ড. মুহাম্মদ ইউনূস
হঠাৎ জওশান আরার মৃত্যু সংবাদ শুনে মনটা দুঃখে ভরে গেলো। অনেক দিন যোগাযোগ নেই সেটা একরকম কথা। কিন্তু একেবারে আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে যাবে সে কেমন কথা!
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
কলেজে পড়ার সময় জওশন আরার সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনি কলেজে আমার দুই বছরের সিনিয়র। বিবাহিতা। একটি কন্যা সন্তানের জননী। তার সাত— আট বছরের মেয়ে মুন্নির সঙ্গে আমার খুব ভাব। তাঁর স্বামী মাহবুব আলম চৌধুরী নামকরা কবি ও ব্যবসায়ী। কলেজ কর্তৃপক্ষ জওশন আরা এবং আমাকে কলেজ ম্যাগাজিন ‘অন্বেষা’র যৌথ সম্পাদক নিযুক্ত করলো। মহা আনন্দের সঙ্গে সে দায়িত্ব দুজনে পালন করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে জওশন আরা ইউনিসেফের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
আমি যখন দেশে ফিরে আসি তখন তিনি ইউনিসেফের বড় কর্মকর্তা। গ্রামীণ ব্যাংক যখন শুরু করি তখন তিনি একাজে খুবই উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। আমরা তখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড দাঁড় করাচ্ছিলাম।
জওশন আরা আমাদের কাজকর্ম যতই দেখলেন ততই উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। আমাদের কাজের সঙ্গে ইউনিসেফকে যুক্ত করতে চাইলেন। তিনি আমাদের কাজগুলোকে এগিয়ে নেবার জন্য উৎসাহী হলেন। গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের নারী উন্নয়ন কর্মসূচি গঠনে অনেক সাহায্য করলেন। আমাদের মহিলা কর্মশালাগুলি ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালনা করার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর সহযোগিতা এবং উৎসাহে গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলাদের জীবনী নিয়ে একটা সংকলন তৈরি করলাম। নাম দিলাম “বেলতৈল গ্রামের জরিমন”। বইটি খুবই জনপ্রিয় হলো। মানুষের মনকে খুবই নাড়া দিলো। অনেকে ইংরেজি অনুবাদ চাইলো। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলো। বইটি এখনো পৃথিবীর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপারিশকৃত পাঠ্যদের তালিকায় থাকে।
গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক বাড়ি বাড়ি নলকূপ স্থাপনের যে কর্মসূচি নিয়েছিলাম তার জন্য কারিগরি সাহায্যের ব্যবস্থাও জওশন আরা করে দিয়েছিলেন। জওশন আরা আমাদের শাখাগুলি পরিদর্শনের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক পরিদর্শক নিয়ে আসতেন।
কলেজ জীবনে তাঁর বাড়ি ছিল আমার আড্ডার একটা প্রিয় স্থান। এখানে আমি প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যা তাঁর পরিবারের সাথে কাটাতাম এবং আমাদের প্রিয় বিষয়গুলি নিয়ে তর্ক করতাম। পরবর্তীতে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব শীর্ষ মহিলা সেসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম সারির। কলেজ জীবনে আমাদের আলাপের একটা বড় বিষয় থাকতো মহিলাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
আড্ডায় অনিয়মিত সঙ্গীরাও যোগ দিতো। প্রতি সন্ধ্যায় যথারীতি আমার প্রিয় পিঁয়াজু সহকারে নানা খাবার তৈরি করত জওশান আরা। একাজে কোনোদিন তাঁর উৎসাহের কোনো ঘাটতি হয়নি।
আমার বন্ধু জওশন আরা আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। তাঁর প্রিয় স্মৃতি গুলি শুধু থেকে গেলো।
আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসীব করুন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী
প্রধান উপদেষ্টা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার