স্বপ্নের কথা
আমিনুল ইসলাম
স্বপ্ন দেখাবো না, এ নিয়তে রাত না বাড়তেই ঘুমিয়ে পড়ি রোজ।
তবে তার আগে চান্দিতে একরতি জবাকুসুম লাগাই,
রেগুলেটার ঘুরিয়ে গতি বাড়াই ফ্যানের,
পিতামহীর দেওয়া স্বপ্নহীন মাদুলিটা
মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে সুরা ফালাক্Ñনাস পড়ে ফুঁ দিই।
দু’চোখ আঁধার করে চোরা-আসক্তির মতন ঘুম এলে
প্রশান্ত অনস্তিত্বে তলিয়ে যাই আমি অনুভবহীন অতলে ।
হঠাৎ বামদিক হতে এক ফেরিওয়ালা কপালে মোহন চুমু দিয়ে
আমাকে জাগায়, শব্দের ফুলঝুরি ছড়িয়ে বলে:
‘স্বপ্নছাড়া বাঁচবে কী করে ভাই? আমার কাছে স্বপ্ন আছে!
লাল স্বপ্ন,
নীল স্বপ্ন,
লম্বা স্বপ্ন,
খাটো স্বপ্ন,
এবং পাঁচমিশালী স্বপ্ন।
স্বপ্ন দিয়েই ঢাকা আমাদের অতীত,
স্বপ্ন দিয়ে ভরা আমাদের বর্তমান,
স্বপ্ন নিয়েই যাবো আমরা ভবিষ্যতে।
তুমি হয়তো জানো না, তোমার সে পূর্বপুরুষেরা
ভূুরি ভুরি স্বপ্ন দেখতেন,
আর প্রত্যেক সকালে খোয়াবনামা ঘেঁটে
গফুর মারফতীর কাছে ব্যাখ্যা শুনতেন হা করে;
আর তাজ্জব তুমি সেই বংশের ছেলে হয়ে কাটাতে চাও স্বপ্নহীন রাত?’
আমি বলি: ‘শূন্য গোলা, শূন্য গোয়ালও Ñ
আকাশের নিচে অগণিত মাথা;
স্বপ্ন দিয়ে তো ক্ষুধাতুরের পেট ভরে না একবেলাও!’
ফেরিওয়ালার বিরক্ত স্বর: ‘আহা! বোঝো না কেন-
স্বপ্নটাই মানুষের জীবন!
রুটি-মাংস-ডালভাত এইসব আদতে ইতর-চাহিদা;
জেনে রাখোÑ একমুঠো স্বপ্ন বহুগুণে মূল্যবান
একগুদাম মোটা চালের চেয়ে;
আমাদের গরুমার্কা স্বপ্নগুলো কালোত্তীর্ণ
আর এ কৃষিপ্রধান দেশে কার্যকরী ষোলআনা;
অতএব নিজে নাও, বাড়তি দামে অন্যদেরও দাও, বেশি বেশি;
ঠকবে নাকো মোটেই।’
দ্বিমত পোষণে আমি: ‘ক্ষুধার অন্ন আর বস্ত্রহীনের বস্ত্র ছাড়া
আমরা চাই না অন্যকিছু;
আমাদের এ-জীবন তো আমাদেরই,
স্বপ্নহীন যায় যদি আমাদের রাত কিংবা দিন,
তাতে কী ক্ষতি অন্যের ?
আর জোর করে স্বপ্ন দেবে, গণতান্ত্রিক দেশে এটা কেমন কথা ভাই?’
অগ্নিশর্মা ফেরিওয়ালা পিস্তল বের করে গর্জে ওঠে:
‘আমাদের স্বপ্ন নিয়ে হেলাফেলা?
আমাদের পূর্বপুরুষের অসম্মান?
যদি স্বপ্নহীন বাঁচার সখ এতই,
তবে যাও শালা একেবারে স্বপ্নহীন দেশে!’
রুদ্ধ আর্তনাদে টুটে যায় আমার ঘুম; তৎক্ষণাৎ বুক চেপে উঠে বসি
ঘামভেজা বিশৃংখল চাদর; বালিশটার দিকে হাত বাড়াতেও ভয় পাই।
————————————
যে ঢেউ ভাঙেনি পাহাড়
ফকির ইলিয়াস
শক্ত ভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছি। নরম ঘাসের
ভবিষ্যৎ দেখে,বলে দিতে পারছি সবুজের কররেখা-
আর বিগত প্লাবনে ভাসমান সর্বশেষ নারীর মুখ
দেখে বলে দিতে পারছি তার অশ্রুর অতীত।
বলে দিতে পারছি,অধীন আষাঢ়ের রাতে কতটি
পাখি গৃহহারা হবে।কতজন মানুষ তাদের দোচালা
ঘরের ছায়া থেকে হবে বঞ্চিত! কিংবা কতজন
প্রেমিক তাদের প্রেমিকার নাম ভুলে গিয়ে,অন্য
কোনো নারীর নামে বাতাসে মিশাবে ফরমালিন।
বিষাক্ত বাষ্পের আলো বুকে নিয়ে আগামীকাল
এই পৃথিবীতে জন্ম নেবে কতজন শিশু!
গণক নই- তবুও বলে দিতে পারছি নিশ্চুপ
ঈগলের মতো ট্যাক্সাস বিমান ছাউনিতে বিগত
শীতে,বরফে ঢাকা পড়েছিল যে ক’টি যুদ্ধবিমান
সেগুলো উড়ে যাবে কোথায়!
কোন মানুষগুলোকে হত্যা করার পর কিছু সৈনিক
উল্লাস করতে করতে বলবে- এরাই শত্রুপক্ষ!
আমি জোটনিরপেক্ষ প্রথা অনেক আগেই
অস্বীকার করেছি। আমার স্বৈরহাতে একদিন
তুলে নিয়েছিলাম যে কলম- তাকে বলেছি;
পক্ষাবলম্বন করাই শক্তির ধর্ম, আর যুদ্ধই
ভাগ্যের নিয়ামক।
যে ঢেউ ভাঙেনি পাহাড়, যে স্রোত আমাকে
আগলে রেখে দেখিয়েছে পথ-
তাদের উত্থান স্পর্শ করেছি বিনীত বিভায়।
তারপর আকাশকে বলেছি,
আরেকটু কাছে এসো- এতো নীলের গভীরতা
পৃথিবীর দুঃখবোধ ঢেকে দিতে পারছে না কেন!
================================
অশান্ত নদী
আনন্দমোহন রক্ষিত
শান্ত হও, অশান্ত নদী
তোমার তীরে ভয়ার্ত মানুষ
জীবন ঝুঁকিতে শংকিত
তোমার নিষ্ঠুর ঢেউয়ে
ভাঙছে পাড়, ভাঙছে মানুষের হৃদয়
এই মানুষগুলোর বেদনার ক্ষত
শুকায়না কখনও।
এই একটি জায়গায় আমরা
সবসময় অসহায়, সর্বস্ব হারাতে হারাতে
ভিটে বদল করতে করতে
পরিজনের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়।
সারারাত নির্ঘুমে কাটে মানুষগুলোর
মৃত্যু আতঙ্ক বুকে নিয়ে, বিষণœ বিদুর
মন। এ অমাবশ্যা কালের দ্রুত অবসান চায়।
=============================
সময়
আকতার হোসাইন
আমাকে যে পথ দেখিয়েছে, আমি তার
পথে চলি না। উল্টো চলাতেই আনন্দ
আমার। যেদিক থেকে ঝড় ধেয়ে আসে,
আমি ঠিক সেদিকেই বুক পেতে দিই,
পালাতে গেলেই মনে হয় মুখ থুবড়ে পড়বো।
অপারেশন টেবিলে দেহাবশ করার
বিশেষজ্ঞ দেখে তাকে আমার দেবদূত
মনে হয়। ঘুম আনার দেবতা। আমাদের
চিরঘুম কেন এরকম নির্বিঘ্ন হয় না।
কেন আমাদের পাঁজরের ভেতর বিষের
থলে, কেন আমাদের লুকানো নখে
মিশরীয় রাজকুমারীর দু’ ধারি ছুরি, কেন
আমাদের হাসিতে আবরাহা রাজার দম্ভ,
যখন আমরা স্বচক্ষেই দেখি শিয়রে
যমদূত ময়ূরপালকের চামরে সান্ত¡নার হাওয়া দিচ্ছে!
আমি কি সেই মধুর সময় পেরিয়ে
আসিনি, যখন মায়ের স্তনে মুখ রেখে
ভাবার অবকাশ ছিল না, কোথা ‘ থেকে এ
দুগ্ধনহর বয়ে চলেছে আমার জন্য, আর
পিতার বুকে মাথা রেখে ঘুমুতে গিয়ে
ভাবতে পারিনি, এ কোন মহান
ফেরেশতার মোলায়েম বুকে মাথা পেতে
রেখেছি আমি অনাদিকাল!
সময় আমাকে ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে
মোহনার দিকে ধেয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র
ডাকছে ইশারায়, যখন জলের অন্তিম
রেখায় হৃদয়ের সমস্ত আবির ঢেলে দিয়ে
পা-ুর সূর্য প্রশান্তির আনন্দে হেলে পড়ছে।
=========================
বারুদগন্ধী মানচিত্র
আশীষ সেন
কাছে এসো, সম্মুখে দাঁড়াও, বসে আছি
ফণীমনসার ঝোপে
ডুব দিয়ে মুখ ঢেকে, বুদবুদ ভাসে জলের রেখায়,
দূরে দাঁড়িয়ে কচি শিশুটির মতন কলাপাতা দুলছে।
যাবো কি যাবো না বুক পুড়ে যায়, পুড়ে যায়
ছোঁব কি ছোঁব না দিন চলে যায়, চলে যায়।
আমরা পতাকা পুঁতেছি দ-ে, যাবো কোথায়?
এই সেই বুকের ভেতর বারুদগন্ধী মানচিত্র
অঘ্রাত অঘ্রাণে হাজার বছরের সুর-তান-লয়
আমাকেই শুধু কানে কানে বলে বুকে টেনে নিয়ে,
থেকে যাও, কেড়ে নাও আগুন ফোটাও
শ্রাবণে চৈত্রে বারমাসে।
=========================
বঁধুয়া
হাবিব আহসান
অরন্ধনে রাঁধবো তোমায়
কালের রাধিকা-
আমলকি পাতা চুয়ে
ঝরছে শিশির
জল ধরে রাখি
চীনামাটি পাত্রে
কনকনে উত্তুরে হাওয়া
অম্লজান ভরে রাখি
কাচের বোতলে।
আগুন কোথায় পাবো?
আগুনে পোড়াবো না তোমায়
মাঝ গগনের
সূর্য থেকে চুরি করে আনা
গনগনে রোদে রাঁধবো বঁধুয়া।
চলবে জীবনভর
রন্ধনের ইতি নাই
একূল ওকূল দুইকূলে ভাসি
কুলবধূ কূল নাই।
===========================
খোঁজাখুঁজি
খালেদ সরফুদ্দীন
ভ-গুলোর মিথ্যা কথায়
কাকে কে আর জেতাবে,
বিশ্রীকথার বাকুম বাকুম
পাই না খুঁজে কেতাবে।
সত্যকথা বলবে কখন
পাই না খুঁজে তারে,
কোন্ সে নেতা আসবে উঠে
খুঁজবে মানুষ কারে!
আমরা এখন চাইয়া দেখি
তেলেসমাতির সাজ,
ডানে বামে ঊড়ছে দেখো
কথার কারুকাজ।
কর্মসভায় ফালদি ওঠে
পাই না খুঁজে জবাব,
শেখ মুজিবের বাংলাদেশে
‘অ ভাই’ মানবতার অভাব।
===========================
কালোত্তীর্ণ পুরুষ
মুস্তফা হাবীব
নেতা সে-ই, যে শিক্ষকের শিক্ষক, মহামনস্বী
যার আঙুলের ইশারায় আকাশের ধূসর মেঘ
জল হয়ে নেমে ভেজায় তৃষিত মাটি।
যার দুরদর্শী ভাবনায় থাকে
মানুষের জীবন বদলে দেয়ার অনির্বাণ কৌশল,
সমূহ উন্নয়নে থাকে কুমির তাড়ানোর মন্ত্রসুধা ।
যুগে যুগে কোনো দেশেই এমন
মেধাবী ক্ষণজন্মার জন্ম হয় না
হয়তো শতাব্দীতে দু’ একজন আসে পৃথিবী রাঙাতে
কালের কার্নিশ ছেড়ে প্রবেশ করে মহাকালে।
শেরেবাংলার কথা বলছি,
চৌকস বুদ্ধিমত্তার ধারক ছিলেন বলেই
শিক্ষার বৃক্ষ রোপিত হয়েছিল নদীমাতৃক এই দেশে
বন্ধকী জমি ফিরিয়ে দিয়েছিল ঋণগ্রস্ত নিরন্নজনকে ।
এখন রাক্ষসের করালগ্রাস থেকে মানুষ বাঁচাতে
শেরেবাংলার মতো একজন মানুষ প্রয়োজন।
যিনি বালাম নাজিরশাইল চালের ভাত একা খাবে না
গড়ে তুলবে না টেমস নদীর তীরে হিরার চন্দ্রবিতান।
===========================
রসায়ন
হুমায়রা খানম
সবকিছু এমন;
এমন করেই বদলে গেল খুব সহজে,
জটিল হৃদয় ভেঙে দিল ¯েœহ-মায়ার সহজ যাপন
কিংবা প্রচুর ভালোবাসার বিচিত্র সব রসায়ন।
এখন জ্বলে; জ্বলেই জ্বলে
বুকের ভেতর অষ্টপ্রহর নিরেট পাথর,
সবকিছু আজ ভেঙেচুরে যাচ্ছে, যাক
বিট্রে করে আপন মানুষ; নষ্ট কিছু ভাইরাস
শেকল পরে বন্দিঘরে গুমড়ে কাঁদে প্রিয়জনের বিশ্বাস।
আসলে সব মিথ্যে মায়া, মিথ্যে হিংসে খেলা
মিথ্যে কায়া, মিথ্যে ওসব ছোট্টবেলার জোলাপাতি খেলা
খেলার জন্যই বাঁচা, বেঁচে থেকে কী আর করা
কষ্টগুলো আঁতকে উঠে মধ্যরাতে ধুঁকতে থাকা,
মৃত্যু নাগাদ – আমার এমন বেঁচেই থাকা।
সবকিছু এমন;
এমন করেই বদলে গেল খুব সহজে,
জটিল হৃদয় ভেঙে দিল ¯েœহ-মায়ার সহজ যাপন
কিংবা প্রচুর ভালোবাসার বিচিত্র সব রসায়ন।
==========================
এখনো কি হৃদয়ে বাজে?
জাফর আলম
উচ্ছল কথক নৃত্যের উন্মুখ জলছবি,
ছুঁয়ে যায় দীপান্তরে যৌবনের প্রভাতফেরি,
আশাহত ভোরের গানে, তানপুরায় ভৈরবী,
হররোজ, অভিসারিকার অনিচ্ছাকৃত দেরি।
ঘরে ফিরে, ত্রাহি মধুসূদন,আত্ম সংস্থানে,
সুধাকর, নিবেদিত পূজারি বিহ্বল !
রজনী শেষে,মৃত জোছনায়, রেশ রয়ে যায় গানে,
সম্প্রীতিতে প্রেমিকপ্রবর, হরিণা চঞ্চল !
ষোড়শী কুন্তলা, নটোবর নটরাজে,
লাজুক আভাময়ী বিচ্ছুরণ,
কেমন আছো হে সখি ? এখনো কি হৃদয়ে বাজে ?
কারো উপস্থিতি? আনে গায়ে শিহরণ ?
…….না, আমি তো আর ওখানে নেই,
করেছি তাহার যবনিকাপাত প্রভাতফেরিতেই !
=========================
অপ্রকাশিত
মাইনুর নাহার
অজস্র পঙক্তি হারাতে হারাতে
মনে পড়ে সেইসব প্রতিশ্রুতি
ভুলে গিয়েছিলাম যা।
কথা হয়েছিল হয়ত-
দেখা হবে অথবা হবে আলাপন দূর-আলাপনিতে, সময় মিলবে যখন
অপেক্ষার পাললিক শীলা সাক্ষ্য দেয়
হারিয়ে যাওয়া সময়ের,
আবেগ জমতে জমতে প্রস্তর খ- যেন
কুয়াশা জমেছে চাঁদের গায়।
কক্ষপথ বিচ্যুত কঙ্করের মতো
কী করে বিলোবে সমান আলো?
জানি, অপেক্ষার নিষ্ফল আক্রোশে প্রেমময় গাঢ় চুম্বন
বিষণœ সুরে ঘোষণা করে মানবিক পরাজয়।