ইউসুফ মুহম্মদ :
আমরা সবাই জানি শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানুষের মন ও মননের বিকাশ ঘটায় এবং শান্তি ও সৌহার্দ্য স্থাপনে এর বিকল্প মেলা ভার। এ বিষয়টি মাথায় রেখে এবং সার্কভুক্ত দেশসমূহের কবি, সাহিত্যিক ও চিন্তকদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি ও সৌহার্দ স্থাপনের লক্ষে এবং সাংস্কৃতিক সংযোগের মাধ্যমে সার্ক অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-কল্পনায়, সার্কের গঠন-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটারর্স এ্যান্ড লিটারেচার (ফসওয়াল) প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রখ্যাত লেখক অজিত কাউর ১৯৮৭ সালে এর গোড়াপত্তন করেন। ‘সার্ক এপেক্স বডি’ হিসেবে ফসওয়ালকে ইতিমধ্যে সম্মানিত করা হয়েছে। তিনি ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘একাডেমি অব ফাইন আর্টস।’
অজিত কাউর পাঞ্জাবি ভাষার সুপরিচিত গল্প লেখক। ইতিমধ্যে তাঁর ২৮টি গল্প, উপন্যাস ও উপন্যাসিকা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা ও গল্পের অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ৯টি। তাছাড়া তাঁর সম্পাদিত বহু প্রবন্ধ ও স্বনামখ্যত জার্ণাল রয়েছে, যেগুলোর সংখ্যা ২০-এর অধিক। তাঁর বেশকিছু গ্রন্থ ইংরেজিসহ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ১৯৮৬ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ও ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী লাভ করেন। লেখালেখির ব্যস্ততার মধ্যেও ফসওয়াল প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি একক প্রচেষ্টায় প্রতি বছর নিয়মিত দুটি করে সাহিত্য উৎসব আয়োজন করে থাকেন । এ যাবত ৬৪টি সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উৎসবসমূহের ব্যয় তাঁর নিজের বা তাঁর মেয়ে অপর্ণা কাউরের শিল্পকর্ম বিক্রির অর্থে নির্বাহ করা হয়।
এসব সাহিত্য উৎসবে উপস্থিত লেখকদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে হৃদয়ের বন্ধন তৈরি হয়, তাঁদের একই রজ্জুতে আবদ্ধ করে এবং লেখকরা বিশ্বব্যাপী শান্তির বাণী প্রচারের সুযোগ লাভ করেন। এই শীতের মৌসুমেই ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ফসওয়াল লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল।
ফসওয়াল লিটারেচার ফেস্টিভ্যালের এবারের বিষয় ছিল বুড্ডিজম, সুফিজম ও ভক্তি। এর ভিত্তিতে চিন্তাবিদরা
Budhism and its influence on peace and tranquility in the South Asian region,’ `Sufism and its impact on peace and tranquility,’ Bhakti and its impact on peace and tranquility,’ and `Sharing with you my most favourite book’- বিষয়ে প্রতি সেশনে আলোচনা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কথাসাহিত্যিক অজিত কাউর স্বাগত বক্তব্য রাখেন। সার্ক অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে যাঁরা ফসওয়াল সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দকে ধন্যবাদ ও স্বাগত জানান এবং বলেন, আমরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বন্ধুদের এবার মিস করছি। স্রষ্টা যেন তাদের দ্রুত আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনেন।
তিনি বলেন, সার্ক অঞ্চলে আমরা আমাদের মেঘ, বর্ষা ভাগাভাগি করার পাশাপাশি আমাদের পাখি, আমাদের মহাসাগর এবং নদী, আমাদের উদ্ভিদ এবং প্রাণী, দীর্ঘদিনের সভ্যতা, আনুভূমিক ও উল্লম্বভাবে, মাইক্রো এবং ম্যাক্রো স্তরে ভাগাভাগি করে থাকি। একইভাবে আমরা আমাদের দুঃখ-বেদনাও ভাগ করে নিই।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের সমস্ত সংবেদনশীল মানুষ বেদনায় কাতর এবং যন্ত্রণাবিদ্ধ। দুটি নির্বোধ যুদ্ধই এর কারণ। যুদ্ধে যা হয়, শিশু ও বৃদ্ধদের এবং অবশ্যই যুবক, যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে তাদের হত্যা করা হয়। আক্রমণকারীরা বিধ্বংসী সমরাস্ত্রে সুন্দর শহরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বোমা হামলা শুরু হয় এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরু হয়। সব যুদ্ধেই ভুক্তভোগী হয় নিরীহ মানুষ।
ভারতে আমরা ক্রমাগত সন্ত্রাসবাদের শিকার ও লক্ষ্যবস্তু এবং আমাদের সীমান্ত ক্রমাগত উত্তপ্ত যুদ্ধের শিকার। আমরা সন্ত্রাস, যুদ্ধের বেদনা ও যন্ত্রণা জানি। আমি বিশ্বাস করি সশস্ত্র বাহিনী, নেভি ও বিমান বাহিনীর লোকও গভীরভাবে দুঃখ অনুভব করে, মনে গভীর আঘাত পায়। কেননা তারা রোবট নয়, তারাও মানুষ, মানুষের অনুভূতিসহ প্রাণী।
তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয় প্রথম দিনের (৩ ডিসেম্বর, ২০২৩) অধিবেশন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রফেসর রেণুকা সিংহ। এতে সভাপতিত্ব করেন ড. মাধব কৌশিক। ভক্তি, বুদ্ধ মতবাদ ও সুফি মতবাদ সম্পর্কে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে প্রফেসর হারবাং মুখিয়া, প্রফেসর কে টি এস সারাও ও সাইল মায়ারাম। দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘দুটি নির্বোধ যুদ্ধের যন্ত্রণা’ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন নেপাল থেকে আগত প্রফেসর আবিহ সুবেদি, ভারতের এম এল লাহুতি ও এইচ এস ফুলকা প্রমুখ। এ সেশনে সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন গভর্ণর এন এন ভোরা। পরের অধিবেশনে ফসওয়াল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। এটি ছিলো বেশ আকর্ষণীয়। এতে পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকদের উদ্দেশ্যে সম্মাননাপত্র পাঠ করেন ড. ভনিতা। এবারের উৎসবে বাংলাদেশের লেখক, প্রফেসর ফখরুল আলম, ভূটানের ছাদর ওয়াঙমো, নেপালের মেঘরাজ শর্মা (মনজুল) ও গোবিন্দ গিরি প্রেরণা এবং শ্রীলঙ্কার ড. কানদিয়াহ শ্রীগণেশানকে তাঁদের সাহিত্য কর্মের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। অতপর সম্পন্ন করা হয় এ সময়ে প্রকাশিত লেখকদের পুস্তক প্রকাশনা অনুষ্ঠান। এতে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন প্রফেসর আখতারুল ওয়াসি। কবি ও গল্পকারদের স্বরচিত কবিতা ও গল্পের নির্বাচিত অংশ পাঠ করা হয় বিকেলের অধিবেশনে। কবিতা পাঠে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের কবি ড. বিমল গুহ, আশরাফ জুয়েল ও সৌম্য সালেক, ভারতের কবি ড. মন্দিরা ঘোষ, প্রফেসর কল্যাণী রাজন, প্রফেসর নন্দিনী সাহু, পানকৌরী শুকলা, গায়ত্রী মজুমদার, কিংশুক গুপ্ত, সীমা জেইন ও সুশমিন্দরজিত কাউর, নেপালের কবি সংস্কৃতি দেওয়ারী ও শ্রীলঙ্কার কবি কে. শ্রীগণেশান। এ সেশনসমূহে সভাপতিত্ব করেন রাষ্ট্রদূত ড. অমরেন্দ্র খাটুয়া ও ভুটানের কবি ড. রিনজিন রিনজিন। বাংলাদেশের কবি ডাক্তার আশ্রাফ জুয়েলের সঞ্চালনায় অন্য এক সেশনে অনুষ্ঠিত হয় গল্পের নির্বাচিত অংশ পাঠ। এতে গল্প পাঠে অংশগ্রহণ করেন শ্রীলঙ্কার সামান্তা ইলাগাকুন ও ড. নিপুনিকা ডিলানী মাদুগোডাগি, নেপালের ড. সন্তোশ কুমার পোখরেল। এ সেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের কবি, অনুবাদক ও গল্পকার অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। একইভাবে পরবর্তী দিবস অর্থাৎ ৪, ৫ ও ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানকে ৬টি পর্বে ভাগ করা হয়। কোনো পর্বে যুদ্ধ ও এর ধ্বংসলীলা তুলে ধরা হয়, কোনো পর্বে ফিকশন ও কবিতা পাঠ করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান থেকে প্রায় ১৫০জন কবি, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ থেকে আমরা যারা আমন্ত্রিত হয়েছিলাম তাঁরা নির্ধারিত তারিখের আগের দিন অর্থাৎ ২ ডিসেম্বর দিল্লি পৌঁছে যাই। রাতে খাবার টেবিলে অনেকের সাথে দেখা হয়। আমাদেরকে রাখা হয় নয়দার বুটানিক্যাল ইন্সটিটিউটের ডরমিটরিতে। এ ডরমিটরির চারদিকে ফুল ও বিভিন্ন জাতের বৃক্ষের শোভা ও সৌন্দর্য খুবই আকর্ষণীয়। ভোরে পাখির গান আর প্রজাপতির নৃত্য দেখতে দেখতে চলে আমাদের প্রাতরাশ। সকাল সাড়ে আটটায় আমরা সবাই, সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে যারা এসেছেন তারাসহ এক গাড়িতেই রওনা দিই অনুষ্ঠান স্থলের দিকে। অনুষ্ঠানের মূল ভেন্যু ছিল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে। এটা নয়দা থেকে প্রায় ৪০ কি. মি. দূরে। নয়দা নতুন শহর বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, প্রশস্ত রাস্তা … সবমিলে মনে রাখার মতো। অন্যান্যদের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে আড্ডা দিতে দিতে আমরা যথাস্থানে পৌঁছে গেলাম, সময় লাগলো পঞ্চাশ মিনিট । চাপর্ব শেষে যথা সময়ে শুরু হয় সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন ও মূল অনুষ্ঠান, এ প্রসঙ্গে আগেই বলেছি। বাংলাদেশ থেকে আমরা আরও যারা অংশগ্রহণ করেছি তারা হচ্ছেন, প্রফেসর আবদুস সেলিম, কবি কামরুল হাসান, সাহেদ কায়েস, সিহাব শাহরিয়ার, ইউসুফ মুহম্মদ ও সেঁজুতি বড়–য়া।
অনুষ্ঠানের শেষ দিন ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখ ছিল দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন। কবি, গবেষক ও ইতিহাসবিদ রবিনসনের ধারা বর্ণনায় এ ভ্রমণ ছিলো খুবই আকর্ষণীয়। এ যাত্রায় আমরা মোগল স¤্রাট হুমায়ুন সৌধের অনেক অজানা তৈথ্য জানতে পারি। এ সৌধে প্রবেশের পথে হানিকম্ব দেখার মাধ্যমে আমরা পরিদর্শন শুরু করি। এটি আমি আগেও দেখেছি, কিন্তু এবারের দেখা যেনো ভিন্ন এক চোখে। হুমায়ুন ও তাঁর কবরের ওপর নির্মিত সৌধের স্থাপত্য-কারুকাজ দেখে হৃদয় তৃপ্ত হয় নতুন মাত্রায়। লাল বেলেপাথর দ্বারাএটি নির্মিত হয়েছিল ১৫৬০ সালে। এই ধরনের ভবন নির্মাণে এ পাথর প্রথম ব্যবহার করা হয়। দূর থেকে দেখলে তাজমহল বলে ভ্রম হয়। অনেকে মনে করেন এই স্থাপত্য দেখেই শাহজাহান তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের কবরের ওপর তাজমহল নির্মাণ করেন। তবে সফেদ সাদা পাথরে। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর প্রথম স্ত্রী বেগা বেগম পার্সি স্থাপত্য নকশায় এ কীর্তি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো এই স্মৃতিসৌধকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ স্মৃতিসৌধে হুমায়ুন ছাড়াও মোগল পরিবারের প্রায় ১৬০ জনের কবর রয়েছে। আরো রয়েছে স¤্রাট হুমায়ুনের স্ত্রী বেগা বেগমের সমাধি। এটা দেখে ইতিহাস খুঁড়তে খুঁড়তে আমরা ফিরে আসি সাহিত্য একাডেমিতে। এদিন শেষ হয় দিল্লিতে আমাদের সাহিত্য ভ্রমণ। অনাড়ম্বর তবে গুরুত্বপূর্ণ এ উৎসবে উপস্থিত থাকতে পেরে অনেক গুণি মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার ও তাঁদের সান্নিধ্য লাভ করার সুয়োগ হয়। এতে আমি আলোকিত ও পুলকিত হয়েছি। আমার অনেক কিছু শেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে, যা পরম প্রাপ্তির ও তৃপ্তির।
ইউসুফ মুহম্মদ, কবি ও প্রাবন্ধিক