এখন সময়:রাত ১০:০৫- আজ: বুধবার-৯ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-বর্ষাকাল

এখন সময়:রাত ১০:০৫- আজ: বুধবার
৯ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-বর্ষাকাল

বাঁশি: চিরন্তন বাংলার গৌরব ও ঐতিহ্যের নিজস্ব সুর

নাজমুল টিটো :

কবে কখন কোথায় কে প্রথম বাঁশিতে সুর তুলেছিল তা এখনো অমীমাংসিত। অ্যাড্রাল পাওয়েলের মতে, “অনেক প্রাচীন সংস্কৃতিতে বাঁশির মতো সরল যন্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। লোকমত এবং পুরাতত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে বাঁশির তিনটি জন্মস্থান চিহ্নিত করা যায়: মিশর, গ্রিস ও ভারত। আড়াআড়ি বাঁশি এই তিনটে জায়গাতে পাওয়া গেলেও পাশাপাশি বাজানোর (অনুদৈর্ঘ্য) বাঁশি একমাত্র প্রাচীন ভারতেরই অবদান। পাওয়েলের ধারণা, মধ্যযুগের পর থেকে ভারতীয় বাঁশির গঠনে তেমন কোনো বিবর্তন হয়নি। তাছাড়া ভারতীয় বাঁশি থেকে সামান্য আলাদা নকশার বাঁশি দেখা যায় চীনে, সেই ভিত্তিতে বলাই যায়, প্রথম বাঁশির জন্ম ভারতেও হয়নি, চীনেও হয়নি। সম্ভবত এর জন্ম হয়েছিল আরো অনেক আগে, মধ্য এশিয়ায়।” মধ্যযুগের ভারতীয় বাঁশি অন্যান্য সংস্কৃতিতে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় শিল্পকলায় বাঁশির প্রভাব এতটা বেড়েছিল যে, লুসার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ছাত্র লিয়েন এলিচের মত ছিল, “বাঁশি ১০ম শতাব্দীতে ভারত থেকে বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যে পৌঁছায় এবং ভারতের মতোই ইউরোপেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।”

বাঙালির বাঁশি

বাঁশি বাঙালি সংস্কৃতির আদি ও প্রাচীনতম এবং জনপ্রিয় দেশীয় একটি বাদ্যযন্ত্র তাতে কোন দ্বিমত নেই। খুব সহজে ও স্বল্প খরচে এটা বানানো যায়। গঠনশৈলীও খুবই সাধারণ এবং সাদামাটা। আর সুর? এর সুর বিশ্ব সংগীতের অন্যান্য সুরযন্ত্রের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এই সুর চিরন্তন বাংলার গৌরব ও ঐতিহ্যের একান্ত নিজস্ব সুর। এতে কারো ভাগ নেই। এতে কোনো খাদ নেই। বাঙালির নিজস্ব প্রায় ৬০০ ধরণের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বাঁশি ও তার সুর স্বকীয় ও অন্যতম।

দুই অক্ষরের এই ফুৎকার বাদ্য যন্ত্রটি একইসঙ্গে আনন্দ-বিরহ, প্রেম-প্রলয়, জীবন-মৃত্যু, মূর্ত ও বিমূর্তের প্রতীক। বাঁশি চেনেন না কিংবা বাঁশি সম্পর্কে ধারণা নেই এমন কোনো বেরসিক বাঙালির খোঁজ পাওয়া দুষ্কর হবে। বাংলায় বাঁশিকে মুরলী, মোহন বাঁশি, বেণু , বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বাঁশির পাশ্চাত্য সংস্করণের নাম ফ্লুট (flute)।

আবাল বৃদ্ধ নরনারী, ধনী-দরিদ্র, সাধু- শয়তান, রাজা-প্রজা, সবার কাছেই বাঁশি সমান প্রিয়। তাইতো বাঁশি আপন মহিমায় আজো বেজে চলেছে বাংলার হাঁটে-মাঠে-ঘাটে, মেঠোপথে, জীর্ণ কুটিরে, অট্টালিকায়, প্রাসাদে, রাজপথে,জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ অনুষ্ঠানে, সুরের জলসায়, মেলা-পালা-পার্বণে, সাংস্কৃতিক ও সভামঞ্চে। এক কথায় গ্রাম থেকে শহরে সর্বস্থানে সর্বস্তরে বাঁশির মর্মস্পর্শী সুরের মূর্ছনা সমান জনপ্রিয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। ইদানীং কেউ কেউ শখের বশে বিভিন্ন ধাতব পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরি করেন। উপমহাদেশে বিভিন্ন রকম বাঁশী দেখা যায়। তার মধ্যে বহুলপরিচিত সরল বাঁশি, আড়বাঁশি, টিপরাই বাঁশি, সানাই বাঁশি, বীণ বাঁশি, মোহন বাঁশি উল্লেখযোগ্য।

বাঁশি প্রসঙ্গ এলেই মনের পর্দায় সর্বাগ্রে ভেসে ওঠে অর্ফিয়াস, নিরো, হ্যামিলন, ও শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির ছবি, সুর এবং তাঁদের নিয়ে রচিত অজস্র মিথ, পুরাণ, গল্প ও কল্পকথা।

 

অর্ফিয়াসের বাঁশি:

অর্ফিয়াস প্রাচীন গ্রীক ধর্মের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, কবি এবং ধর্মগুরু। গ্রিক মিথ ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা যায় অর্ফিয়াস নির্ভর কাব্য ও সাহিত্য রচনার সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী কিম্বা তারও আগে থেকে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অ্যাপোলনিয়াস রোডিয়াসের লেখা গ্রীক মহাকাব্য, হেলেনিস্টিক এলিজিয়াক কবি ফ্যানোক্লেস অনুসারে অর্ফিয়াস অনেক পুরনো পুরাণ চরিত্র। দারভেনি প্যাপিরাস অনুসারে অর্ফীয় পুরাণ খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের শেষের দিকে রচিত হয়েছিল। অর্ফীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুশীলন হেরোডোটাস, ইউরিপিদেস এবং প্লেটো দ্বারা সত্যায়িত হয়।

অর্ফিয়াস হচ্ছে গ্রীক মিথলজির এক সুরেলা চরিত্র ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব সুর স্রষ্টা। দেবতাদের পরে মরণশীলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সুরের জাদুকর এই অর্ফিয়াস মূলত ছিলেন একজন বংশীবাদক। কারো কারো মতে অর্ফিয়াস থ্রেসের রাজা ইগ্রাসের সন্তান। তবে দেবতা এপোলোর পুত্র হিসেবেই তিনি বেশি স্বীকৃত। অর্ফিয়াসের মা ছিলেন মিউজ ক্যালিওপ। অর্ফিয়াস বাস করতেন অলিম্পাসের কাছাকাছি পিম্পলিয়ায়। যেখানে শৈশব তাঁর বাবা-মা ও বোনদের সাথে কেটেছে। অর্ফিয়াসের সুর, সঙ্গিত ও কাব্যগুরু ছিলেন স্বয়ং তাঁর মা ও বাবা। অর্ফিয়াস “Lyre” নামক যে বাদ্যযন্ত্রটি বাজাতেন এটি দেবতা এপোলোই অর্ফিয়াসকে বাজানো শেখান। অর্ফিয়াসের সংগীতে মুগ্ধ হয়ে দেবতা এপোলো কচ্ছপের খোল দিয়ে তৈরি নিজের খুৎবটি অর্ফিয়াসকে উপহার দিয়েছিলেন। শেক্সপিয়র তার কবিতায় যন্ত্রটিকে “Lute” বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তা শুধুমাত্র কবিতার ছন্দ বজায় রাখার স্বার্থে হয়তোবা। গ্রীক পুরাণে “Lyre” খুবই জনপ্রিয় একটি বাদ্যযন্ত্র। উপমহাদেশে যা বাঁশি হিসেবে অধিক পরিচিত। দেবতা হারমিসের তৈরি এ বাঁশির পূর্ণতা পেয়েছিল অর্ফিয়াসের কাছেই। তাঁর সুর শুনে প্রাণীকুল থেমে যেতো, নদীর গতিপথ বদলে যেতো, গাছপালা শিকড় ছিঁড়ে সামনে এগিয়ে যেতো, পাথর থেকে ঝরে পড়তো কান্না। এমনও হয়েছে যে অর্ফিয়াসের সুর শুনে দেবতাদের যুদ্ধ থেমে গেছে , ঝরে যাওয়া ফুলগুলো আবার হেসেছে।

অর্ফিয়াস ও ইউরিডাইসের অমর প্রণয় গাথাটি হলো অন্যতম জনপ্রিয় গ্রীক মিথ। তাঁর এই অমর প্রেম কাহিনির সবচেয়ে বড প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল অর্ফিয়াসের বাঁশির সুর। অর্ফিয়াস প্রথম দেখাতেই ইউরিডিস নাম্নী এক অপূর্ব রূপবতী মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। ইউরিডিসকে তার ভালোবাসার কথা জানায়। তাঁর মতো সুর সম্রাটকে কোনো কুমারীর পক্ষেই  প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা ছিল না। ইউরিডিস অর্ফিয়াসের ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করে। ক’দিন বাদে তাঁরা বিয়ে করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের সুখ স্থায়ী হয়নি। বিয়ের দিনই ইউরিডিস তাঁর সখীদের সাথে নিয়ে বাগানে হাঁটার সময় ভয়ঙ্কর এক বিষাক্ত সাপের ছোবলে ইউরিডিস মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ইউরিডিসের মৃত্যুতে অর্ফিয়াস শোকে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন। তাঁর বিষণœ সুরে দেবতারাও কাঁদতে থাকেন। অর্ফিয়াস তাঁর বাঁশির সুরের মূর্ছনায় পাতালপুরীতে গিয়ে ইউরিডিসকে ফেরত আনতে দুঃসাহসী অভিযানে নেমে পড়েন। তবে এই পথ ছিল খুবই বিপদসংকুল। পথ চলতে চলতে তিনি পৌঁছান আকেরুসিয়া নামক এমন এক উপত্যকাতে যেখান থেকে পথ গভীর হতে হতে পাতালপুরীর দিকেই নেমে গেছে। সেখানে অর্ফিয়াস এমন এক মায়াবী সুর উঠালেন তাঁর বাঁশিতে সমস্ত পাতালপুরী স্তব্ধ হয়ে গেলো। মৃত্যুপুরীর দরজায় পাহারা থাকা কুকুর সারবেরাস থমকে গেলো। সিসিফাস তাঁর কাজ ফেলে বসে রইলেন বিশ্রামে, ইকসায়নের অগ্নিচক্র স্থির হল, ট্যান্টালাস ভুলে গেলেন তাঁর তৃষ্ণার কথা , ভয়ঙ্কর ফিউরি দেবীদের চোখ থেকে প্রথমবারের মতো অশ্রু ঝরল।

হেডিসের রাজা ও রাণি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই সুর বিমোহিত হয়ে অবশেষে ইউরিডিসকে অর্ফিয়াসের সাথে যেতে দিতে রাজি হলেন। তবে শর্ত একটাই ছিল যে মৃত্যুপুরী থেকে বের হবার আগে অর্ফিয়াস ইউরিডিসকে দেখতে পারবেন না। যদি তিনি দেখেন, তবে ইউরিডিস চিরদিনের জন্য আবার হারিয়ে যাবে। অর্ফিয়াস এ প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি বাঁশি বাজিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। পিছে ছিল ইউরিডিস। তিনি জানতেন তাঁর পিছে থাকবে ইউরিডিস কিন্তু তবু তাকে এক পলক দেখার জন্য তাঁর হৃদয় আকুল হয়ে উঠলো। পথ আর বেশি বাকি নেই , অন্ধকার মিলিয়ে মর্ত্যলোকের আলো দেখা যাচ্ছে, ঠিক এসময় দেবতাদের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে অর্ফিয়াস পিছে তাকালেন। তিনি তাঁর হাত বাড়ালেন ইউরিডিসকে আলিঙ্গনের জন্য। কিন্তু ইউরিডিস দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলো চিরদিনের জন্য। পাগলপ্রায় অর্ফিয়াস আবার মৃত্যুপুরীতে ফেরত যেতে চাইলেন। কিন্তু জীবন্ত কাউকে মৃত্যুপুরীতে দ্বিতীয়বার ঢুকতে দেয়ার নিয়ম নেই। অর্ফিয়াসকে একাই মর্ত্যলোকে ফিরে যেতে হল। বিষণœতায় ডুবে গিয়ে অর্ফিয়াস মানুষের সাহচর্য ত্যাগ করলেন। তাঁর বাঁশির সুরই হল একমাত্র সঙ্গী। একা একা তিনি ঘুরে বেড়াতেন থ্রেসের দুর্গম সব অঞ্চলে। তাঁর সুরের শ্রোতা ছিল প্রকৃতি, গাছপালা, পর্বতমালা। নিঃস্ব অর্ফিয়াস একাকী এভাবেই ঘুরে বেড়াতে থাকেন দিনের পর দিন। অবশেষে একদিন থ্রেসিয়ান মেইনাডরা তাঁদের দেবতাকে অবমাননার অভিযোগ এনে অর্ফিয়াসকে আক্রমন করে হত্যা করে। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে অর্ফিয়াসের জীবন ও তার বিখ্যাত বাঁশির সুর।

 

নিরোর বাঁশি:-

ইংরেজিতে প্রবাদ আছে “Nero fiddles while Rome burns”. বাংলায় “রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন”। ওখানে মূলত বাঁশি নয়, বেহালার কথা বলা হয়েছিল। যাই হোক এই ঘটনা কিংবা রটনার মধ্য দিয়ে নিরো চিহ্নিত হয়ে আছেন ইতিহাসের কুখ্যাত স্বৈরাচারী সম্রাটদের একজন এবং তাঁর নামের সাথে স্থায়ীভাবে এই বদনাম জড়িয়ে গেছে যে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে রোমের নাগরিকরা যখন দিশেহারা তখনও সম্রাট নিরো বেহালা/চিতারা কিংবা বাঁশিতে সুর তুলে সংগীতের নির্যাশ আস্বাদনে নিমগ্ন।

রোমের পঞ্চম সেনাপতি এবং জুলিও-ক্লদিয়ান বংশের শেষ শাসক নিরো ক্লডিয়াস সিজার অগাস্টাস জার্মানিকাস (পূর্ণ নাম) জন্ম গ্রহণ করেন ৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর। এই জুলিও-ক্লদিয়ানই রোমান সামাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। নিরোর বয়স যখন মাত্র ২ বছর, তখন সম্রাট ক্যালিগুলা নিরোর মা অ্যাগ্রিপিন্নাকে নির্বাসে পাঠান। নিরোর মায়ের প্র-পিতামহ ছিলেন অগাস্টাস, যিনি ছিলেন এই এই সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা। ৩ বছর বয়সে নিরো তার বাবাকে হারান। এরপর তিনি তাঁর খালার কাছে বড় হতে থাকেন। রাজা ক্লদিয়াস ৪১ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিগুলাকে খুন করে ক্ষমতা দখল করার পর অ্যাগ্রিপিন্নাকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে বিয়ে করেন। সেই সুবাদে নিরো তার সৎ বাবার সংসারে আবারো মায়ের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পায়। নিরো’র মা এগ্রিপ্পিনা দি ইয়াঙ্গার ক্লদিয়াসকে হত্যা করেন। ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পর মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৩ অক্টোবর, ৫৪ খ্রিস্টাব্দে নিরো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন। ক্লদিয়াসের ঔরসজাত পুত্র ব্রিটানিকাসের পরিবর্তে নিরোর সিংহাসন গ্রহণ নিশ্চিতকল্পে ইয়াঙ্গার এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে অজনপ্রিয় সম্রাট নিরোর রাজত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, হত্যা, রক্তপাত ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অসংখ্য হত্যাকান্ডের মূল হোতা সম্রাট নিরো নিজের মা’কে হত্যা করেন, বিষ খাইয়ে মেরেছেন সৎ ভাই ব্রিটানিকাসকেও। প্রচলিত আছে, নিরো তাঁর প্রথম স্ত্রী অকটাভিয়াকেও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেষে ৯ জুন, ৬৮ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩০ বছর বয়সে নিরো আত্মহত্যা করেন।

এতো গেল তাঁর ব্যক্তিজীবন। শাসনামলে যে ঘটনার জন্য সম্রাট নিরো ইতিহাসের নিন্দিত নায়ক হিসেবে কিংবদন্তি হয়ে আছেন তা হলো রোমের অগ্নিকাণ্ড । যেটি ইতিহাসে “দ্য গ্রেট ফায়ার অব রোম” নামে পরিচিতি পায়।

অনেক ইতিহাসবিদের মতে ১৯ জুলাই, ৬৪ খ্রিস্টাব্দে নিরো অ্যান্টিমে (যেটি এখন ইতালির অ্যানজিও শহর) ছুটি কাটানোর সময় রোম নগরীতে আগুন লাগার খবরটিকে তাচ্ছিল্যের সাথে গুজব বলে উড়িয়ে দেন এবং Lyre বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান গাওয়া অব্যাহত রাখেন। এক সপ্তাহ পর যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে রোমের ১৪টি জেলার ১০টি পুরোপুরি ভষ্ম হয়ে যায় এবং শহরের ৫-১০ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। আবার অনেকের ধারণা নিরো নিজেই এই আগুন লাগিয়েছেন এবং রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, নিরো নাকি তখন তার প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাচ্ছিলেন।

রোমের ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস ও ড্রেক  এর মতে- অগ্নিকাণ্ডের সময় নিরো আগুনের খবর শুনে স্বভাবতই দ্রুত রোমে ফিরে যান এবং ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নেন। নিজস্ব তহবিল থেকে যাবতীয় ব্যয়ভারও বহন করেন। এমনকি যে প্রাসাদে দাঁড়িয়ে তিনি বেহালা বাজাচ্ছিলেন বলে গুজব প্রচলিত, সেখানে তিনি বরং গৃহহীনদের আশ্রয় দেন। সংগীতের ইতিহাস গবেষকদের দাবি ১১ শতাব্দীর আগে বেহালা আবিষ্কার হয়নি। তবে নিরো নিজে সংগীত চর্চা করতেন এবং সংগীতের একজন বড় সমঝদার ছিলেন এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।

তবে ঐ সময়ের জীবিত ইতিহাসবিদদের মধ্যে দিও ক্রাইসোসতম, প্লুতার্ক এবং এপিকটেটাস এর অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে কোনরকম মন্তব্য না থাকার কারণটা বড্ড  রহস্যজনক। এতে এ ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক ভয়ংকর স্বৈরাচারী শাসক নিরোর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভীত হয়ে হয়তোবা তাঁরা মুখ খোলার সাহস করেন নি।

বস্তুত, সম্রাট নিরো রোম পুড়ে যাওয়ার সময় বেহালা বাজাচ্ছিলেন এই কথাটি ছড়ানো শুরু হয় ওই অগ্নিকান্ডের দেড়শ বছর পর থেকে! আর এই কাহিনীটি রচনা করেছিলেন ক্যাসিও ডিও। যা রটে তার কিছু তো বটে। গুজব হোক আর সত্য হোক বিশ্ববাসী বিশ্বাস করতে শুরু করে নিরোর কারণেই। তিনি অগ্নিকান্ডের পর পুড়ে যাওয়া জায়গায় তাঁর স্বপ্নের ডোমাস অরিয়া (Domus Aurea) বা স্বর্ণগৃহ নির্মাণ শুরু করেন। আর এই ডোমাস অরিয়া স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই অনন্য নিদর্শনের জন্য  মানুষ তাঁকে মনে রাখেনি। কারণ,অগ্নিকান্ডের দায়ভার খৃষ্টানদের ওপর চাপিয়ে তাদের হত্যা করা এবং ধ্বংসস্তূপের উপরই এই প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করার মাধ্যমে নিরো নিজেই নিজেকে ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ করে দিয়ে গেছেন। এটিই হয়ত পোয়েটিক জাস্টিস!

 

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা:-

হ্যামেলিন (Hameln/Hamelin) হচ্ছে জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের ছোট্ট একটি শহর। ১২৮৪ সালে এই শহরে আগন্তক এক অদ্ভুত বংশীবাদককে নিয়েই এই গল্প। হ্যামেলিন শহরে তখন ইঁদুরের প্রকোপে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে যেন এসে  হাজির হলেন এক বাঁশিওয়ালা। তার গায়ে ছিল রঙ বেরঙের পোশাক। ইঁদুরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে এই বাঁশিওয়ালা শহরের প্রধান ব্যক্তি মেয়রকে ইঁদুর তাড়ানোর একটি প্রস্তাবনা দিলেন। মেয়র তার কথামতো রাজি হয়ে গেলেন। সত্যিই ইঁদুর তাড়াতে পারলে মেয়র তাকে ১০০০(এক হাজার) সোনার মুদ্রা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বাঁশিওয়ালা তার বাঁশিতে মোহনীয় এক সুর তুললো। সেই সুরে শহরের সব ইঁদুর সুড়সুড় করে বংশীবাদকের পিছু নিল। বংশীবাদক শহরের পাশের Weser নদীর তীরে গিয়ে হঠাৎ বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দিল। ইঁদুরের দল নদীর পানিতে তলিয়ে গেল।

বাঁশিওয়ালা ফিরে এসে মেয়রের কাছে তার প্রাপ্য সোনার মুদ্রা চাইলেন। কিন্তু মেয়র তাকে ১ হাজার সোনার মুদ্রা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। দিলেন মাত্র ৫০টি সোনার মুদ্রা। মেয়রের আচরণে বাঁশিওয়ালা কষ্ট পেলেন এবং প্রতিশোধের প্রত্যয় ব্যক্ত করে চলে গেলেন।

কিছুদিন পর শহরের একটি চার্চে শহীদ ‘সেন্ট জন পল দিবস’ স্মরণে অনুষ্ঠান চলছিল। সে অনুষ্ঠানে সবাই চার্চে  ছিল। সেদিন বাঁশিওয়ালা আবার ফিরে এলো। তবে এবার তার গায়ে ছিল সবুজ রঙের পোশাক। তখন সকাল সাতটা। বাঁশিওয়ালা এবার বাজাতে শুরু করল ভিন্ন আরেক মায়াবী সুরে। সাথে সাথেই হাঁটতে পারে এমন সব শিশু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আর বাঁশিওয়ালার সম্মোহিত বাঁশির সুর অনুসরণ করে ১৩০ জন শিশু এক পাহাড়ের গুহায় ঢুকে গেল। আর ফিরে এলো না। তাদের সঙ্গে নিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল সেই বাঁশিওয়ালা। হারিয়ে যাওয়া শিশুদের সঙ্গে মেয়রের মেয়েও ছিল। শিশুদের মধ্যে দু’জন দল থেকে পিছিয়ে পডিেছল। তারাই নাকি ফিরে এসে এসব কথা জানাল শহরবাসীকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শিশু দু’টির একজন মূক ও অন্যজন দৃষ্টিহীন হওয়ায় বাঁশিওয়ালার গন্তব্য সম্বন্ধে সঠিক তথ্য আর জানা যায়নি।

 

ইতিহাস বিখ্যাত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে এ যাবত কম গবেষণা হয়নি। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা, গল্প আর উপন্যাস এমনকি ছায়াছবিও তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এর অনুকরণে নানা রূপকথা চালু আছে। হ্যামিলন শহরে এ সংক্রান্ত একটি জাদুঘরও রয়েছে। ওই জাদুঘরে সঞ্চিত পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা কয়েকটি বইয়ে এ রহস্যময় কাহিনির বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার রহস্য আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে।

 

শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি:-

“কৃষ্ণের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়, বৈদিক সাহিত্যে। বেদ-এ একাধিকবার কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। সেখানে তিনি ইন্দ্রবিরোধী একজন অনার্য যোদ্ধা হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। কোথাও তাকে ঋষি এবং অসুরও বলা হয়েছে। ছান্দোগ্যোপনিষৎ এবং কৌষিতকীব্রাহ্মণে কৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন এই কৃষ্ণই পৌরাণিক যুগে বাসুদেব কৃষ্ণে পরিণত হয়েছেন। মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগভত এবং বৈষ্ণবকাব্যে যে কৃষ্ণের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে তার আবির্ভাব দ্বাপর যুগে। কৃষ্ণকে কেউ কেউ অনার্য দেবতা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের মতে আদিম জনগোষ্ঠীর উপাস্যই দেবতা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তন হয়। কৃষ্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তি কি-না এ বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন তাঁর মানবীয় কোনো অস্তিত্ব ছিল না, আবার কারও কারও মতে তিনি একজন আদর্শচরিত্র ঐতিহাসিক পুরুষ, ধর্ম প্রবক্তা ও সংস্কারক ছিলেন এবং কালক্রম ভক্তরা তাঁকে দেবতা, এমনকি ভগবানের পর্যায়ে উন্নীত করেন। প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে মাতুল কংসের কারাগারে ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথিতে কৃষ্ণের জন্ম। তাঁর জন্মসূত্রে এ দিনটি প্রতিবছর জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়। কৃষ্ণের কাহিনির পিছনে ঐতিহাসিক সত্য থাক বা না থাক, তিনি যিনিই হোন না কেন, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন গ্রন্থে এবং ভক্তদের বোধ বিশ্বাসে, মন ও মননে তাঁর যে আদর্শ রূপটি গড়ে উঠেছে, তার প্রভাব হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিতে এবং সংস্কৃত ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। ভারতীয় অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যও কৃষ্ণকাহিনির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দম, বড়–চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের এক বিরাট অংশ শ্রীকৃষ্ণ কাহিনি নিয়ে রচিত। পদাবলী, কীর্তন, পালাগান, বিচ্ছেদী গান ইত্যাদি লোকসংগীত রাধা কৃষ্ণের প্রণয়-কাহিনীকে আশ্রয় করেই রচিত হয়েছে। এগুলি এক সময়ে বাঙালি  সমাজের খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং আজও তা শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়।”

[ বাংলাপিডিয়া: কৃষ্ণ, দুলাল ভৌমিক]।

বিভিন্ন গ্রন্থ ও কাহিনিতে কৃষ্ণ চরিত্রের বর্ণনায় যে বৈচিত্র্যময় রূপ পাওয়া যায় তার প্রধানত তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরোপকারী, প্রেমিক ও রাজনীতিজ্ঞ। কৃষ্ণের প্রেমিক রূপের পরিচয় পাওয়া যায় তার বৃন্দাবন লীলায়। হরিবংশপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থে তিনি চিত্রিত হয়েছেন একজন প্রেমিক, ভক্তসখারূপে। আর এই প্রেমিক পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রধান অস্ত্রই ছিল বাঁশির সুর। বাঁশির সুরে মুগ্ধ হত সবাই। শ্রীকৃষ্ণ বলতেই বাঁশি হাতে তাঁর ছবিই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই বাঁশির সুরেই পাগল হয়ে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতেন শ্রীরাধিকা। শ্রীকৃষ্ণের মোহন বাঁশি প্রেম, ভালোবাসা ও আকর্ষণের প্রতীক। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির নাম মহানন্দা। একে সম্মোহিনীও বলা হয়ে থাকে। বাঁশির সেই সম্মোহনী সুরে শ্রী রাধার যে বেহাল দশা হয়েছিল বডুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বংশীখ-ের বিখ্যাত এই ভক্তি রসে সমৃদ্ধ গানের মাধ্যমেই পাঠক তার বাস্তবের রসে সিক্ত হন।

“সুসর  বাঁশরি নাদ শুণিআঁ বড়ায়ি

রান্ধিলোঁ যে সুনহ কাহিনী।

আম্বল  ব্যঞ্জনে  মো বেশোআর দিলেঁ।

সাকে দিলোঁ কানাসোআঁ পাণী।।

রান্ধনের  জুতী  হারয়িলোঁ বড়ায়ি

সুণিআঁ বাঁশীর নাদে।।ধ্রু।।

নান্দের নন্দন কাহ্ন আড়বাঁশী নদে।।ধ্রু।।

যেন রএ পঞ্জরের  শুআ।

তা সুণিআঁ ঘৃতে মো পরলা বুলিআঁ

ভাজিলো এ কাঁচা গুআ।।

সেইত বাঁশীর নাদ সুনিআঁ  বড়ায়ি

চিত্ত মোর ভৈল আকুল।

ছোলঙ্গ চিপিআঁ নিমঝোলে খেপিলোঁ।

বিণি জলে চড়াইলোঁ চাউল।।

যমুনার তীরে  কদম তরুতলে

তহি বসি কাহ্ন  বাএ বাঁশে।

তাক আণিআঁ বড়ায়ি রাখহ পরাণ

গাইল বড়ু চন্ডীদাসে”।।

 

অর্থাৎ কৃষ্ণের বাঁশির সুর রাধাকে পাগল করে তুলেছে। মন আর তাঁর বশে নেই।সে মন দাসখত লিখে দিয়েছে বংশীবাদকের শ্রীচরণে। আর তাই কৃষ্ণের প্রেমে দিশেহারা হয়ে যাওয়া শ্রীমতীর সকল কাজে কেবলই ভুলের সংখ্যা বাড়ে। রাধা তার সখি বড়াইকে সেই ভুলের বৃত্তান্ত শোনাচ্ছেন,”বড়াই গো, সুমধুর সেই বংশীধ্বনি শুনে কি রাঁধন আমি রাঁধলাম সে কাহিনি বলি শোনো। অম্বল ব্যঞ্জনে আমি দিলাম ঝাল মশলা আর শাকের হাঁড়িতে আমি এত জল ঢাললাম যে সে হাঁড়ি  কানা অবধি ভরে উঠল। বড়াই গো,  বাঁশির শব্দ শুনে আমার রান্নার জুত হারিয়ে গেল। নন্দনন্দন যে আড়বাঁশি বাজান তার সুর শুনলে মনে হয় পিঞ্জরে বদ্ধ শুকপাখি গান গাইছে। রাধারানী বলছেন, সেই সুর শুনে দেখো আমি পটল ভেবে কাঁচা সুপুরি ঘিয়ে ভেজে ফেলেছি। বুঝে দেখ বড়াই সেই বাঁশির ধ্বনি শুনে চিত্ত আমার কেমন আকূল। আমি তিক্ত নিমের ঝোলে লেবুর রস দিয়ে ফেলেছি, আর জল  ছাড়াই হাঁড়িতে ভাত চাপিয়েছি। বড়াই, ওই যমুনার তীরে কানাই বাঁশি বাজাচ্ছেন। তাকে আমার কাছে এনে দাও তুমি। তাকে না পেলে আমি যে আর বাঁচবো না। তাকে এনে তুমি আমার প্রাণ বাঁচাও।” সমাজের সাধারণ নারীর মত রাধার এই আর্তি আমাদের হৃদয়কে রসে পরিপূর্ণ করে তোলে।

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে শিশু কৃষ্ণকে বাঁশি উপহার দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব। পুরাণ কথা অনুসারে মহর্ষি দধীচির শরীরের হাড় দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি তৈরি হয়। শ্রীকৃষ্ণ যখন ছোট বালক ছিলেন, তখন একবার সেই ছোট্ট গোপালের লীলা দর্শন করতে আসেন স্বয়ং মহাদেব। তিনিই কৃষ্ণকে ওই বাঁশি উপহার দেন। তারপর থেকেই বাঁশি হয়ে ওঠে শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয়। বাঁশির সুরে গোটা বিশ্বব্রহ্মা-কে মোহিত করে দেন শ্রীকৃষ্ণ। গোকূলে তিনি যখন গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাতেন, তখন শুধু সেখানকার বাসিন্দারা নন, বনের প্রাণীও ভিড় করে আসত তাঁর বাঁশির সুর শুনতে।

একসময় কংসকে বধ করার উদ্দেশ্যে বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা রওনা দেন কৃষ্ণ। কংস বধ করার পরে স্বর্ণ দ্বারকা নির্মাণ করে সেখানেই রাজত্ব স্থাপন করেন তিনি। সেখানে রুক্মীনিকে বিবাহ করে সংসার জীবন শুরু করেন। রুক্মীনিকে স্ত্রীর সম্মান ও ভালোবাসা দিলেও মন থেকে কখনোই রাধাকে দূর করতে পারেননি শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর মন সব সময় রাধার প্রতি অনুরক্ত ছিল। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে সারা জীবন নিজের সকল কর্তব্য পালন করে শেষ সময়ে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন কৃষ্ণ। সেই সময় কৃষ্ণ রাধাকে কিছু প্রার্থনা করতে বলেন। তখন রাধা শেষবারের মতো কৃষ্ণের মোহন বাঁশির সুর শুনতে চান। তখন রাধাকে বাঁশি বাজিয়ে শোনান কৃষ্ণ। সেই বাঁশির পাগল করা সুর শুনতে শুনতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাধা। রাধাকে হারানোর শোক সহ্য করতে না পেরে নিজের বাঁশি ভেঙে ফেলে তা ছুড়ে ফেলে দেন কৃষ্ণ। এভাবেই শ্রীকৃষ্ণের হাতেই তাঁর প্রিয় বাঁশির মৃত্যু হয়। সেই সাথে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে জীবন্ত কিংবদন্তি চরিত্র রাধা কৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে তাঁদের প্রণয়ের প্রধান অনুঘটক কৃষ্ণের বাঁশির সুর যে ভূমিকা পালন করে তা অবিস্মরণীয়।  কৃষ্ণের তিরোধানের পর সেই বাঁশির সুর, চেতনা, রস, রেশ, সবই স্বমহিমায় ছড়িয়ে পড়ে উত্তর প্রজন্মের মাঝে। তারই ধারাবাহিকতায় শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বৈষ্ণব কবিদের হাত ধরে সরাসরি চলে আসে রবীন্দ্রনাথের হাতে।

 

রবীন্দ্রনাথের বাঁশি:

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র সাহিত্যজুড়ে আছে বাঁশির বিশেষ প্রভাব। উত্তারাধিকার সূত্রে শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিতে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই প্রভাব তিনি ধারণ করেছেন তাঁর বহুমাত্রিক সৃষ্টিতে। অনন্য কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতে, “বাঁশি-সংক্রান্ত যে ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, সে ঐতিহ্যকে তিনি তাঁর নিজস্ব দর্শন, অনুভবের প্রতীকে পরিণত করেন। রবীন্দ্রনাথের বাঁশি জীবনের অপূর্ণতাকে পূর্ণতার সমান্তরালে স্থাপন করে আমাদের। কবির উপলব্ধির মধ্য দিয়ে এসব কবিতার সত্য মানুষকে জীবন-উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের বাঁশি লৌকিক এবং অলৌকিক অনুভবের আলোছায়ায় সম্পৃক্ত করে আমাদের। আমরা তাঁর রচনায় কখনো দৃশ্যমান বাঁশির সুর শুনি, কখনো অনুক্ত উচ্চারণে সে সুর আমাদের মাঝে জেগে থাকে। তার বাঁশির সুর শুধু ব্যক্তি জীবনকে নয়, ভেঙে দেয় ব্যক্তি জীবনের গন্ডিকে। সে বাঁশি সমষ্টির হয়। কখনো দিকনির্দেশনারও কাজ করে।”

শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি ও বৈষ্ণব পদাবলীতে রবীন্দ্রনাথ এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী সময়ে কবির কাব্য সাধনার প্রথম পর্বে রচিত ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ কাব্যের প্রতিটি পদাবলীতে বাঁশি এক বিশেষ উপাদানের স্থান দখল করে নেয়। পদাবলী প্রসঙ্গে কবি বলেন, প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা স্লেটের উপরে, অন্তঃপুরের কোণের ঘরে-

“গহনকুসমকুঞ্জমাঝে মৃদুল মধুর বংশি বাজে।”

[ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-৮]

 

এরপর প্রতিটি পদাবলীতে শুনতে পাই এই বাঁশির সুর এবং সুরের ব্যঞ্জনা। যেমন :

 

৬ নম্বর পদাবলী :-

“ইতি ছিল নীরব বংশীবটতট,

কথি ছিল ও তব বাঁশি?”

 

৭ নম্বর পদাবলী :-

“শুন সখি, বাজত বাঁশি

গভীর রজনী, উজল কুঞ্জপথ

চন্দ্রম ডারত হাসি

 

কহ সখি, কহ সখি, মিনতি রাখ সখি,

সো কি হমারই শ্যাম?

মধুর কাননে মধুর বাঁশরী

বজায় হমারি নাম?

 

শ্যাম রে,

শুনত শুনত তব মোহন বাঁশি,

জপত জপত তব নামে,

সাধ ভইল ময় দেহ ডুবায়ব

চাঁদউজল যমুনামে!”

 

৯ নম্বর পদাবলী :-

“সজনী শুন, বাঁশরী বাজে,

কুঞ্জে আওল কালা।

চকিত গহন নিশি, দুর দূর দিশি

বাজত বাঁশি সুতানে।”

 

১০ নম্বর পদাবলী :-

“বজাও রে মোহন বাঁশি।

সারা দিবসক বিরহদহনদুখ,

মরমক তিয়াষ নাশি।

রিঝমনভেদন বাঁশরিবাদন

কঁহা শিখলি রে কান?

হানে থিরথির মরমঅবশকর

লহু লহু মধুময় বাণ।”

 

১৩ নম্বর পদাবলী :-

“বোল তো সজনী, এ দুরুযোগে

কুঞ্জে নিরদয় কান

দারুন বাঁশি কাহ বজায়ত

সকরুণ রাধা নাম।”

 

১৯ নম্বর পদাবলী :-

‘মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান’-

 

এই পদাবলীতে বাঁশি এসেছে এভাবে-

“দূর সঙে তুহুঁ বাঁশি বজাওসি,

অনুখন ডাকসি, অনুখন ডাকসি

রাধা রাধা রাধা!”

 

 

অন্তঃপুরের কোণের ঘরে বসে স্লেটের ওপর লেখা দুটি পঙ্ক্তির মধ্যে যে বাঁশি কবিগুরু বাজানো শুরু করেছিলেন, পরবর্তী জীবনে সে বাঁশিকে তিনি বহু বিচিত্রতর করেছেন।

‘পুনশ্চ’ কাব্যের ‘বাঁশি’ কবিতায় তিনি বলেন, “‘আকবর বাদশার সঙ্গে/হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই/বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে/ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে।’’

এখানে তিনি আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পাননি। কেননা মৃত্যু নামক সত্যের কাছে কে কেরানি আর কে বাদশা সে বিবেচনা গুরুত্বহীন।  (চলবে )

 

নাজমুল টিটো, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

রেম্ব্রান্টের জন্মশহর লেইডেন, ইনডেক্স পোয়েট্রি বুকস এবং কেইস নুটবুমের তিনটি কবিতা

আলম খোরশেদ বছর ছয়েক আগে জার্মান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের আমন্ত্রণে বিশ্বখ্যাত নাট্যোৎসব থিয়েটার ট্রেফেন এর ছাপ্পান্নতম আসরে যোগ দিতে বার্লিন গিয়েছিলাম, পৃথিবীর আরও কুড়িটি দেশের

আমরাই শেষ জেনারেশন

বৈজয়ন্ত বিশ্বাস ভিক্টর আমরাই শেষ জেনারেশন, যারা গরুর গাড়ি থেকে সুপার সনিক কনকর্ড জেট দেখেছি। পোস্টকার্ড, খাম, ইনল্যান্ড লেটার থেকে শুরু করে আজকের জিমেইল, ফেসবুক,

আন্দরকিল্লা সাহিত্যপত্রিকা এবং স্মৃতিকাতর চাটগাঁ

প্রবীর বিকাশ সরকার “আন্দরকিল্লা” ম্যাগাজিনটি ২৭ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে, আদৌ কম কথা নয়! সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজবিষয়ক একটি সাময়িকী বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহর