নুসরাত সুলতানা
রহমতের সাথে কথা বলা শেষ হতেই আফজাল সাহেবের রাগে-দুঃখে ক্ষোভে সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে আফজাল সাহেব বলে- স্কাউন্ড্রেল, শুয়োরের বাচ্চাটাকে পেলে আমি গলা টিপে মেরে ফেলতাম।
আফজাল সাহেবের একমাত্র মেয়ে টুম্পা তিনদিন আগে কানাডা থেকে ফোন করে জানায় ছেলে স্বপ্নীলের ভয়াবহ অসুস্থতার কথা। সেই থেকেই আফজাল সাহেব এবং তার স্ত্রী চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। একমাত্র নাতির মরণব্যাধি। কী করে এমন হতে পারে! সবসময়ই তো তারা মিনারেল ওয়াটার খাইয়েছে নাতীকে।
দুই.
স্মৃতিপটে একে একে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠতে থাকে সিনেমার মতো। সেদিন বিকেল পাঁচটায় বেশ খোশ মেজাজে বসেছিলেন তিনি। সময়টা শরৎকাল। ড্রাইভার রহমত দৌড়ে অফিসে প্রবেশ করে, আফজাল সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে-“বড়সাব আমারে ছুটি দেন আমার পোলাডা খুউব আসুস্থ! আজ তিনদিন ধইরা কিছু খায় না।”
আফজাল সাহেব নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেন,” কি হয়েছে তোর ছেলের? আজ আমার একমাত্র মেয়ে টুম্পা দাদুভাইকে নিয়ে দেশে আসবে। মাস দুয়েক থাকবে। ওদেরকে বিমানবন্দরে আনতে যেতে হবে। এই নে দুহাজার টাকা। তুই বাড়িতে পাঠিয়ে দে। দুইদিন পরে যাস বাড়িতে। যা বিকাশ করে আয়। আমি তোকে নিয়ে বের হব”
তিন.
রহমতের বাড়ি বেনাপোলে। ড্রাইভার হলেও ছেলেকে নিয়ে রহমতের অনেক স্বপ্ন। বউকে সবসময়ই বলেছে ছেলেকে দুধ- ডিম- কলা খাওয়াতে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে রেখে দিয়েছে হোম টিউটর। রহমতের বউ এবং মা ও এই ছেলের যতেœর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। দেশি মুরগির ডিম, আড়াইশ গ্রাম দুধ রোজ করে খাওয়ায় ছেলেকে। রহমতের বাবা মারা গিয়েছিলেন অকালে কালাজ্বরে ভুগে। নিজে তাই পড়াশোনা করতে পারেনি। নিজের অবাস্তবায়িত স্বপ্ন ছেলের মাধ্যমেই পূরণ করতে চায় রহমত। তার খুব আশা – ছেলে এম এ পাস দিয়া অফিসের বড় সাইব অউবে। রহমত তখন চায়ের দোকানে গিয়া আয়েশ করে চা- সিগারেট খাবে। ভালো ভালো কাপড় পরবে। বউকে টাকা বিকাশ করে সে বলে, “মাসুমরে সদরে নিয়া ডাক্তার দেহাও। আমি দুইদিন পর আইতাছি।
আইয়া মাসুমরে বড় ডাক্তার সাবের ধারে লইয়া যামু।”
কোনো চিন্তা কইরো না মাসুমের মা। আল্লহরে ডাকো।
গরীবের আল্লাহ ছাড়া আছে কেডা! ফোনের অই প্রান্তে নি: শব্দ চোখের পানি ফেলেছে মাছুমের মা।
চার.
আফজাল সাহেবকে আল্লাহ সুখ শান্তি ধন দৌলত সবই দিয়েছেন। সেদিন একমাত্র মেয়ে আসবে কানাডা থেকে তার কলিজার টুকরো নাতিকে নিয়ে। আর একমাত্র ছেলে টিপু আমেরিকায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.বি. এ পড়ছে। ফিরে এসে তার পাঁচ পাঁচ টা ইন্ডাস্ট্রির হাল ধরবে এটাই তার একান্ত প্রত্যাশা।
ওইতো তার দাদু ভাই স্বপ্নীল। মাশাল্লাহ দাদুভাই বেশ মোটাসোটা আর নাদুসনুদুস হয়েছে। চোখগুলো কী ঢলঢলে আমার নাতিটার! আফজাল সাহেবের চোখে দ্যুতি খেলে যায়। মেয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ড্যাড তোমার ভুঁড়ি এত বেড়ে গেছে! আফজাল সাহেব মেয়েকে বুকে নিয়ে সাতরাজ্যের আদর দেন।
স্বপ্নীল বলে, হেই ওল্ডম্যান হাউ আর ইউ? আফজাল সাহেব অমনি দরাজ গলায় হা আ হা আ হা আ করে হেসে ওঠেন।
সবাইকে নিয়ে আফজাল সাহেব গুলশানের বাসায় এলেন। তার বাসায় চাঁদের হাট বসেছে। স্বপ্নীলকে কী খাওয়ালে হয়! সারাক্ষণ ব্যস্ত রাহেলা বেগম। আর রহমত ব্যস্ত বাজার করা নিয়ে। সারাদিনই ফল, মাছ, ফাস্টফুড, ড্রিংক এসব নিয়ে রহমতের ছুটাছুটি।
রহমতের ছুটি আরও দুইদিন পিছিয়ে দেয়া হল। সারাক্ষণ রহমত প্রহর গোনে এই বুঝি বড় সাব ছুটি দেল। রহমতের কলিজায় পানি নাই। তার চোখের মনি মাসুমের অবস্থা ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এদিকে বড়সাবের অমতে যেতেও পারছে না। চাকরি চলে গেলে বউ,বাচ্চা আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে সে খাবে কী?
ছেলেকে মানুষ করবে কী করে! অগত্যা রাহেলা বেগমের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে ছুটি আদায় করে সে।
পাঁচদিন পরে রহমত হাজির হয় অসুস্থ ছেলের সামনে। ছেলে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। চোখ মুদেই বাবাকে বলে বাবা আমার গাড়ি আনছ ? রহমত বলে,”বাবা আমি দুন্নাই একলগে আইন্না দিমু,তুমি আগে সুস্ত অও।”
আংগুরি অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে। বকে চলে রহমতের মা,”তুই কেমন বাপ?
চাকরী ছাইড়ড়া ক্যান চইল্লা আইলিনা? দিনমজুরি কইরা খাইতি!
পাঁচ.
কিছুদিন পর ফিরে আসে রহমত। সাথে অনেক উপঢৌকন। গ্রাম থেকে ডাব, কলা, দেশি মুরগির ডিম নারকেল, ডালের বড়ি। আফজাল সাহেব খুব খুশি হয়।আহ্লাদী কন্ঠে বলে কীরে এতকিছু কেন এনেছিস! দাদু ভাইয়ের জন্য? নে তোকে একহাজার টাকা বকশিস দিলাম। রহমত বলে শুকনো হাসি দেয়। একটা অদ্ভুত দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে বলে- লাগবে না স্যার। আপনের নাতি তো আমারও পরম আত্মীয়।
আফজাল সাহেব রহমতের ছেলের খোঁজ খবর নেন।রহমত বলে সে অনেকটা সুস্থ। তবে চিকিৎসা চলছে।
রহমত সোৎসাহে আফজাল সাহেবের বাসায় বাজার ঘাট করতে থাকে। একদিন স্বপ্নীলের জন্য মিনারেল পানি আনতে পাঠায়। রহমত ১০ লিটারের বোতল নিয়ে আসে। কিন্তু বোতলের মুখ খোলা। রাহেলা বেগম জিজ্ঞেস করলে বলে,স্বপ্নীল ভাইজানকে নীচে পানি দিয়া আইছি।
দুইমাস প্রায় শেষ করে টুম্পার ফিরে যায় কানাডা। বাবা মা চোখের জলে বিদায় দেয় মেয়েকে। ফেরার সময় রাহেলা বেগমের চোখের জল বাঁধ মানে না। আফজাল সাহেব বারবার নাতিকে চুমু খান আর বলেন ওল্ডম্যানকে দেখতে আবার এস দাদুভাই! ওল্ডম্যান অলওয়েজ উড বি ওয়েটিং ফর ইউ।
কানাডা গিয়ে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয় স্বপ্নীল। তার পেটে প্রচ- ব্যাথা। নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বলেন,স্বপ্নীলের রক্তে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
টুম্পা চোখে অন্ধকার দেখে। ফোনে বাবাকে স..ব জানায়।
আফজাল সাহেব কোন কূলকিনারা খুঁজে পাননা। পান না রাহেলা বেগমও। সবসময় স্বপ্নীলকে মিনারেল ওয়াটার খাওয়ানো হয়েছে।
ছয়.
দু তিনদিন হয়েছে রহমত মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বাড়ি গেছে। তারপর ছয়দিনের মাথায় রহমতের ফোন আসে,” স্যার কেমন আছেন? আফজাল সাহেব বিমর্ষ চেহারায়, ভেঙে যাওয়া ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠস্বর নিয়ে বলে- ভালো নেই রহমত। আমার দাদু ভাইয়ের খুউব অসুখ! তুই তো সবসময় মিনারেল পানি এনেছিস! রহমত নিষ্ঠুর হাসি হাসে আর বলে,স্যার আপনার বাসায় বাজার করার জন্য আমার ছেলের কাছে আসতে দেন নাই। মারা গেছে আমার ছেলেটা। হেই রাত্তিরে পোলার কবরে হারা রাইত বইয়া থাইক্কা পতিজ্ঞা করছিলাম আমি খুনেত পতিশোধ নিমু। আপনে আমার পোলাডারে খুন করছেন। তাই আমি আপনের নাতির পানিতে আর্সেনিক মিশাইয়া দিছি। বোঝেন একটু হারানোর ব্যথা কী! আমারে আপনে জিন্দেগীতেও খুইজ্জা পাইবেন না। এই সীমডা হালাইয়া দিমু।
আফজাল সাহেবের মাথায় আর কিছুই ঢোকে না। তিনি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। আর তার কানে ঠা-ঠা করে অনবরত বেজে চলেছে রহমতের অট্টহাসি।
নুসরাত সুলতানা, কবি ও কথাসাহিত্যিক