মোহিত কামাল
পৌষমেলা বসেছে রমনার বটমূলে। তারই লাইভ শো দেখাচ্ছে একটি টিভি চ্যানেল।
আদুরে পৌষ মাসে ঘরে ঘরে নতুন ধান উঠেছে। কৃষাণীর কর্মমুখর ঘামঝরানো শ্রম চষে নতুন ধান থেকে বেরোয় নতুন চাল। চালের গুঁড়া থেকে তৈরি হয় পিঠে পুলি পাটিসাপটা এবং ঘন তাজা দুধ মিশিয়ে বানান হয় দৃষ্টিনন্দন নানা রকম পিঠা। খেজুরের রস, আখের রসসহ লোকজ মিষ্টির পিঠা শহরেও পাওয়া যায় এ সময়। গরম গরম ভাপা পিঠা ও চিতই পিঠার মজা নিচ্ছে নগরবাসী। টিভি চ্যানেলে ভেসে উঠেছে আনন্দঘন সেই সব দৃশ্যপট। গ্রামের দৃশ্য হানা দেয় শহুরে রান্নাঘরেও। গ্রাম থেকে পাঠানো নতুন চালের গুঁড়ার পিঠা দিয়ে সাজানো হচ্ছে খাবার টেবিল।
সাজানো টেবিলের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালেন ইমরান নুর। দুধসাদা রঙের পাটিসাপটার দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি।
রুবিনা নুর, ইমরান নুরের স্ত্রী কিচেন থেকে খাবার টেবিলে এসে সরিয়ে দিলেন টেবিলে সাজান পাটিসাপটার প্লেট।
চোখ তুলে তাকালেন স্বামী। অসহায় কণ্ঠে বললেন, সরাচ্ছ কেন?
এ প্লেট তোমার জন্য না। তোমারটা আলাদা। এটা পাভেল আর রুমুর জন্য।
আলাদা কেন আমারটা?
চিনি, চিনি তোমার শত্রু। ডায়াবেটিস রোগীদের জিব সামলাতে হয়। জীবনে অনেক খেয়েছ। এবার জিহ্বা সামলাও। রোগ সারাও।
‘পৌষ এনেছে বিজয়ের উত্তাপ’-পৌষমেলার স্লোগানটার উত্তাপ কেড়ে নিল রুবিনা। রুবিনার কথার তোড়ে ভেসে গেল আনন্দ। মনে পড়ে গেল ডায়াবেটিসের রোগী তিনি। মিষ্টি, মিঠা, চিনিজাতীয় খাবার নিষিদ্ধ করেছেন চিকিৎসক। এখন তৈরি হচ্ছে নিষেধ অমান্য করার ইচ্ছা। নড়েচড়ে বসে ইমরান নুর বললেন, সবাই আনন্দ করছে। আনন্দে শরিক হতে দাও, আজ খেয়ে নিই। আর খাব না।
প্রতিদিন একই কথা বল, ‘আর খাব না’ শুনতে শুনতে কান পচে যাচ্ছে।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এবারই শেষ। সারা বছর পৌষ থাকবে না। পৌষের ম-ম গন্ধ থেকে বঞ্চিত কোরো না, প্লিজ।
কঠিন গলায় রুবিনা উচ্চারণ করলেন, না।
শক্ত ‘না’ শুনে দমে গেলেন ইমরান নুর। সাজানো খাবারের প্রতি লোভ আরও বেড়ে গেল। লালসা ফুটে উঠল চোখেও। করুণভাবে তাকিয়ে থাকলেও মন টেবিলে নেই। মন উড়ে গেছে শৈশবে
ভোরের কুয়াশা ঠেলে বেরিয়েছে পূর্বাকাশের কাঁচা সূর্য। বাড়ির উঠোনের এক কোনে মাটির চুলায় পিঠা ভাজছেন মা। চুলার চারপাশ ঘিরে বসেছে পাঁচ ভাইবোন। গান গাইছে ছোট ভাই অপু। একটা করে নামছে চিতই পিঠা। গরম গরম পিঠা নিয়ে কাড়াকাড়ি। হইচই। আহা! কতই না আনন্দের সেই দিন। কতই না মমতার সেই দিন! ফিরে কি আসবে আবার কখনো…
অমন বোকার মতো তাকিয়ে আছ কেন? ধমক দিলেন রুবিনা।
ধমক খেয়ে শৈশব থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন ইমরান নুর। কথার জবাব দিলেন না। টেবিল থেকে উঠে যাচ্ছিলেন।
রুবিনা আবার ধমক দিয়ে কমান্ড করলেন, বসো। উঠছ কেন। ডায়াবেটিক সুগার দিয়ে তোমার জন্য মালকোঁচা পিঠা বানানো হচ্ছে। ধৈর্য ধরতে পার না! লোভ সামলাতে পার না? নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পারলে চলবে? আরও কমপক্ষে বারো বছর বাঁচতে হবে তোমাকে।
দুম করে বসে পড়লেন ইমরান নুর। চোখ তুলে তাকালেন রুবিনার দিকে। এ সুন্দর পৃথিবীতে মাত্র বারো বছর তাঁর আয়ু আশা করছে রুবিনা? বারো বছর পর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে ওর! হায়! জীবন এত ছোট কেন? এত ছকে বাঁধা কেন?
কেন? বারো বছর কেন? আর একটু বেশিদিন বাঁচলে অসুবিধা আছে তোমার?
না। বেশিদিন বাঁচলে অসুবিধা নেই। অসুবিধা আছে কম বাঁচলে।
অসুবিধাটা কী?
আহা! যেন কিছু বোঝে না! কচি খোকা! এই যে ফ্ল্যাটটা নিয়েছ লোন তুলে, কিস্তি পরিশোধ করছ। পনেরো বছরের কিস্তিতে মাত্র তিন বছর গেছে। মাঝপথে মরলে সাগরে ভেসে যাব না? কী হবে আমাদের? থাকার জন্য বস্তিতেও জায়গা পাব না আমরা।
ওহ! বুঝেছি। মনে মনে বললেন ইমরান নুর বেঁচে থাকতে হবে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য। এ জগতে বেঁচে থাকার আর কোনো যুক্তি নেই?
কংক্রিটের দেয়ালের দিকে তাকালেন তিনি। মনে হচ্ছে, প্রাণ আছে, জীবন আছে ওই দেয়ালের। দাঁড়িয়ে থাকবে বছর বছর। একজন মানুষ টুপ করে ঝরে যায়। নিষ্প্রাণ হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করে, কঠিন দেয়ালকে আর কঠিন মনে হলো না। মনে হলো নরম। মনে হলো মানুষ না হয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ভালো হতো। অন্তত অনেক বছর দাঁড়িয়ে থাকা যেত!
ঘোষণা হচ্ছে টিভিতে। পৌষমেলার অনুষ্ঠান জমে উঠেছে। এখন কবিতা আবৃত্তি করবেন জয়তু দেব। ঘুরে বসলেন ইমরান নুর। রুবিনা চলে গেছে কিচেনে। একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন রুবিনার দিকে। মনে হলো এক অপরিচিতা নারী সরে গেল সামনে থেকে। এই নারী ভালোবাসে বাস্তবতাকে। ভালোবাসে কংক্রিটের পিলারে গড়ে ওঠা ফ্ল্যাটবাড়িটাকে।
আবৃত্তি শুরু করেছেন গুণী বাচিকশিল্পী। মনোযোগ দিলেন ইমরান নুর। জয়তু তাঁর প্রিয় আবৃত্তিকার। ক্যাসেটে শুনেছেন তাঁর আবৃত্তি। মুগ্ধ হয়ে শুনতেন, তাঁর দরাজ গলার সঙ্গে মিশে যেতেন। মিশতে পারছেন না এখন। তাঁর হাতে বই; পড়ে পড়ে আবৃত্তি করছেন তিনি! আবৃত্তিকার আবৃত্তি করবেন মুখস্থ। তাকিয়ে থাকবেন দর্শকদের দিকে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তা দেখে প্রাণ জেগে উঠছে না পৌষের কবিতায়। এত বড় আবৃত্তিকারের একি দশা! টেলিভিশনে মুখ দেখানোর দরকার নেই তাঁর। জনপ্রিয় নাট্যশিল্পীও তিনি। মুখস্থ না করে কেন গেলেন সেখানে? ‘পৌষ এনেছে বিজয়ের উত্তাপ’-এই স্লোগান মাটি হয়ে গেল। মাটি হচ্ছে খাঁটি। খাঁটি জিনিসও মনে হচ্ছে খাঁটি না, মাটি করে দিচ্ছে মনের ভেতরের পৌষের ডাক।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বাইরের করিডরে এলেন ইমরান নুর। কুয়াশা-মাখা ভোরের ঠান্ডা বাতাসে বড় করে শ্বাস নিলেন। নিঃশ্বাস ছেড়ে তাকালেন দরজার দুপাশে দুটো টবের দিকে। দুটো পিটুনিয়া ফুল ফুটে আছে দুই টবে। পিটুনিয়া ফুল ফোটে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে। পুষ্পবিজ্ঞানের কল্যাণে পিটুনিয়ার কিছু হাইব্রিড জাত এসেছে দেশে বাণিজ্যিক কারণে। গ্রীষ্মের চেয়ে শীতেই এখন ভালো ফুল দেয় এসব জাত। টবের পিটুনিয়া হচ্ছে চেরি ফ্রস্ট জাতের। এটার নাম ব্লু ফ্রস্ট। ফুলটির কোঁচকানো পাপড়ির কিনারা বরাবর রয়েছে সাদা বোর্ডার। আর পুরো পাপড়ির রং নীল।
‘নীল’ দেখার সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল মনের মধ্যে জমে ওঠা কষ্টের নীল রং। তাজা রং জেগে ওঠায় ফুর্তি এল মনে। আর বাস্তববাদী মনে হলো না রুবিনাকে। মনে হলো ফুলবাদী সে। এমন আবেগের চাষ করতে পারে যে তাকে আবেগবাদীও বলা যেতে পারে। পৌষের সকালে নীল রঙের জন্য তাজা ভালোবাসায় ভরে উঠল মন। সেই মন নিয়ে ফিরে গেলেন ডাইনিং টেবিলে।
ডায়াবেটিক সুগার দিয়ে মালকোঁচা পিঠা বানিয়ে টেবিলে রাখল রুবিনা। চামচ দিয়ে একটু করে তুলে দিল ইমরান নুরের মুখে। পৌষের স্বাদ পেলেন মালাকোঁচা খেয়ে। মুগ্ধ চোখে তাকালেন বউয়ের দিকে। এ সময় ছুটে এল রুমু। সাত বছরের রুমু বলল, আমাকেও দাও আম্মু।
মালকোঁচার প্লেট টেবিলে রেখে পাটিসাপটার প্লেট তুলে নিলেন রুবিনা।
রুমু বলল, এটা না, আম্মু। ওইটা খাব। আব্বুকে যেটা খাওয়ালে সেটা দাও।
ওঠা তোমার আব্বুর জন্য আলাদা করে বানান। ওষুধ আছে ওটাতে।
না। আব্বুরটা খাব। এটা খাব না আমি।
চোখ তুলে রুবিনা তাকালেন স্বামীর চোখের দিকে। বুঝিয়ে দিলেন তোমারটা মেয়েকে খাওয়ানো যাবে না। এখন সামলাও মেয়েকে।
রুবিনার চোখের ভাষা পড়তে দেরি হলো না ইমরান নুরের। মেয়েকে দ্রুত বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, যেটা আমি খাব, সেটাই খাবে তুমি?
রুমু মাথা দুলিয়ে মুখে ছোট্ট করে শব্দ করল, হুঁম।
ঠিক আছে মামণি, এই যে, এটা খাচ্ছি আমি। তুমিও খাও, বলে পাটিসাপটার প্লেট থেকে লম্বা একটা পিঠা তুলে মুহূর্তে কামড় বসিয়ে দিলেন নুর। সঙ্গে সঙ্গে রুমুও পাটিসাপটা খেতে শুরু করল।
রুবিনার দিকে তাকাচ্ছেন না ইমরান। মেয়ের সঙ্গে খেতে লাগল সুস্বাদু পিঠা। একটার পর একটা, তিনটা পিঠা সাবাড় করে দিলেন প্লেট থেকে। তারপর বিজয়ীর বেশে তাকালেন স্ত্রীর মুখের দিকে।
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন রুবিনা। বুঝে গেলেন, এমন গোগ্রাসে গিলে খেলে বিপদ হবে ডায়াবেটিসের রোগীর। এ ধরনের রোগীদের লোভ সামাল দেওয়া কঠিন। কঠিনের সামনে আরও কঠিন হতে হবে নিজেকে। ক্ষুব্ধ চোখে স্বামীর ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকালেন রুমুর দিকে। বাবার সঙ্গে আনন্দ নিয়ে মেয়ে উদযাপন করছে পৌষের সকাল। ক্ষতি কি! মেয়ের আনন্দই পরিবারের আনন্দ! এ আনন্দ থেকে ফেরাতে চাইলেন না স্বামীকে। রেগে গিয়েও ঠান্ডা হয়ে গেলেন। সরে গেলেন সামনে থেকে।
দুই
হাতে মুখের ভর রেখে টেবিলের সামনে কিছুটা ঝুঁকে চেয়ারে বসে আছেন ইমরান নুর। টেবিলে বসে থাকলেও মন নেই সেখানে। মন কোথায় আছে জানেন না। জানার মতো আগ্রহও নেই। কিছুটা শূন্য চাউনি। শূন্য অভিব্যক্তি নিয়ে দেখছেন সামনের দেয়াল। দেয়ালে ঝোলান আছে নতুন বছরের একটা ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারে হাসছে এক চঞ্চল কিশোরী। বুকের কাছে দুহাতে মুঠি করে ধরে আছে সে একটা রজনীগন্ধার স্টিক। ফুলের মতো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নড়ে বসলেন নুর।
লেখার কাগজ আর বল পয়েন্ট টেনে বসে গেলেন লিখতে। মন ভালো থাকলে লেখার টান আসে ভালো। বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে, বুঝতে পারেন। পরিশ্রম মানে বাড়তি ইনকাম। ইনকাম মানে ফ্ল্যাট-লোনের কিস্তির টাকা শোধ করার সহজ পথ খুলে রাখা। সহজ পথে থাকার অর্থ হচ্ছে চাপমুক্ত থাকা। চাপমুক্ত থাকার জন্য লিখছেন, তা নয়। চাপমুক্তি ঘটে লিখতে পারলে। সিরিয়াল নাটক চলছে তার। ইতোমধ্যে প্রতি সিরিজ থেকে ইনকাম হচ্ছে ভালো।
টান আসছে লেখার, গতিতে এগোচ্ছে কলম।
হঠাৎ খেয়াল করলেন, পাভেল এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
ছেলেকে দেখে থেমে গেল কলম।
কিছু বলবে, আব্বু?
হুঁম।
‘হুঁম’ বলার অর্থ খোশ মেজাজে আছে ছেলে। রুমুও খুশি থাকলে ‘হ্যাঁ’র জায়গায় ‘হুঁম’ বলে। ‘হুঁম’ শব্দটাও চট করে মনে জাগিয়ে দিল স্বস্তি।
একটু সময় নিয়ে তিনি বললেন, বলো, কী বলবে, বলে ফেলো।
পুরনো গাড়িটা চলছে না, আব্বু। ওটা বিক্রি করে আরও কিছু ভরে নতুন গাড়ি কিনো একটা।
কেন? চলছে না কেন? আমি তো দেখছি ভালো সার্ভিস দিচ্ছে।
ভালো সার্ভিস দিচ্ছে না। ইঞ্জিন প্রায় বসে গেছে। প্রতি সপ্তাহে বেশি মবিল খাচ্ছে। যেকোনও মুহূর্তে বসে যেতে পারে।
তাই নাকি? ড্রাইভার কিছু বলেনি কেন আমাকে?
যেভাবে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছ তুমি, ড্রাইভার কিছু বলার সাহস পায়নি।
ওহ। এজন্য তোমাকে দিয়ে বলাচ্ছে?
না। আমাকে দিয়ে বলাচ্ছে না। নিজে থেকে রিয়েলাইজ করেছি। আমার পক্ষ থেকে প্রোপোজাল দিচ্ছি তোমাকে। হয় ইঞ্জিন বদলাতে হবে, নয় নতুন গাড়ি কিনতে হবে।
তোমার প্রপোজাল ভেবে দেখতেই হবে। আমি ভেবেছিলাম, তোমাকে দিয়ে ড্রাইভারই বলাচ্ছে। গাড়ি গ্যারেজে গেলে ড্রাইভারদের লাভ। গ্যারেজ থেকে কমিশন পায় তারা। প্রায় প্রতিটা গ্যারেজের সঙ্গে এটা ড্রাইভারদের অলিখিত চুক্তি। ওদের টাকার প্রয়োজন হলে, গাড়ি গ্যারেজে ঢোকার হারও বেড়ে যাবে।
না আব্বু। এটা আমার দাবি। ড্রাইভারের না।
তোমার দাবির পেছনে যুক্তিটা কী?
সবকিছুতে যুক্তি খোঁজো কেন? যুক্তি দিয়ে সব দাবি বিচার করতে হয় না। তুমিই বলেছ, ভালো লাগা, মন্দলাগারও দাম দিতে হয়। গাড়িটা ভালো লাগছে না আর। ওটা দিয়ে তো প্রেস্টিজ থাকছে না।
প্রেস্টিজ থাকছে না কেন? এত সহজে প্রেস্টিজ হারানোর শঙ্কা কি ভালো?
শঙ্কা না আব্বু। সত্যি সত্যি ভালো লাগছে না গাড়িটা।
তাহলে অবশ্যই ভাবব আমি। কী করা যায়, অতিরিক্ত টাকাগুলো কোন খাত থেকে ম্যানেজ করা যায়, ভেবে তোমার সঙ্গে কথা বলব পরে।
থ্যাংকস্ আব্বু। কথা শেষ করে খুশি মনে ওর ঘরে চলে গেল পাভেল।
লেখা থেমে গেছে। ইমরান নুর বাড়তি চাপে পড়েছেন। কিন্তু এ চাপ বাস্তব চাপ দিচ্ছে না। ছেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা হয়েছে। পারিবারিক প্রেক্ষাপটে এমন কথাবার্তা প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগটা ভালো থাকলে সুখ থাকে ঘরে। সুখের কাঙাল ইমরান নুর, চাপকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। নতুন গাড়ি কিনতে হবে ভেবে টনক নড়ে গেল আবার। বুঝলেন বেশি ইনকামের জন্য বেশি লিখতে হবে। শ্রমের মধ্যে যদি রিক্রিয়েশন থাকে, সেটাকে বিনোদন হিসেবে দেখতে হবে। পরিশ্রম করছি, তেমন ভাবলে চলবে না। ‘পরিশ্রম করছি’ এ বোধও ভেতরে ভেতরে চাপ তৈরি করবে। চিকিৎসক বলেছেন, এ ধরনের চাপ গ্লুকোজ লেবেলের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা তৈরি করে। ভেতর থেকে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় দেহ। অনিয়ন্ত্রিত দেহ মনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে না। বড় করে শ্বাস ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। প্লেট দিয়ে ঢাকা গ্লাসটা তুলে দেখলেন, গ্লাস শূন্য। পানি নেই গ্লাসে। শূন্য গ্লাস দেখে মন খারাপ হলো না। মনে হতাশা জাগল না। সাধারণত ঢাকনা দেওয়া শূন্য গ্লাস সইতে পারেন না তিনি। এখন সইতে পেরেছেন। ভালো একটা গুণ তৈরি হচ্ছে। কেন তৈরি হচ্ছে? ছেলের সঙ্গে কথা বলে মন ভালো হয়েছে, এ কারণে?
হতে পারে। নিজেকে প্রবোধ দিয়ে ডাইনিং টেবিলে এলেন। পানির মগ যথাস্থানে নেই।
বুয়াকে ডাক দিয়ে ফেলেছিলেন প্রায়। ভেতরের ডাক থামিয়ে দিয়েছেন সাকসেসফুলি। এত ‘সাকসেস’ কেন আজ তিনি?
ছেলের সঙ্গে কথা বলে মন ভালো হলেও, এক্সট্রা টাকার চাপ থাকার কথা। অতিরিক্ত চাপ কোথায় পালাল? অবাক তিনি।
রুবিনা নুর বেরিয়ে এলেন গেস্টরুম থেকে।
কী খুঁজছ?
পানি খাব। মগ পাচ্ছি না। আমাদের ঘরে গ্লাসটাও খালি।
পানি খুঁজে না পেয়েও চিৎকার করছ না, এটা তো মানায় না তোমার স্বভাবের সঙ্গে।
স্ত্রী ঠান্ডা কথার ভেতর দিয়ে নিজেকে দেখলেন ইমরান নুর। সত্যি বলেছে রুবিনা?
এত ঠুনকো নিজের মেজাজ? এত অল্পতে চেঁচামেচি করেন? ভেতর থেকে আসা প্রশ্নের জবাব না খুঁজে তাকালেন স্ত্রীর মুখের দিকে। মনে হচ্ছে, পেরেশানিতে আছে সে।
এমন লাগছে কেন তোমাকে?
কেমন লাগছে?
মনে হচ্ছে, চাপে আছো।
কোনো উত্তর দিলেন না রুবিনা। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।
চাপে আছ? আবারও প্রশ্ন করলেন।
চাপে থাকলেও কি তোমাকে বলা যায় কিছু? বলার জন্য সময় খুঁজতে হয়, সুযোগ খুঁজতে হয়। বলা হয় না।
বলো। তোমার কথা শুনি।
চাপে আছি আমি, বুঝতে পেরেছ তুমি। এটাই আমার আনন্দ। এ মুহূর্তে চাপ চলে গেছে। আমার দিকে তোমার নজর আছে ভেবে ভালো লাগছে।
অপরাধবোধটা আবার হানা দিল মনে। বউয়ের দিকে নজর দেয় না, এমন বাজে স্বামী সে! অপরাধবোধটা কি রিয়েল, নাকি ফলস? মেপে দেখার চেষ্টা করলেন। মাপতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন না। তবে নিজস্ব উপলব্ধি নাড়িয়ে দিলআই অ্যাম হান্ড্রেড পার্সেন্ট ডেডিকেটেড টু মাই ফ্যামিলি। হান্ড্রেড পারসেন্ট ডেডিকেটেড টু মাই ওয়াইফ, সান, ডটার অ্যান্ড প্রফেশন, এজ ওয়েল এজ রাইটিংস। প্রফেশনের কারণে কি ওয়াইফকে অবহেলা করছেন? সন্তানদের অবহেলা করছেন? তাঁর লেখালেখি কি পরিবারের আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে?
উত্তর পেয়ে গেছেন নিজে থেকে অবহেলা করছেন না। অন্তর জুড়ে রয়েছে পরিবারের জন্য ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার বাইরের প্রকাশ ঘটাতে পারছেন না। এটা যথাযথ উত্তর। এই উত্তর খুঁজে পাওয়া উচিত ছিল রুবিনার। পায়নি। এটা তার ব্যর্থতা। দোষ থাকলেও, ব্যর্থ নয় নিজে। নিজেকে একশত ভাগ শুদ্ধ ভাবলেন মনের টানের কারণে। এ টানে কোনো ঘাটতি নেই ভেবে স্বস্তি খুঁজে পেয়ে বললেন, তোমাকে বুঝতে পাচ্ছি নাকখনো এমন আচরণ দেখেছ আমার প্রকাশভঙ্গিতে?
রুবিনা আবার বললেন, থাক, এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছি না এখন।
কখন দেবে? এখন দাও। এখন প্রশ্ন করছি। পরে উত্তর দিলে এখনকার অস্বস্তিটা আমাকে সারাক্ষণ জ্বালাবে না?
অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলো। অস্বস্তির কিছু নেই। খুশি হয়েছি। অল্পতে খুশি হই। বেশি কিছু চাই না তোমার কাছে। আমাকে বুঝলেই খুশি আমি।
ওহ।
থেমে গেলেন ইমরান নুর। একটু ব্রেক নিয়ে বললেন, তোমাকে বুঝি না কে বলল? অবশ্যই বুঝি। সেটার প্রকাশ দেখাতে পারি না বলে মনে কর বুঝি না।
থাক। ব্যাখ্যা দিতে হবে না। চলো আজ সবাই মিলে বাইরে খেয়ে আসি।
বাইরে খাওয়ার ইচ্ছা হয়। তবু স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিতে পারছেন না রুবিনার কথায়। পিছুটান লেগে গেছে জীবনের চাকায়। লোনের টাকায় ফ্ল্যাট কেনার পর খরচ কমানোর প্রবণতা ঢুকে গেছে মাথায়। সবকিছুতেই খরচ বাঁচানোর হিসাবটা নিজে থেকে করেন না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে। এই গোপন চিন্তাটা পুরো আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান নুরের। জানেন, রুবিনার আবদার বাতিল করে টাকা খুব একটা বাঁচান যাবে না। তবু হোঁচট খেলেন। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি সামলে উঠে স্থির গলায় বললেন, কোথায় খেতে চাও?
রাইফেলস স্কোয়ারের টপ ফ্লোরে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সেখানে দেশি ও চায়নিজ-দু ধরনের খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। চল, সেখানে যাই।
ঠিক আছে। রুমু-পাভেলকে প্রস্তুত থাকতে বোলো। আজ রাতে বাইরে খাব সবাই।
তিন
রাত প্রায় নটা। এখনই বেরোনো উচিত। পাভেল ও রুমু রেডি হয়ে টিভি দেখছে। রুবিনা গেস্টরুমে। গেস্ট এসেছে। রুবিনারই গেস্ট। উঠতে পারছেন না সে। গেস্ট বিদায় না হলে ওঠা সম্ভব না। তাঁদের বিদায়ও করতে পারছে না।
ইমরান নুর ডাকলেন পাভেলকে। বসার ঘর থেকে পাভেল উঠছে না। রুমু এল ডাক শুনে।
তোমার আম্মু কি রেডি?
আম্মু রেডি। মেহমান গেলে বেরোব আমরা। আম্মু বলেছে আমাকে আর ভাইয়াকে।
দেখে এসে, কী অবস্থা। মেয়েকে পাঠিয়ে স্বস্তি নিয়ে বসে আছেন নুর। গোপন একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছে গেস্টরা দেরিতে গেলেই ভালো। বেশি রাত করে গেলে আরও ভালো। রাইফেলস স্কোয়ারের প্রোগ্রামটা বাতিল হলে দুই থেকে তিন হাজার টাকার খরচ বেঁচে যাবে। প্রশ্নটা তাড়াতে চাইল মন থেকে। তাড়াতে পারছেন না। ছি! আমি কি কিপটে হয়ে যাচ্ছি! হাড় কিপটে! না, এমন হওয়া চলবে না। লোন নিয়েছি বলে কি জীবন থেকে বাতিল হয়ে যাব? হতে পারে না। প্রশ্ন করে নিজেকে চাঙ্গা করে তুললেন ইমরান নুর। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এলেন। ইচ্ছা ছিল রুবিনাকে তাড়া দেবেন। ইচ্ছা থেমে গেল অতিথির কথায়। রুবিনার ছোট বোনের ননাস এসেছেন। সঙ্গে একজন অপরিচিতা। ননাস-ননদ টাইপের অতিথিদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হয়। এমনভাবে চলতে হয় যেন তারা সম্মানবোধ করেন। অসম্মানিত বোধ করলে ছোট বোনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যেতে পারে।
ইমরান নুরকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন অতিথি চম্পা বেগম। তিনি স্কুলটিচার। স্বামী ভালো পদে সরকারি চাকরি করেন।
চম্পা বেগম বললেন, আপনার সঙ্গে একটা বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছি।
চমকে উঠলেন রুবিনা। এতক্ষণ মহিলা বিষয়টা তোলেননি! সেনসিটিভ সময়ে ভুলেছেন প্রসঙ্গটা। স্বামীর দিকে তাকানোর সাহস পেলেন না রুবিনা।
ইমরান নুরও তাকালেন রুবিনার মুখের দিকে। ভাবলেন, এতক্ষণ পরে কথা? এখনই বাসা থেকে বেরোনোর সময়।
হাসিমুখে ইমরান নুর বললেন, কী বিষয়?
একটা ফ্ল্যাট নেওয়ার কথা হচ্ছে আমাদের। লোন নিতে হবে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলেছে আমার হাজব্যান্ড।
লোনের কথা শুনে নড়ে উঠলেন নুর।
আজকের প্রোগামে যাওয়ার জন্য মনের কোনে একটা বাধা লুকিয়ে ছিল। ওপর দিয়ে তাগিদ বোধ করলেও আলাপের বিষয় শুনে সামনের খালি চেয়ারে বসে পড়লেন।
কী কথা জানতে চাচ্ছেন, বলুন।
লোনের বিষয়টা কীভাবে দেখছেন আপনি? লোন কোত্থেকে নিলে ভালো হবে?
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটা দিচ্ছি প্রথমে। সব লোনদাতাদের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র এক রকম। তারা লোন দেবে হাসিমুখে। কিনে নেবে অন্তত পাঁচ থেকে পনরো বছরের শ্রম। শ্রম অগ্রিম বিক্রি করে পুরোপুরি শ্রমিক হয়ে যেতে হবে আপনাকে। সবসময় কিস্তি পরিশোধের চিন্তা ঘুরবে মাথায়। তা নিয়ন্ত্রণ করবে আচরণ।
চম্পা বেগম হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন ইমরান নুরের কথা শুনে।
রুবিনা নুর বললেন, ও মা! এটা কী কথা! শ্রমিক হতে হবে কেন? নেগেটিভ কথা না বলে পজিটিভ কথা বলো। ভালো পরামর্শ দাও।
ভালো পরামর্শ হচ্ছে, লোনদাতারা অনেক কিছু লুকোছাপা রাখবে। লোন দেওয়ার আগে অন্তর ছুঁয়ে মিশে যাবে আপনার সঙ্গে। আস্তে আস্তে বেরোবে ফাঁদগুলো। অনেক ফাঁদ আছে, জানতে হবে এসব বিষয়।
যেমন, একটা ফাঁদের কথা বলুন।
ধরুন, একটা কথা আছে ‘অ্যাডজাস্টয়েবল রেট’। অর্থাৎ যে সুদের হারে টাকা দিচ্ছে, ইচ্ছামতো পরে তারা রেট বদলাতে পারবে। কিস্তির সংখ্যাও বেড়ে যেতে পারে। আইনের চোখে ধরতে পারবেন না তাদের।
সেকি! এক মুখে দুই কাজ?
না। ভুল বুঝেছেন। একমুখে এক কাজ। ওরা লোন দেওয়ার সময়ই শব্দটা আপনার নজরে আনবে। বিষয়টা হচ্ছে, শব্দটা বুঝবেন না আপনি। না বুঝে কোনো প্রশ্ন করবেনও না। করলেও এটা ওদের সেটরুল বলে থামিয়ে দেবে আপনাকে।
ওহ। তাহলে দেখছি লোন নেওয়া ঠিক না।
‘ঠিক না’ এটা আপনার কথা। প্রয়োজনে লোন নিতে হবে। লোন ছাড়া এখন কি বাড়ি কেনা সম্ভব?
চম্পা বেগম বললেন, হঠাৎ কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে কী হবে?
ও রে বাবা! ভয়াবহ প্রশ্ন তুলেছেন। কিস্তি পরিশোধে এখনো ব্যর্থ হইনি। সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে রিলেটেড বিষয়ে। বিষয়টা শেয়ার করা দরকার। শেয়ার করব?
রুমু এসে গেস্টরুম থেকে ঘুরে গেছে। পাভেলও দরজার মুখে উঁকি দিয়ে গেছে। ওরা অস্থির। বুঝতে পারছেন না অতিথিরা, এই বাসার লোকজন বসে আছেন বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। আর তিনি তুলেছেন কঠিন প্রসঙ্গ। ভেতর থেকে রুষ্ট হতে লাগলেন রুবিনা। ইমরান নুরের কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন, এ প্রসঙ্গে পরে আলাপ করলে হয় না? ভাইকে পাঠিয়ে দেবেন। সামনাসামনি আলাপ করলে মনে হয় ভালো হবে।
আগে আমার সন্তুষ্ট হতে হবে, আপা। আমার সিগন্যাল পেলে আপনার ভাই লোনের জন্য এগোবে।
ওহ। থেমে গেলেন রুবিনা নুর।
ইমরান নুর বলতে শুরু করলেন, লোনদাতারা অগ্রিম চেকে সই করিয়ে নিয়ে রাখবে। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট তারিখে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চলে যাবে।
এটা তো ভালো। ডিসিপ্লিন আছে বলতে হবে সিস্টেমে।
ডিসিপ্লিন আছে, সেটা অস্বীকার করা যায় না। একবার আমার অ্যাকাউন্টে টাকা থাকা সত্ত্বেও ফেরত যায় চেক। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। প্রথমে চিঠি পাঠায় বাসার ঠিকানায়। চিঠিটা দেরিতে পেয়েছি। ওরা যখন ফোন করে। তখন মোবাইল বন্ধ ছিল। বাসায় ল্যান্ডফোনে কল করেছে তিন বার। বুয়া জানায়নি। মেসেঞ্জার পাঠিয়েছে বাসায়।
তা তো পাঠাবেই। মোবাইল বন্ধ রাখবেন, চিঠির জবাব দেবেন না, মেসেঞ্জার পাঠাবে না?
পাঠাক, আপত্তি নেই। আপত্তি হচ্ছে তুচ্ছ ঘটনায় চেক ফেরত যাওয়ার জন্য জরিমানা দু হাজার টাকা। টেলিফোন করার জন্য ছয় টাকা। মেসেঞ্জার পাঠানোর জন্য দুই শ টাকা, মোট বাইশ ছয় টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে আমাকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ব্যাংকে নতুন স্টাফ এসে ভুল করেছে। নোট পড়ে দেখেনি যে প্রতি মাসের দুই তারিখে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে চেক যাবে। চেক দেওয়ার জন্য আলাদা ইনফরমেশন জানানোর দরকার নেই, বিষয়টা জানা ছিল না নতুন স্টাফের।
ওহ। তাহলে এই দশা।
লোন কোন ব্যাংক থেকে নেবেন, এটা আপনাদের সিদ্ধান্ত। সব লোনদাতার লেজের গিঁট এক বিন্দুতে বাঁধা। একই রকম। ডেভেলপারদের ফাঁক আবার ভিন্ন রকম।
ফাঁকটা কী?
বলবে, বারো মাসের মাথায় বাসায় উঠবেন। সেই বাসা বুঝিয়ে দেবে তিন বছর পর। চুক্তি হবে, লিফট দেবে ইতালি বা জার্মানির, লাগিয়ে দেবে চাইনিজ। গ্যাসবিল আর কত টাকার। বিলটাও বকেয়া রাখবে। ইলেকট্রিক বিলেরও একই দশা।
সবাই কি এক রকম? এত ছ্যাঁচড়া?
না। সবাই এক রকম না। এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় আপনাকে।
অস্থির হয়ে রুমু এবার বলে ফেলল, যাবে না, আম্মু?
চম্পা বেগমের হুঁশ হয়েছে এতক্ষণে।
বাইরে যাবেন আপনারা?
হ্যাঁ। আজ সবাই বাইরে খাব বলে ঠিক করেছি।
ওহ। তাহলে তো আটকিয়ে রাখলাম আপনাদের।
আটকালেন কোথায়? কথা বলেছে আমার সাহেব। তিনিই আটকিয়েছেন।
এই! আমার দোষ কেন! চলুন চম্পা আপা, আপনিও চলুন। রাইফেলস স্কোয়ারে যাব। আপনার বাসার কাছেই তো। চলুন।
না না করেও রাজি হয়ে গেলেন চম্পা বেগম।
মাথায় না, বুকে এসে বাজ পড়ল। বাদ দিতে চেয়েছিলেন বাড়তি খরচ। খরচের পিঠে খরচ চাপছে। বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। খরচের পাগলা ঘোড়া কোথায় টেনে নেবে, জানেন না তিনি।
চার
বাজারে এসে পকেট থেকে লিস্ট বের করলেন ইমরান নুর। পঁচিশতম ম্যারেজ ডে পালন করতে যাচ্ছেন তাঁরা আগামীকাল। রুবিনা যত্ন করে লিস্ট করে দিয়েছেন। লিস্টটা পড়তে গিয়ে চমকে উঠলেন। এত বাড়তি খরচ কেন? মুরগি নিতে বলেছে পঁচিশটা! এক কেজি ওজনের পঁচিশটার দাম প্রায় চার হাজার টাকা। মুরগিতেই চার হাজার! গরুর মাংস নিতে বলেছে দশ কেজি! কী সর্বনাশ! কত জনকে দাওয়াত করেছে রুবিনা? পুরো লিস্ট পড়ে আনুমানিক খরচটা হিসাব করলেন নুর। প্রায় দশ হাজার টাকার ব্যাপার!
ম্যারেজ ডের জন্য এত টাকা খরচ করতে হবে?
কিস্তি পরিশোধের জন্য চারপাশের আনুষঙ্গিক খরচ কমানোর কথা ভাবতে হচ্ছে সবসময়। কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। স্বাভাবিকের চেয়ে খরচ কেবল বাড়ছে।
সবজি-বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে ভালো হয়ে গেল মন। উড়ো চিন্তা উড়ে চলে গেল মাথা থেকে। পৌষের সবজির বাহারি রূপ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। শিমের বিচি উঠেছে বাজারে। মাছের মাথা দিয়ে শিমের বিচি রাঁধলে দারুণ লাগে। শিমির বিচি কেনার ইচ্ছায় দাঁড়ালেন দোকানির সামনে।
কত দাম?
একদাম, সাব। এক শ’ টেহা কেজি।
চমকে উঠলেন ইমরান নুর। ইলেকট্রিক শকের চেয়েও তীব্র শক খেলেন। এত দাম!
এক শ’ টাকায় শিমের বিচি কেনার তাঁর সামর্থ্য নেই, তা নয়। সামর্থ্য থাকলেও এত দাম দিয়ে কেন কিনতে হবে?
নুরের চলমান চিন্তার স্রোতে ভাটা পড়ে গেল। চিন্তা করে লাভ নেই। বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। হাতে যে টাকা নিয়ে এসেছেন, মোটামুটি রুবিনার সব আবদার পূরণ করে নিজের শখ পূরণ করা যাবে। তবে পূরণের ইচ্ছা তেতো হয়ে উঠছে। হাতের টাকাগুলোকে আর টাকা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে গাছের হলুদ পাতা। একটুখানি বাতাস এলে কিংবা গাছ নাড়া খেলে যেমন ঝরে যায় হলদে পাতা, তেমনি ঝরে যায় টাকাও। টাকার কোনো মূল্য নেই। ফ্ল্যাট কেনার সময় দেখেছেন, বস্তাবন্দি টাকা আসলে কচুপাতায় জমা টলমলে পানির ফোঁটার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী। হুশ করে ঝরে যায়। হুশ করে শেষ হয়ে যায়। এখন মাসিক কিস্তির টাকা শোধ করতে গিয়ে বুঝেছেন, পানির ট্যাপ খোলা। খোলা ট্যাপ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে যায় ট্যাংকের পানি। গাজী ট্যাংকেও কাজ হচ্ছে না। ট্যাংক খালি। ভরছে না। বিরাট শূন্যতা দখল করে আছে চারপাশ।
শিমের বিচি বাদ। কচুর লতির দিকে চোখ গেল ইমরান নুরের। সার দেওয়া মোটা লতির চেয়ে চিংড়ি দিয়ে দেশি লতি খেতে কী মজা! মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে গেল চট করে। গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল পুরো পরিবার। বাড়ির আঙিনা ঘুরে ঘুরে কচুর লতি তুলতেন মা। কচুর কচিডগা কেটে নিয়ে আসতেন। কিশোর ইমরান চলে যেতেন বাড়ির পাশের খালে। ঠেলা জাল দিয়ে ধরে নিয়ে আসতেন চিংড়ি মাছ। তাজা লতি। তাজা কচু। সঙ্গে তাজা চিংড়ি! হুঁম! এত স্বাদ! এখনো জিবে লেগে আছে সেই স্বাদ!
দেশি লতির দিকে আঙুল দেখিয়ে ইমরান জিজ্ঞেস করলেন, কত দাম?
আশি টেহা কেজি।
দুম করে বাজ পড়ল মাথায়। কচুর লতির দাম আশি টাকা! অনেক দিন বাজারে আসা হয় না। বাজারে আগুন। গাজায় যেমন নির্বিচারে বোমা ফাটাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা, ধোঁয়া উড়ছে চারপাশে, অসহায় নারী-পুরুষ শিশুরা যেভাবে ধ্বংসস্তূপের মাঝে লাশ হয়ে আটকে আছে, তেমনিভাবে কালো ধোঁয়ার মধ্যে ধ্বংসস্তূপে যেন ঢুকে গেছেন তিনি। তার মাঝ থেকে মাথা তুলে কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে বললেন, কারা কেনে এত দামে?
বলেন কী, সাব! এইডা ইসপিশিয়াল আইডম। হুমহাম উইড়া যাইব হগল আইডম।
উড়ে গেলেন ইমরান নুর। বিক্রেতার ইংরেজি কথার তোড়ে ভিরমি খেয়ে সরে গেলেন সামনে থেকে। মনে মনে ভাবলেন, আগে নিজের শখটা জবাই হোক। তারপর কাটছাঁট করবেন রুবিনার লিস্ট।
লিস্টে চলেছে সংস্কারের ছুরি। ফিফটি পার্সেন্ট কতল হয়েছে, মুরগি কিনতে গিয়ে লিস্ট কতল হলেও, টাকা বাঁচেনি। বাজারের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে হিসাবের টাকা। বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ইমরান নুর।
বাজার দেখে রুবিনা খুশি। কাটা-ছোলা মুরগির ব্যাগ হাতে নিয়ে বললেন, এত কম লাগছে কেন? তোমাকে না লিখে দিয়েছি পঁচিশটার কথা!
টোটাল বাজার থেকে ফিফটি পার্সেন্ট কাটল করেছি। পঁচিশটা মোরগের অর্ধেক হচ্ছে সাড়ে বারো। বিপদে পড়ে গেলাম। বললাম তেরোটা দাও। সেখানেও বিপদ। বিক্রেতা বলে, ‘আনলাকি থারডিন’ লিবেন, সাব?
বিক্রেতার প্রমিত ইংরেজি উচ্চারণ দেখে ঘাবড়ে গেলাম, চৌদ্দটা নিলাম। চৌদ্দ মানে সেভেন প্লাস সেভেন। অর্থাৎ একজোড়া লাকি সেভেন হাজির করেছি তোমার জন্য।
মানুষটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন রুবিনা। চেনাই যাচ্ছে না লোকটাকে। আগে বস্তা ভরে বাজার নিয়ে আসত। দশটা মোরগ আনতে বললে নিয়ে আসত বিশটা। আর আজ ম্যারেজ ডের লিস্টে ছুরি চালিয়েছে!
রাগে দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
কেঁদেই উঠলেন রুবিনা। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কে বলেছিল তোমাকে ফ্ল্যাট কিনতে? শেষমেশ ম্যারেজ ডের লিস্টেও ছুরি চালিয়েছ!
ইমরান নুর মিউমিউ করে বললেন, আরও বারো বছর বাঁচতে হবে আমাকে। বারো বছর পর ফ্ল্যাটের আসল মালিক হবে তোমরা। পাভেলের দাবিও পূরণ করতে হবে। নতুন গাড়ি কিনতে হবে। এখন লিস্টে ছুরি না চালালে সেই ছুরির ফলা তো ঢুকে যাবে নিজের বুকের নরম মাংসে। ফালাফালা হবে হৃৎপিণ্ড। বাঁচতে হবে না বারো বছর?
মোহিত কামাল, কথাসাহিত্যিক