এখন সময়:রাত ৩:৩০- আজ: বৃহস্পতিবার-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

এখন সময়:রাত ৩:৩০- আজ: বৃহস্পতিবার
২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

বাবা

রোখসানা ইয়াসমিন মণি

সিনথি যেয়ো না,থামো। এই ভারী বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাচ্ছো?শাহানা ওরে থামা। মমতাজ উদ্দিনের চোখ ছানাবড়া। মেয়েটির কী হলো? এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেতে চাচ্ছে? মাত্র স্কুল থেকে এলো। ভিজে একাকার। আবার এই ভেজা শরীরে বের হয়ে যাচ্ছে। হনহন করে ঘরে ঢুকে শুধু এটুকু বললো,আসি।

আসি মানে? কোথায় আসতেছো? মমতাজ উদ্দিনের কন্ঠে উৎকন্ঠা।

বাড়ি যাব।

কোন বাড়ি?

সিনথি ভেজা আঁচল নখের ডগায় প্যাঁচিয়ে বলে,

বাবার বাড়ি।

মানে কী?

সিনথি কোন কথা বলে না।শুধু ছাতাটা পাল্টে আরেক ছাতা নিয়ে ভেজা কাপড়েই বের হয়ে যায়।

ভাল হবে না সিনথি। ঘরে ফেরো। তুমি কার হুকুমে বাসার বাইরে যাচ্ছ? বাবার বাড়িতে যাওয়া তোমার নিষেধ না? অমান্য করো কোন সাহসে?

কে শোনে কার কথা? শাহানা ওকে থামাতে গেলে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বের হয়ে আসে।  মমতাজ উদ্দিন অবাক। সিনথির যাওয়ার পথে হা করে তাকিয়ে আছেন। বুঝে উঠতে পারেন না ও কেন এমন করেছে? দরজা খুলে রাখা যাচ্ছে না।

 

 

 

 

 

বৃষ্টির দমকে সব ভেসে একাকার। এরকম বৃষ্টি কস্মিনকালে কেউ দেখেনি। সে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। স্কুল ছুটির সময় বৃষ্টি নামে। তখন সবার বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। এসময় বৃষ্টি নামলে কেমন লাগে? জগত সংসার চুরমার করে বৃষ্টি নেমেছে। জলের ঝাপটায় স্কুলের বারান্দা, ক্লাসরুম, অফিস সব ভেসে যায়। চারদিকে শোঁ শোঁ জলের সাইরেন। একটু দূরে উচ্চবিদ্যালয়। জলের তীব্রতায় সব ঢেকে যায়।যেদিকে চোখ যায় শুধু শাদা আর শাদা। জলের শাদা আবরণে গাছপালা, মাঠ,সামনের উচ্চবিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন কিছুই দেখা যায় না।সিনথি জীবনে এরকম বৃষ্টি দেখেনি। সিনিয়র টিচাররা বলাবলি করে, এই বৃষ্টি একঘন্টা থাকলে নুহের প্লাবন বয়ে যাবে। বৃদ্ধ তবারক স্যার বলেন, হানিফ গজব নামলোনি দুনিয়ায়?

সিনথির বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে। কতমাস, কতদিন মায়ের সাথে দেখা নেই। কী করছে মা এখন? এই বৃষ্টিতে বাবা কি পাশে আছে? সে খবর পেয়েছে বাবা অসুস্থ। ঢাকায় যাবে চিকিৎসার জন্য। বাবার সাথে দেখা হয় না কত মাস!

মাঝখানে স্কুলে এসে সিনথিকে দেখে গেছেন। বাপ- মেয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে কী কান্না! কথায় কথায় আবুল হোসেন জানান,তাঁর হার্টে ব্যথা।  আর থাকা যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখাতে হবে।

সিনথি তাড়া দেয় যত তারাতাড়ি সম্ভব বাবা যেন ডাক্তার দেখিয়ে আসে। সিনথির কাছ থেকে যাওয়ার অনেকদিন পর খবর পায় বাবা আবুল হোসেন শয্যাশায়ী। সেদিন থেকে ভেতরটা ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে।বাবাকে একনজর দেখার জন্য রায়হানকে কত অনুরোধ করে।রায়হান ওর স্বামী। একটি বিদেশি কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। ভালো বেতনের চাকরী। চট্টগ্রাম থাকে। রায়হানের কাছে জবাব না পেয়ে শাহানার কাছে আসে। শাহানা ওর ননদ। রায়হান যখন থাকে না তখন সিনথির সাথে ঘুমায়। ওর বডিগার্ড হয়ে থাকে। বাবার অসুখের খবরে সিনথি ছটফট করে। মায়ের জন্য কাঁদে। বাবার জন্য, ভাইবোন সবার জন্য ওর বুক ফেটে যায়। বিছানায় ছটফট করে। ছটফটানিতে শাহানা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। বিরক্ত হয়ে বলে,ঘুমাও না ভাবী? এরকম করছো কেন? শাহানার হাত চেপে সিনথি বলে, একটি কাজ করে দাও না ভাই?

কী কাজ?

বাবাকে বলো না,আমাকে আমাদের বাড়ি দিয়ে আসতে! বাবার খুব অসুখ।

তুমি কীভাবে জানলে?

মা,চিঠি পাঠিয়েছে। সেই থেকে আমার কেমন যেন করছে! কোথাও মনে হয় কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

ভাইকে বলো!

বলেছি,কিছু বলে না।

তো ভাই কিছু না বললে আমি কী করবো?

ভাই, এমন বলো না। দোহাই লাগে। আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। আমার বাবার যদি কিছু হয়ে যায়?

ডাক্তার দেখাতে বলো।

সিনথি জানে শাহানা থেকে এমন জবাব পাবে। তবুও  চেষ্টার ফল উল্টো হতে পারে ভেবে একটু প্রচেষ্টা। বিফল সিনথি পাশ ফেরে শোয়। ঘুম আসে না। চোখের উজান ঠেলে স্রোত নামে। বেদনার স্রোত। না বলা কথা, উপেক্ষা, অবহেলারা বুকের ভেতর জলের বাসা বাঁধে। ওগুলো চুৃঁইয়ে চুঁইয়ে ছড়িয়ে পড়ে নিরব রাত্রিতে। কে রুখে এই জল!

পরেরদিন বুকে সাহস এনে মমতাজ উদ্দিনকে বাবার অসুখের কথা বলে। জবাবে মমতাজ উদ্দিন বলেন, চিন্তা করো না। তোমার বাবারে আমি দেখে আসব। সিনথি খুশি হয়ে বলে,সত্যি বলছেন? আপনি যাবেন?

বলেছি যখন যাব।

আমাকে নেবেন?

তুমি গিয়া কী করবা? এছাড়া রায়হান নাই।

ও না থাকলে কী হবে? আপনিতো আছেন। আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবেন। সিনথির বুক হু-হু করে ওঠে।

মমতাজ আহমেদ কথা বলেন না। সিনথি জবাবের অপেক্ষায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। না পেয়ে  অসার রুগীর মত বের হয়ে আসে। বুকের প্রাচীর ভাঙতে থাকে। কে যেন কুঠার দিয়ে কুপিয়ে দিচ্ছে পাঁজরের হাড়। মা- বাবাকে দেখার অদম্য স্পৃহারা লাল তৃষ্ণা ঠেলে জেগে ওঠে। রক্তের টান তীব্র হয়।

ভেতরের মাংসকোষ খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়।নিজের ভেতর থাকতে পারে না সিনথি। অপেক্ষাগারের সমস্ত শিকল টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ে। অস্থিতে দাউদাউ আগুন জ্বলে। বুক ঠেলে কান্না আসে। ফোঁপানিতে খাট কেঁপে ওঠে। ওর ভেতর ভাঙছে। সুকোমল হৃদয়টা কে যেন খামচে, কচলে ভর্তা করে দিচ্ছে। এই ব্যথা সে নিতে পারে না। এভাবে রাত যায়। সারারাত একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি। বেদনার দল ঝাঁকে ঝাঁকে জড়ো হয় ওর নিদ্রাহীন চোখে। মা-বাবার কাছে ছুটে যেতে আত্মা অতৃপ্ততার গাঙে গোঙাতে থাকে। সুতীব্র যাতনা হু-হু করে টেনে নিয়ে যায় ওকে বিদ্রোহী সিঁড়িতে। সে খুঁজতে থাকে বাইরে বেরুবার পথ আর ওখানে রাখার মত সাহসী পা। স্বামী রায়হান,শ্বশুর মমতাজ আহমেদ, শাশুড়ী রেহানা বেগম, ননদ শাহানা কারো কাছে ওর কদর নেই। সে সবার আজ্ঞাবহ। বাবাকে একনজর দেখার যাতনায় স্কুলে সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকে। স্কুলের বড় আপা মিনারা কাদের। সিনথি তাকে খালাম্মা ডাকে। এই এক মহিলা সিনথিকে মেয়ের মত আদর করেন। স্কুলের সাথেই বাসা। বিরতির সময় সিনথিকে সাথে নিয়ে যান। দুপুরে একসাথে খান। মিনারা কাদের একা থাকেন। স্বামী মকবুল কাদের ঢাকায় একটি হাই স্কুলে পড়ান। ছেলেমেয়েরা বাবার কাছে লেখাপড়া করে।

সিনথি ভাল নেই মিনারা কাদের জানেন। সারাদিন স্কুলে দুম মেরে পড়ে থাকতে দেখে মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। সিনথি হাতের স্পর্শে হু-হু করে কেঁদে ওঠে।

আমি থাকতে পারছি না, খালাম্মা। বাবাকে একনজর দেখতে না পেলে মরে যাব।

মিনারা কাদের বলেন,তুমি তোমার জামাইকে বলো না কেন দিয়ে আসতে?

বলেছি, কিন্তু সে একটা পাষণ্ড। আপনিতো জানেন, আমার শ্বশুরবাড়িতে কেউ আসে না। রায়হানের দূর্ব্যবহারে আমার বাবার বাড়ির লোক বিরক্ত। আমি মরে গেলেও কেউ এই বাড়িতে আসবে না।

মিনারা কাদের বলেন, বিয়ে হয়েছে এত বছর। এখনোও রাগ থাকতে আছে? বাবারে,তোমাদের কোনকিছু বুঝি না! তবে তুমি ধৈর্য ধরেছ অনেক। আরেকটু ধরো,মা!দেখো কী হয়। মিনারা কাদের স্বান্তনা দেন সিনথিকে। শান্তনায় কি মন ভরে? সিনথি কেঁদেই চলে। বিপদের ডাক শুনতে পায় সে। ভেতরে কে যেন জানান দেয় সিনথি, তোমার কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। আত্মভোলা হয়ে থেকো না। উঠে দাঁড়াও, দৌড়াও! চরম বিপদ তোমার! ভেতরের তাড়না ওকে অসহিষ্ণু করে তোলে। সে এক মুহূর্তও দেরী করতে চায় না। প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বের হতে উদ্যত হয়। ছাতিটা খুলে দেবে দৌড়। এমন সময় আসমত স্যার হুলুস্থুল করেন,এই সিনথি এই! বৃষ্টিতে কই যাও? পাগল হইছো? বাইরের অবস্থা দেখো না? স্কুল মাত্র ছুটি হইছে। বৃষ্টি থামোনের লাইগা আমরা সবাই অপেক্ষা করতেছি না? তোমার এমন কী কাম যে এই মেঘ তুফান মাথায় নিয়া বাইর হইতে হইবে? আসমত স্যার বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক। একসাথে কাজ করে ওরা। সিনথিকে খুব স্নেহ করেন। সিনথিও খুব সম্মান করে। বের হওয়ার সময় জানায়, স্যার,আমার কলিজা বের হয়ে যাচ্ছে। যেমন করেই হোক মায়ের কাছে যেতে হবে। আমার মায়ের কিছু একটা হয়েছে। না হলে আমার এমন লাগছে কেনো?আসমত স্যার অবাক। বলে কী এই পুঁচকে মেয়ে? ও মাকে দেখতে যাবে? এটা যে সপ্তাশ্চর্যের এক মহাআশ্চর্য! যে মেয়ে চিরবন্দী সে মেয়ে যাবে মাকে দেখতে? অন্যসময় হলে কথা ছিলো। এই দূর্যোগের সময়? ভাবা যায়?

সিনথি বের হয়ে যায়। ওর যাওয়ার পথে স্কুলের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। আসমত স্যার আবারো থামাতে চেষ্টা করে বিফল হন। কাতর কণ্ঠে বলেন, হইছেডা কী মাইয়াডার?

স্যার, যতকথাই বলেন, মেয়েটার মন ছুটেছে। ওর ভাবগতি স্বাভাবিক না।

আসমত স্যার চিন্তিত হয়ে বলেন, দেখেন আপা,আমি ভাবতাছি অন্য কথা। মেয়েটার না আবার বিপদ বাড়ে। ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কেমন খাট্টাস সেতো আমরা সবাই কমবেশি জানি।

মিনারা কাদের এক দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়েন। শিশুর মত সহজ সরল সিনথিকে শত্রুও না ভালোবেসে পারবে না। অথচ মমতাজ ভাইরা মেয়েটাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে? অপত্য স্নেহের ভারে মিনারা কাদেরের চোখের কোণে জলবিন্দু জড়ো হয়। বুক চিরে বের হওয়া দীর্ঘশ্বাস শোঁ- শোঁ শব্দে চাপা পড়ে।

আসমত স্যার বলেন, আহা! কী সুন্দর ফুটফুটে মাইয়াডা। আল্লাহ লাখে এরকম তৈরী করে। কী নাই মাইয়াডার কনতো আপা? রূপে, গুণে, শিক্ষায়, উঁচালম্বায়,পারিবারিক ঐতিহ্য কোনদিক দিয়া  মাইডারে ঠেলতে পারবো ?

বেশি পেয়ে গেলে যা হয় স্যার। মমতাজ ভাইরা চোগলখোর। সবাই জানে।

এমন উন্মাতাল বৃষ্টিতে পাগলও নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। সিনথি উম্মাদের মত হাঁটতে থাকে। বৃষ্টির চাপে ছাতা সামলানো দায়। শাড়ীর আঁচল লেপ্টে মিশে যায় শরীরে। ডানে, বাঁয়ে, ওপর নিচে কে যেনো জলের নল খুলে দিয়েছে। এই নল উপচে যেদিকে পারছে ছুটছে। জলের সাথে বাতাসের ঝাপটা। বাতাসের ঘূর্ণিতে জল সাঁই সাঁই করে একবার ওপরে ওঠে আবার নিচে নামে। বৃষ্টির ফোঁটায় মাটি আলগা হয়ে যায়। ফোঁটা খুব বড়। জলে পড়তেই গোল চক্বর খেয়ে স্রোত তৈরী হয় তখন পা চালিয়ে হাঁটা দায়। শাড়ি পেঁচিয়ে যায় দুই হাঁটুতে। প্যাঁচ টেনে কোনরকম এগুতে থাকে সিনথি। বাতাসের ঝাপটায় ছাতা যায় উল্টে। ধরে রাখা যায় না। জোর করে টেনে ধরে রাখে। মুখ আড়াল করার জন্য। যা ভেজার ভিজে গেছে। কিন্তু এই দূর্যোগে সে ছাড়া আর কেউ পথে নেই। রাস্তার পাশে যেসব ঘরবাড়ি আছে সবার দরোজা জানালা বন্ধ। ভাগ্যিস, ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেলে রায়হানের কানে পৌঁছতে দেরী হবে না।

বৃষ্টির দমক প্রবল হচ্ছে। সে এগোয় আর ভাবে, যে করে হোক বাবার বাড়ি যেতে হবে। কারো কথা শুনবে না। আমাকে তো কেউ দিয়ে আসবে না।

যদি আমি যাই কেটে ফেলবে? ফেলুক! জবাই করবে? করুক! কিছু এসে যায় না। এই যে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার কয়জনে খোঁজ রাখছে? দম ফেরাতে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। কেউ আমার বুকের ব্যথা বুঝলো না। যদি মরতেই হয় মা- বাবার কাছে গিয়ে মরব। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে। স্কুল থেকে বাসা দশ মিনিটের পথ। বাসায় যখন পৌঁছে তখন ভিজে একাকার। শরীর চুঁইয়ে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। একবার ভেবেছে শ্বশুর বাড়ি যাবে না। স্কুল থেকে বাবার বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। রায়হানকে সে ভয় পায়। এছাড়া না বলে গেলে শ্বশুর মমতাজ উদ্দিন ক্ষেপবেন। শাশুড়ীর গলাও জিরাফের মত নেমে আসবে রায়হানের কানের কাছে। সব মিলিয়ে যন্ত্রণার ওপর যন্ত্রণা চেপে বসবে। এমনিতেও কম হইচই হবে না। হোক,যা খুশি হোক। মা- বাবা, আত্মীয়–স্বজন না দেখে থাকার যন্ত্রণা ওরা বোঝে?

কৈশোরের সকাল পেরিয়ে একদিন রায়হানের সাথে  ওর বিয়ে হয়। সে থেকে জীবন কারাগারে আটকে গেছে। সিনথিকে দেখার পর পিছু নিতে থাকে রায়হান। কী কলেজ,কী রাস্তাঘাট যখন যেখানে দেখে সিনথিকে বিরক্ত করে। পরিবারের সবাই  টের পেয়ে ওকে নানা বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সেখানে কিছুূদিন থেকে ছোট খালামণি শাহীন আফরোজের বাসায় চলে আসে। খালামণির হাজবেন্ড আহমেদ বশির মেরিন চিফ ইঞ্জিনিয়ার। একটানা ছয়মাস জাহাজে থেকে দেশে ফিরেছেন। সবার সাথে রোজার ঈদ করবেন। ঈদের আর মাত্র পাঁচদিন। একদিন খালামণির বাসায় খালুর ছোট ভাইয়ের ফ্রেন্ড বেড়াতে আসে। সেও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। দেশে এসেছে। বিয়ে করার জন্য পাত্রী খুঁজছে। সিনথিকে দেখে ফেলে মাহমুদ হাসান।

আর যায় কোথায়? সাথে সাথেই শাহীন আফরোজকে জিজ্ঞেস করে, আপাএখানে একটি মেয়ে দেখলাম। কী হয় আপনার?

খালামণি বলে, ওহ সিনথির কথা বলছো? সে আমার বড় বোনের মেয়ে।

কোন রাখঢাক না রেখে মাহমুদ হাসান বলে, আপনার গৃহে রাজকন্যা রেখে আমি কোন তেপান্তর ঘুরছি? এত চষে বেড়ালাম কোথাও বিয়ের পাত্রী খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ সে চোখের সামনে। আপা,এই মেয়েকে আমি বিয়ে করব। আম্মু আব্বুকে খবর পাঠাচ্ছি। ওরা এসে দেখে যাক।

শাহীন আফরোজ কিছু একটা ভাবেন। এরপর বলেন,দেখো মাহমুদ, কথা দিতে পারি না। ওর মা- বাবা আছে। ওদেরও পছন্দের ব্যাপার আছে।

ঠিক আছে আপা,আপনি যে করেই হোক খবর পাঠান।আমি আমার আম্মু আব্বুকে জানাচ্ছি। পরদিন আবুল হোসেন আসেন। মাহমুদ হাসানকে দেখে পছন্দ হয়ে যায়। ছেলে মাশাল্লাহ রাজপুত্তুর,সিনথির মায়ের পছন্দ হবে। আবুল হোসেন খুব খুশি হন মাহমুদ হাসানকে দেখে। নায়েব বাড়ির বড় জামাই দেখতে শুনতে জেল্লাধারী না হলে মান থাকে? সিনথিকে দেখে মাহমুদ হাসানের মা- বাবা অবাক।বাহ,এত সুন্দর মেয়ে! মাহমুদ যেরকম বলেছে এই মেয়ে তারচেয়েও বেশি সুন্দর।

অনেক মেয়ে দেখা হয়েছে। একটা পছন্দ হলে আরেকটা হয় না। আরেকটা হলে অন্যটা হয় না। এই মেয়ে কচি বাঁশের মত মসৃন। টানাটানা চোখ,একহারা শরীর,হলুদে মাখা গায়ের রঙ, কোমর ভেঙে হাঁটু অব্দি নেমেছে চুল। সরিসৃপের মতো চুলগুলো এঁকেবেঁকে ছুঁয়ে আছে মাটি। লাখে এরকম  মেয়ে পাওয়া যায়। কিছুতেই একে হাতছাড়া করা যাবে না। ওরা সেদিনই এনগেজমেন্ট সেরে ফেলতে চায়। আবুল হোসেন বাধ সাধেন। গ্রামের রীতি ভাঙতে পারবেন না। সর্দারকে জানাতে হবে। এছাড়া  ভাইবোন আছে। সিনথি পরিবারের বড় মেয়ে।ভায়- ভাতিজির মধ্যে প্রথম বিয়ে। এভাবে এনগেজমেন্ট হলে সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। কথা হয় ইদের পরদিন এনগেজমেন্ট হবে। আবুল হোসেন বাড়ি আসেন। দুদিন পর ঈদ। আসার সময় সিনথিকে নিয়ে আসেন। সবে মাত্র আঠারোয় পা দিয়েছে সিনথি। বিধাতার নিজ হাতে তৈরী সে। কোথাও খুঁত নেই। রূপে পুবের সুরুজ। যেদিকে তাকাও সেদিকেই আলো। এমন ঝলমল রূপে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। যে এই মেয়ের  হৃদয়ে ঢুকবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। রূপবতীদের পোড়াবার ক্ষমতা বেশি। উল্টোও হয়। নিজ রূপ কখনো বুমেরাং হয়ে আপনাকেই পোড়াতে আসে। সিনথির হয়েছেও তাই। রায়হান থেকে বাঁচতে ওর পরিবার ওকে নানাবাড়ি দিয়ে আসে। ওদিকে রায়হান সিনথিকে না পেয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কোন হদিস পায় না। সিনথিদের এক প্রতিবেশির সাথে রায়হান সম্পর্ক গড়ে। ওদের টাকা পয়সা দেয়। বিনিময়ে সিনথিদের বাড়ির খোঁজ খবর পায়। সিনথির পরিবার কখন কী করে,কী খায় সব খবর  রাখে। এভাবে চলতে থাকে। সিনথিরা কিছুই টের পায় না। ওর বিয়ে ঠিক হওয়ায় বাড়ি এসেছে। খবর পৌঁছে যায় রায়হানের কাছে। আর দেরী করে না সে। বল্গা ঘোড়ার মত উড়ে আসে। সিনথি চলে যাবার পর বেশ কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় রায়হান। নাকচ করে দেন আবুল হোসেন। রায়হানরা বনেদী এবং ধনী। বাছবিচার করার কিছু নেই। আবুল হোসেন খবর নিয়ে জেনেছেন,শ্বশুর শ্বাশুরী হবার যোগ্যতা রায়হানের মা বাবার নেই। এরওপর টাকা পয়সার প্রভাব দেখিয়ে ছেলেটা এলাকায় চষে বেড়ায়। অনেকটা গুণ্ডাদের মত। আবুল হোসেন চাননি ওর সহজ সরল মেয়ে এক পাষণ্ড পরিবারে পড়ুক। বিয়ের প্রস্তাব এলে তিনি ঘুরেফিরে তেমন ইঙ্গিত দিতেন। উন্মত্ত রায়হানের জিদ চেপে যায়। সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সিনথি এসেছে জেনে এলাকার হোমড়াচোমরা নিয়ে দলবেঁধে ওদের বাড়ি জড়ো হয়। বাকবিতন্ডা চলে প্রচুর। রায়হান চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে। যদি সিনথিকে বিয়ে করতে না পারে তবে আর কেউ বিয়ে করতে পারবে না। যেখানেই বিয়ে দেয়া হবে সেখান থেকে তুলে আনা হবে। প্রয়োজনে বাড়ি পেট্রোল দিয়ে পুড়ে দেয়া হবে। পুরো গ্রামে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। গ্রামের লোকদের শান্ত করতে সে টাকা ছোঁড়ে। টাকা খেয়ে কিছু লোক ওর পক্ষ নেয়। কিছু লোক নিন্দা করে। পরিবেশ উত্তপ্ত দেখে আবুল হোসেন ভাবেন মেয়েকে যে করেই হোক রাতে সরিয়ে ফেলবেন। কেন মেয়েকে নিয়ে এলেন আক্ষেপ করতে থাকেন। সিনথিকে রাতে সরিয়ে ফেলবে জেনে যায় রায়হান। সারারাত ওদের বাসার সামনে পাহারা বসায়। পরদিন মেয়র, উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আসে। সিনথির বাবাকে বোঝানোর জন্য। সারাদিন তর্ক বিতর্ক চলে। ওখানে বিয়ে দিতে সিনথির বাবা,কাকারা কেউ রাজি নয়। শেষে এক উকিল এসে সিনথির বাবার হাত ধরে বলেন, জেঠামশাই,আমরা সব এক জায়গার মানুষ। বোনটার জন্য এসেছি। দিয়ে দেন আমাদের। রায়হানকে বাছার মত কিছু আছে বলেন? ওদের প্রভাব প্রতিপত্তি ওর শিক্ষা কোনদিক থেকে  আপনাদের চেয়ে কম? দেখতে সুন্দর মানানসই। সিনথির সাথে মানাবে। সে ওকে ভীষণ পছন্দ করে। আমি ওর বোনের জামাই।কাল সারারাত কেঁদেছে। বলেছে,সে যদি সিনথিকে না পায় তাহলে আত্মহত্যা করবে। এবার বোঝেন ওর মানসিক অবস্থা।! সে আপনাদের যতই হুমকি দিক আসলে সিনথিকে পাওয়ার জন্যই এসব করেছে। রাজি হয়ে যান জেঠামশাই। উকিল সাহেবের অনুনয় বিনয় শুনে মেয়র উঠে এলেন। সাথে আরো হোমড়াচোমরারা। এসেই সিনথির বাবার হাত চেপে ধরেন। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়, আর এতো সামান্য আবুল হোসেন!

এতগুলো মানুষের আর্জি আর ফেলতে পারেন না তিনি। চোখ মুছে রাজি হলেন মেয়েকে রায়হানের হাতে তুলে দেবেন। আবুল হোসেন রাজী হবেন এটা কেউ কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় রায়হান মাটিতে দুম করে পড়ে যায়। ওর সাঙ্গপাঙ্গরা খুশির চোটে চিৎকার দিতে থাকে। মানুষের ভীড় সিনথিদের উঠোনে। কী হয় দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।রায়হান সন্দেহ করে এটা আবুল হোসেনের চালাকি নয়তো? বিয়ে দেবার নাম করে মেয়েকে সরিয়ে ফেলবে নাতো? নাহ,বিশ্বাস নেই। সে দ্রুত ওঠে।উকিল সাহেবকে কী যেন বলে আর অমনিই তিনি প্রস্তাব করেন,জেঠামাশাই একটা আর্জি ছিল

বলুন,কী আর্জি।

মানে, আমরা চাই বিয়েটা আজকেই হোক।

পাগল হয়েছেন? কী বলছেন এসব! আমার কি গ্রাম সমাজ নেই? এছাড়া ভাইবোন আছে। যুক্তি পরামর্শের ব্যাপার আছে। আমাদের বংশের সন্তানের প্রথম বিয়ে। জাঁকজমক,জৌলুস না হলে চলে? ছেলেখেলা পাইছেন?

উকিল সাহেব দমবার মত নন। তিনি আবার বলেন,

তাহলে কাল হোক?

কী? খেঁকিয়ে ওঠেন আবুল হোসেন। কী বলছেন আপনি? আগামীকাল ঈদ। আর ঈদের দিনে বিয়ে?

আপনারা এসব কী শুরু করেছেন? আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবেন? অবশেষে মেয়র বলেন,সব বাদ। আমিই ঠিক করে দিচ্ছি। আজ এনগেজমেন্ট। ঈদের পরদিন বিয়ে। ওরা এক মুহূর্তও দেরী করতে রাজী নয়। যদি আবুল হোসেন রাজী থাকেন সব খরচ ওরা বহন করবেন। যত লোক খাওয়ানো প্রয়োজন,

আয়োজনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব খরচ রায়হানের পরিবার দেবে। আবুল হোসেন রেগে যান। অপমান! রীতিমতো অপমান। আমি আপনাদের কাছে টাকাপয়সা চেয়েছি? সময় লাগবে সময় চেয়েছি। মেয়ে বিয়ে দিতে হলে যোগাড়যন্ত্র লাগবে না? আর যেখানে বিয়ে ঠিক করেছি ওটা ক্যান্সেল করতে হবে না? ওটা শেষ না করে এটা করি কী করে? ওদের কী বলব,ভাবতে হবে না? ওরা যদি আপনাদের মত ঝামেলা করে তখন?

মেয়র বলে ওঠেন এজন্য আমরা আছি। আপনি চিন্তা করবেন না। তবে এনগেজমেন্ট এখনই হোক।

তাড়াহুড়োর মধ্যেই সিনথির এনগেজমেন্ট হয়ে যায়। রায়হানদের সাথে আত্মীয়তা হোক সিনথির পরিবার কেউ চায়নি। রায়হান রাজনীতি ছাড়া আর কিছু করে না। বংশের বড় মেয়ের জামাই। মানুষকে কী পরিচয় দেবেন আবুল হেসেন? জামাই রাজনীতি করে,এটা বলবেন? এটা পরিচয়? নাহ,মানসম্মান রইলো না। আবুল হোসেনের ভাইবোন এনগেজমেন্টে এলো না। তর্কে সবাই ছিলো। বড় ভাই অটল থাকতে পারেনি দেখে মনেকষ্ট নিয়ে সবাই চলে যায়। ঈদের পরদিন বিয়ে। বিশাল আয়োজন। পুরো গ্রামের মানুষ খাওয়াচ্ছেন আবুল হোসেন। ভাইবোনেরা এলো তবে কেউ খেলো না। মানুষকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় দিচ্ছে। বুঝতে দিচ্ছে না মনের রাগ। ওরা কোমরের খোঁটে খিলিপান নিয়ে এসেছে। বড় ভাইয়ের এখানে এক ফোঁটা পানিও স্পর্শ করেনি। খোঁট থেকে পান বের করে খায় আর হাসিমুখে মেহমান বিদেয় করে। যথাসময়ে রায়হানেরা এলো। মেয়েকে সাজানোর জন্য তোরজোর চলছে। সিনথিকে সাজানো হচ্ছে।

ওমা কী কাণ্ড!

সিনথির চাচী বলেন, এই সেরেছে! মেয়ের তো নাক ফোঁড়ানো নেই।

উপায়?

দাদী রেজিয়া বেগম বলেন,উপায় আছে। অহনই নাক ফোঁড়াইয়া দাও।

কী বলেন, চাচী?

হ,বউ। অখন এইডাই করতে হইবো। নাক ফুডা না করলে বিয়া অইবো?

ব্যথা পাইব না?

পাইলে করার কিচ্ছু নাই। হোনো বউ,নাক ফুডা করার লগে লগেই নাকফুল পড়াইয়া দিবা। ব্যথার উপরেই ব্যথা। তহন আর শোধ থাকবো না। নাকফুল ভিতরে চইলা যাইব। যে কথা সে কাজ।

রেজিয়া বেগম সিনথির মাকে বলেন,যাও বৌমা।অহনই হুঁইচ হুতা নিয়া আসো। সিনথির নাক ফুডা করোন লাগবো।

সিনথির মা কাঁদছেন দুদিন থেকে। মেয়েকে এই জায়গায় বিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। ছোটবোন শাহীন আফরোজ কত ভাল ঘরে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় বোন, বোনের জামাই কেউ আসেনি। মাহমুদ হাসান বিমর্ষ। অল্প দেখার শোক ভুলতে পারছে না। মনের ভেতর অসাধারণ এক স্বপ্নসৌধ নির্মান করে রেখেছে সে। কত সুখ সুন্দর নিমিষেই ভেঙে গেলো?

শাহীন আফরোজের দেবর আর বাসায় আসবে না জানিয়ে দিয়েছে। এই অপমানের কথা শাহীন আফরোজ বাবার বাড়ির সবাইকে বলেছে। মেয়ের বিয়েতে বাবার বাড়ির কেউ নেই এই দুঃখে তিনি বিহ্বল হয়ে আছেন। এখন মেয়ের নাক ফোঁড়াতে হবে। কেমন লাগে? ব্যথায় মেয়েটা মারা যাবে। সিনথির চাচী ওর মাকে বলে,ভাবী এটা কোন কথা হলো! মেয়ের নাক ফোঁড়ালেন না কেন?

আরে ভাই, মেয়ে ছিল আমার বোনদের কাছে। আমার কাছে কতদিন ছিলো?

যেখানেই থাক, মেয়ে বিয়ে দিতে হবে,জানেন না?

জানিতোরে ভাই,তবে এত তাড়াতাড়ি দিতে হবে জানতাম? ওই রায়হান পোলাটার জন্য আমার মেয়েকে নির্বাসনে পাঠাইছি। মেয়েটার সাথে থাকতে পারলাম কই?। মেয়েটা আমার দূরেই চলে যাচ্ছে। সিনথির মা ফোঁপাতে থাকেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কাঁদতে থাকেন। সিনথিও মাকে জড়িয়ে বিলাপ করতে থাকে। মা মেয়েকে আলাদা করা হয়। সিনথির দুইহাত চেপে ধরে আছে দুইজন। একজন কোমড় টেনে আছে। আরেকজনের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে সেজ চাচী দিলেন নাকে সুঁই ঢুকিয়ে। আরেকজন সাথে সাথে নাকফুল ঠেসে চেপে দিচ্ছে ভেতরে। ডায়মন্ডের নাকফুল। ডাঁসা বড়। চিকন নাক ঠেলে নাকফুল ঢুকানোর কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। তীব্র ব্যথায় সিনথি অজ্ঞান হয়ে যায়। রক্তে ভেসে যায় মুখমণ্ডল। গত চারপাঁচদিনের হুলুস্থুল, ভয়, আতংকে এমনিতেই সে ভীতসন্ত্রস্ত। এরওপর নাযিল হলো নাক ফুটো। মেয়েটি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মা- চাচীরা মাথায় জল ছিটাচ্ছে। কেউ কেউ বলে হায়!  এখন উপায়? নাকের রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না।মেয়েকে সাজাব কী করে? ওদিকে উঠোনে সোরগোল শুরু হয়। কে বা কারা সামিয়ানার ওপর দিয়ে বরের খাবার পাতে জল ঢেলে দিয়েছে। মাত্র সবাই খেতে বসেছে। এমন সময় খাবার পাতে জল পড়ায় অতিথিরা প্যান্ডেল ছেড়ে উঠে আসে। উঠানে হৈ চৈ, চিৎকার, চেঁচামেচি। বরপক্ষের কেউ কেউ রাগে চলে যাচ্ছে। কেউ রয়ে যায়। রায়হান স্টেজ থেকে নেমে ফুঁসতে থাকে। সে এখানে কিছু খাবে না।এই অপমান বরদাস্ত করবে না। ভেতরঘরে ঢুকেই বলতে থাকে,কনে রেডি করে দিন। নিয়ে যাব। রাতের বিয়ে। সারাবাড়িতে আলো জ্বলছে।কারা এই কাণ্ড করেছে হদিস পাওয়া গেলো না। পরে রেজিয়া বেগম খবর আনে পাশের বাড়ির হারুন আর ওরসাথে পোলাপান এমন কাজ করেছে। সিনথিরা ধনী ও প্রভাবশালী। সে নায়েবের নাতনী। ওদের ধন প্রাচুর্যে মারাত্মক ঈর্ষা পাশের প্রতিবেশী হাশেম মিয়ার। গরীব,দিন আনতে পান্তা ফুরায়।নায়েবের সাহায্যে বেঁচে আছে। সেই হাশেম মিয়ার ছেলে করেছে এই কাণ্ড। সিনথির বিয়ে নিয়ে  গ্রাম দুপক্ষ হয়ে গেলে সুযোগ নেয় হাশেম মিয়া। ওদের অপমান করার জন্য। বরপক্ষ উঠে চলে যাচ্ছে। হতবিহ্বল হয়ে দেখে আবুল হোসেন। কিছুই করতে পারেন না। শেষে রায়হানের দুলাভাই এসে বলেন, জ্যঠামশাই, মেয়ে নিয়ে আসুন। বিয়ের কাজ শেষ করি।ব্যথায় বিবর্ণ সিনথিকে বিয়ের মঞ্চে তোলা হয়। এরপর কী হয় সে জানে না। জ্ঞান ফেরার পর সে নিজেকে রায়হানদের বাড়িতে দেখে। কেউ নেই ওর আশেপাশে। একমাত্র খালাত বোন সিমি ছাড়া কেউ আসেনি। সিমির কাছে জানতে পারে সিনথির বাবা রাতে ওকে দিতে চায়নি। পরদিন নিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু ওরা কেউ কথা শোনেনি। সিনথিকে নিয়েই এসেছে। ব্যথায় নাক ফুলে ঢোল হয়ে আছে। রায়হানদের বাড়ি মেহমানে গিজগিজ করছে। বাইরের উঠোনে হইচই। পরদিন সিনথিদের বাড়ির লোকজন আসবে। ওদের খাওয়াতে গরু জবাই হচ্ছে। ওকে নিয়ে যাওয়া হয় ছোট্ট একটি ঘরে। সেখানে রায়হান এলে সিনথি ভয়ে খামোশ হয়ে যায়। কোন কথা নেই, বার্তা নেই  মাথার ওড়না সরিয়ে গালে চড় মারে রায়হান। ধবধবে ফর্সা গালে বসে যায় বাসরের চিহ্ন পাঁচ আঙুলের দাগ। সিনথি  মাগো বলে চিৎকার করে ওঠে। চড়টা বাম গালে পড়ে। যেখানে  নাকফুল ঢোল হয়ে আছে। ব্যথায় জ্বর আসে সিনথির। রায়হান গজগজ করতে থাকে,খুব দেমাক তাই না? মেয়েদের এত দেমাক থাকতে নেই। দেমাক কীভাবে ভাঙতে হয় দেখবে। আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না। তো কার কাছে দেবে? শোন,তোর মা–বাবা ভাইবোন,আত্মীয় স্বজন এমনকি চোদ্দগুষ্টির কেউ যেন কালকের পর আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না পারে। তোরও বাবা বাড়ি যাওয়া বন্ধ। তুই আজ থেকে বন্দী। তবে এইকথা যদি কাউকে বলিস খুন করে ফেলব। সিনথি ভয়ে সিঁটিয়ে যায়।পরদিন বাবা বাড়ির লোকেরা আসে। আত্মীয় স্বজনহীন আবুল হোসেন গ্রাম সর্দার কিছু গন্যমান্য ব্যক্তি আর চাষাভুষাদের নিয়ে আসে। চাচা, চাচী,ফুফা ফুফু, মামা,মামি,খালা, খালুদের কেউ নেই। আবুল হোসেনের কত স্বপ্ন ছিলো জাঁকজমক আর আড়ম্বরপূর্ণ করে মেয়ে পাত্রস্থ করবেন। কিন্তু এ হলো কী? অসহায় আবুল হোসেন মেয়ের কাছে আসেন।মেয়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এদিকের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মেয়ে নিয়ে চলে এলেন।সারারাত সিনথি কেঁদেছে। সেই যে কান্না শুরু হয় ওর আর শেষ হয়নি। সিনথি বন্দী হলো। যে ঘর-সংসার নিজের মনমতো হবার কথা,মাধুরি মিশিয়ে সাজানোর কথা সেই ঘরেই সে বন্দি হলো। মা- বাবা, ভাই-বোন,আত্মীয় স্বজনহীন সিনথির জীবনের পায়ে শিকল দেয়া হলো। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত,মান– অপমানের জের পুঁচকি মেয়ে সিনথিকে চুকাতে হলো চরম মূল্যে।যে লোকটি জোর করে বিয়ে করে ঘরে

নিয়ে এলো সে কী স্বামি নাকি অন্যকিছু বুঝে উঠতে পারেনি সিনথি। মা- বাবার আদরে বড় হয়েছে সে, ধমক কী জিনিস দেখেনি। রায়হানের সংসারে এসে কথায় কথায় ধমক খেয়ে বুক কেঁপে ওঠে সিনথির। সে যেন চোর। অবস্থা এমন হয়েছে যে, রায়হানকে দেখলে পালিয়ে বাঁচে। এভাবে জীবন বয়ে যেতে থাকে। মাঝে মাঝে  মা বাবা,ভাই বোন স্কুলে এসে  দেখে যায়। সেও চুরি করে বাবার বাড়ি যায়। স্কুলের শিক্ষকরা ব্যাপারটা জানত।ওরা খুব সহমর্মী ছিল। মাঝে মাঝে ওকে কাঁদতে দেখলে বলত,মায়ের জন্য বুক পুড়ছে? বাবার জন্য মন খারাপ তাই না? শিক্ষকদের এই স্নেহবার্তায় সে আরো আর্দ্র হয়ে উঠত। যেন সাত সাগরের ওপার থেকে ফেনিল তরঙ্গরা বয়ে নিয়ে আসত স্নেহাশীষ। বুক উপচে বের হওয়া জল ভেঙে দিত নরম চোখ। শিক্ষকরাই মূলত সিনথিকে ভালবেসেছে। ব্যথাতুর হৃদয়ে ওদের স্নেহ মলমের প্রলেপ দিত। শিক্ষকদের পশ্রয়ে গিয়ে দেখে আসত মা- বাবাদের। বেশিক্ষণ থাকতে পারত না। কখন আবার সিনথির শ্বশুর স্কুলে বসে থাকে কে জানে! শিক্ষকদের ও ভয় ছিল। তবুও ওরা ঝুঁকি নিত। দেখ সিনথি, তোমাকে যেতে দিচ্ছি। আমাদের মান রেখো মা। তোমার শ্বশুর এই স্কুলের সভাপতি। আমাদের চাকরী যাবে। সিনথি রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে যেত। মা- বাবার সান্নিধ্যে সময় যে কখন ফুরিয়ে আসে! তৃষ্ণা মেটে না। ওদের ছেড়ে আসতে মন চায় না। থেকে যেতে ইচ্ছে করে। এরকম করে যায় দিন। এরমাঝে মায়ের চিঠি আসে স্কুলের ঠিকানায়। বাবার অসুখ। রায়হানকে জানায় সিনথি। যেতে দেয় না ওকে ওর পাষণ্ড স্বামী ও শ্বশুর শাশুড়ী। গত কয়েকদিন থেকে অস্থির যাতনায় ছটফট করতে থাকে। ঘুম হয় না। খাবার গলা দিয়ে নামতে চায় না। ভেতরে কুডাক শোনে। যেন কিছু হারাতে বসেছে। মা বাবার কিছু হয়নিতো? ভাবতে ভাবতে উম্মাদ হয়ে যায় সিনথি। আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কোন কিছু পরোয়া না করে বৃষ্টির মধ্যে বের হয়ে যায়।

অবাক, নিস্তব্ধ, বিস্মিত মমতাজ উদ্দিন ওর যাওয়ার পথে চেয়ে থাকেন। রেহানা বেগমকে বলেন, কী করলো বউটা?

রেহানা বেগম জবাব দেন,আমি ভাবছি সাহস পাইলো কই?

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সিনথি ছাতা নেয়।তবে এবার নিলো শরীফ ছাতা। ছাতাটি বড় এবং শক্ত। খুলে দিলে বাদুড়ের ডানার মত ছড়িয়ে যায় চারদিকে। মুখ থেকে শরীরের আধেক পর্যন্ত কিছু দেখা যায় না। ছাতাটা মমতাজ উদ্দিনের। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি টের পাননি সিনথি ওনার ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেছে। জলের ভেতর লম্বা পা ফেলছে সিনথি। ওর ভয় শ্বশুর যদি পিছু নিয়ে ওকে ধরে ফেলে? তাহলে আর এই জন্মে বাবার বাড়ি যাওয়া হবে না। সে পারলে দৌড়ায়।হাঁফাতে হাঁফাতে সড়কে ওঠে।কোথাও কোন গাড়ি নেই। প্রায় একমাইল হাঁটার পর একটি রিক্সা পায়। ওটায় উঠে বাড়ি আসে সিনথি। ওর মা রুবিনা বেগম একটি মেয়েকে দাওয়ায় উঠতে দেখে অবাক হন। কে এলোরে এই বৃষ্টি মাথায় করে? প্রথমে ভাবেন হয়ত প্রবল মেঘে আটকা পড়া পথচারী। সেটা ভেবে দরোজা খুলে দিলেন।ভূত দেখলেও মানুষ এত চমকে ওঠে না। যতটুকু তিনি সিনথিকে দেখে চমকে ওঠেন!

বিশ্বাস করতে পারছেন না এই বৈরী আবহাওয়ায় মেয়ে বাড়িতে আসবে। মেয়েকে ঝাঁকি দিয়ে বলেন,কিছু হয়েছে সিনথি? রুবিনা বেগমের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। সিনথি ছাতা বন্ধ করে ভেজা শরীরে মাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,মাগো মা! তোমাদের ছাড়া থাকতে পারছি না ! আমাকে ওইবাড়ি থেকে নিয়ে আসো। আমি আর সংসার করবো না। ওই বাড়িতে থাকলে আমি মারা যাব। আমাকে নিয়ে আসো মা! তোমাদের জন্য সারাদিন কেঁদে কেটে কলিজা ফেটে যায়। মেয়েকে বুকে টেনে নেন রুবিনা বেগম। ভেজা শরীরে মেয়ের শরীরে ঢেলে দেন উষ্ণতা। অপৎেযের কপালে এঁকে দেন চুমু। পরম মমতায় ঘরে নেন মেয়েকে। বহুবছর পর মায়ের হাতে গরম গরম ভাত খেয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে যায় সিনথি। দীর্ঘ পাঁচ বছরের অপমান, গ্লানি,হতাশারা বৃষ্টির দিনে ওর চোখে ঘুম হয়ে এল এল। চোখে পাঁচ বছরের ঘুম বুকে মায়ের স্পর্শ মাতৃস্বর্গে তলিয়ে গেল সে। সকাল সাতটা। দরজায় কারা যেন দুমদাম শব্দ করছে। রুবিনা বেগম ধড়মড় করে ওঠেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন সাতটা। হায় এত বেলা হয়ে গেল? নামাজ ক্বাজা হয়ে গেছে। আফসোস করতে করতে দরজা খুলেন। বৃষ্টি নেই। আকাশ কালো হয়ে আছে। দেখেন উঠানের আশেপাশে অনেক মানুষ। ব্যাপার কী? কেউ বৃষ্টিতে আটকে থাকা ডালপালা তুলছে। কেউ পাতা সরাচ্ছে। কেউ ঝাড়ু নিয়ে অন্য জায়গা পরিস্কার করছে। রুবিনা বেগম জিজ্ঞেস করেন,কী ব্যাপার নসু ভাই,খোরশেদ,সেলিম তোরা এগুলা করোস ক্যান?

খোরশেদ কিছু বলে না। সেলিম মিয়া বলে,ভাবী,

মেহমান আসবে। এখানে বসবে। তাই এগুলা পরিস্কার করতেছি।

কই থেকে মেহমান আসবে?

ঢাকা থেইকা।

ঢাকা থেইকা মানে?

কেউ কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর ফরিদা বেগম পরোটা, ডিমভাজি আর চা নিয়ে এসে বলে,ভাবী খেয়ে ফেলেন।

রুবিনা বেগম অবাক। ফরিদা তুই আমার জন্য নাস্তা আনলি কেন?

আরে ভাবি, মেহমান আসতেছে। মেঘ বৃষ্টি হইছে। কখন কী রান্না করবেন। দরকার নাই। আমি নিয়া আসছি খাইয়া ফেলেন। ফরিদা বেগম একরকম জোর করে রুবিনা বেগমকে খাওয়াতে গেলে বলেন,

আরে থাম! সিনথি আসছে।

ফরিদা বেগম ঠাটাপড়া মানুষের মত হাঁ করে বলে,কে আসছে?

সিনথি।

ওম্মা! মেয়ে কেমনে আসছে ভাবি? জামাই আসছে?

আরে না,মেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় মেঘে ভিজে একা একা আসছে।ফরিদা বেগম অবাক। একদৌড়ে ঘরে ঢুকে সিনথিকে ধাক্কাতে থাকে।

মা,উঠো। ঘুম থেকে উঠো। দেখ,কে আসছে? কতবছর পর সিনথিকে পেয়েছে ফরিদা বেগম। মেয়েকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আসলে এ কান্না সিনথির জন্য নয়। এ কান্না গোপন শোকের কান্না। যা এতক্ষণ সবাই লুকিয়ে রেখেছে বুকের ভেতর। সবার বুক ছলছল করছে। কিন্তু ঠেকিয়ে রাখছে চোখ। কিছুতেই এই জল এখন রুবিনা বেগমকে দেখানো যাবে না। সবাই কাঁদছে গুমরে গুমরে। এই জল ফেলার সূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না কেউ। স্ত্রূ তৈরী হলো সিনথিকে দিয়ে। ফরিদা বেগমের চিৎকারে রুবিনা বেগম ভাবে বহুবছর পর সিনথিকে পেয়ে আবেগে কাঁদছে ফরিদা। কারণ,ফরিদা এই বাড়ির বউ হয়ে এলে সিনথি বেশিক্ষণ চাচীর কাছে থাকত। এই চাচীর সাথে ওর মধুর সম্পর্ক। ফরিদার কান্না শুনে উঠানের সবাই কাজ ফেলে ঘরে আসে। ওরাও কান্নার সূত্র পেয়ে কাঁদতে থাকে। রুবিনা বেগম আর সিনথি বোঝে বহুদিন পর সিনথি ফিরে আসা ওদের শোকের কারণ। সময় বাড়তে থাকে। সিনথিদের উঠোনে দু একজন করে মানুষ জড় হয়।ওরা অবাক। কেন এই দূর্যোগের মাঝে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষেরা আসছে? সিনথির জন্য?  সিনথিতো সবাইকে চেনে না। এর ঠিক কিছুক্ষণ পর মুল সড়ক থেকে সিনথির মেজো ফুফুর গগনবিদারী চিৎকার শুনে চমকে ওঠে রুবিনা বেগম। ও ভাইরে ভাই,ও কলিজার টুকরা ভাই,আমাদের ফাঁকি দিয়া কেমনে চইলা গেলা! ভাইরে ভাই,কেন তোমারে দেখতে পাইলাম না। ও ভাইগো, তোমার এত অসুখ গেছে কেন একনজর দেখতে আসলাম না! মেজ ফুফু বিলাপ করতে করতে ঘরের দাওয়ায় রুবিনা বেগমকে পেয়ে গলা প্যাঁচিয়ে ধরে বলেন, ও ভাবিগো,শুনছোনিগো, আমার ভাই আমাদের ফাঁকি দিছিগো! ও ভাবিগো……! বিলাপ চলতে থাকে। বিলাপের চোটে সিনথিদের বাড়িতে মাতম ওঠে। লুকিয়ে থাকা সমস্ত গোপন শোক বুকের দরজা ঠেলে বের হয়ে আসে। সবাই হাউমাউ চিৎকার জুড়ে দেয়।

যে যেভাবে পারে আবুল হোসেনের স্মৃতিবন্দনা করে চোখের জলে। ওদিকে রুবিনা বেগম মেজো ফুফুর গলা প্যাঁচানো অবস্থায় মূর্ছা গেলেন। সিনথি পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে জড়িয়ে অনেকে কাঁদছে। আশ্চর্য!  যে মেয়ে বাবা বাড়ি আসার জন্য কেঁদে কেটে জীবন শেষ করেছে সেই মেয়ের চোখের জল গেলো কোথায়? রেজিয়া বেগম সিনথিকে জড়িয়ে বলছেন,ও বইনগো বইন,আইলাতো আইলা বইনগো শেষ সময়ে আইলা। চোখেতে না দেখিয়াই বাপরে বিদায় দিলা। তোমার বাপে তোমার জন্য কত কাঁনত দিনরাইত। আর কইত আমার মাইয়ার কপালে খোদা দেয় নাই সুখ একছটাক। নির্বিকার সিনথি স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকে। খবর চলে যায় চতুর্দিকে। মাইকিং হচ্ছে শান্তপুর নিবাসি নায়েব হাজী ইউনুস মিয়ার বড় ছেলে মোহাম্মদ আবুল হোসেন গতকাল ভোররাতে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ঢাকা,হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। ইন্না-লিল্লাহে….. রাজিউন। খবর পৌঁছে যায় সিনথির শ্বশুরবাড়ি।তখন ওরা মিটিং করছে সিনথিকে কীভাবে কঠোর শাস্তি দেয়া যায় এ নিয়ে। রায়হান আসছে। কঠিন বিচার হবে সিনথির। কিন্তু একি শুনছে ওরা? বেয়াই নেই? শাহানা বলে,এবার বুজছো,কেন ভাবী এত উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলো? যে ভাবী কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না,সে কেন কাউকে পরোয়া করলো না? ওর ভেতর খবর হয়ে গেছে বাপ যে মরে যাবে। বাপের টান তাকে এই ঝড়বৃষ্টিতে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নাই।

রায়হান আসে শ্বশুরবাড়ি। মমতাজ উদ্দিন, রেহানা বেগম, শাহানা ওরা সিনথির হাত ধরে আছে। লাশবাহী গাড়ি আসে তিনটায়। বাড়িতে শোকের মাতম ওঠে। রুবিনা বেগম বারবার মূর্ছা যান। জ্ঞান ফিরে শুধু এটুকু বলেন,সিনথির বাপ,তুমি এটা কী করলা? আমারে কার কাছে রেখে গেলা? মেয়েগুলার কী হবে! সিনথির বাপ! ও সিনথির বাপ! এরপর আবার অজ্ঞান।

 

 

 

 

 

 

 

সিনথি কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। বহুবছর পর বাবার বাড়ি এসে একরাত কাটিয়েছে। মায়াবী সুখ আর মোহে সে ভেসেছিল। এখন দেখে বাড়িতে মানুষ উপচে পড়ছে। ঠাঁই দেয়ার জায়গা নেই।বাবা নেই।নেই মানে কী?

আড়াল হয়েছে ওদের থেকে? কয়দিন থাকবে এভাবে ওদের ছেড়ে? এসব ভেবে সে কফিনের সামনে দাঁড়ায়। সবাই ওকে জায়গা করে দেয় বাবাকে দেখার জন্য। সে দেখে কত সুন্দর পবিত্র একটি মুখ। কী নিবিড় প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। ওই চোখে কোন বেদনা নেই,দুঃখ নেই,দিন যাপনের কোন তাড়না নেই,ঘুম থেকে জেগে ওঠার কোন বাসনা নেই। আহা কী পরম শান্তি! এমন শান্তিময় ঘুম সিনথিও গতকাল রাতে মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল। সে জানে ঘুম না হওয়ার যাতনা কী! একটি রাতের ঘুমসুখ কী এটাও গতকাল রাতে জেনেছে। ওকে কেন সবাই ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে? আনমনে সবাইকে বলে, তোমরা আমার বাবার সামনে থেকে যাও। বাবা ঘুমাচ্ছে। কী শান্তির ঘুম। যাও সবাই চলে যাও। বাবা বহুদিন ঘুমায়নি।এখন তাঁকে ঘুমাতে দাও।

বেদনাদের মুক্তি দিয়ে সিনথি বাবার শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশ ভার হয়ে আছে। আবার যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। হুজুরদের তাড়া লাশ বেশিক্ষণ রাখা ঠিক না। সবাই আসেন,একটু পর জানাযা হবে। কফিন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মৌলুক চাঁদ পুকুরপাড়ে কবর দেয়া হবে। শত শত মানুষ। মানুষের চাপ,হাঁটা চলায় উঠানের পেককাদা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। অন্তিম শয়ানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামের সবচাইতে ভালো মানুষটাকে। মানুষের ভেতর জিকির ওঠে। জিকির করতে করতে সবাই কফিনের পিছু নেয়। সিনথির চোখের সামনে চলে যায় বাবা আবুল হোসেন। বড় সৌখিন,প্রাণখোলা,উদার ছটফটে এক মানুষ। এক আনন্দের জাদুকর। অন্দরমহল ভেদ করে শোকের সুতীব্র চিৎকার জমিন ছেড়ে আরশে পৌঁছে। শোক, কান্না, আহাজারি পরস্পর পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকে। শুধু ভাবলেশহীন সিনথি দূরে তাকিয়ে দেখে,একটি কফিনের ভার বহন করার জন্য কী করে শতশত মানুষ ছুটোছুটি করছে!

ছয়মাস পর…

আবার সেই  তোলপাড় ওঠে সিনথির বুকে।

এমন লাগে কেন? প্রতিদিন স্কুলে আসে যায়। কিন্তু বাবা কোথায়? এতদিন হয়ে গেল বাবা একদিনও  আসেনি। সিনথিকে দেখতে স্কুলে এসেই ডাক জুড়ে দিতেন কই আমার ময়না পাখি,কই আমার টিয়া মা,কইগো মা জননী আমার? বাবার ডাক শুনেই ক্লাস ফেলে দৌড়ে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত সিনথি। স্কুল ছিলো ওর বাড়িঘর। এখানেই সে বাবা- মাকে দেখতে পায়। বাবা আসার সময় কত কী নিয়ে আসে। সিনথি আইসক্রিম পছন্দ করে। বাবা এনে বলত, দেখি দেখি,আমার সামনে খানতো আম্মাজান? কেমনে আইসক্রিম খায় একটু দেখি? বক্সে ভরে ভাত তরকারি নিয়ে এসে বলতেন,দেখি মা জননী খায়া দেখানতো এট্টু! চুলের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ইসসিরে! কতদিন চুলে তেল দেয়নাই আমার মা! এই দেখেন আম্মাজান, আপনার জন্য কিউট সুগন্ধি তেল নিয়া আসছি। একেবারে দামী তেল। আহা! আমার মায়ের চুল স্যাম্পু করা নাই। চুলগুলান কেমন রুক্ষ, মলিন হয়া গেছে। কোন আফসোস নাই। দেখেন আপনার জন্য ক্রিম,লোশন,পাউডার, লিপস্টিক, সাবান, শ্যাম্পু সব নিয়া আসছি। আর কাইন্দেন না, এবার একটু হাসেন। বাপ মেয়ে দুজন একসাথে হেসে ওঠে। কতদিন হয়ে গেল বাবা আর আসে না। স্কুলে এলে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। এই বুঝি বাবা এলো। এসেই ডাক দেবে, কই আমার আম্মাজান কইগো! দেখেন তো, আপনার এই ছেলেটাকে চেনেন কি না? সিনথি কান পেতে রয়। নাহ,কোন ডাক আসে না। ওর ভেতর লণ্ডভণ্ড হতে থাকে। বাসায় এসে কাঁদে। আবারো কান্না রোগে পেয়ে বসে। ভীষণ বাবা ডাকতে ইচ্ছে করে। জোরে,খুব জোরে। সিনথির ডাক শুনে বাবা যেখানেই থাকুক যেন ছুটে আসবে। কিন্তু কোথায় ডাকবে? সে জায়গা খোঁজে। আজকে বাবাকে ডাকতেই হবে। না হলে সে মারা যাবে। পাগলের মত ভোঁ-ভোঁ  করতে থাকে। ছাদে ওঠে। নাহ,এখানে হবে না। ওর চিৎকার শুনে সবাই ছুটে আসবে। দৃষ্টি প্রসারিত করে। দূরের দিগন্তে বিস্তৃত অগ্রহায়নের মাঠ চোখে পড়ে। নবান্নের ডাক হেমন্তের বনে। ক্ষেতের পর ক্ষেতে সোনালি ধান কেটে শুইয়ে রেখেছে কৃষক। জমিনের ওপর ধানের বিছানা। হলুদ ধানে চোখ পড়তেই মন হু- হু করে ওঠে। দূর থেকে দূরে কুয়াশার কুণ্ডলী পৃথিবীকে ঘিরে আছে। তখনই সিনথি ভাবে ওখানেই যাব। ওই হেমন্তের মাঠে যাব। ওখানে পবিত্র বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে বাবাকে ডাকব। বাবা, নিশ্চয়ই আমাকে শুনবেন। ছাদ থেকে দ্রুত নামে সিনথি। দৌড়ে গেটের কাছে যায়। গিয়ে দেখে তালা মারা। আরো বেশ কয়েকটা গেটের কাছে যায়। সেখানেও একই অবস্থা। রায়হানদের বিশাল বাড়ি। এত বড় বাড়ি যে একদিনে দেখে শেষ করা যায় না। চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীর। বাড়িতে তিনটি মেইনগেট। আর আটটি পকেটগেট। পকেটগেট একটি পড়েছে সিনথির ঘর বরাবর। ওটায় সবসময় তালা  থাকে। এর চাবী বুয়ার কাছে। যে খালা সিনথির দেখভাল করে এবং সিনথিকে পাহারায় রাখে ওই খালার কাছে গেটের চাবী। একেক করে প্রতিটা গেট বন্ধ পেয়ে সিনথি খালার কাছে চাবি খোঁজে। খালা দিতে অস্বীকৃতি জানালে হাত ধরে বলে,খালা একটু দয়া করুন। চাবিটা দেন। যাব আর আসব। কিছু টাকা বুয়ার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে এই নিন,পান সুপারি খাবেন।

খালা বলে,মাগো,চাবি খ্ুঁজতেছেন। আমার নিজেরই শরম করতেছে। আপনি মালিক আর আমি চাকর। কাকু জানতে পারলে আমারে মাইরা ফেলবে।আমি কী করতাম?

রায়হান জানবে না। দেন,একটু দেন। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি মরে যাব। সিনথির কান্না দেখে জরিনা বুয়ার দয়া হয়। সে চাবি দেয় আর বলে,যান, তারাতাড়ি যান। আমি গেটের সামনে আছি। পাহারা দেমু। তয় কই যাইবেন?

ওই যে ওই মাঠে। যাব আর আসব।

সিনথি চলে গেলে জরিনা বুয়া ভাবে,মাইয়াডা একটা আচানক। এই বাড়িত কত মাইয়া আছে, বউ আছে। তয় এই মাইয়াডা কারো লাহান না, কার লাহান?কারো সাথে মিল করতে পারে না জরিনা বুয়া।

অবাক হয়ে ভাবে,এই হাঞ্জেবেলায় হাত্রে মাইয়াডার কী কাম? এট্টুপর মাগরিবের আজান দিবো! কী কাম ওইহানে?

সিনথি দৌড়াতে থাকে। দূর দিগন্তে দৃশ্যমান গোলাকার পৃথিবী ছোট হয়ে আসে। পুরো অগ্রহায়ন হেমন্তের বুকে শুয়ে আছে। মাঝক্ষেতে সিনথি দাঁড়ায়। চারিদিকে তাকায়। ওপরে ঘোলাটে আকাশ। কুয়াশা গিলতে আসছে পৃথিবীকে। সে ওপরে মুখ তোলে। তারপর শরীরের যত শক্তি আছে তা দিয়ে ডাকতে থাকে বা–আ–আ- –বা, বা—আ—-বা! ডেকেই চলে সিনথি। পূবে তাকায়,পশ্চিমে তাকায়,উত্তরে তাকায়,দক্ষিণে তাকায় নাহ,বাবার জবাব আসে না। কোথাও বাবার জবাব শুনতে পায় না। শুধু  কুয়াশার পর্দা ভেদ করে উল্টো প্রতিধ্বনি ফিরে আসে বা—আ—-আ——বা,বা—-আ—আ —বা!

সিনথি ফুঁপিয়ে কাঁদে। বাবা, বাবাগো! কোথায় তুমি?

আমার ডাক শুনতে পাও না? আমাকে ছেড়ে কোথায় আছো? সিনথি সোনালি ধানের খড়ের ওপর মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। বুকের দীর্ঘশ্বাস অগ্রহায়নের সন্ধ্যায় আছড়ে পড়ে। বহুদূর থেকে উড়ে আসে ঝাঁক ঝাঁক কুয়াশার দল। একাকীত্ব, নির্জনতা,বুকের পার ভেঙ্গে আসা তীব্র অশ্রুতে সমর্পিত সিনথি ছোট ছানার মত কুঁইকুঁই করতে থাকে। ক্লান্ত মুখে বাবা, বাবা,বাবা আর বাবা ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। দূর আকাশে উড়ে যায় বলাকার দল। নীড়ে ফিরবে বলে। কুয়াশা ঢাকা আকাশটায় ওদের অস্পষ্ট ছবির মত মনে হয়। যে ছবি শুধু প্রকৃতি আঁকে। এমন বিহবলতায় অগ্রহায়নের খড়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকে সিনথি।

 

রোখসানা ইয়াসমিন মণি, কথাসাহিত্যিক, কুমিল্লা

কাজী নজরুল ইসলাম : বাংলা সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণপুরুষ

আ.ম.ম. মামুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম মৌলিক কবি। রবীন্দ্র অনুবর্তী একগুচ্ছ কবির একজন তিনি নন। তিনি অন্যরকম স্বতন্ত্র। শিল্প সাধনায়,

আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ 

প্রবীর বিকাশ সরকার ১৯২৯ সালে বহির্বিশ্বে অবস্থানকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে ঘটেছে যুগপৎ দুঃখজনক এবং আনন্দদায়ক কিছু ঘটনা। যা নিয়ে বাংলায় সামান্যই আলোচনা হয়েছে, অথবা

হিংস্র ও বুনো অপশক্তির বিনাশ চাই

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় গ্রীষ্মকালটা বড়ই অসহনীয় ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে এই ঋতুটির তেজ আগে কখনও এত তীব্র ছিলো না। ইতোমধ্যেই