মুজিব রাহমান :
শোকে-সন্তাপে সর্বংসহা স্থির-বৃক্ষ কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন :
জলপাই গাছগুলো যদি জানতো
সে-হাতের অরুন্তুদ ইতিবৃত্ত
যে হাত রুয়েছিল তাদের
তাহলে তাদের তেল
বিমর্ষ বিষাদে অশ্রু হয়ে যেতো!
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পটভূমিতে ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার আরব স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে বৃটিশ সরকার প্যালেস্টাইনে ইহুদি জাতীয় নিবাস প্রতিষ্ঠায় পূর্ণ সমর্থনপূর্বক ‘বেলফোর ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে ভঙ্গ করেছিলেন সেই প্রতিশ্রুতি। মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। যদিও ‘বেলফোর ঘোষণা’ ফিলিস্তিনিদের সামগ্রিক অধিকার অক্ষুণ- রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো পরবর্তীতে তা চাতুর্যপূর্ণ উপহাসে পরিণত হয়। ১৯২০এর দশকে আরব নেতৃবৃন্দ প্রথম জায়নবাদি হাই কমিশনার স্যার হারবার্ট স্যামুয়েল-এর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইহুদিবাদি উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ব্রিটিশ অভিপ্রায় সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠেন। ইহুদি বসতি স্থাপনের সেই দিনগুলোতে ১৯২১ সালে বিশিষ্ট ইহুদি শিক্ষাবিদ জর্জ অ্যান্টোনিয়াস জেরুজালেমে আসেন এবং তদানীন্তন হাই কমিশনার স্যামুয়েল, মুখ্য সচিব স্যার গিলবার্ট ক্লেইটন, পরিচালক হামফ্রে ব্রাউম্যান এবং জেরুজালেমের মুফতি আল-হাজ্ব আমিন আল-হুসাইনির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভায় দোভাষী ও বিশ্লেষকের কাজ করেন। মূলত, তিনি ছিলেন ব্রাউম্যানের প্রধান সহকারী কিন্তু বিভিন্ন সময়ে জর্জ অ্যান্টোনিয়াস ব্রাউম্যানের অনুপস্থিতিতে শিক্ষা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবেও কাজ করেন। উল্লেখ্য, ১৯২৫ সালে ফিলিস্তিনে বেলফোরের সহগামী ও সহযাত্রী ছিলেন জর্জ অ্যান্টোনিয়াস। সে সময়ে প্যালেস্তানিয় আরব মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছিলেন ব্রটিশ রাজনীতিবিদ বেলফোর। লেবাননে জন্মগ্রহণকারী সিরিয় সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে অ্যান্টোনিয়াস বেলফোরের এ দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম ভালভাবে গ্রহণ করেননি। অ্যান্টোনিয়াসের মন্তব্য থেকেই আজকের বাস্তবতার শেকড় কতো গভীরে প্রোথিত তা আঁচ করা যায়:
‘Palestine was to him ( Arthur Balfour) a game, a sort of historico-intellectual exercise and diversion, into which he found himself drawn by the flattery of a plausible and astute Jew. Of the Arabs he was at first not even conscious… When the Arabs became vocal, he regarded them as a nuisance – hooligans who had never read Hume or Bergson and who must not be suffered to disturb the serene philosophy of his historical meditations or the delicate equilibrium of his fantastic experiment.
[ Antonius to J.M. Jeffries, 17 November 1936, R.C. 65/AT 26-866-330, Israel State Archives, Hakirya.]
একজন আরব হওয়ার কারণে অ্যান্টোনিয়াস বাউম্যানের পর শিক্ষাবিষয়ক পরিচালক হতে পারেননি। অবশেষে প্যালেস্তিনিয় আরবদের প্রতি ব্রিটিশ বৈষম্যমূলক নীতির বিরোধিতা করে১৯৩০ সালে অ্যান্টোনিয়াস ব্রিটিশ চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।
পরবর্তীতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইসরায়েলকে দিয়েছে সামগ্রিক রাজনৈতিক সুরক্ষা। আজকের দিনেও গাজায় প্যালেস্তাইনি গণহত্যায় সামগ্রিকভাবে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে অ্যামেরিকা। দেশে দেশে মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডে অ্যামেরিকার ভূমিকা সভ্যতাগর্বী এ রাষ্ট্রটির জন্যে চরম লজ্জাজনক। ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে, ইসরায়েলের নিরন্তর নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষাকারী দেশগুলোর কোনো মানবিক জিজ্ঞাসা নেই। ‘আকাশে উড়ছে মৃত বিবেকের ধোঁয়া’। আর জাতিসংঘের দশা তো কবি আগেই বলে গেছেন:
‘জ্ঞানের বিষাদ এসে দাঁড়িয়েছে হত্যার বিজ্ঞানে
কেবল প্রযুক্তি খোঁজে শাদামাথা হত্যার নায়ক
সিদ্ধহস্ত খুনীদের নব্যতর বিশ্বের বিধানে
এক ঠ্যাঙে বসে আছে জাতিসংঘ বিবেকের বক।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত নিউইয়র্ক অফিসের পরিচালক ক্রেইগ মখাইবার যিনি দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি জাতিসংঘ ও অ্যামেরিকার ব্যর্থতায় চরম হতাশ হয়ে পদত্যাগ করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার হাইকমিশনার ভলকার টার্কের কাছে লেখা ইস্তফা পত্রে তিনি লিখেছেন:
This is a textbook case of genocide.
গাজায় ২০২৩ এসেও যা ঘটছে তা নির্বিবেক হত্যাযজ্ঞ। গণহত্যার এমন নির্মম বাস্তবতা কোনো সভ্য পৃথিবীর কথা বলে না, সভ্যতার কথা বলে না। বলে নির্বিবেক ও পরাজিত পৃথিবীর ওপর ইসরায়েলি তথা মার্কিন তথা পশ্চিমা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের কথা।
এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানের অসলো চুক্তিকে তিনি আর প্রযোজ্য মনে করেন না। সংঘাত নিরসনে ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রকরণে বিশ্বাসী তিনি। এবং সম নাগরিক মর্যাদার ভিত্তিতে
এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভেতর সমাধান নিহিত বলে তিনি মনে করেন।
ফিলিস্তিনিদের পাইকারিভাবে হত্যা নীতির প্রতিবাদ করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ব্রতী লড়াকু আইনজীবী মখাইবার।
অ্যামেরিকার সরাসরি সাহায্যে প্যালেস্টাইন এক সম্প্রসারিত কবরস্থানে রূপান্তরিত হয়েছে বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে। আগ্রাসী ইসরাইল এবং তার মিত্র অ্যামেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদেরকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রবক্তা দাবি করলেও তাদের দ্বিচারিতা ইতিহাসে অন্যায় চর্চায় প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সামরিক সহায়তা পুষ্ট ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের অস্তিত্ব মুছে দিতে সতত উদ্যত মধ্যপ্রাচ্যের বুক থেকে। ৭ই অক্টোবরের পর থেকে এই ১১ই অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি দশ মিনিটে একজন করে শিশু হত্যা করছে ইসরায়েলি সৈন্যবাহিনী। গত ৭ই অক্টোবর থেকে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত ২৬দিনে ইসরায়েলের অমানবিক ও নৃশংস হামলায় উপত্যকাটিকে ৯ হাজার ৬১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৬০জন শিশু। এবং যে ২হাজার ৬০০ জন নিখোঁজ রয়েছে তার মধ্যে ১ হাজার ১৫০জন শিশু রয়েছে। ফিলিস্তিনের আগামীকে হত্যা করার জন্যে ইসরায়েলের এ এক সুপরিকল্পিত যুদ্ধ। অথচ যুদ্ধ বিরতির কোনো পশ্চিমা প্রচেষ্টা নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন শর্তাধীন যুদ্ধ বিরতির কথা বলেছেন। হামাসের হাতে ইসরায়েলি যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির দাবিই তার দাবি। প্যালেস্টাইনি শিশু নারী ও আমজনতার কোনো দাম নেই ইসরায়েলিদের কাছে। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধে জড়িত ইসরায়েল।
জাতিসংঘের সাধারণ সংঘ আনীত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতি জানায়নি অ্যামেরিকাসহ চৌদ্দটি পশ্চিমা দেশ। তারা হামাসের সন্তান ও ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্যে মরিয়া। এ-কোন্ সভ্যতা পশ্চিমাদের এ জিজ্ঞাসা আজ বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।
চলমান আগ্রাসী আক্রমণ নিরন্তর চালু রাখার জন্যে বাইডেন ইতোমধ্যে কংগ্রেসকে ১৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মার্কিন সাহায্য প্যাকেজ অনুমোদনের আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে ইসরায়েল বাছবিচারহীনভাবে হত্যাযজ্ঞ মেতে আছে। ভূমিচ্যুত প্যালেস্টাইনিদের শরণার্থী বানাচ্ছে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে। চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে আহতদেরকে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গাজার ৩৫টি হাসপাতালের ১৬টি। এসবের মোকাবেলায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডানই একমাত্র দেশ যে দেশটি ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক অবনমিত করেছে। নিজের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে সরে যেতে বলেছেন।
তার একদিন পর দূরান্তের দেশ ল্যাটিন আমেরিকার বলিভিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তেল আবিব ছেড়ে গেছে রাষ্ট্রদূত।
রাজধানী হিসাবে জেরুজালেমকে কেন্দ্রে রেখে নদী থেকে সমুদ্র অবধি এক মুক্ত স্বাধীন প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠার যে ন্যায্য আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী নির্লজ্জ বেশরম ও পাশবিক আক্রমণ আগ্রাসনে এখন তা ছিন্নভিন্ন। নানা জাগতিক লাভালাভ ও সংকীর্ণ ধর্মীয় স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্য এতটাই বিভক্ত যে ইসরায়েল তাদেরকে থোড়াই কেয়ার করছে। আশার কথা এই যে, সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠে একটি স্লোগান –
From the river to the sea Palestine will নব ফ্রেএ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এডওয়ার্ড সাইদের অনুগামীরাও একই স্লোগানে উচ্চকিত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইসরাইলের পক্ষে পশ্চিমের দেশগুলোর একযোগে দাঁড়ানো এবং আসুরিক ভূমিকা পালন গণতন্ত্রের চর্চাকে সমাধিস্থ করার প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্বিত করছে।
ফিলিস্তিনের শতভাগ মানুষ স্বাধীনতা চায়। শান্তি চায়।তারা উগ্রতা চায় না। তারা হামাসের যুদ্ধংদেহী মনোভঙ্গি পছন্দ করে না। আর এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে যে আগ্রাসী ইসরায়েল ও সাম্রাজ্যবাদী অ্যামেরিকা তাকেও ঘৃণা করে। কিন্তু অ্যামেরিকা এ বাস্তবতাকে কখনও আমলে নিতে চায় না। এ যাবৎ নেয়নি। যে কারণে সাম্প্রতিক হামলার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন যে, হামাসের হামলা ‘did not happen in a vacuum’ আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় একটি ৭ই অক্টোবর অকারণে ঘটেনি তার পেছনে রয়েছে অজস্র হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ইতিহাস। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরকে দখল করে নিয়েছে। এখন ফিলিস্তিনের দক্ষিণ দিককার প্রদেশ গাজাকে নিশ্চিহ্ন করার নির্বিচার ও নির্বিবেক পাশবিক উন্মত্ততায় মেতে আছে। মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার অধিকার অর্জন করতে হলে মানবাধিকার সুরক্ষার কাজ করতে হয়। সে-কাজ অ্যামেরিকা-ইসরাইল করেনি। আজও করছে না। তাদের হাত বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে প্যালেস্টাইনি শিশুদের রক্তে ভেজা। এবং শক্তির ভাষাই হয়ে উঠেছে একমাত্র ভাষা। তারা গাজাকে বানিয়েছে পৃথিবীর নৃশংসতম নির্যাতন শিবির। তাদের আক্রমণের শিকার অপাপবিদ্ধ শিশু, গর্ভবতী নারী, নিরপরাধ হাসপাতাল, হাসপাতালের চিকিৎসাসন্ধানী পঙ্গু উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনি গণমানুষ। কালের পরিক্রমায় সমস্ত অধিকার থেকে ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জীবনের হর্তাকর্তাবিধাতা। স্বাধীনতাপাগল নিজবাসভূমে পরবাসী একটি জাতির তাঁবু জীবনের আলেখ্য কোনো সভ্য পৃথিবীর বার্তা বহন করে না। দুর্ভাগ্য এমনই যে, দু একটি ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ২২টি আরবদেশ সাক্ষীগোপালের মতো এখনও অবলোকন করছে ফিলিস্তিনিদের অরুন্তুদ জীবনেতিহাস।
যে স্বাধীনতার জন্যে ফিলিস্তিনিদের রক্তদীপময় প্রাণদান পৃথিবীতে দীর্ঘ ৭৫বছর ধরে মানবজাতির নিষ্ঠুরতার ইতিবৃত্ত রচনা করে চলেছে সেই ফিলিস্তিনের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইউসেফ এস ওয়াই রামাদানের কথাটি সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের মনের কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর কথায়:
‘একটা কথা জেনে রাখুন, নিজ দেশে নিজ ঘরের দাওয়ায় বসে জুতো পরিষ্কার করা একটা পরাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হওয়ার চেয়ে সম্মানজনক।’
মানুষের মঙ্গলই হোক মানুষের ভবিতব্য।
মুজিব রাহমান
কবি, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক