মঈন ফারুক :
প্রথম যেদিন কথা বলি, ২০১৯ সাল, চন্দ্রবিন্দুর জন্য একটা লেখা চাওয়া নিয়ে। বলেছিলেন, তরুণরা সচেতন না হলে, পরম্পরার নামে আরোপিত আদর্শবোধ পথভ্রষ্টতা শিখিয়ে যাবে। কথাটা অনেকটা এরকম, হুবহু মনে নেই। লেখাটা হাংরি আন্দোলন নিয়ে ছিল না। ছিল লেখকদের জীবনযাপন ও আত্মহত্যা নিয়ে। এরপর, মাঝে মাঝে কথা হতো, নিজেও খবর নিতেন প্রায় সময়। করোনার সময়টাতে কথাবার্তা হয়নি।
হঠাৎ করে, ২০২২ সালে, মেসেজ পাঠিয়ে মেইল আইডি চাইলেন। মেইলে পেলাম হাংরি আন্দোলন নিয়ে পা-ুলিপি। প্রাপ্তির খবর জানালে, বললেন, প্রয়োজনীয় মনে হলে করতে পারো। আমি খুশি হওয়ার অনুভূতি জানালাম এবং বইটি প্রকাশ করলাম। গত সেপ্টেম্বরে তাঁর সর্বশেষ উপন্যাসও প্রকাশিত হয় আমার প্রতিষ্ঠান চন্দ্রবিন্দু থেকে। উপন্যাসের নাম ‘ঘেরাটোপ’। এটা প্রকাশের পর ২৬টি উপন্যাসের পা-ুলিপি পাঠালেন, আলাদা আলাদা ফাইলে। পাঠিয়ে বললেন, উপন্যাসগুলো পাঠিয়ে রাখলাম, তোমার সময় মতো সমগ্র প্রকাশ করতে পারো। জবাবে বলেছিলাম, এ মেলায় প্রথম খ- আনবো দাদা। বললেন, ঠিক আছে।
যথারীতি, এ কাজটি দ্রুত শেষ হলো। প্রচ্ছদ ও বিন্যাসের কাজ শেষ। উৎসর্গটা বাকি ছিল। ভেবেছি, সময় আছে, প্রিন্টে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে নেয়া যাবে। কিন্তু, আর সুযোগ থাকলো না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি, তিনি নেই। ফলে সিদ্ধান্ত নিলাম, উপন্যাস সমগ্র তাঁকেই উৎসর্গ করবো।
এই যে, তাঁর সাথে আমার যোাগযোগ ও কথাবার্তা বিস্ময়কর লাগতো। রাখঢাক না রেখে যে প্রশ্নগুলো তাঁকে যৎতৎ করে বসতাম, সেগুলো কিনা, যে অতি অল্প সময়ে আমার চিন্তাকে গুরুত্ব দিলেন এবং বই প্রকাশের জন্য নির্ভর করলেন, জানি না।
২.
মলয় রায়চৌধুরীর দুটি সত্তা, দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা ও কথাসাহিত্যে মলয়, এবং সাহিত্যের সর্বশেষ বিপ্লবী ও আন্দোলনের পুরোধা মলয়। বিপ্লবী মলয়কে মার্চপাস্ট করে তোপধ্বনির মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে সেলুট করতে ইচ্ছা হয়। আমাদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে; আস্থাকে পুঁজি করে শোষকের প্রসাদ তো আমরা চাই না। বরং সত্য বলো, সত্য স্বীকার করো। মোড়কে সাজানো প্রতারণার পরম্পরা কেন মেনে নেব? এই মলয়, এই মলয় রায়চৌধুরীকে পড়া-জানা-বোঝা এবং চিন্তার ঐক্য সংবেদনশীল সম্পর্কে উন্নীত হয়, আমার।
তিনি ক্ষুব্ধ হতেন প্রকাশ্যে। বলতেন, আত্মবিশ্বাসের সাথে। দুর্বল চিত্ত কবির হতে পারে নাÑ একথায় তিনি ধ্যানস্থ। শোষকের পলিশ দেয়াল ভেঙে চিন্তার মুক্তির কথা বলেছেন কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে-নিবন্ধে। প্রতিটি সাক্ষাৎকারে সেগুলোরই দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ ছিল।
সাহিত্যবাজ ও তাত্ত্বিক দর্শনিক সাহিত্যিকদের মধ্যে পার্থক্যটা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বারবার। ভাষা চিনিয়েছেন আমাদের। গোখরোর ফণায় চমক থাকবে, এটা বিষের তাজাল্লি, ভুলে থাকলে চলবে নাÑ তার ভাষায় তাকে জবাব দেয়ার চিন্তা যে-সময় কেন এ-সময়ও কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে বলতে হয়েছেÑসাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা”।
কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী থেমে যাননি, শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছেন। প্রতিষ্ঠানের পোয়াতিদের বিরুদ্ধে সে লড়াই তার মৃত্যুও থামায়নি। যে ম্যানুফেস্টু দিয়ে শুরু হয়েছিল হাংরি আন্দোলন, তার প্রত্যেক লেখা, সরব আছে সেই চেতনাকে ধারণ করে। তিনি এখন, তাকে জানা, তার সম্পর্কে ভুল জানা এবং ভুল ব্যাখ্যার নৈরাজ্যের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন।
বিপ্লবী মলয় প্রতিরোধের মুখে যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন, তার জন্য তাজ্য হয়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন, তবু থামেননি। বরং আরো তীব্র হয়েছিল সে প্রতিবাদ। শেষ পর্যন্ত তা যেখানে গিয়ে ঠেকেছিল তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মাইলফলক। এমন ফলক স্থাপনের সাধ্য আর কারো হবে, এমনটা অসম্ভব। সুতরাং তিনিই শেষ বিপ্লবী কবি।
৩.
যে কবিতা দিয়ে চক্ষুশূল হয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, বা মহান মানি তাঁকে বা অপছন্দ করি, সে কবিতাটি বেশিরভাগ পড়েনি, কেবল শুনে শুনে হায়-হায় করেছেন। তার কবিতার, এবং গদ্য লেখায় ভাষাগত বৈচিত্র্য বা চমৎকারিত্ব খুব একটা নেই। যা আছে তা শব্দ ও বাস্তব প্রেক্ষিতকে ঘিরে। এটাই হয়ত তিনি চেয়েছিলেন। এখানে কারণ ব্যাখ্যা করতে যাবো না, পরিধিগত কারণে। এটা ঠিক, ভাষার ব্যাপারটার চেয়ে নৈরাজ্যমূলক প্রতীকি চিন্তা প্রাধান্য পেয়েছে উপন্যাসে।
প্রবন্ধ-সাক্ষাৎকারে যে তাত্ত্বিক আলাপ ছিল, উপন্যাস-গল্পে ফিকশনিকভাবে সে কথাও হাংরি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়েই বিশেষায়িত। চরিত্রগুলোও একই রকম রেখেছেন। মানে, যদুর নাম যদু, মধুর নাম মধু। এক্ষেত্রে ভয়-সংকোচ কোনোটাই করেননি।
কবিতায় মেটাফোরিক হাংরি আন্দোলন, গল্প-উপন্যাসে তার ফিকশনিক ভার্সন, প্রবন্ধে তাত্ত্বিক আলোচনা-পর্যালোচনা। তার লেখার সবটুকু জুড়ে শুধু ক্ষুধার্তদের কথা। হাংরি আন্দোলন আর হাংরি আন্দোলন। উদগাতা হিসেবে তাঁর সৃষ্ট চিন্তা থেকে একেবারেই সরেননি। ক্রমাগত বলেছেন, বলেই গেছেন।
৪.
মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে, বলেছিলাম, দাদা কথা ছিল। বললেন, অপেক্ষা করো, ফোন দিচ্ছি। তখন আমার পাশে বসে কাজ করছিলেন শিল্পী উত্তম সেন। কিছুক্ষণ পরেই ফোন বেজে উঠল। সেই শেষ তার চেহারা দেখা। উত্তম সেনের সাথেও কথা বলেছিলেন সেদিন।
বললাম, চট্টগ্রাম আসেন বেড়াতে। বললেন, তোমাদের আড্ডা দেখে ইচ্ছে হয়, কিন্তু সম্ভব না। বাসা থেকেও নামতে পারি
না। বাসার সামনে একটা দোকান আছে, কিছু লাগলে দোকানদার এসে দিয়ে যায়। একেবারে অচল। ঘরের ভেতর যতটুকু নড়াচড়া। এই ছিল শেষ কথা। শেষ স্মৃতি। তার আর কোনো মেসেজ আসবে না, আমার কাছে। আর কোনো কথাও হবে না। ২৬ অক্টোবরের পর থেকে আমরা পরস্পর স্মৃতি-বিচ্যুত।
মঈন ফারুক
কবি, সম্পাদক ও প্রকাশক