বিমল গুহ : মুস্তফা হাবীব ১৯৬৫ সালের পহেলা জানুয়ারি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলাধীন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন : কবিতা পার্ক, শরিকল মডেল স্কুল রোড, গৌরনদী,বরিশাল। সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : স্বপ্নের মুখোমুখি জীবন ( কাব্য), একটু দাঁড়াও সুমিত্রা,’ (কাব্য), নিসর্গ রমণী (কাব্য), একমুঠো স্বর্ণকমল (কাব্য), নন্দিতার সেই চিঠি (কাব্য), যে ঠোঁটে বসন্তের সৌরভ (কাব্য), মন পবনের নৌকো (যৌথ কাব্য), আমি সেই কিংবদন্তি (কাব্য ), নীলমণিদের ঘুড়ি ( কিশোর কাব্য ), ডিজিটাল এই দেশে (ছড়াগ্রন্থ), রূপম দেখবে আকাশ (কিশোরকাব্য ) ময়ূর নীলিমা (গল্পগ্রন্থ ), বিধ্বস্ত বালিয়াড়ি ( নাটক)। এইসব জলের নূপুর ‘ (উপন্যাস )। সম্পাদনা কাব্যসংকলন : ক. আবহমানকালের একশ শ্রেষ্ঠ কবিতা, খ .শান্তি ও সুন্দরের জন্য কবিতা। গ . একশো শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। কবিতায় অসামান্য অবদানের জন্য কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পুরস্কার, মাদার তেরেসা সম্মাননা, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, কবি জীবনানন্দ স্মৃতিপদক, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সম্মাননা, বিদ্যাপীঠ সাহিত্য সম্মাননা, বিজয় দিবস সম্মাননা ও কবি সুফিয়া কামাল পুরস্কার লাভ করেন। আসল নাম : মো. সিরাজুল ইসলাম। শিক্ষা : বি.কম (অনার্স), এম.কম, হিসাব বিজ্ঞান, পেশা: শিক্ষকতা। সম্পাদক: কবিতার ছোট কাগজ ত্রৈমাসিক ‘অরুণিম’।
মানুষ চিন্তা করতে ভালোবাসে, নিজের অনুভবকে অন্যের কাছে জানান দিতে ভালোবাসে। এটা মানুষের প্রকৃতি। ষড়ঋতুর আবর্তনে বাংলাদেশে এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরাজমান, সেখানে অনেকেই কবি বা শিল্পী হবেন- তাই স্বাভাবিক। কথার কথা হলেও এর পেছনের নানান যুক্তি দাঁড় করানো কঠিন হবে না। আমাদের নদীর মাঝি, মাঠের কৃষক, গরুর রাখাল কিংবা কঠিন-কাজের শ্রমিক- সবার মুখে নানা ছড়া/কবিতা শোনা যায়, স্বরচিত গানের সুর শোনা যায়; এর প্রমাণের জন্য তা যথেষ্ট। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে নতুন বাংলাদেশে প্রাণের উচ্ছ্বাস এতবেশি ছিলো যে, তখন সারাদেশে প্রায় হাজার কবির আবির্ভাব হয়েছিলো, কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছিলো বেশির ভাগ কবির। সে অর্থে বাংলাদেশ কবিতারই দেশ।
প্রকৃত কবি সমাজ ও সভ্যতার রূপকার। আলোচ্য কবি মুস্তফা হাবীবের কবিতা পড়ে আমার এই প্রতীতি জন্মেছে যে, আমাদের কবিতা সময়কে যথার্থভাবে ধারণ করতে সক্ষম। মুস্তফা হাবীব লেখেন সুদূর বরিশালে থেকে। তাঁর কবিতা আত্মগত চেতনার রূপায়ণ। শব্দের অন্তর্গত মহিমাকে ইঙ্গিতে প্রকাশের কাজ করেন তিনি। কবিতা পড়ে তাঁর সেই ইঙ্গিতকেঅনুভব করেছি। ‘আমি সেই কিংবদন্তি’ কাব্যগ্রন্থে কবি বলছেন- ‘যখন পৃথিবীর সৌন্দর্য জলে সাঁতার দিয়ে/ চিনেছি নির্মেঘ আকাশ ও জীবনের রূপরেখা,/ চিনেছি আমি স্বাধীন জন্মভূমি বাংলাদেশ,/ সেদিন থেকেই আমি পথ হাঁটি/ চন্দ্র সূর্য তারাদের সমান্তরাল।’ এই চেতনা দেশাত্মবোধের। কবিতার প্রথম স্তবকে পাঠককে জানান দেয় তা কবির স্বতঃপ্রণোদিত বোধ। জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রুতিবহ শব্দগুচ্ছ। এই অনুভব প্রকৃত মানবসত্তার, সে অর্থে একজন প্রকৃত কবির।
কবি ‘ মানচিত্র ‘ শিরোনামের কবিতার প্রথম স্তবকে বলেছেন – অঢেল ভূ-সম্পত্তির মালিক নই আমি / তবু কখনো কালো টাকার উৎস খুঁজে / কখনো ঝরাইনি মেধার ঘাম, তবু সুখে আছি ;/
সুখে আছে আমার সমচিন্তার আত্মীয়স্বজন। এ কবিতাটি শেষ স্তবকে — আমার সুচারু স্বপ্নের পথে যারা বাধ সাধবে /
তারা পথের নিরেট পাথর, কালের জঞ্জাল,/
আমাকে এসব কৃত্রিম শৃঙ্খলে বন্দি করো না, /
আমার সাধ সাধ্যের ভেতরে থেকে /
যত পারি রেখে যাব দর্শনীয় সৃষ্টির সৌধ। কবির এ স্বগোক্তি কবিকে সত্যের পথে হাঁটতে সাহস যোগায়। কবির আরো একটি কবিতা ‘ জীবনসিঁড়ি ‘। এ কবিতাটির শেষ স্তবকে লিখেছেন — এই ধরিত্রীর মোহমায়া মননে রেখে / স্রষ্টার গুণগানে, ধ্যানে খেয়ালে, চেতনায় স্মরণে / বহুরূপী জীবনের সিঁড়িতে এখন আমার চরণযুগল /। কবি ‘দেশকাল ‘ কবিতার শেষ দুটি চরণ এ রকম —- এই মাটি হোক সর্বাধিক স্বচ্ছ মানুষের দুগ্ধ খামার / এই মাটি হোক সহস্র রূপমের স্বাধীন স্বপ্নের মাটি।
জীবন তো থেমে থাকে না। কবিকে এর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। যেতে হয় ক্রমাগত সামনের দিকে সত্যনির্মাণের পথে, শাশ্বত বোধের কাছে, জাগ্রত মানবসত্তার কাছে। কবির এই বোধ আমরা অনুভব করি ‘অচেনা সুর’ কবিতায়।
এই অচেনা সুরও বোদ্ধাপাঠকের কাছে অচেনা থাকে না। কারণ, প্রকৃত বোদ্ধাপাঠকের বোধও কবির অনুভবের সমীপবর্তী। বলা হয় কবিতা তো সর্বাংশে অনুভবেরই শিল্প। একটি স্তবকে কবি বলছেন- ‘কিছু চারা রোপণ করেছি নিজ হাতে/ জৈবসার দিয়ে এঁটেল মাটিকে দিয়েছি অনন্য শক্তি/ ওরা অনুকূল পরিবেশ পেয়ে লাফিয়ে উঠছে।’ এই চারা চেতনার বীজ, মানবিক সৌকর্যের জ্ঞানবীজ; যেখান থেকে আত্মশক্তিতে জেগে উঠবে ভরন্ত নতুন পৃথিবী।
কবিরা হন দূরদর্শী, মানবমুখী এবং একই সঙ্গে জীবনমুখী। সকল হীনতার ঊর্ধ্বে তাঁর আসন, অমোঘ সত্যের কাছে। মুস্তফা হাবীবের কণ্ঠে যখন ‘সক্রেটিস এবং আমি’ কবিতায় শুনি- ‘তাই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষগুলোকে/ বারবার অন্ধ বিচারের মুখোমুখী হতে হয়।/ যেমনটা হয়েছিলো সক্রেটিসের যুগে,/ সক্রেটিস হাতে তুলে নেয় হেমলকের পেয়ালা।’ তখন সচকিত হতে হয় পাঠককে। পৃথিবীর গতি নিরন্তর ধাবমান। ধাবমান বিশ্বেও দূরগামী মানুষ স্বপ্নের অন্তিমে জয়ী হয়; হেমলকের তুচ্ছ স্বাদও তাঁকে সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।
এই সত্যবোধ যাঁর কবিতায় পাই সেই কবি মুস্তফা হাবীবকে সাধুবাদ জানাই, তাঁর কবিতা পাঠের অমিয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠি। তাঁর কবিতা সুপথের সন্ধান দেবে সত্যনিষ্ঠ পাঠককে আগামীতে।
বিমল গুহ, কবি ও প্রাবন্ধিক