নাজমুল টিটো
(রবীন্দ্রনাথের বাঁশি)
# প্রাচীন ভারতীয় ধ্যান ও তপস্যার রূপ ফুটে ওঠে নৈবেদ্য (১৯০১) কাব্যে। এখানে কবি বাঁশিতে তোলেন আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চেতনার সুর।
“বিশ্বপ্রকৃতির বৃহৎ-শান্তির মধ্যে তাঁর গর্ভবাস।“ কবি নিজের সম্বন্ধে নৈবেদ্যে’র ৪৬ নম্বর সনেটে এমন কথা বলেন;
(৭৭)“মাতৃস্নেহবিগলিত স্তন্যক্ষীররস
পান করি হাসে শিশু আনন্দে অলস-
তেমনি বিহ্বল হর্ষে ভাবরসরাশি
কৈশোরে করেছি পান; বাজায়েছি বাঁশি
প্রমত্ত পঞ্চম সুরে, প্রকৃতির বুকে
লালনললিতচিত্ত শিশুসম সুখে
ছিনু শুয়ে; প্রভাত-শর্বরী-সন্ধ্যা-বধূ
নানা পাত্রে আনি দিত নানাবর্ণ মধু
পুষ্পগন্ধে মাখা।”
[৪৬, নৈবেদ্য]
এই বাঁশির সুরের প্রতি ধিক্কার দিয়ে কবি পরবর্তী ৪৭ নম্বর সনেটে প্রার্থনা করলেন,
“ভাবের ললিত ক্রোড়ে না রাখি নিলীন
কর্মক্ষেত্রে করে দাও সক্ষম স্বাধীন।”
# পতœী মৃণালীনি দেবীর অকাল প্রয়াণ স্মরণে কবি বেদনার্ত বাঁশির সুর তোলেন তাঁর স্মরণ (১৯০৩-১৯০৪) কাব্যের ২০ নং কবিতায়।
(৭৮)“আমার বক্ষে বেদনার মাঝে
করো তব উৎসব।
আনো তব হাসি, আনো তব বাঁশি,
ফুলপল্লব আনো রাশি রাশি,
ফিরিয়া ফিরিয়া গান গেয়ে যাক
যত পাখি আছে সব।
বেদনা আমার ধ্বনিত করিয়া
করো তব উৎসব।”
[২০, স্মরণ]
# মাতৃহারা সন্তানদের উপলক্ষ্য করে শিশু (১৯০৯)’র কবিতাগুলো রচিত। শিশু বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ আঁকাআঁকি ও লেখালেখির মধ্য দিয়ে বড় হতে হতে বিশ্বকবির খ্যাতিটা যখন নিজের করে নেন তখনো তিনি শিশুতোষ রচনায় অমনোযোগী হননি। তাই কবির শিশুসাহিত্যে সর্বশ্রেণির শিশুদের সার্বজনীন প্রতিনিধিত্ব পাওয়া যায়। কবি তাঁর শিশুকালে শোনা বাঁশির বিচিত্র সুর বার্ধক্যেও বিস্মৃত হননি।
(৭৯)“বাঁশ-বাগানে সোঁ সোঁ ক’রে
বাজিয়ে দিয়ে বাঁশি
অমনি দেখ্ মা, চেয়ে-
সকল মাটি ছেয়ে
কোথা থেকে উঠল যে ফুল
এত রাশি রাশি।”
[বৈজ্ঞানিক, শিশু]
(৮০) “তবু তো তার সঙ্গে আমার
বিবাদ করা সাজে না।
সে নইলে যে তেমন ক’রে
ঘরের বাঁশি বাজে না।”
[পরিচয়, শিশু]
# রবীন্দ্রকাব্যগ্রন্থাবলীর মধ্যে উৎসর্গ (১৯১৪) ব্যতিক্রম ও এর গূরুত্ব অসামান্য। এ কাব্যের রচনাকালে কবির বয়স মাত্র ৪২ বছর। এরপর আরো কবি চার দশকে অজগ্র কবিতা লিখেছেন। অথচ এই কাব্য সাধনার মাঝ পর্যায়ে কবির সঙ্গে তাঁর জীবনদেবতার আত্মিক যোগাযোগের গভীর উপলব্ধির বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে পরিলক্ষিত। এই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বাঁশির বিচিত্র সুরে কবি তাঁর কবিতায় নানাভাবে খেলা করেছেন।
(৮১) “তোমায় খনে খনে আমি বাঁধিতে চেয়েছি
কথার ডোরে।
চিরকাল-তরে গানের সুরেতে
রাখিতে চেয়েছি ধরে।
সোনার ছন্দে পাতিয়াছি ফাঁদ,
বাঁশিতে ভরেছি কোমল নিখাদ,
তবু সংশয় জাগে ধরা তুমি
দিলে কি!
কাজ নাই, তুমি যা খুশি তা করো-
ধরা না’ই দাও মোর মন হরো,
চিনি বা না চিনি প্রাণ উঠে যেন
পুলকি।”
[৬, উৎসর্গ]
(৮২) “নিজের গানেরে বাঁধিয়া ধরিতে
চাহে যেন বাঁশি মম
উতলা পাগলসম।
যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর
রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।”
[৭, উৎসর্গ]
(৮৩) “আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসি।
Í———————-
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই,
সে কথা যে যাই পাসর।
আমি উৎসুক হে,
হে সুদূর, আমি প্রবাসী।
Í———————–
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
নাহি জানি পথ, নাহি মোর রথ
সে কথা যে যাই পাসরি।
আমি উন্মনা হে,
হে সুদূর, আমি উদাসী।
Í———————–
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার
সে কথা যে যাই পাসরি।”
[৮, উৎসর্গ ]
(৮৪) “যা আছে থাক্ আমার থাক্ তাহা।
পেয়েছি এই সুখে আজি
পবনে উঠে বাঁশরি বাজি,
পেয়েছি সুখে পরান গাহে ‘আহা’।”
[১১, উৎসর্গ]
(৮৫) “হে রাজন, তুমি আমারে
বাঁশি বাজাবার দিয়েছ যে ভার
তোমার সিংহদুয়ারে-
ভুলি নাই তাহা ভুলি নাই,
———————————
বাঁশি লই আমি তুলিয়া।
তারা ক্ষণতরে পথের উপরে
বোঝা ফেলে বসে ভুলিয়া।”
[১১, উৎসর্গ]
(৮৬) “শৈলতলে চরায় ধেনু,
রাখালশিশু বাজায় বেণু,
চূড়ায় তারা সোনার মালা পরে।
সোনার তুলি দিয়ে লিখা
চৈত্রমাসের মরীচিকা
কাঁদায় হিয়া অপূর্বধন-তরে।”
[১১, উৎসর্গ]
(৮৭)“সেদিন কি তুমি এসেছিলে ওগো,
সে কি তুমি, মোর সভাতে।
হাতে ছিল তব বাঁশি,
অধরে অবাক হাসি,
সেদিন ফাগুন মেতে উঠেছিল
মদবিহ্বল শোভাতে।”
[৩৯, উৎসর্গ]
# রবীন্দ্রকাব্যে আধ্যাত্মিক চেতনার সূচনা নৈবেদ্য কাব্যের কবিতার মধ্য দিয়ে। সেই উপলব্ধি খেয়া (১৯০৬) কাব্যে এসে আরো ঘনিষ্ঠ হয়। বাঁশির সুরও অধিক ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
(৮৮) “ যাবে সে সুদূর পুরে,
শুধু সঙ্গের বাঁশি কোন্ মাঠ হতে
বাজিবে ব্যাকুল সুরে।”
[শুভক্ষণ, খেয়া]
(৮৯) কডি ও কোমল কাব্যে রচিত বাঁশি নামক কবিতার পর এ পর্যায়ে এসে কবি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির অনুক্রমণ হিসেবে বাঁশি শিরোনামে পুনরায় আরেকটি পূর্ণাঙ্গ কবিতার সৃজন করেন।
বাঁশি
“ওই তোমার ওই বাঁশিখানি
শুধু ক্ষণেক-তরে
দাও গো আমার করে।
শরৎ-প্রভাত গেল ব’য়ে,
দিন যে এল ক্লান্ত হয়ে,
বাঁশি-বাজা সাঙ্গ যদি
কর আলস-ভরে
তবে তোমার বাঁশিখানি
শুধু ক্ষণেক-তরে
দাও গো আমার করে।
Í————————————-
রাতে উঠবে আধেক শশী
তারার মধ্যখানে,
চাবে তোমার পানে।
তখন আমি কাছে আসি
ফিরিয়ে দেব তোমার বাঁশি,”
[বাঁশি, খেয়া]
এখানে কবি তাঁর প্রিয় উপাদান বাঁশিকে বিশেষভাবে ব্যবহার করে ‘বাঁশি’ কবিতার মতো খেয়া কাব্যে কবি রূপকধর্মী অনেকগুলো কবিতায় নিজের সঙ্গে বিশ্ব দেবতার সাক্ষাৎকার ঘটিয়েছেন।
“কবি এ সময় রূপের জগতের রসলীলা ছেড়ে অরূপ জগতের আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিকে পা বাড়িয়েছেন কিন্তু গীতাঞ্জলি পর্বে তখনও তার প্রবেশ ঘটে নি। তাই কবি সত্য সত্যই যেন খেয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছেন যে খেয়ায় চড়ে আধ্যাত্ম সাধনার জগতে পাড়ি জমাবেন। গীতাঞ্জলি পর্বের প্রবেশমুখে ‘খেয়া’ কাব্যখানি স্থাপিত হয়ে যেন আমাদের এটাই বুঝাতে চেয়েছেন কবি এখন সীমা অসীমের মাঝখানটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন- তিনি এখন ঘরেও নন ওপারেও পৌঁছুতে পারেন নি, মাঝ-দরিয়ায় দাঁড়িয়ে তাঁর জীবন-তরীর মাঝিকেই ডাকছেন-
ওরে আয়
আমায় নিয়ে যাবি কে রে
বেলা শেষের শেষ খেয়ায়।”
(৯০) “মলিনবরন মালাখানি
শিথিল কেশে সাজে,
ক্লিষ্টকরুণ রাগে তাদের
ক্লান্ত বাঁশি বাজে।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে-
ডেকে বলি, ‘এই ছায়াতে
কাটাবি দিন আয় রে তোরা,
কাটাবি দিন আয় রে।”
[অবারিত, খেয়া]
(৯১) “আমার দিন কেটে গেছে কখনো খেলায়,
কখনো কত কী কাজে।
এখন কি শুনি পূরবীর সুরে
কোন্ দূরে বাঁশি বাজে।
বুঝি দেরি নাই, আসে বুঝি আসে,
আলোকের আভা লেগেছে আকাশে,
বেলাশেষে মোরে কে সাজাবে ওরে
নবমিলনের সাজে।”
[গোধূলিলগ্ন, খেয়া]
(৯২) “ওগো ধন্য তোমরা দুখের যাত্রী,
ধন্য তোমরা সবে।
লাজের ঘায়ে উঠিতে চাই,
মনের মাঝে সাড়া না পাই,
মগ্ন হলেম আনন্দময়
অগাধ অগৌরবে-
পাখির গানে, বাঁশির তানে,
কম্পিত পল্লবে।”
[নিরুদ্যম, খেয়া]
(৯৩)“মোদের ঘরে হয়েছে দীপ জ্বালা,
বাঁশির ধ্বনি হৃদয়ে এসে লাগে,
নবীন আছে এখনো ফুলমালা,
তরুণ আঁখি এখনো দেখো জাগে।
বিদায়বেলা এখনি কি গো হবে,
পথিক ওগো পথিক, যাবে তবে?
Í——————————————–
এ মেলা যদি না লাগে তব ভালো,
শান্তি যদি না মানে তব প্রাণ,
সভার তবে নিবায়ে দিব আলো,
বাঁশির তবে থামায়ে দিব তান।
স্তব্ধ মোরা আঁধারে রব বসি,
ঝিল্লিরব উঠিবে জেগে বনে,
কৃষ্ণরাতে প্রাচীন ক্ষীণ শশী
চক্ষে তব চাহিবে বাতায়নে।
পথপাগল পথিক, রাখো কথা,
নিশীথে তব কেন এ অধীরতা।”
[পথিক, খেয়া]
(৯৪)“আকাশ ছেয়ে মন-ভোলানো হাসি
আমার প্রাণে বাজালো আজ বাঁশি।
লাগল আলস পথে চলার মাঝে,
হঠাৎ বাধা পড়ল সকল কাজে,
একটি কথা পরান জুড়ে বাজে
‘ভালোবাসি, হায় রে ভালোবাসি’-
সবার বড়ো হৃদয়-হরা হাসি।”
[বিদায়, খেয়া]
(৯৫) “তীরে তরুর ডালে ডালে
ডাকল পাখি প্রভাত-কালে,
তীরে তরুর ছায়ায় রাখাল
বাজায় বাঁশি মনের সুখে।
[সমুদ্রে, খেয়া]
(৯৬) “তোমার রথের ‘পরে
সোনার ধ্বজা ঝলবে ঝলমল,
সাথে বাজবে বাঁশির তান-
তোমার প্রতাপ-ভরে
বসুন্ধরা করবে টলমল,
আমার উঠবে নেচে প্রাণ।”
[প্রচ্ছন্ন, খেয়া]
# গীতাঞ্জলি (১৯১০) প্রসঙ্গে কবির নিজের মুখেই শোনা যাক,“গীতাঞ্জলির গানগুলো ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলাম। এগুলো পরবর্তী সময়ে কবিতা বলে বিবেচিত হয়েছিল। আর সেটাই আমার গদ্যছন্দে কবিতা লেখার প্রেরণা।” তিনি আরো বলেন,“গীতাঞ্জলি হচ্ছে আমার আধ্যাত্মিক গান এবং কবিতার সর্বোত্তম সংগ্রহ।”
ইয়েটস এভাবে বলেন : “একটা সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির চরম প্রকাশ এই কাব্য (গীতাঞ্জলি), কিন্তু এমন স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন সহজে মাটিতে জন্মায় ঘাস, জলে নলখাগড়া… এই ঐতিহ্য যেখানে কবিতা আর ধর্মবোধ সমার্থক শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে এসেছে, শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয়ের কাছ থেকেই গ্রহণ করেছে উপমা ও আবেগ, তারপর জনসাধারণের কাছে ফিরে গেছে মহান চিন্তার প্রকাশকে বহন করে।”
১৯১২ ক্রিস্টাব্দে লন্ডনে প্রথম এটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। অনূদিত গ্রন্থটি প্রচ্ছদে এরঃধহলধষর (ঝড়হম ঙভভবৎরহমং) নামাঙ্কিত। কবিতাগুলি পাশ্চাত্যে খুবই সমাদৃত হয় এবং পরের বছর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে গীতাঞ্জলির জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে তিনি বিশ্ব কবির খ্যাতি লাভ করেন। । তবে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে বাংলা গীতাঞ্জলি’র একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। রবীন্দ্রনাথ মূল গীতাঞ্জলি’র ১৫৭টি গান/কবিতা থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে (ঝড়হম ঙভভবৎরহমং) মাত্র ৫৩টি স্থান দিয়েছেন। বাকি ৫০টি বেছে নিয়েছেন গীতিমাল্য থেকে ১৬টি, নৈবেদ্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে ৩টি, কল্পনা থেকে ১টি, চৈতালি থেকে ১টি, উৎসর্গ থেকে ১টি, স্মরণ থেকে ১টি এবং অচলায়তন থেকে ১টি কবিতা/গান নিয়ে তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলির বিন্যাস করেছেন। অর্থাৎ ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে মূল বাংলা গীতাঞ্জলিসহ মোট ৯টি গ্রন্থের কবিতা বা গানের সমাবেশ রয়েছে। গীতাঞ্জলি’র দ্বারা কবি তাঁর সমস্ত শ্রেষ্ঠ গীতের অঞ্জলি দিলেন গ্রষ্টাকে। “গীতাঞ্জলির প্রতিটি গানেই রবীন্দ্রনাথের সীমা থেকে অসীমের দিকে অভিযাত্রা এবং তার ভক্তি রসাত্মক পরমাস্তিক চিন্তা ও বোধের উৎসারণ ঘটেছে যথারীতি।” আর এসব গান/কবিতায় কবি তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ বাঁশিকে ব্যবহার করেছেন বিচিত্র রূপে।
(৯৭) “যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি
বাতাসে আজ ছুটছে হাসি।
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
কাটবে সকল বেলা।”
[গীতাঞ্জলি-৮]
(৯৮) “যতই উঠে হাসি,
ঘরে যতই বাজে বাঁশি,
ওগো যতই গৃহ সাজাই আয়োজনে,
যেন তোমায় ঘরে হয় নি আনা
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।”
[গীতাঞ্জলি-২৪]
(৯৯) “তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার
বাজাই আমি বাঁশি।
গানে গানে গেঁথে বেড়াই
প্রাণের কান্নাহাসি।”
[গীতাঞ্জলি-৪৪]
(১০০)“এবার নীরব করে দাও হে তোমার
মুখর কবিরে।
তার হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে
বাজাও গভীরে।
নিশীথরাতের নিবিড় সুরে
বাঁশিতে তান দাও হে পুরে,
যে তান দিয়ে অবাক কর,
গ্রহশশীরে।
Í—————————–
বহুদিনের বাক্যরাশি
এক নিমেষে যাবে ভাসি,
একলা বসে শুনব বাঁশি
অকূল তিমিরে।”
[গীতাঞ্জলি-৫৯]
(১০১) “অতীত জীবন ছায়ার মতো
চলছে পিছে পিছে,
কত মায়ার বাঁশির সুরে
ডাকছে আমায় মিছে।”
[গীতাঞ্জলি-৬৩]
(১০২) “উৎসবে তার আসে নাই কেহ,
বাজে নাই বাঁশি, সাজে নাই গেহ-
কাঁদিয়া তোমায় এনেছে ডাকিয়া
ভাঙা মন্দির-দ্বারে।”
[গীতাঞ্জলি-৭২]
(১০৩) “যদি তোমায় ভালোবাসি,
আপনি বেজে উঠবে বাঁশি,
আপনি ফুটে উঠবে কুসুম,
কানন ভরে।”
[গীতাঞ্জলি-৭৩]
(১০৪) “বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি,
সে কি সহজ গান।
সেই সুরেতে জাগব আমি
দাও মোরে সেই কান।”
[গীতাঞ্জলি-৭৪]
(১০৫) “যাত্রী আমি ওরে।
যা-কিছু ভার যাবে সকল সরে।
আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে
ভাষাবিহীন অজানিতের গানে,
সকাল-সাঁঝে পরান মম টানে
কাহার বাঁশি এমন গভীর স্বরে।”
[গীতাঞ্জলি-১১৭]
(১০৬) “জীবন লয়ে যতন করি’
যদি সরল বাঁশি গড়ি
আপন সুরে দিবে ভরি
সকল ছিদ্র তার।”
[গীতাঞ্জলি-১২৫]
(১০৭) “ওরে মাঝি, ওরে আমার
মানবজন্মতরীর মাঝি,
শুনতে কি পাস দূরের থেকে
পারের বাঁশি উঠছে বাজি।
তরী কি তোর দিনের শেষে
ঠেকবে এবার ঘাটে এসে।
সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে
দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি।”
[গীতাঞ্জলি-১৪০]
(১০৮) “কত তীব্র তারে, তোমার
বীণা সাজাও যে,
শত ছিদ্র করে জীবন
বাঁশি বাজাও হে।”
[গীতাঞ্জলি-১৫৪]
# গীতিমাল্য (১৯১৪) কাব্যটি কবির পরিণত জীবনে সঙ্গীতের পবিত্র মাল্য। এটি গীতাঞ্জলি পর্বের কাব্য। রবীন্দ্রনাথ গীতিমাল্যের ১৬টি কবিতা গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ সং অফারিংসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ পর্বের রচনায় কবি ক্ষুদ্র সত্তা হতে বৃহৎ সত্তা তথা গ্রষ্টার সঙ্গে যুক্ত হবার তীব্র বাসনায় বাঁশির বিচিত্র সুরে বন্দনা করেছেন।
(১০৯) “একলা কে যে বাজায় বাঁশি
বেদনভরা বেহাগ সুরে
মনের মাঝে অনেক দূরে।”
[গীতিমাল্য-৪]
(১১০) “কে গো তুমি বিদেশী।
সাপ-খেলানো বাঁশি তোমার
বাজালো সুর কী দেশী।
Í——————————
গোপন গুহার মাঝখানে যে
তোমার বাঁশি উঠছে বেজে
ধৈর্য নারি রাখিতে।
Í——————————-
নাটের লীলা হায় গো এ কী,
পুলক জাগে আজকে দেখি
নিদ্রা-ঢাকা পাতালে।
তোমার বাঁশি কেমন বাজে,
নিবিড় ঘন মেঘের মাঝে
বিদ্যুতেরে মাতালে।
Í————————–
তোমার বাঁশির বশ মেনেছে,
বিশ্বনাচের রস জেনেছে,
রবে না আর ঢাকা সে।”
[গীতিমাল্য-১০]
(১১১) “শূন্যমনে কোথায় তাকাস।
সকল বাতাস সকল আকাশ
ওই পারের ওই বাঁশির সুরে
উঠে শিহরি।”
[গীতিমাল্য-১৬]
(১১২)“পথে পায়ে পায়ে দুখের বাঁশরি
বাজবে তোরে ডাকি।
মধুর সুরে বাজবে তোরে ডাকি।
জাগো এবার জাগো,
বেলা কাটাস না গো।”
[গীতিমাল্য-১৮]
(১১৩) “কত যে গিরি কত যে নদীতীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব।”
[গীতিমাল্য-২৩]
(১১৪)“জানি আমি জানি ভেসে যাবে অভিমান,
নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,
শূন্য হিয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান,
পাষাণ তখন গলিবে নয়নজলে।”
[গীতিমাল্য-২৪]
(১১৫) “যে বাঁশিখানি বাজিছে তব ভবনে
সহসা তাহা শুনিব মধু-পবনে।
তাকায়ে রব দ্বারের পানে,
সে তানখানি লইয়া কানে
বাজায়ে বীণা বেড়াব গান গাহি রে।
এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে।”
[গীতিমাল্য-২৫]
(১১৬) “প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে প্রভু ঢালো।
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি আরো আরো আরো দাও তান।”
[গীতিমাল্য-২৮]
(১১৭)“বাজাও আমারে বাজাও।
বাজালে যে সুরে প্রভাত-আলোরে
সেই সুরে মোরে বাজাও।
যে সুর ভরিলে ভাষাভোলা-গীতে
শিশুর নবীন জীবন-বাঁশিতে
জননীর মুখ-তাকানো হাসিতে-
সেই সুরে মোরে বাজাও।”
[গীতিমাল্য-৩৯]
(১১৮) “পথের ধারে বাজবে বেণু,
নদীর কূলে চরবে ধেনু,।
আঙিনাতে খেলবে শিশু,
পাখিরা গান গাবে।
তবুও দিন যাবে এ দিন যাবে।”
[গীতিমাল্য-৪০]
(১১৯)“রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি
বেলাশেষের তান।
পথে চলি, শুধায় পথিক,
“কী নিলি তোর দান?”
Í——————————
ঘরে আমার রাখতে যে হয়
বহুলোকের মন।
অনেক বাঁশি অনেক কাঁসি
অনেক আয়োজন।”
[গীতিমাল্য-৪০]
(১২০) “তোমার সাথে গানের খেলা
দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায়
সকল বেলা যে।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি
বাজাবে গো আপনি আসি,
আনন্দময় নীরব রাতের
নিবিড় আঁধারে।”
[গীতিমাল্য-৭০]
(১২১)“ এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে
আমার বাড়ি।
কেউ বা আসে এপারে, কেউ
পারের ঘাটে দেয় রে পাড়ি।
পথিকেরা বাঁশি ভ’রে
যে সুর আনে সঙ্গে করে
তাই যে আমার দিবানিশি
সকল পরান লয় রে কাড়ি।”
[গীতিমাল্য-৭৪]
(১২২) “দিন-রজনীর বাঁশি পুরে,
যে গান বাজে অসীম সুরে,
তারে আমার প্রাণের তারে
বাজানো চাই।”
[গীতিমাল্য-৭৪]
(১২৩) “হে অন্তরের ধন,
এই বিরহে কাঁদে আমার নিখিল ভুবন।
তোমার বাঁশি নানা সুরে
আমায় খুঁজে বেড়ায় দূরে,
পাগল হল বসন্তের এই
দখিন সমীরণ।”
[গীতিমাল্য-৮২]
(১২৪) “ বল তো এই বারের মতো,
প্রভু, তোমার আঙিনাতে
তুমি আমার ফসল যত।
কিছু বা ফল গেছে ঝরে,
কিছু বা ফল আছে ধরে,
বছর হয়ে এল গত।
রোদের দিনে ছায়ায় বসে
বাজায় বাঁশি রাখাল যত।”
[গীতিমাল্য-৮৫]
(১২৫) “ ওদের সাথে মেলাও, যারা
চরায় তোমার ধেনু।
তোমার নামে বাজায় যারা বেণু।
পাষাণ দিয়ে বাঁধা ঘাটে
এই যে কোলাহলের হাটে
কেন আমি কিসের লোভে এনু।”
[গীতিমাল্য-৮৭]
(১২৬)“প্রাণে গান নাই, মিছে তাই ফিরিনু যে
বাঁশিতে সে গান খুঁজে।
প্রেমেরে বিদায় ক’রে দেশান্তরে
বেলা যায় কারে পূজে?”
[গীতিমাল্য-৯৩]
(১২৭) “এই তো তোমার আলোক-ধেনু
সূর্যতারা দলে দলে;
কোথায় বসে বাজাও বেণু,
চরাও মহা-গগনতলে।”
[গীতিমাল্য-১০৩]
(১২৮) “তারি পূজার মালঞ্চে ফুল ফুটে যে।
দিনে রাতে চুরি ক’রে
এনেছি তাই লুটে যে।
তারি সাথে মিলন আসি,
এক সুরেতে বাজবে বাঁশি,
তখন তোমার দেখব হাসি,
ভরবে আমার চেতনা।”
[গীতিমাল্য-১০৫]
# গীতালী (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থও গীতাঞ্জলি পর্বের অন্তর্ভুক্ত। কবি অরূপ দেবতাকে প্রিয় সখারূপে কল্পনা করে তাঁর সাথে মিলনের নানা আকুতি ও আকাঙ্ক্ষার সুরারোপ করেছেন বাঁশিতে।
ক্রমশ…
নাজমুল টিটো, প্রাবন্ধিক ও গবেষক