ইলিয়াস বাবর :
: আসগর সাহেব! জোনে ছোট শাখা হিসেবে আমরাই সবচে বেশি জনের করোনা-ইনসেনটিভ পেয়েছি, এই খবর নিশ্চয়ই জানেন?
: জ্বি স্যার।
: কাল রাতে জোনাল অফিস মেল দিয়েছে।
: আচ্ছা স্যার।
: জোনাল অফিস বলেছে, কোনোভাবেই এক তৃতীয়াংশের বেশি লোকবল ইনসেনটিভের আওতায় যেন না আসে, হেডঅফিস খরচ কমানোর ব্যাপারে অতি তৎপর। বুঝতে পারছি না কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখবো। কীভাবে ব্রাঞ্চ সামলাবো!
: বাস্তবতা হচ্ছে স্যার, সীমিত আকারের ব্যাংকিং সেবা আছে পত্রিকায়। আগে যে লোড আমরা ছয়-সাত ঘন্টায় নিতাম তা এখন নিতে হচ্ছে দুই-আড়াই ঘণ্টায়। এত কম লোকবল দিয়ে এটা কঠিন হয়ে যায় স্যার। তবুও কিছু লোক, যারা ব্যাংকিং বোঝে না, ব্যাংকিংর বাস্তবতা বোঝে না তারাই ফেসবুকে অযথা কথা বলছে ব্যাংকারদের করোনা-ইনসেনটিভ নিয়ে! ঝুঁকি নিয়ে অর্থনীতির চাকা চালু রেখেছি, মানুষের জীবনমান সহজিকরণে ভূমিকা রেখে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত সেটা তারা দেখে না, দেখে ইনসেনটিভটা…
: আমরা সার্কুলার বা নির্দেশনার বাইরে যেতে পারি না আসগর সাহেব। আমিও চাই আমার সব জনশক্তি ইনসেনটিভ পাক। এবার যে আমাদের প্রায় স্টাফ পেল, তা নিয়েও কথা শুনতে হয়েছে। এখন লোক কমানো ছাড়া উপায় নেই। বাইরে থেকে, বিশেষ করে ফেসবুকে যে যাই বলুক ওসব কানে তুলতে নেই। পেশাদারিত্বের জায়গায় আমাদের হতে হবে নির্মম, একরোখা।
: এখানকার লোকজন এত অসচেতন আর খেয়ালি, কোনো কথাই শোনে না স্যার। দূরত্ব বজায় রাখতে আমাদের সিকিউরিটি গার্ডেরা প্রাণান্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ। মাস্কটা পর্যন্ত পরে না এরা।
: দিনশেষে এরাই আমাদের গ্রাহক, এরা না থাকলে কম্পিটিটিভ মার্কেটে আমরা টিকতে পারবো না। যাগগে, জোনাল অফিস আমাদের জন্য গ্লাভস, মাস্ক ও পিপিই পাঠাবে আজ। আমাদের সচেতন থাকতে হবে, সেবাও দিতে হবে। নিজেকে বাঁচতে হবে, গ্রাহককেও বাঁচাতে হবে।
: জ্বি স্যার। কালকের দৈনিকে পড়লাম এক ব্যাংকার মারা গেছেন করোনায়, বেশুমার আক্রান্ত হচ্ছে সারাদেশে। পিপিই আরো আগে দেয়া দরকার ছিল বৈকি।
: আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। বলুন তো, আপনার ডিপার্টমেন্টে কাকে কোন দিন রাখা যায়?
: আপনি যেটা ভালো মনে করেন তাই হবে স্যার।
: আচ্ছা, আপনি ডেস্কে যান। ম্যানেজার অপারেশন্সকে একটু আসতে বলবেন।
: জ্বি স্যার।
চেম্বার থেকে বের হতেই বুক টিপটিপ করছে আমার। আচানক ওঠানামা করছে মনঘড়ি। এসির কৃত্রিম ঠা-ার মাঝেও ঘেমে উঠি আমি। ম্যানেজার স্যারের চেম্বার থেকে আমার ডেস্কের দূরত্ব বিশ কদমের বেশি না। অন্য দিন হলে পা টিপে চেম্বার থেকে বেরুলেই নাগালে আসে আমার ডেস্ক। অফিসে অন্যদের তুলনায় খানিক বেশি উচ্চতা আমার। এ-নিয়ে কলিগদের মজা করার শেষ নেই। আসগর ভাইয়ের জিরাফের পা, ফ্লোর পেরুতে আমাদের তিন মিনিট লাগলে উনার লাগে এক মিনিটের কম! আমার হাসি পায় তাদের কথায়। ব্যাংকিং পেশার মতো চাপবহুল কাজে না হাসলে পেটে বায়ু জমে যায়। তাতে মেজাজ খিটখিটে হবার সম্ভাবনা থাকে। আজ আমার ডেস্কটাকে মনে হয় দূরদেশের হিমালয়। যার চূড়া ছুঁতে চায় আরোহীরা। বেঁচেবর্তে থেকে চূড়ায় পদচিহ্ন দিতে পারলে কেল্লা ফতে। মৃত্যুর ও প্রান্তে তখন হেসে ওঠে অজস্র সূর্য। পার্থিব-অপার্থিব যোগ্যতায় যোগ হতে থাকে সহস্র ডানা। কোনক্রমে চূড়ায় উঠতে ব্যর্থ হলে কিংবা তারও আগে প্রাণপাখি উড়ে গেলে বরফের খাবার হয় যতেœ গড়া দেহ। তা নিউজ হয় না, মাল্য পায় না। আজ চেম্বার থেকে ডেস্কে আসার সামান্য এই পথটুকু আমার কাছে চূড়া ছোঁয়ার আগের মুহূর্তের মতো লাগে। মনের ভেতর উঁকি দিতে থাকে হাজারো কু-পাখির ডাক!
ডেস্কে বসি বটে, মন আমার অচেনা সাগরের ঢেউ-এ ভেসে চলে যায় দূরের নগরে। ঢেউ এর সাথে ভেসে ওঠে বৌয়ের মুখ। গত মাসে করোনাকালে ডিউটির বাড়তি ইনসেনটিভটা তার হাতে তুলে দিতে সে কী হাসি! সামান্য ক’টা টাকায় তার মুখে নেমে আসে রাজ্যের প্রশান্তি। কতদিন ধরে সে বলে আসছে, গরমের রাতে বাবা ঘুমাতে পারেন না, ছটফট করেন বিছানায়। ঘরে একটা আইপিএস লাগালে ফ্যান চলবে সবসময়, কষ্ট হবে না আব্বার। অন্তত বাড়তি টাকাটা দিয়ে তা-ই করা যাবে এবার। নানা রোগে পর্যুদস্ত বাবা আমার অশীতিপরকালে পুত্রের বউকে মা-জ্ঞান করে ভুল করেননি। সালেহা, আমাকে তো রেখেছেই; পুরো সংসারকে গুছিয়ে রেখেছে পরম মমতায়। মা আমার গত হয়েছেন প্রায় এক যুগের অধিক, এই সময়ে সালেহার কোনো ব্যবহারে বাবা কষ্ট পেয়েছেন বলে মনে হয় না আমার। উল্টো বাবাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ খাঁড়া করেন তার আম্মা সালেহার দরবারে। বহুদিন ধরে কিনবো কিনবো করা আইপিএসটি কিনে হঠাৎ-পাওয়া টাকাটার সদ্ব্যবহার করতে চায় সালেহা। আইপিএসের পাওয়ার সাপ্লাই পুরো ঘরে সিলিং ফ্যানের হাওয়া লাগবে বটে তবুও বৌয়ের চোখে আব্বার প্রতি এমন দরদ আমাকে মিশিয়ে দেয় মাটির সাথে। লোকে কত কথা বলে বউ নিয়ে, এমনকি কোন কোন কলিগের মুখেও শুনি বউয়ের বদনাম; তখন সালেহার সৌম্য মুখটা ভেসে ওঠে আমার মনে, খানিক শান্তি দিয়ে যায় অলৌকিকভাবে। বাড়ি থেকে বের হবার আগে তার ধরিয়ে দেয়া মাস্ক, গ্লাভস আর হ্যান্ড সেনিটাইজারের ছোট্ট বোতলটা দেখি বারেবারে। করোনাকালে তাবৎ ঝুঁকি নিয়ে অফিস করাও অনেকটা সহজ ব্যাপার হয়ে গেল আমার কাছে, সালেহার সৌজন্যে। মনে পড়ে, সালেহাকে প্রথম দেখতে
গিয়েছিলাম আব্বা, আম্মা, জেঠিমা, আমি আর এক বড়ভাই। নাস্তার টেবিলে পাশাপাশি বসেছি আমরা। নতমুখে বসে আছে সালেহা। নাস্তা শেষে, বড় ভাইয়ের ইশারায়, নাম জিজ্ঞেস করি সালেহার। নাম জানা আছে, এর বাইরে প্রশ্ন করার সাহস নেই বলেই হালকা হবার চেষ্টা। বেচারি আরো লাজুক, যেন লজ্জ্বাবতী লতা! নরম আর নিচুস্বরে তার নাম বলে সে। কথার পিঠে কথা জোড়া লাগানোর অভ্যেস তার নেই, বুঝলাম। জেঠিমার কেন জানি মনে হলো, মেয়ে বোবা! বাড়ি এসে জেঠিমা বলেন, মাথার চুল হাওয়ায় পাকেনি, ও মেয়ে কথা বলতে পারে না, জবান আটকে যায়। সব ঠিক কিন্তু যায় না মনের খচখচানি। পাশের বাড়ির একজন খবর নিয়ে জানায়, মেয়ে কথা বলতে পারে ভালোই, নেই কোন জন্মগত সমস্যা। কথা বলতে জানা বোবা মেয়েটি জড়িয়ে গেলো জীবনের সাথে! অগত্যা মাওলা সাহেবকে বলি ম্যানেজার স্যারের কথা। রোস্টার হলে আমার ডিপার্টমেন্টের পাঁচজনের মধ্যে দুইজন কী তিনজন রাখতে পারে প্রতিদিন। কাজের চাপ আগেকার স্বাভাবিক দিনের মতো হোক তবুও লোকবল রাখতে হবে এক তৃতীয়াংশ বা একটু বেশি। পুরো ইনসেনটিভের বদলে পাবো সামান্য কিছু অর্থ– যা সংসারের অন্য কাজে লাগানো দূরে থাক পকেট-খরচের বেশি না! আমার ভাগ্যটাই এমন চাকরিজীবনের অর্ধেকের বেশি সময় গত হলো ইনচার্জ হিসেবে। বাকিদের সামলাতে গিয়ে নিজে কবে বেদখল হয়ে গেছি তার হদিস নেই। অভিজ্ঞতা বলে, মাওলা সাহেব যে কেনো ডিপার্টমেন্টের জন্য সম্পদ। মাথা ভালো, কাজ বোঝে, নিজ থেকে কাজ করে দেয়। মালেক সাহেব আর হাক্কানি সাহেবের কাজ গড়পড়তা। ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে দেড় বছর পার করা সোয়েবুর রহমান কাজ শিখছে, মনোযোগ আছে। কার উপর কাঁচি চালাবো, কাকে নিষেধ করবো সেই ভাবনায় ডুব দেয়ার আগেই মাওলা সাহেব বলে বসেন, স্যার! করোনা পরিস্থিতি যখন শুরু হলো, কে কে ছুটি ভোগ করছে মনে আছে আপনার? এখন ইনসেনটিভের কথা যখন আসছে, যখন পকেট ভরার কথা আসলো, বলছে রোস্টারিং বাধ্যতামূলক করতে হবে! তখন বাড়িতে দৌঁড় দিয়েছিলেন সেকেন্ড স্যার আর ইনভেস্টমেন্ট ইনচার্জ, পরে ম্যানেজার স্যার। এখন ইনসেনটিভের বাড়তি গুড়ের আশায় ম্যানেজার স্যার, সেকেন্ড স্যার, ইনভেস্টমেন্ট ইনচার্জ কাজ না থাকলেও বসে থাকেন অফিসে। তাদের ক্ষেত্রে রোস্টারিং পরিপালন নেই? আপনার খেয়াল আছে স্যার! অফিস বন্ধের দিন, এজেন্ট সাপোর্টের জন্য জুনিয়র দুজন আসলেও বড় দুই স্যার অফিসে অবস্থান করেছেন, কেন? স্যারদের মুখে এসব রোস্টারিঙের কথা মানায়! মাওলা সাহেবের ক্ষোভ অমূলক নয়। করোনার ভয়ে সবাই যখন বাড়িতে বসে দিন গুনছিল স্ববেতনে, স্থানীয় বলে প্রথম কোপটা আসে আমার ওপর। ক্যাশের অনেকেই নানা অজুহাতে বাসায়, আমার ডিপার্টমেন্টের সোয়েবকে বসতে হয়েছিল ক্যাশে। শুক্র কী শনিবারের বন্ধেও আমাকে আসতে হয়েছিল ব্রাঞ্চে, কখনো বা লোড দিতে হয়েছিল এটিএমে। এখন বড়রা একযোগে অফিস করবেন, কাঁচি পড়বে তুলনামূলক জুনিয়রদের ডিউটিতে। ভীষম খাই মনে মনে, টাকার চেয়ে শক্তিশালী জীবাণু পৃথিবীতে দুটো নেই!
সালেহার সাথে বসে গত রাতেই হিসেব করেছি, নতুন মাসের করোনা-ইনসেনটিভটা পেলে সদ্যবিবাহিতা ছোটবোনের শ্বশুড়বাড়িতে জামাকাপড় উপহার পাঠাবো। ছোটবোন সেদিন তার ভাবিকে ফোনে হিসেব দিয়েছে, চৌদ্দজনকে ঈদের নতুন জামা দিতে হবে। ঈদ-বাজারের গরমাগরম অবস্থা, তার উপর প্রায় শপিংমল বন্ধ হওয়াতে অনলাইনেই ভরসা। সালেহা সেইমতো প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার যে বেতন অন্যান্য সুযোগসহ, তাতে এসব আতকা পাওয়া ইনসেনটিভের ধার ধারতে হয় না। ওই যে, আমার বাবার একটা বড় স্বপ্ন, তার ছেলের শহরের অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট থাকবে, তার নাতি-নাতনীরা ওখানে থেকে পড়াশোনা করে জজ-ব্যারিষ্টার হবে, সেটা পূরণ করতে গিয়ে আমার বেতনের অর্ধেকের বেশি কাটা পড়ে হাউসলোনের বিপরীতে। শিরদাঁড়া উচু করে চলার মতোন বেতন হোল্ড করেও তাই খুঁড়িয়ে চলতে হয়। অবশ্য ফ্ল্যাটের কাজ শেষের দিকে। যৌথ-উদ্যোগে কিছু সময় ফাউ নষ্ট না হয়ে যায় না একেবারে! কালো দৈত্যটা হঠাৎ পৃথিবীতে নেমে না এলে ফ্ল্যাট রেডি হয়ে ভাড়া গুণতাম এতোদিনে। অসুবিধা আমাকে দিয়ে হিসেব করিয়ে নেয়, কখন আরেকটা ইনসেনটিভ পাবো, কখন বোনাস যোগ হবে, কবে আসছে ইনক্রিমেন্ট লাগার সময়। ডেস্কে বসে সালেহার কথা ভাবি। বেচারির ছিল স্কুল মাস্টারি, সন্তানদের পড়াশোনায় ক্ষতি হবে ভেবে তাও ছেড়ে দিয়েছে বড় সন্তানের বয়স চার বছর থাকতে। বড়-ছোট দুই সন্তানই এখন স্কুলের ভালো রেজাল্টধারী ছাত্র। সন্তানদের কী লাগবে, বাবার কী লাগবে, বোনদের কখন কী দিতে হবে সামাজিক রীতি-চর্চায়, সবই সালেহার নিখুঁত গার্হস্থ্য-বুদ্ধিতে হয়ে যায় ঝামেলাহীন। আমার, বলতে গেলে ব্যাংকারদের সংসারই এমন, সে ঘরে থেকেও নেই, কেবল অর্থসংস্থান করে দায় সেরে দিতে হয়। আগের দিনে ছিল আরো ভয়ানক কান্ড, ম্যানুয়েল লেজার লেখতে লেখতে জীবন শেষ; মাস ক্লোজিং-এর রাত অর্ধেক পার হয়ে যেত অফিসকে ছুটি দিতে। লোকে বলতো, ড্রাগ অ্যাডিক্টেড আর ব্যাংকারদের পাওয়া যাবে রাতের রাস্তায়। ছুটি মেলে না, কখনোবা শুক্র কি শনিবারও চলে যায় অফিসের কাজে। মেহমান আসবে কাঁচা-বাজার লাগবে, দাওয়াত আছে উপহার নিতে হবে– এসব সালেহা কিভাবে ম্যানেজ করে আমার ভাবলেও ক্লান্তি আসে। জুয়েল অবশ্য সাহায্য করে তার ভাবিকে। এক জীবনে সালেহার কথায় আব্বার নিষেধেও কম পয়সা ঢালিনি ছোটভাই জুয়েলের পেছনে। পড়াশোনা তার ভালো লাগে না, ব্যবসা করবে। আমি পুঁজি দিতে পারলে সে ক্ষুদ্র ব্যবসাকে করে তুলবে বড়সড় আকারের। বছর দুয়েক পরে আমার দেয়া পুঁজি সাবাড়, ব্যবসা লাটে উঠেছে জুয়েলের। নিষেধ অমান্যতার কল্যাণে বাবার ঝামটার সাথে কয়েক বছর সময় লেগে যায় ব্যাংকের দেনা শোধ দিতে। তখনো সালেহা নীরব, পক্ষ নেয় জুয়েলের।
মন বসে না আমার অফিসের কাজে। করোনায় মানুষের মনে তালা পড়লেও পেটের দরোজা অহির্নিশ উন্মুক্ত থেকে হয়রান করে যায় মানুষকে– তার দেখা পাই প্রতিদিনই, ব্যাংকে জনস্রোত দেখে। লোকে সঞ্চয় ভেঙে খায়, রেমিটেন্স তুলে খায়। আজ এক মহিলাকে রাগে বলেই বসি, বাচ্চা নিয়ে কেন ব্যাংকে আসেন? বোঝেন না দেশের অবস্থা? টাকা তুলে তারা শপিং করে, চাল-ডাল কেনে, ওষুধ-পথ্য কেনে, জামা-জুতো কেনে। পেটের বাচ্চার সাথে হয়তো বাসায় নিয়ে যায় অদৃশ্য জীবাণুরেখা। বারবার হ্যান্ড স্যানিটাইজারে হাত ভেজাই, কীবোর্ড-মাউস ছুঁয়ে দেই জীবাণুনাশক তরলে, অস্বস্থিবোধ করি পিপিইর ভেতর নিজেকে গুজে দিয়েও। কী-এক আচানক মুদ্রাদোষে, করোনাকালেই বারবার হাত যেতে চায় চোখ-নাকের বারান্দায়! চেম্বারে ডাক পড়লে, ভাবনায় ছেদ পড়ে আমার। স্যার আমার হাতে ধরিয়ে দেন সদ্য নোট করা অফিস অর্ডার। তাতে স্পষ্ট দেখি, সপ্তাহে দুদিন ডিউটি আমার। মনকে প্রবোধ দেই, ভালোই হলো তবে, বাইরে এসে রিস্ক নিতে হবে না। ঘরে থাকবো, পরিবারকে সময় দেবো। আমার দুই ছেলে বাড়ি ফিরতেই যখন আব্বু বলে জড়িয়ে ধরতে আসতো আমার দিকে এড়িয়ে যেতাম কায়দা করে। এখন তা করতে হবে না, বাবা-পুত্রে খেলবো, জড়িয়ে ধরতে পারবো সংকোচহীন। বড় তিন স্যার যথারীতি প্রতিদিন অফিস করবেন, জুনিয়রদের যে দুজন স্যারের খুব প্রিয়ভাজন তারাও ডিউটি করবে প্রতিদিন। কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে যাই চেম্বার থেকে, টাইপ করতে হবে আমাকেই! টাইপ করতে করতে প্রতিদিন বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে আসা রিকশায়লা রশিদ মিয়ার কথা মনে পড়ে আমার। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই অসময়ে রিকশা চালাতে ভয় করে না তোমার? এক গাল হেসে সে বলেছিল, করোনারে ভয় করি না, ভয় লাগে বাড়িতে রাখা পেটগুলারে! পেটে হাত বুলাই, নিজেকে লোভী মনে হয় আমার। ঝাপসাচোখে দেখি, স্যার, রিকশায়লা, আমি এমনকি অসুস্থ পৃথিবীর প্রায় মানুষই ঘুরছি একটা বৃত্তকে কেন্দ্র করে!
ইলিয়াস বাবর, গল্পকার