প্রদীপ খাস্তগীর
লেখক এবং মূলত সাংবাদিক মুস্তফা নঈমের মিষ্টিমধুর শৈশব, কৈশোর ও দূরন্ত যৌবনকাল মাড়িয়ে তার বেড়ে ওঠার রোদেলা সকালের মতই এক চিলতে উঠোন ‘স্মৃতি বিস্মৃতির কানুনগোপাড়া’—গ্রন্থটি পাঠককে অবশ্যই নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত করবে; যেমনটি আমাকেও করেছে। গ্রন্থটি কোনো আত্মজীবনী বা সম্পূর্ণ স্মৃতিচারণ নয়। নয় এ কারণেই,এতে মুস্তফা নঈম নিজের ফেলে আসা নিকট অতীতের ছবি এঁকেছেন, অনেক স্থির চিত্রকে সচল করেছেন, চেনা মুখগুলোকে তুলে এনেছেন, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের খুঁজেছেন, একটি আটপৌড়ে জনপদ ঐতিহ্যসমৃদ্ধ গ্রামের সমাজ-সংস্কৃতিকে যতকিঞ্চিৎ মেলে ধরেছেন। বিস্মৃিতর মাটি খুঁড়ে স্মৃতিকেই মুস্তফা নঈম জীবন্ত করেছেন সাবলীল শব্দকথায়। একারণেই প্রত্যেক পাঠক-ই নিজের ফেলে আসা দিন-রাত, সকাল-বিকেলে আবার ফিরে যাবেন; যেনবা সাদা-কালো বায়োস্কোপ দেখছেন।
মুস্তফা নঈমের শৈশব-কৈশোর-যৌবনের জীবনকথায় যে সকল সঙ্গী-সাথী শিক্ষক, গায়ক, শিল্পী, খেলোয়াড়সহ যেসব নানা চরিত্রের মানুষজন ওঠে এসেছেন নাম-ধাম ভিন্ন হলেও এই চরিত্রগুলোকে গ্রাম সমাজে জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রত্যেক পাঠক-ই খুঁজে পাবেন। গ্রন্থটি পড়তে পড়তেই পাঠক যে অতীতটা ফেলে এসেছেন সেটা বর্তমান হয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়েছে। গ্রন্থটি সম্পর্কে পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় বলা যায়, লেখক মুস্তফা নঈম
স্মৃতি ও সত্তার উজ্বল উদ্ধার করেছেন নির্মেদ ভাষায় নির্মাণ করেছেন অনুপম একটি সমাজচিত্র।
কানুনগোপাড়া— এই জনপদটির আর্থ-সামাজিক ভৌগলিক চিত্র ব্যাপকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য ১৯১ পৃষ্ঠায় মলাটবন্দী বইটি কোন গবেষণালব্ধ দলিল নয়। এজন্য মুস্তফা নঈমের চেষ্টা ও প্রয়াস ছিলো না। লেখকের জন্মভিটা কানুনগোপাড়া নয়— সীতাকুন্ডের নানাবাড়িতে, পৈত্রিক ভিটা চন্দনাইশে। তবে শিক্ষক পিতা অধ্যক্ষ সোলায়মান স্যার অশুতোষ কলেজে শিক্ষকতা করার সুবাদে লেখক নঈম নিজাম কানুনগোপাড়া থেকেই বেড়ে উঠেছেন এবং এই জনপদটিই তার চৈতন্যের দীপশিখা। মুস্তফা নঈম লিখেছেন, ‘আমার বেড়ে ওঠার প্রিয় প্রাঙ্গন কানুনগোপাড়া এবং বোয়ালখালী নিয়ে যে স্মৃতির গল্পকথা সাজানোর চেষ্টা করেছি তাতে অনিবার্যভাবেই ইতিহাস নির্ভর কিছু ঘটনা, ব্যক্তি ওঠে এসেছে।’ তাই অগ্নিযুগের বিপ্লবী স্ফুলিঙ্গ মাস্টারদা সূর্যসেন ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের রাখাল রাজা শেখ মুজিবের (তখনও তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় সিক্ত নন) এই জনপদে বিচরণ ও উপস্থিতির কথাও এই গ্রন্থে উঠে এসেছে। এভাবেই তিনি গ্রন্থে ইতিহাসের ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন এবং ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তির উজ্জ্বলতার সন্ধান দিয়েছেন। পাঠক নিশ্চয় অবাক হবেন, দেশ বিভাগের যাতনার প্রচ্ছন্ন ব্যথা ও যন্ত্রণার সুরটিও কীভাবে লেখকের কিশোর মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। গ্রন্থটির একটি পর্বে লেখক লিখেছেন— ‘একবার সীতাকুন্ড বেড়াতে গিয়ে অনেকদিন ছিলাম। কানুনগোপাড়া এসে দেখি নাগ জেটুরা নেই। ভেবেছিলাম হয়তো স্বপ্না দিদিরা আমাদের মতো তাঁদের নানার বাড়ি বেড়াতে গেছে। কিন্তু সময় গড়িয়ে যায় স্বপ্না দিদিরা আর আসেনা। অনেকদিন পরে জানলাম স্বপ্না দিদিরা আর আসবেন না। ওনারা ইন্ডিয়া চলে গেছেন। তখন ইন্ডিয়া যাওয়ার বিষয়টি এত বুঝতাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপের সবচেয়ে বড় কারণ জেটিমার তৈরী সন্দেশ, খৈয়ের নাড়ু, ছানার পেড়া এসব আর খেতে পারবোনা ভেবে। এখনও নাগ জেঠুর সৌমৗ কান্তি চেহারা, স্বপ্নাদিদির মায়াবী মুখ চোখের সামনে ভাসে…।’ ভাবা যায় কত ব্যথাতুর সেদিনকার বালক মুস্তফা নঈমের ভায়োলিনের তারের বেদনা বিধুর করুণ সুর।
গ্রন্থটির মুক্তিযুদ্ধ পর্বে লেখক তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন বারুদগন্দী হীরকখণ্ড তুলে এনেছেন। নঈম মুস্তফা লিখেছেন—‘কালুরঘাটের প্রতিরোধ যুুদ্ধের আওয়াজ আমরা পাচ্ছি প্রতিদিন। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে সকালের সূর্য ওঠেছে সন্ধ্যায়। রাতের আঁধার ছিন্ন করে মাঝেমধ্যে অস্ত্রবোঝাই পাকিস্তানী সামরিক জাহাজ বাবর ও সোয়াত থেকে আকাশ আলোকিত করা ‘ফাস বোমা’ ছোরা হচ্ছে, ছোড়া হচ্ছে বিকট শব্দের রকেট লাঞ্চার—এই প্রথম ‘ফাস বোমা’ ও ‘রকেট লাঞ্চার’এর নাম জানলাম…’। গ্রন্থটির এই পর্বে আরেক জায়গায় লেখক লিখেছেন— মার্চের ২৬ তারিখ সকালের পর বেশ কয়েকটি ট্রাক এসে দাঁড়ালো শ্যাম রায়ের হাট হরি মন্দিরের মাঠে। খবর পেলাম অনেক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসেছে শ্যাম রায়ের মাঠে। আমরা ছুটে গিয়েছিলাম বেঙ্গল রেজিমেন্ট দেখতে। এই প্রথম অস্ত্রসহ মিলিটারি দেখা। শ্যাম রায়ের হাটে বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে মেজর জিয়া নামে এক অফিসারের নাম শুনেছিলাম, আজকের পাঠক ঐ সময়ে নবীন
কিশোর ছিলেন। লেখকের বর্ণনায় পাঠকের বুকে মুক্তিযুদ্ধের রণ দামামার কাঁপন না ধরলে বুঝতে হবে তিনি এক নির্বোধ কঠিন পাথর।
এই গ্রন্থের মিষ্টি স্মৃতিতে বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি নায়িকা কবরীর কথাও আছে। তার পৈত্রিক বাড়ি কানুনগোপাড়ার আশে-পাশে। মুস্তফা নঈম লিখেছন— এই পরীক্ষা কেন্দ্রে একবার চিত্রনায়িকা কবরী মেট্রিক পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। সময়টা ১৯৬৬ সাল। পরীক্ষা একটা কি দুটো দিয়েছিলেন। বিষয়টি কিভাবে জানাজানি হয়ে যায়। মানুষের সে কি ঢল, কবরীকে এক নজর দেখার জন্য। কবীরকে সামানাসামনি দেখা হয়নি কখনো। কিন্তু যে বোনের অসুস্থতার সুযোগে অনুষ্ঠানে নাচতে এসে মিনাপাল কবরী হয়েছেন সেই লক্ষ্মী দিদি আমাদের সঙ্গে ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েছিলেন।’
অনেক পদের ঝাল-টক-মিষ্টি ও বারুদগন্ধী টুকরো টুকরো স্মৃতিতর্পণে গ্রন্থটিকে সুখপাঠ্য ও উপভোগ করে তুলেছেন লেখক। এই গ্রন্থের মূল্যবান দালিলিক উপস্থাপনা হলো বিখ্যাত দত্ত পরিবার পর্ব। এই দত্ত পরিবারের কীর্তি ও সুষমা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব ছড়িয়েছে। এই পর্বটির কারণেই অনেক পাঠকই এই গ্রন্থটি সংগ্রহের তালিকায় এগিয়ে রাখবেন।
আগেই বলেছি গ্রন্থটি লেখক ও সাংবাদিক মুস্তফা নঈমের আত্মজীবনী ও স্মৃতিচারণমূলক লেখালেখি নয়— স্মৃতি ও সত্তার উজ্জল উদ্ধার; যা আমি করতে পারিনি তা পরমাত্মীয় মুস্তফা নঈম করতে পেরেছেন। তাঁকে অভিবাদন।
প্রদীপ খাস্তগীর, কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক