নাজমুল টিটো
অতীত দুঃখের স্মৃতিচারণা, বাহ্যিক বস্তুর প্রতি আসক্তি—নিরাসক্তির দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয় পরিশেষ (১৯৩২) কাব্যেও বর্তমান। কবি তখন সত্তর বৎসর পার হয়ে একাত্তরে পা দিয়েছেন। এই সময় শ্রী দিলীপকুমার রায়কে লেখা এক পত্রে কবি লিখেছেন— “বয়স সত্তর হ’লো—আমার পরিচয়ের কোঠায় অনুমানের জায়গা প্রায় বাকি নেই”—
এ কথার উপর ভিত্তি করে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সুখেন্দুসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় যে মতামত প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হলো:—
সুতরাং গানের পালা শেষ করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কবি মনে মনে অনুভব করেছেন—’পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থে। তাঁর কাব্যসৃষ্টির পালা শেষ হবে এই রকম অনুমান করে কাব্যগ্রন্থের নামকরণে তার আভাস দিয়েছেন। অবশ্য এর আগেও আমরা কবিকে বারবার তাঁর কবি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করতে শুনেছি ‘সোনার তরী’, ‘কল্পনা’, ‘গীতালি’ প্রভৃতি অনেকগুলি কাব্যই বাণীর বরপুত্রটি বীণাপাণির কাছ থেকে বিদায় নিতে চেয়েছেন কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে শেষের পর আবার শুরু করতে হয়েছে—জীবনদেবতার অমোঘ নির্দেশে কবিকে আবার সাহিত্যসৃষ্টির দুরূহ কর্তব্যভার কাঁধে তুলে নিতে দেখা গিয়েছে।
কিন্তু ব্যক্তি জীবনে সাতের দশকে পা দিয়ে কবি যেন সত্য সত্যই অনুভব করেছেন তাঁর কবি জীবনের এইবার যথার্থ পরিসমাপ্তি ঘটবে— হয়তো ব্যক্তি জীবনেরও, তাই পরিশেষ—ঞযব ঊহফ বলে যে কাব্যের শুরু হল তার সূচনাতেই লিখেছেন,
(১৮৯)
“অর্থ কিছু বুঝি নাই, কুড়ায়ে পেয়েছি কবে জানি নানা—বর্ণে—চিত্র—করা বিচিত্রের নর্মবাঁশিখানি যাত্রাপথে। সে প্রত্যুষে প্রদোষের আলো অন্ধকার প্রথম মিলনক্ষণে লভিল পুলক দোঁহাকার রক্ত—অবগুণ্ঠনচ্ছায়ায়। মহামৌন—পারাবারে প্রভাতের বাণীবন্যা চঞ্চলি মিলিল শতধারে, তুলিল হিল্লোলদোল। কত যাত্রী গেল কত পথে দুর্লভ ধনের লাগি অভ্রভেদী দুর্গম পর্বতে
দুস্তর সাগর উত্তরিয়া। শুধু মোর রাত্রিদিন, শুধু মোর আনমনে পথ—চলা হল অর্থহীন। গভীরের স্পর্শ চেয়ে ফিরিয়াছি, তার বেশি কিছু হয় নি সঞ্চয় করা, অধরার গেছি পিছু পিছু।
আমি শুধু বাঁশরিতে ভরিয়াছি প্রাণের নিশ্বাস, বিচিত্রের সুরগুলি গ্রন্থিবারে করেছি প্রয়াস আপনার বীণার তত্ত্বতে। ফুল ফোটাবার আগে ফাল্গুনে তরুর মর্মে বেদনার যে স্পন্দন জাগে আমন্ত্রণ করেছিনু তারে মোর মুগ্ধ রাগিণীতে উৎকণ্ঠাকম্পিত মূর্ছনায়। ছিন্ন পত্র মোর গীতে ফেলে গেছে শেষ দীর্ঘশ্বাস। ধরণীর অন্তঃপুরে রবিরশ্মি নামে যবে, তৃণে তৃণে অঙ্কুরে অঙ্কুরে
যে নিঃশব্দ হুলুধ্বনি দূরে দূরে যায় বিস্তারিয়া
ধূসর যবনি—অন্তরালে, তারে দিনু উৎসারিয়া
এ বাঁশির রন্ধে্র রন্ধে্র; যে বিরাট গূঢ় অনুভবে রজনীর অঙ্গুলিতে অক্ষমালা ফিরিছে নীরবে আলোকবন্দনামন্ত্র—জপে— আমার বাঁশিরে রাখি আপন বক্ষের ‘পরে, তারে আমি পেয়েছি একাকী হৃদয়কম্পনে মম; যে বন্দী গোপন গন্ধখানি কিশোরকোরক—মাঝে স্বপ্নস্বর্গে ফিরিছে সন্ধানি
পূজার নৈবেদ্যডালি, সংশয়িত তাহার বেদনা সংগ্রহ করেছে গানে আমার বাঁশরি কলস্বনা। চেতানাসিন্ধুর ক্ষুব্ধ তরঙ্গের মৃদঙ্গগর্জনে
নটরাজ করে নৃত্য, উন্মুখর অট্টহাস্যসনে অতল অশ্রম্নর লীলা মিলে গিয়ে কলরলরোলে উঠিতেছে রণি রণি, ছায়ারৌদ্র সে দোলায় দোলে অশ্রান্ত উল্লোলে। আমি তীরে বসি তারি রুদ্রতালে গান বেঁধে লভিয়াছি আপন ছন্দের অন্তরালে অনন্তের আনন্দবেদনা। নিখিলের অনুভূতি সংগীতসাধনা—মাঝে রচিয়াছে অসংখ্য আকৃতি। এই গীতিপথপ্রান্তে হে মানব, তোমার মন্দিরে দিনান্তে এসেছি আমি নিশীথের নৈঃশব্দে্যর তীরে আরতির সান্ধ্যক্ষণে; একের চরণে রাখিলাম বিচিত্রের নর্মবাঁশি— এই মোর রহিল প্রণাম।”
[প্রণাম, পরিশেষ]
যে বিচিত্রের নর্মবাঁশি একদা জীবনের প্রথম প্রভাতে কবি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, না ঠিক কুড়িয়ে পাওয়া নয়, তাঁর জীবনদেবতাই ঐ বাঁশি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন এবং তিনিই বাঁশি বাজানো শেখাবেন বলে আরামের, স্বাচ্ছন্দ্যের কোল থেকে তাঁকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন—সারাদিন বাঁশি বাজিয়ে দিনান্তে গীতিপথপ্রান্তে এসে কবি সেই নর্মবাঁশিখানি তাঁর শেষ প্রণামরূপে জীবনদেবতার পদেই প্রত্যর্পণ করতে চেয়েছেন। কবি তাঁর সুদীর্ঘ কবিজীবনে জীবনদেবতার নির্দেশে যে বাঁশি বাজিয়েছেন তার সুরে অপরে মুগ্ধ হয়েছে কিন্তু বংশীবাদককে তার জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছে ‘বিচিত্রা’ কবিতায় কবি সেই কথাই বলেছেন—
(১৯০)
“ ছিলাম যবে মায়ের কোলে,
বাঁশি বাজানো শিখাবে ব’লে
চোরাই করে এনেছ মোরে তুমি,
বিচিত্রা হে, বিচিত্রা,
যেখানে তব রঙের রঙ্গভূমি।
আকাশতলে এলায়ে কেশ
বাজালে বাঁশি চুপে,
সে মায়াসুরে স্বপ্নছবি
জাগিল কত রূপে;
Í———————————————————————————————
বুকের শিরা ছিন্ন করে
ভীষণ পূজা করেছি তোরে,
কখনো পূজা শোভন শতদলে,
বিচিত্রা হে বিচিত্রা,
হাসিতে কভু, কখনো আঁখিজলে।
ফসল যত উঠেছে ফলি
বক্ষ বিভেদিয়া
কণাকণায় তোমারি পায়
দিয়েছি নিবেদিয়া।
তবুও কেন এনেছ ডালি
দিনের অবসানে,
নিঃশেষিয়া নিবে কি ভরি
নিঃস্ব—করা দানে।”
[বিচিত্রা, পরিশেষে]
(১৯১)
“যে নিশ্বাস তরঙ্গিত নিখিলের অশ্রুতে হাসিতে,
তারে আমি ধরেছি বাঁশিতে।”
[বর্ষশেষ, পরিশেষ]
(১৯২)
“আপনার কাছ হতে বহুদূরে পালাবার লাগি হে সুন্দর, হে অলক্ষ্য, তোমার প্রসাদ আমি মাগি, তোমার আহ্বানবাণী। আজ তব বাজুক বাঁশরি, চিত্তভরা শ্রাবণপ্লাবনরাগে— যেন গো পাসরি।”
[মুক্তি, পরিশেষ]
(১৯৩)
“আকাশকোণে মেঘের রঙে মায়ার যেথা মেলা, তটের তলে স্বচ্ছ জলে ছায়ার যেথা খেলা, অশথশাখে কপোত ডাকে, সেথায় সারাবেলা তোমার বাঁশি শুনেছি বারে বারে।”
[আহ্বান, পরিশেষ]
(১৯৪)
“সহজ মনে পারি যেন আসর ছেড়ে দিতে নতুন কালের বাঁশিটিরে নতুন প্রাণের গীতে।”
[নূতন শ্রোতা, পরিশেষ]
(১৯৫)
“কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা”
[প্রশ্ন, পরিশেষ]
(১৯৬) “বাজে সেথা কী অশ্রুত বেণু।
মধ্যদিন তন্দ্রাতুর
শুনিছে রৌদ্রের সুর,
মাঠে শুয়ে আছে ক্লান্ত ধেনু।”
[আশীর্বাদী, পরিশেষ]
(১৯৭)
“ও যে সুরভবনের রমার কমলবনবাসী,
মর্তে নেমে বাজাইল সাহানায় নন্দনের বাঁশি।”
[পরিণয়, পরিশেষ]
(১৯৮)“বাঁশিতে লই মনের কথা তুলি
বিরহব্যথাবৃন্ত হতে ভাঙা—
গোপন রাতে উঠেছে তারা দুলি
সুরের রঙে রাঙা।
Í—————————————————————————————
সহসা মন উঠিল চমকিয়া
বাঁশিতে আর বাজিল না তো বাণী।
গহনছায়ে দাঁড়ানু থমকিয়া
হেরিনু মুখখানি।”
[নির্বাক, পরিশেষ]
(১৯৯) “বাঁশি যখন থামবে ঘরে,
নিববে দীপের শিখা,
এই জনমের লীলার ‘পরে
পড়বে যবনিকা,
সেদিন যেন কবির তরে
ভিড় না জমে সভার ঘরে,
হয় না যেন উচ্চস্বরে
শোকের সমারোহ;”
[দিনাবসান, পরিশেষ]
(২০০) “সুরের বাঁশি যদি তোমার
মনের মাঝে থাকে,
চলিতে পথে আপন—মনে
জাগায়ে দাও তাকে।”
[বিচার, পরিশেষ]
(২০১)
“ও পাড়ার তেলকলে বাঁশি ডাক দিত।
গলির মোড়ের কাছে দত্তদের বাড়ি,
কাকাতুয়া মাঝে—মাঝে উঠত চীৎকার করে ডেকে।
একটা বাতাবিলেবু, একটা অশথ,
একটা কয়েতবেল, একজোড়া নারকেলগাছ,
তারাই আমার ছিল সাথি।”
[সাথি, পরিশেষ]
# পরিশেষ প্রকাশের বৎসরে ও তার আগে রচিত রবীন্দ্রনাথের যেসব কবিতা বনবাণী বা পরিশেষে সংকলিত হতে পারতো অথচ সেখানে প্রকাশিত হয়নি তেমন কিছু কবিতা সংযোজনে (১৯৩২) সংকলিত হয়েছে। সংযোজনের কিছু কবিতাকে ভেঙে কবি পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র গান রচনা করেন যা গীতবিতানের বিভিন্ন অংশে লক্ষণীয়। সেই সব কবিতা বা গান আরো বেশি নান্দনিক করে তোলার প্রয়াসে কবি বাঁশির ব্যবহার করেন অনিবার্যভাবে।
(২০২) “বাঁশি পড়ে আছে তরুমূলে,
আজ তুমি আছ তারে ভুলে।
কোনোখানে সুর নাই,
আপন ভুবনে তাই
কাছে থেকে আছ দূরান্তরে।”
[প্রবাসী, সংযোজন]
(২০৩) “লিখতে যখন বল আমায়
তোমার খাতার প্রথম পাতে
তখন জানি, কাঁচা কলম
নাচবে আজও আমার হাতে।
সেই কলমে আছে মিশে
ভাদ্র মাসের কাশের হাসি,
সেই কলমে সাঁঝের মেঘে
লুকিয়ে বাজে ভোরের বাঁশি।”
[প্রথম পাতায়, সংযোজন]
(২০৪) “দূর রজনীর স্বপন লাগে
আজ নূতনের হাসিতে।
দূর ফাগুনের বেদন জাগে
আজ ফাগুনের বাঁশিতে।”
[নূতন, সংযোজন]
(২০৫) “কিছু—বা স্মরি পিছু পাসরি।
যে আছে যে—বা নাই আজিকে দোঁহে মিলি
আমার ভাবনাতে ভ্রমিছে নিরিবিলি
বাজায়ে ফাগুনের বাঁশরি।”
[জীবনমরণ, সংযোজন]
(২০৬)
“গোরুর গাড়ি মেঠো পথের তলে
উড়তি ধুলোয় দিকের আঁচল ধূসর ক’রে চলে।
নীরবতার বুকের মধ্যখানে
দূর অজানার বিধুর বাঁশি ভৈরবী সুর আনে।”
[আমি, সংযোজন]
(চলবে—)
নাজমুল টিটো, গবেষক ও প্রাবন্ধিক