এর মোহ কাটিয়ে উঠতে পারিনা কোন ভাবেই।’ ওর কন্ঠ জড়িয়ে যায়। ‘বরং আমি চলে যাচ্ছি। অতৃপ্তি সেতো থাকবেই। যে বেঁচে আছে সেও অতৃপ্ত, মরেও অতৃপ্তি নিয়ে। অদ্ভুত মায়াবী এই প্রত্যন্ত। পৃথিবীর আর কোন ভূখন্ড মনে হয় এমন করে তার সন্তানদের নিবিড় ছায়া দিয়ে রাখে না। আমি চললাম’।
‘দাড়াও।’ আমি ছুটে যাই দরোজার দিকে। চিৎকার করে বললাম, ‘তুমি পিঠা খেয়ে যাবে, কিছুতেই তোমাকে যেতে দেবো না। তোমাদের জীবনের মূল্যে আমরা বেঁচে আছি। তোমাদের ভালোবাসায় আমরা জেগে আছি, ধান বুনি, পাল তুলি, সুর ভাজি, হাতুড়ি চালাই আর স্বপ্ন দেখি। এই দেশ, এই মুক্ত জীবন সব তোমাদের সৌজন্যে, তোমাদের রক্তিম পৃষ্টপোষকতায়।’ আমার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। বুকটা হু হু করছে। অনুনয় করে বললাম, ‘পিঠা তোমাকে খেতেই হবে। তুমি না খেয়ে গেছো জানতে পারলে এ দেশের কোন মা আগামীতে পিঠা বানাতে বসবে না’।
আলী তারেক পারভেজ, কবি, গীতিকার ও গল্পকার