সৌভিক চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক এবং সঙ্গীতজ্ঞ— দুটি পরিচয়ে দীপ্ত ছিলেন বাবা সুচরিত চৌধুরী। ১৯২৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার অন্তর্গত কধুরখীল গ্রামে। পিতা ছিলেন কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকগীতি সংগ্রাহক আশুতোষ চৌধুরী। মা চারুবালা চৌধুরী। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা পিতৃহীন হন। চার বছর বয়সে কধুরখীল গ্রাম ছেড়ে পরিবারের সাথে শহরাভিমুখি হন বাবা এবং নন্দনকাননে আমার ঠাকুরদা’র কেনা একখণ্ড জমিতে বাড়ী বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। ঠাকুরদা বাড়ীটির নাম রেখেছিলেন ‘নিভৃত নিলয়‘। প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত আর বৃক্ষঘেরা এ বাড়ীটিতে বাবা নিভৃতচারী হয়ে আজীবন সাহিত্য আর সঙ্গীতের চর্চা করে গেছেন। খুব বেশিদিন বাবা তাঁর পিতার সান্নিধ্য পাননি। তবে মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিলো। এ সময় মাসিক ‘পূরবী’তে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম কবিতা ‘ কাকের প্রতি’। এরপর থেকে শুরু হয় নিয়মিত লেখালেখি।
৫০’র দশকের প্রথম থেকেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল। এর প্রভাব এ দেশেও পড়েছিল। কিন্তু এতটুকু পিছপা হননি বাবা। ১৯৪৫ সালের দিকে তিনি বাঁশিতে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন চট্টগ্রামের অর্কেস্ট্রা এবং নৃত্য প্রতিষ্ঠান ‘সুরবাণী’র অলোক মুখার্জীর কাছে। এভাবে চলতে থাকলো তাঁর বাঁশীবাদন আর সঙ্গীত সাধনা। ১৯৪৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম আর্য সঙ্গীত সমিতির পরিচালক ড: সুরেশ চক্রবর্তীর কাছে তালিম নেন। ১৯৫১ সালে কিছুদিন তালিম নিয়েছেন ভারতের বিখ্যাত বংশীবাদক শক্তিপ্রসাদ ঘোষের কাছে। বাবা বলতেন, ‘প্রথমত আমি শিল্পী তারপর সাহিত্যিক।
পিতার খ্যাতি রক্ষার জন্যই আমি সাহিত্যচর্চা করি মূলত আমি হলাম সঙ্গীত সাধক। আমি মনে করি সঙ্গীতই হল সকল শিল্পের উৎস। ‘কবিতা দিয়ে যেখানে তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু সেখানে তিনি উপলব্ধি করলেন, সঙ্গীতের মাধ্যমে নিজের অন্তরের সৌন্দর্যকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব।
সঙ্গীত সাধনার জন্য ভোরবেলাকেই বেছে নিয়েছিলেন বাবা। খুব সকালে যখন তিনি বাঁশি বাজাতেন তখন এ নিভৃত নিলয়ের পরিবেশ হয়ে উঠতো স্বর্গীয়। দুই থেকে তিন ঘন্টা একনাগাড়ে তিনি বাঁশি বাজিয়ে যেতেন । রেডিওতে তিনি খুব একটা বাজাতেন না। কারণ হিসেবে বলতেন, ‘মাত্র তিরিশ মিনিটে বাঁশিতে বিস্তার ঘটানো যায়না, যেখানে সুর তুলতেই লেগে যায় একঘন্টা আর আলাপে আরো একঘন্টা সেখানে আধঘন্টায় সুরের বিস্তার সম্ভব নয়। ‘এ কারনেই তিনি বাঁশি বাজানোর জন্য মঞ্চ এবং ঘরোয়া জলসাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আসলে বাঁশি ছিলো বাবার নিত্য সঙ্গী। যখন সাহিত্য সাধনার মেজাজ থাকতো না তখন বাঁশি বাজাতেন। আর বাঁশি বাজানোর মেজাজ না থাকলে সাহিত্য চর্চায় বসে যেতেন।
উচ্চাঙ্গ সংগীতের জগতে বাবার বিচরণ ছিলো নিরবধি। সাত হাজার রাগরাগিনী তাঁর আয়ত্তে ছিলো। লিখেছেন গান, প্রকাশ করেছেন ‘সুরলেখা’ নামে গানের বই ১৯৬৭ সালে। তিরিশটি গান নিয়ে বেরোয় এই ‘সুরলেখা’ বইটি। তিরিশটি রাগের সমন্বয়ে লেখা তিরিশটি গান। সংখ্যাগরিষ্ঠ গান সন্ধ্যাকালীন সময়ের ব্যাপ্তিতে রচিত। রাতের পরশও রয়েছে কিছু গানে। সন্ধ্যা এবং রাতের বিভিন্ন রাগের আঙ্গিকে রচিত গানগুলোতে রয়েছে প্রেম এবং মিলনের অনুভূতি। একটি গানের কথা বলা যায়, চঞ্চল দিনের শেষে বধুর সাজ আকর্ষণ করে চিরপান্থকে। ভীমপলাশ্রী রাগে রচিত নিচের গানটিতে মিলনের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে এভাবে ঃ
চঞ্চল দিন হলো শান্ত
মাঠের পাখিরা সব ক্লান্ত
…………………………………
দেহলিতে পাতা রং ছায়া ওঠে নড়ি
নাচে যেন কিশোর কিশোরী
আয়নায় মুখ রেখে সাজে বধু
মালতীর বুক থেকে ঝরে মধু
পথ ধরে চলে চিরপান্থ।
‘মধুবন্তী’ রাগে রচিত গানে সন্ধ্যামালতী আঁকা গোধুলীতে বধু খুঁজে ফেরে তার প্রিয়তমকে। ব্যাকুল মনে যাকে প্রাপ্তির আশা কিন্তু সে তো ফেরে না, নিরুদ্দিষ্ট পাখির মতো গভীর অজানায় সে গমন করে। ছন্দের বন্ধনে প্রকৃতির সাথে অন্তরের মেল বন্ধন প্রকাশ পেয়েছে গানগুলোতে। চৈতালি সন্ধ্যার ক্ষণে মুখোমুখি বসে থাকার মুহূর্তগুলো রাগের বিভিন্নতায় রূপালী হয়ে উঠে অবিসংবাদিতভাবে। নান্দনিক ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে গানগুলোতে সন্ধ্যা ও রাতের প্রতি ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে।
রাগরাগিনী নিয়ে নিরন্তর ভাবনা আর বিশ্লেষণ করতেন বাবা। প্রবহমান গানের কলি তাঁর মানসপটে বাস্তবতায় রূপ নিয়ে সৃষ্টি করেছিল প্রায় তিনহাজার গানের জগত। এর সূচনা বাংলা ১৩৯৫ সালের ১ বৈশাখ (১৯৮৮ সালের ১৪ এপ্রিল)। সেই বছরের প্রথম দিন থেকে যাত্রা শুরু করে আমৃত্যু তিনি এর সৃষ্টিশীলতায় নিমগ্ন ছিলেন। এ গানগুলোর মধ্যে কিছু গান নিবন্ধগীত হিসেবে ‘ভারত বিচিত্রায় ‘নিয়মিত প্রকাশিত হতো। শহরের বাইরে ভ্রমণকালেও তিনি ডায়রীতে লিখে যেতেন গান। রাগভিত্তিক কিছু গানের স্বরলিপি করে গেছেন তিনি। প্রকৃতিকে উপজীব্য করে, দিন ও রাতের সমন্বয়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রচিত এ গানগুলোতে তাঁর হৃদয়ের আবেগ ফুটে উঠেছে। প্রতিটি গানের বিষয়বস্তু এবং প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে বাবা বিভিন্ন রাগের প্রয়োগ ঘটাতেন। সঙ্গীতকে কতটা সজীব করে তোলা যায়, কতটা হৃদয়গ্রাহী করে তোলা যায় সে বিষয়ে তিনি যত্নবান ছিলেন।
বাবা যে শুধু নিজ নামেই লিখতেন তা নয়, ছদ্মনামেও লিখেছেন। শুধু চৌধুরী, সুরাইয়া চৌধুরী কিংবা কখনো চলন্তিকা রায়। ‘শুধু চৌধুরীর শুধু কবিতা’ বেরোয় ১৯৫১ সালে আর ‘সুরাইয়া চৌধুরীর সেরা গল্প’ বেরোয় ১৯৫২ সালে। ৫০‘র দশকে তিনি ‘সীমান্ত’ সাহিত্য পত্রিকায় ‘চলন্তিকা রায়’ নামে লিখতেন। বইটিতে এ নামে বিভিন্ন সময়ে তিনটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। সুরাইয়া চৌধুরী ছদ্মনামে বই বের করার পর একদিন ভ্রমণকালে এক মহিলা প্রশ্ন করেন, ছদ্মনামে কেন লিখেন ? নিজের নামে যদি লিখতে না পারেন তো লিখবেন না । সেই থেকে বাবা নিজের নামে লেখা শুরু করেন।
১৭ টি কবিতা নিয়ে ‘শুধু চৌধুরীর শুধু কবিতা‘র কলেবর। কবিতাগুলো দীর্ঘ এবং বাস্তবতা প্রসুত। এর মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে’ কবিতাটি মানুষের সংগ্রামমুখর জীবন এবং সমাজের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের অবিমিশ্র অনুভূতি নিয়ে রচিত। যা অনেকটা ব্যঙ্গাত্মক। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সমসাময়িক প্রেক্ষাপট কতটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, কতটা চেতনার শাণিত অনুভব নিয়ে মূর্ত। অন্য কবিতাগুলোতে আছে প্রেম, বিরহ কিংবা ট্র্যাজেডি। ‘আকাশলীনা’ তেমনই একটি কবিতা। যেখানে রোমান্টিকতা মিশে আছে জীবনের পরতে পরতে। আকাশলীনার মাঝে অসীম আকাশ যেন লীন হয়ে যায়। ‘স্কেচ’ কবিতাটি এক শিল্পীর চোখে আঁকা অদ্ভুত মেয়ের রোমান্স স্কেচ। কল্পনাপ্রবণ শিল্পীর ক্লাসিকেল রোমান্সের এক অধ্যায় চিত্রিত হয়েছে। যেখানে মনে মনে এক অপার্থিব প্রেম শিল্পীর হৃদয়ে অনুভূত আর বন্ধুবর কবির অন্তরকে দোলা দিয়ে যায়। ‘তোমাকে’, ‘লালচে মেয়েকে’ কিংবা ‘তিনটি কবিতা’ এগুলোর প্রতিটিতেই চিরন্তন প্রেম এবং ভালোবাসার প্রাধান্য দিয়ে যৌবনের বন্দনা করার প্রয়াস পেয়েছেন তিনি।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রকে বাবা অসীম মাত্রায় সমৃদ্ধ করেছিলেন। ৬০‘র দশক থেকে গল্প লিখনের যাত্রা শুরু। ‘সুরাইয়া চৌধুরীর সেরা গল্প’ লিখে এগিয়ে গেছেন অপ্রতিরোধ্যভাবে, স্বনামে লিখেছেন বহু গল্প যা প্রকাশিত হয়েছে পত্র পত্রিকায়। লিটল ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় লিখতে তিনি বেশী পছন্দ করতেন। তাই প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। তিনি বই প্রকাশের ব্যাপারে দারুণ উদাসীন ছিলেন। আকাশে অনেক ঘুড়ি (১৯৬২), একদিন একরাত (১৯৬৬), নির্বাচিত গল্প (১৯৯২), কিংবদন্তির গল্প (১৯৯৩) প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বই প্রকাশনা সংস্থা ‘বইঘর’ থেকে বের হয় সুরাইয়া চৌধুরীর সেরা গল্প, একদিন একরাত, আকাশে অনেক ঘুড়ি (পরবর্তীতে এ,কে, খান ফাউন্ডেশন থেকে পুনঃপ্রকাশিত)। মুক্তধারা থেকে বের হয় ‘নির্বাচিত গল্প’ আর উপন্যাস ‘নদী নির্জন নীল’ (১৯৯৯)। বাংলা একাডেমি থেকে বের হয় কিংবদন্তির গল্প ঃ চট্টগ্রাম। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে বইটি বাতিঘর থেকে পুনঃমুদ্রিত হয়। ছোট গল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরষ্কার পান। ছোটদের নিয়ে লেখা ‘ঋতু ‘ বের হয় ২০০৯ সালে শিশু একাডেমি থেকে, যা ২০১২ সালে অগ্রণী ব্যাংক—শিশু একাডেমি শিশু সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করে। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রবর্তিত একুশে পদক লাভ করেন ১৯৯৬ সালে।
বাবা নাটক রচনা করেছেন বিভিন্ন সময়। পার্কের কোণ থেকে, আরেকজন শহীদ, সুতরাং, আলো নিরুত্তর এগুলো তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বেতারে ‘ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ অনুষ্ঠানে প্রতি সপ্তাহে এই শহরের বিভিন্ন স্থানের নামকরণের উপর নাটক প্রচারিত হত।
‘নিভৃত নিলয়’ বাড়িতে শিল্পী সাহিত্যিকের আনাগোনা ছিল উল্লেখ করার মতো। মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, ঢালী আল মামুন থেকে শুরু করে শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শামসুজ্জামান খান, চট্টল গবেষক আব্দুল হক চৌধুরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, ডঃ আনিসুজ্জামান পর্যন্ত আসতেন এ বাড়িতে। এছাড়া অসংখ্য কবি সাহিত্যিক আসতেন এবং সাহিত্যের আড্ডা দিতেন নিয়মিত। কখনো সাহিত্য আলোচনা, কখনো বংশীবাদন এভাবে কেটে যেতো সময়। অতিথিদের মায়ের হাতের চা, বিস্কুট কিংবা বাড়িতে লাগানো ফলের গাছের সুস্বাদু ফল পরিবেশনার মধ্য দিয়ে মুখর হয়ে উঠতো আমাদের বাড়ি।
লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনার ব্যাপারে বাবার আগ্রহ ছিলো প্রবল। ১৯৪৭ সালে এ ব্যাপারে তাঁর অনুভূতি আরো বেগবান হয়ে ওঠে যখন একুশের প্রথম কবিতার জনক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সাথে ‘সীমান্ত’ লিটল ম্যাগাজিন বের করেন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয় এর প্রথম সংখ্যা। দুই বাংলার বহু বিখ্যাত লেখক লিখেছেন এই পত্রিকায়। ধারাবাহিকভাবে এই পত্রিকাটি বের হতো। তবে ১৯৪৯ সালের অক্টোবরের পর তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা ছাপানোর ব্যাপারে বরাবরই আগ্রহী ছিলেন বাবা। যারা এ ধরনের পত্রিকা প্রকাশ করতেন তাদের তিনি উৎসাহিত করতেন, বিভিন্ন ভাবে তাদের সহযোগিতা করতেন। তিনি জানতেন, লিটল ম্যাগাজিন বের করা কতটা কষ্টসাধ্য। কত লেখকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে লেখা সংগ্রহ করতে হয়। আর এত পরিশ্রমের পর একটা ম্যগাজিন বের হলে তা হয় অত্যন্ত সুখকর। বাবা মনে করতেন লিটল ম্যগাজিনের মাধ্যমে তরুণ লেখকরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ছোট কিছু না করে বড় হওয়া যায় না। প্রবীন আর নবীনের লেখা লিটল ম্যগাজিনে স্থান পায় আর নবীন প্রবীণের লেখার সমন্বয়ে সেই ম্যাগাজিন পায় এক নিজস্ব সত্তা। তাই লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা জরুরী বলে তিনি মনে করতেন । বাবার অসংখ্য লেখা বের হতো বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং ঢাকার ম্যাগাজিনে।
আজীবন পোষাক পরিচ্ছদে বাবা ছিলেন একেবারে জাঁকজমকহীন। তাঁর সঙ্গী ছিল পায়জামা পাঞ্জাবী। এ পোষাকে ঘুরে বেড়াতেন স্বচ্ছন্দে। সময় জ্ঞান ছিল প্রচণ্ড। বাঙালির সময় জ্ঞান নেই, এ ধারণার ব্যাতিক্রম ছিলেন তিনি। কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলে ঠিক সময়মত গিয়ে উপস্থিত হতেন। নিয়মানুবর্তিতায় বাঁধা ছিল তাঁর প্রাত্যহিক কাজকর্ম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কোনদিন বাঁশি বাদন, আবার কোনদিন সাহিত্য চর্চা, সময়মতো নাওয়া খাওয়া এভাবে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করতেন তিনি। মন ভালো না থাকলে বাঁশি বাজাতেন । মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন নিবন্ধ গীত আর গান রচনা নিয়ে।
আমার ঠাকুরদা আশুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত ‘নছর মালুম’ লোকগাঁথা অবলম্বনে ‘আমিনা সোন্দরী’ লোকনৃত্যনাট্যে বাবা সুরারোপ করেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকগাঁথায় এমন সুরের মাধুর্য এতটাই নিপুণ ছিল, যারা এটি দেখেছেন তারাই অনুভব করবেন এর বিশেষত্ব। চট্টগ্রাম লোকগাঁথা সম্প্রদায়ের ব্যানারে ১৯৭৬ সালে এটি প্রথম মঞ্চায়ন হয় চট্টগ্রামের মুসলিম হলে। আমাদের নিভৃত নিলয়ে চলত এর মহড়া। ‘আমিনা সোন্দরীতে’ অংশগ্রহনকারীদের বেশীরভাগই ছিলো তরুণ। তাদের দারুন উৎসাহিত করতেন বাবা। বাসায় আসতেন নির্দেশক মিলন চৌধুরী আর অভিনয় করতে আসতেন শুক্লা ইফতেখার, শান্তনু বিশ্বাস, সনজীব বড়ুয়া, চন্দন দাশ, রবীন দে, সুতপা বড়ুয়া, অরুন্ধুতী খাস্তগীর, গানে ছিলেন মিলন মজুমদার, তপন চৌধুরী, মন্দিরা রায় প্রমুখ। পরম লালিত্য আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি দাঁড় করেছিলেন এই ‘আমিনা সোন্দরী’ এতে যে সুরারোপ তিনি করেছিলেন তা কালোত্তীর্ণ আর আঞ্চলিক লোকনৃত্যনাট্যের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যমন্ডিত।
১৯৯৩ সালের শেষার্ধে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন ‘আমিনা সোন্দরী’ মঞ্চায়নের। আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটি মঞ্চায়নের চিন্তা করেছিলেন বাবা, এ জন্যে পাত্র পাত্রী যোগাড় আর সংগঠিত করা যেন ধ্যানে জ্ঞানে পরিণত হয়েছিল, নাট্যজন মিলন চৌধুরী ছিলেন এর নির্দেশক। বাবা তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। আমিনা সোন্দরীর জন্মলগ্ন থেকে তিনি এর সাথে জড়িত ছিলেন। অনেক পরিকল্পনা ছিলো আমিনা সোন্দরিকে সবার মাঝে পরিচিত করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি। সময়টা ছিলো শীতকাল। আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমি থেকে মহড়া শেষ করে রাতে দেরীতে বাসায় ফিরতেন। কথা ছিলো একাডেমীর ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে এটি মঞ্চায়ন হবে। কিন্তু ১৯৯৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাবা সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে। সেদিন সূর্য ওঠার আগেই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তিনি। তার আগে নিয়মিত লেখার কাজে বসে লিখছিলেন ‘টাইগার পাস’ নামে একটি কথিকা। যা চট্টগ্রাম বেতারে প্রচার হওয়ার কথা ছিল। এই অসমাপ্ত লেখাটিই ছিল তাঁর শেষ লেখা। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে অসুস্থ বোধ করায় ফিরে এলেন বাসায়। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। চট্টগ্রামে নেমে এলো শোকের ছায়া, সংস্কৃতির অঙ্গনে এলো শূন্যতা।
তাঁর এই আকস্মিক প্রস্থান সহজে পূরণ হবার নয়। আমার কাছে মনে হয় অনেকটা অকালেই যেন তিনি চলে গেলেন। যে সৃষ্টিশীলতায় তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন সাহিত্য এবং সঙ্গীতের ভুবন তা আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো। আমরা তাঁকে হারিয়েছি, কিন্তু তিনি যা দিয়ে গেছেন তা আমি শুধু পুত্র হিসেবে নয়, সবার দায়িত্ব একে বাঁচিয়ে রাখা। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃজিত কর্মের মধ্যে। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
সৌভিক চৌধুরী, প্রাবন্ধিক ও বাচিক শিল্পী