আলমগীর মোহাম্মদ
মাহমুদুল হকের জন্ম বারাসাতে। দেশভাগের সময় সরকারি চাকুরেদের জন্য অপশন ছিল পাকিস্তান না ভারত বেছে নেয়ার। মাহমুদুল হকের বাবা পাকিস্তান বেছে নিয়েছিলেন। তবে তাঁর মা রাজি হননি সহজে। দেশে ঘর উঠানো শুরু ক‘রে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর বাবার জোরাজুরিতে অবশেষে দেশভাগের তিন বছর পর তাঁরা চলে আসতে বাধ্য হন কারণ বাবা পাকিস্তানে থাকায় স্থানীয়দের সাম্প্রদায়িকতার শিকার হতে হয়েছিল মাহমুদুল হকের পরিবারকে। মা‘র প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল মাহমুদুল হকের। এক সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, ‘মা চলে যাওয়ায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।‘ তাঁর মা‘র নাকি ইচ্ছে ছিল মাহমুদুল হক তাঁকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। উপন্যাস লেখা না হলেও অনুর পাঠশালার অনুকে মায়ের খুব কাছাকাছি রেখেছেন লেখক। অস্তিত্বের সংকট, এলিনিয়েশন, প্রেম হতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া মাহমুদুল হকের উপন্যাসের নিয়মিত থিম।
মাহমুদুল হকের নাম খুব বেশি উচ্চারিত হতে দেখা যায় না আমাদের চারপাশে। আগাগোড়া আধুনিক এই লেখকের লেখা পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন ভদ্রলোক অসম্ভব পড়ালেখা করতেন এবং দর্শন বিষয়ে তাঁর পড়ালেখা ছিল অন্য পর্যায়ের। তাঁর লেখায় মার্ক্স, মার্ক নিৎসে অনায়াসে ঘুরে বেড়ান গল্পের ভেতর। ইতিহাস, স্মৃতি ও গল্প এই তিনের সমাবেশ তাঁর লেখালেখিতে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘অশরীরী‘ বাংলা সাহিত্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বাদ দিলে বাকিটা টিপিক্যাল মাহমুদুল হক প্লট। মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী আচরণ, ফ্রয়েডিয় ‘রিটার্ন অব দ্য রিপ্রেসড‘, যৌতুকের করাল গ্রাসে বলি নারীজীবন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত কর্মকা–ের বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এই উপন্যাসের মূল চরিত্র আম্বিয়া। পেশায় সাংবাদিক। তাঁর স্ত্রী তাহেরার সাথে অবনিবনা তুঙ্গে পৌঁছালে দুজনের সংসারে ছেদ ঘটে। পুপু তাঁদের একমাত্র সন্তান। সংসার ভাঙার মূল কারণ তাহেরার মানসিক বৈকল্য যা সে সহজে স্বীকার করতে চায় না। তাহেরা বড় হয় মামার বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে। দুই মামা দিলগণি আর মালগণির সম্পদের পরিমাণ অনেক। মেসবাড়িও আছে একটা। মেস বাড়িতে থাকতো আম্বিয়া। একটা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার দায়িত্বে কাজ করতেন তিনি। পেশায় সাংবাদিক হলেও এলাকায় তাঁকে সবাই চিনতো ম্যানেজার হিসেবে। ম্যানেজার মানে মেসের ম্যানেজার। ছাত্র মাত্রই মেসের সাথে পরিচিত।
মেস বাড়ির মালিকের ভাগ্নি তাহেরার বয়স একটু বেশি হওয়ায় মামারা তাকে ঘরে শিক্ষক রেখে পড়ালেখা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। আম্বিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয় শিক্ষক হিসেবে। চাকরিজীবী অথচ আয় কম এমন অনেকেই ট্যুশন করেন অফিস ফেরত হয়ে।
তো, তাহেরা মামির অত্যাচারে বড় হতে থাকে। পড়ালেখাও মোটামুটি ভালো চলছিল। হঠাৎ একদিন আম্বিয়ার ট্যুশন বন্ধ হয়ে যায়। ভেতর থেকে মামির চড়াগলা শুনে তিনি আঁচ করতে পারেন তাহেরার কিছু একটা হয়েছে।
তাহেরা তার মামির ভাই মোস্তাফিজের কাম লালসার শিকার হয় একদিন। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে মামি উঠে পড়ে লেগে যান দায়টা অন্য কারো ওপর চাপাতে। আম্বিয়াকে টার্গেট করলেও সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে তাহেরা একদিন পালিয়ে আম্বিয়ার ম্যাসে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সবকিছু জেনেশুনে আম্বিয়া আচম্বিত সিদ্ধান্ত নেন তাহেরাকে বিয়ে করার; পিতৃত্বের দায় নিয়ে বিয়ের পর তাহেরা মামার বাড়িতে থাকে। বাচ্চা হওয়ার পর কিছুটা বড় হলে বাচ্চাটাকে কোনো একটা রেল স্টেশনে ফেলে চলে আসে তাহেরা। তারপর আম্বিয়ার সাথে ঘর সংসার শুরু। আম্বিয়ার বোন আঞ্জুম শ্বশুর বাড়িতে অত্যাচারিত হয়ে ভাইয়ের বাসায় উঠলে তাহেরা শুরুর দিকে খুব যতœখাতির করতো। কিন্তু শেষতক তার দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে আম্বিয়া বাধ্য হয়ে বোনকে শ্বশুর বাড়ি রেখে আসেন। যৌতুকের জন্য আঞ্জুমের স্বামী তাকে নিয়মিত অত্যাচার করতো এবং খুন করার হুমকি দিতো। অত্যাচারের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌছালে আঞ্জুম আত্মহত্যা করেছিল। স্ত্রীর জেদের কাছে অসহায় আম্বিয়া সেদিন কিছুই করতে পারেনি বোনের জন্য।
এদিকে তাহেরা আম্বিয়াকে নানা কারণে সন্দেহ করতে থাকে। ঘরের কাজে সহযোগিতার জন্য তাঁর খালাতো বোনকে বাসায় নিয়ে এসেছিল আম্বিয়া। ফুটফুটে এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় তাহেরা। ছেলের নাম রাখেন পুপু। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে সংসার জীবন উপভোগ করতে শুরু করেন আম্বিয়া।
কিন্তু তাহেরার সন্দেহবাতিক আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন আম্বিয়া। খালাতো বোনটাকে বের ক‘রে দিতে বাধ্য হন তিনি। শেষতক এমন ঘটলো তাহেরা আম্বিয়াকে ত্যাগ করে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠল। পুপুকেও নিয়ে গেল সাথে।
নিঃস্ব আম্বিয়ার ঠাঁই হয় সেই পুরনো মেসে। ইতোমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পত্রিকা অফিস বন্ধ হয়ে যায়। মেসে তাঁর খাটের তলায় গ্রেনেড পায় পাক বাহিনী।
তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে রাখে দিগম্বর ক‘রে। রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে অত্যাচারের মাত্রা দিনদিন বেড়ে যায়। শেষের দিকে গণকবর খোঁড়ার কাজে তাঁকে নিয়ে যায়। আহত, ক্লান্ত, পরিত্যক্ত আম্বিয়া দু‘হাত জোর করে ব‘লে উঠেন, ‘আমাকে গুলি ক‘রে মারুন-‘
একাত্তরের মার্চ–এপ্রিলে পাক বাহিনী দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার পরিচয় পাওয়া যায় এই বইয়ে। একসময় মামা বাড়িতে আশ্রিতা এতিম তাহেরার কপালে সংসার জুটে আম্বিয়ার সহানুভূতিশীল ব্যক্তিত্বের সুবাদে। সেই তাহেরা আম্বিয়ার আপন বোনকে সহ্য করতে পারে না সংসারে, বের ক‘রে দিয়ে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। সংবেদনশীল ও সহজ ব্যক্তিত্বের আম্বিয়া বঞ্চিত হয় তাঁর স্বাভাবিক জীবন থেকে। মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী চরিত্রের কাছে ব‘লি হয় তাঁর স্বাভাবিক জীবন।
আলমগীর মোহাম্মদ, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক