বাবুল সিদ্দিক
১৩৫০ কোটি বছর আগে ‘বিগ ব্যাং‘ এর সংঘটন হয়। এক মাধ্যমে বস্তু ও শক্তি অস্তিত্ব লাভ করে। বস্তু ও শক্তি অস্তিত্বমান হওয়া মানে পদার্থ বিজ্ঞানের জন্ম নেওয়া। মহাবিশ্বের সৃষ্টির একদম শুরুর দিকে অণু—পরমাণু বলতে কিছুই ছিল না। অল্প সময় পর পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মে এদের উদ্ভব ঘটে। অণু—পরমাণু উদ্ভবের সাথে সাথে জন্ম নেয় রসায়ন। ‘ বিগ ব্যাং ‘ এর আগে কি ছিল কিংবা আদৌ কোনো কিছু ছিল কি না সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও সন্ধিহান।
৯০০ কোটি বৎসর আগে জন্ম লাভ করে আমাদের সৌরজগৎ। কয়েক আলোকবর্ষ ব্যাপী মহাজাগতিক মেঘ (Interstellar Cloud) মহাকর্ষের টানে পরস্পর একত্রিত হয়ে সৌরজগৎ গঠন করে। যে অংশটিতে সবচেয়ে বেশি পদার্থ জমা হয়েছিল সেটি বর্তমানে সূর্য। সূর্যের পদার্থ জমতে জমতে এতো বেশি পদার্থ জমা হয়েছিল যে সেখানে অকল্পনীয় চাপ তৈরি হয়েছিল। এই চাপে হাইড্রোজেন পরমানুগুলো ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করে। এক হাইড্রোজেন ঢুকে যায় আরেক হাইড্রোজেনের ভেতর। এ ঘটনায় প্রচন্ড তাপ ও আলোক শক্তি বিকিরণ হতে থাকে। ফলে জ্বলে ওঠে সূর্য, আলো দিতে থাকে চারদিকে।
৪৫০ কোটি বৎসর আগে পৃথিবীর জন্ম। সুর্য যখন জন্ম হচ্ছিল তখন তার পাশাপাশি গ্রহ—উপগ্রহও বিকশিত হচ্ছিল। সূর্য থেকে দূরে আলাদা করে প্রত্যেকেই মধ্যে পদার্থ জমতে থাকে এবং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা প্রভাব বলয় তৈরি হয়।
এই প্রভাবে পার্শ্ববর্তী উপগ্রহগুলো গ্রহদের কেন্দ্র করে আবর্তন করতে থাকে, সুর্যকে কেন্দ্র করে নয়।
৩শত ৮০ কোটি বৎসর আগে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি এবং জীববিজ্ঞানের জন্ম। শুরুতে পৃথিবী প্রচণ্ড উত্তপ্ত ছিল। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে উপরিভাগ শীতল হয়ে আসে তবে পৃথিবীর ভেতর ভাগটা এখনও প্রচণ্ড উত্তপ্ত। পানি এবং বরফবাহী প্রচুর ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়ে এবং সাগর ও মহাসাগরের জন্ম হয়। পানির উপস্থিতিতে প্রাণের উৎপত্তির জন্য বেশ একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ঠিক কি ভাবে প্রাণের জন্ম হয়েছিল সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতবাদ হচ্ছে পানি, জৈব রাসায়নিক উপাদান, বিদ্যুৎ যদি উপযুক্ত তাপ ও চাপে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে তা হলে সেখানে প্রাথমিক স্তরের আদি প্রাণ তৈরি হতে পারে। এ নিয়ে স্ট্যানলি মিলারের বিখ্যাত একটি পরীক্ষা আছে।
৩ শত ৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে অক্সিজেনের মজুদ পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে। ঠিক কি ভাবে এটা হয়েছিল সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। তবে এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য মতবাদ হচ্ছে, এক ধরনের সায়ানোব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ছাড়াতে শুরু করেছিল। প্রাণের জন্ম হয়েছিল সমুদ্রে, বায়ুমণ্ডলে তখন অক্সিজেন ছিল না। ঢেউ—এর মাধ্যমে কিছু ব্যাকটেরিয়া ডাঙায় উঠে আসে এবং সুর্যের আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ সম্পন্ন করে।
প্রথমে মহাদেশ (স্থল ভাগ) তৈরি হওয়ার পর একশত কোটি বছর তেমন কিছু হয়নি পৃথিবীতে। একেবারে একঘেয়ে একটি সময় কাটে। মহাদেশগুলো আটকে ছিল ট্রাফিক জ্যামে অর্থাৎ তেমন একটা নড়াচড়া করে নি। প্রাণের তেমন কোন উন্নতিও ঘটে নি এ সময়।
প্রাথমিক পর্যায়ে পৃথিবীর সব মহাদেশগুলো একত্রে ছিল। তখন এর নাম ছিল ‘প্যানজিয়া’। ‘প্যানজিয়া’ ধীরে ধীরে বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায় এবং তৈরি করে অনেকগুলো মহাদেশ। বিভিন্ন মহাদেশের পর্বতমালাগুলো দেখে গবেষকরা বের করতে পারেন, ঠিক কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা একত্রে যুক্ত থেকে পরে আলাদা হয়ে এসব বিশাল মহাদেশগুলির সৃষ্টি করেছিল।
৭৫ লক্ষ বছর আগে হঠাৎ করে করেই একটা বড় মহাদেশ অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে বের হয়ে যায়। এ সময় পৃথিবী একেবারে ঠান্ডা হয়ে একটা বিশাল বরফের গোলায় রূপান্তরিত হয়। এ সময় হিমবাহ দিয়ে ঢাকা ছিল ভূ—পৃষ্ঠ। এমন কি বিষুবীয় অঞ্চলেও ছিল হিমবাহ।
৬৫ লক্ষ বছর আগে বায়ুমণ্ডলে বাড়তে থাকে অক্সিজেন এবং এ সময় বিভিন্ন প্রাণীর উদ্ভব হতে থাকে। এককোষী প্রাণীর পাশাপাশি আসতে থাকে বহুকোষী প্রাণী।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিলুপ্তি ঘটে আজ থেকে ২৫ লক্ষ বছর আগে, পারমিয়ান প্রিরিয়ডে। মাত্র ৬০ হাজার বছরের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ জীবের বিলুপ্তি ঘটে। ডায়নোসরসহ ৯০ শতাংশ জীবের বিলুপ্তির কারণ ছিল সাইবেরিয়ার এক বিশাল অগ্নুৎপাত। পরিবেশ পরিবর্তনের কারণেও বিলুপ্তি ঘটতে দেখা গেছে। ৪৫ লক্ষ বছর আগে বড়সড় এক তুষার যুগের কারণে বিলুপ্তি ঘটে ৭৫ শতাংশ জীবের। পাঁচটি বড় বরফ যুগ দেখা যায় পৃথিবীর ইতিহাসে।
২৫ লক্ষ বছর আগে হোমো গণের উৎপত্তি হয়। মানুষ এবং মানুষের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের প্রাণীগুলো এই হোমো গণের অন্তর্ভূক্ত। মানুষের মতো দেখতে হোমো ইরেকটাস বা হোমো নিয়ান্ডারথাল এই গোত্রেই সদস্য। এ সময় প্রথম পাথর দিয়ে হাতিয়ার ব্যবহার শুরু হয়।
২০ লক্ষ বছর আগে মানুষের আদিম জ্ঞাতিরা আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় বসবাস শুরু করে। আলাদা আলাদা এলাকা, এক গোত্র থেকে আর এক গোত্র বিচ্ছিন্ন। কোনো প্রাণীর গঠন, বৈশিষ্ট্য, আচার, আচরণ কেমন হবে তা নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে তাদের গঠন বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন ভিন্ন হতে থাকে।
৫ লক্ষ বছর আগে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে লিয়ান্ডারথালরা বিস্তার হতে থাকে। ৩ লক্ষ বছর আগে দৈনন্দিন কাজে আগুনের ব্যবহার শুরু হয়। ২ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষেরা পূর্ব আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করে।
৭০ হাজার বছর আগে জ্ঞানের বিপ্লব ঘটে। ভাষার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। তখন থেকেই লিখিত ইতিহাসের জন্ম। এই সময়কালের মধ্যে আধুনিক মানুষ আফ্রিকা ছাড়িয়ে বাইরের দিকে বিস্তার লাভ করতে থাকে। ৪৫ হাজার বছর আগে মানুষেরা অস্টে্রলিয়ার গিয়ে পৌঁছায়। মানুষের প্রভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় সেখানকার অনেক প্রাণী।
৩০ হাজার বছর আগে বিলুপ্তি ঘটে লিয়ান্ডারথালদের। মানুষেরই তাদের ধরে ধরে মেরে শেষ করে ফেলে। ১৬ হাজার বছর আগে মানুষ আমেরিকায় পৌঁছায়। বিলুপ্ত হয়ে যায় সেখানকার অনেক প্রাণী, প্রজাতি । ১৩ হাজার বছর আগে হোমগণের সকল প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১২ হাজার বছর আগে কৃষিতে বিপ্লব ঘটে। এর আগে মানুষ যাযাবর জীবনযাপন করতো। খাবারের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। যেখানে খাবার পেতো সেখানেই যেতো। এক সময় খেয়াল করলো, খাবারের গাছ ও খাবারের প্রাণীগুলোকে চাষ—বাস কিংবা লালন—পালন করা সম্ভব। এতে অনিশ্চিত ও বিপদসংকুল পথে ভ্রমণ করতে হয় না, জীবনের নিরাপত্তা থাকে। এরপর থেকে শুরু হয় কোথাও স্থায়ী ভাবে বসবাস করার রীতি।
৫ হাজার বছর আগে হস্তশিপি ব্যবহারের মাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়। এ সময়কালে বহুশ্বরবাদ বিকাশ লাভ করে। এ সময় পৃথিবীর শহরভিত্তিক বড় বড় সভ্যতা গড়ে ওঠে। যেমন সুমেরুয়ী সভ্যতা, বেবিলনায় সভ্যতা, মহেন্জদারো—হরপ্পা সভ্যতা ইত্যাদি। ৪ হাজার ২৫০ বছর আগে আক্কাদীয় সামরাজ্যের উত্থান ঘটে। ২ হাজার পাঁচশত বছর আগে মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন হয়। ২ হাজার বছর আগে চীনে হান সামরাজ্যর বিস্তার ঘটে। একই সময় ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে রোমান সা¤্রাজ্যের উত্থান ঘটে। এ সময় মধ্যপ্রাচের জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ করেন জিসাস ক্রাইস্ট (ঈশা নবী) এবং খৃস্টধর্ম প্রচার শুরু হয়। একেশ্বরবাদের বাণী মানুষ প্রথম জানতে পারে। ন্যায় নীতি ও ধর্মের পথে আসার জন্য তিনি মানুষকে আহবান করেন। প্রায় সমসাময়িক কালেই ভারতবর্ষের উত্তর অঞ্চলে কপিলাবস্তু (বর্তমানে নেপালে) গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। তিনি মানুষকে জীবন, মৃত্যু, রোগ—শোক, জরা সুখদুঃখের বানী প্রচার করেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক। তিনিও মানুষকে ন্যায়ের পথে আহবান জানান ও পশুত্ব পরিহার করে মনুষত্ব বিকাশের বাণী প্রচার করেন।
১৪০০ বছর আগে আরবে ইসলামের উত্থান ঘটে। মক্কা নগরীতে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মানুষের জীবন ব্যাবস্থা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। তিনি এক আল্লাহর বন্দনা ও প্রার্থনার বাণী মানুষকে শোনান। মানুষে মানুষে সম—মর্যাদা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতিৃত্বের এক নতুন বারতা পেলো মানব জাতি। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও মন্দ কাজের জন্য শাস্তির কথা বললেন তিনি। মানুষ তাঁর বাণী গ্রহণ করে ও ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়। বিশ্বের চতুর্দিকে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়ে।
৫০০ বছর আগে ইউরোপ ও আমেরিকায়সহ বিভিন্ন দেশে উপনেবিশিক শক্তির উদ্ভব ঘটে। সমুদ্র পথের চলাচলের রাজত্ব চলে আসে তাদের হাতে। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে তারা উপনিবেশ গড়ে তোলে। সমসাময়িক কালে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা হয়। ৩০০ বছর আগে শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়। বিজ্ঞানের বিপ্লবের কারণে একে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি হতে থাকে। যে কাজ আগে মানুষ করত, সে কাজ করানো হতে থাকে যন্ত্রের সাহায্যে। যে কাজ মানুষের দ্বারা সম্ভব হতো না, সে কাজও করতে থাকে যন্ত্র। শিল্প বিপ্লবের ফলে নগর ও বাজার প্রসার হতে থাকে। সমান্তরালে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হতে থাকে।
আর বর্তমানে সমগ্র পৃথিবী জয় করে ফেলেছে মানুষ। পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্ত, সমুদ্রের গভীর তলদেশে, মহাকাশের সু—উচ্চ শিখরে মানুষের পদচারণা। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাঁচানোর মতো প্রতিষেধক, লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার মতো অস্ত্র মানুষের হাতের নাগালে।
বাবুল সিদ্দিক, প্রাবন্ধিক
নিউ ইয়র্ক প্রবাসী লেখক