এখন সময়:রাত ৯:২৫- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৯:২৫- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : মানুষের মানচিত্রের কবি

আ.ম.ম. মামুন
সত্তরের দশক বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে যুগপৎ সম্ভাবনা ও হতাশার দশক। জাতীয় জীবনে সংগঠিত নানা ঘটনা, দুর্ঘটনা, হতাশা, নৈরাজ্য আর রাজনৈতিক অস্থিরতা গ্রাস করেছে কাব্যাঙ্গনকেও। এমনই এক অরাজক সময়ে নিজেকে ‘শব্দ শ্রমিক’ ঘোষণা দিয়ে কাব্যমঞ্চে আবির্ভূত হন রুদ্ধ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১) সত্তর দশকের সবচেয়ে আলোচিত প্রতিভাবান কবি। শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যশা পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে কাব্যচর্চায় ব্রতী হন রুদ্র। আধুনিক জীবনের সাথে লোকজ জীবন ও দেশজ প্রকৃতি রুদ্রের কবিতার প্রধান উপজীব্য। সূচনা পর্বেই তিনি বিষয় নির্বাচন, প্রকার প্রকরণ, শব্দ বিন্যাস এবং বাক্-প্রতীমা নির্মাণের প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্যে নিজের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করেন। রুদ্রের কবিতা তাঁর বিশ্বাসের ধারক ও বাহক। তিনভাগ জলের ওপর একভাগ মানবিক মাটিই তাঁর নিজস্ব ভুবন।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র নিরন্তর কাব্যচর্চায় ও কাব্যগ্রন্থের শিরোণাম নির্বাচনের মধ্যে আমরা এক ধারাবাহিক মানবেতিহাসের সন্ধান পাই। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রæত উপকূল’ (১৯৭৯) এ ‘শব্দ শ্রমিক’ রুদ্র (আমি কবি নই-শব্দ শ্রমিক/শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়) নগর সভ্যতার বিনাশ দেখে বিষন্নবোধ করেছেন। যে উপকূলবাসী তার শ্রম দিয়ে, উত্তাল সমুদ্রে সলিল সমাধি কবুল করে সভ্যতার বৈতরণী ভাসান, নাগরিকের রসদ যোগান, শ্রমলব্ধ সবটুকু তুলে দেন সভ্যতার সোনারতরীতে, বুকে ক্ষয়কাশ নিয়ে গুণটেনে জীবন জীবিকার উপাদান সমর্পন করেন নাগরিক মহাজনের হাতে, সেই মানুষগুলো বিরূপ প্রকৃতির ভয়াল জলোচ্ছ¡াসে, সভ্যতার যান্ত্রিক অভিঘাতে বিপন্ন বিধ্বস্ত। এই জলবন্দী অনিকেত মানুষগুলোকে উদ্ধারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন রুদ্র একা, নির্ভীক। সন্ধান করেন এমন সাহসী পুরুষ, যিনি অর্জুনশক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবেন নিচ্ছিদ্র অমাবশ্যায়, উজান¯্রােতে। জ্বালাবে পূর্ণিমা-প্রদীপ। গড়ে তুলবে স্বর্ণগ্রাম।
রুদ্রের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ (১৯৮১) ‘আমাদের ইতিহাস, জাতিসত্ত¡া আর প্রেরণাময় ঐতিহ্যের প্রতীক। স্বর্ণগ্রাম বাঙালির আত্মার নাম, রক্তের নাম।’ (সুবিনয় রেজা, গ্রন্থ-আলোচনা, সিম্পনী, জুন ১৯৮১) এখানে রুদ্র এমন গ্রাম ফিরে পাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, যে গ্রামের মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে নয়, বর্ণবৈষম্য চিনে না, যে মানুষ অরণ্য সাগরের ভাষা বোঝে। সেই স্বর্ণগ্রামে বর্গির আক্রমণ নেই, যান্ত্রিক অভিঘাত নেই, আছে গোয়ালে গরু, গোলায় ধান, পুকুরে মাছ, আছে রোগ ব্যাধিতে শল্য চিকিৎসা, জ্যোৎ¯œায় উৎসবÑযে গ্রামে সমানে চলে ফসল ও হৃদয়ের চাষাবাদ। কিন্তু সেই স্বর্ণগ্রাম আজ লুপ্ত।
নগরীরর রুখো গ্রাম থেকে সেই গ্রামখানি মোর
দুধভাত, মিঠে, রূপশালি ধান, সেই গ্রামখানি
কেড়ে নিতে চাই, কেড়ে নিতে চাই, কেড়ে নিতে চাই। (কাঁচের গেলাশে উপচানো মদ)

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে প্রগতির সড়ক ধরে মানুষ আমূল বদলে যেতে থাকলো। দূরকে নিকটে আনলো দূরবীণ বানিয়ে, ক্ষুদ্রকে তীব্র স্পষ্ট করে তুললো অনুবীক্ষণে, নিরীক্ষাকে নিখুঁত করতে বানালো কম্পিউটারর। আসলে যন্ত্রকে আত্মস্থ করে মানুষ যন্ত্রনাকেই বাড়িয়ে দিলো। মানুষ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো নিজের থেকে, মানুষ ও নির্মল আলো থেকে। একটি নতুন কম্পিউটার ও নির্মাণ পুর্ববর্তী আবিষ্কারকে কেবল বাতিলই করলো না, মানুষকেও বন্দী করলো নতুন নতুন খাঁচায়। সংঘবদ্ধ মানুষ হয়ে পড়লো একা এবং নি:সঙ্গ। তার কবিতার ভাষায়Ñ ‘জন্মেই জড়ায়ে গেছি মানুষের সচতুর জালে ও খাঁচায়। (মানুষের মানচিত্রÑ১)। এই জড়িয়ে পড়া, আটকে যাওয়া যে কতোটা জটিল, কী ভয়ংকর ও নির্মম তা তিনি উপলব্ধি করেছেন তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষের মানচিত্রে’ (১৯৮৪)। গ্রন্থের স্বীকারোক্তিতে রুদ্র বলছেনÑ
‘মানুষের মানচিত্রে সেই অন্ধকার জীবনের সামান্য কিছু ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্ষুধার অন্ধকার, বস্ত্রহীনতার অঙ্গীকার, চিকিৎসাহীনতার অন্ধকার, শিক্ষাহীনতার অন্ধকার আর শোষণের অন্ধকার। যে বিশাল জনগোষ্ঠীÑধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতায় তাদের বড়ো একটা দেখা যায়নি।
মানুষের মানচিত্রে প্রধানত ভাঙাচোড়া মানুষদের উপস্থিত করতে চেষ্টা করেছি।’
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর স্বর্ণগ্রামে এমনসব মানুষের মানচিত্র আঁকতে চায়, যাঁরা সুলতানের ছবির পুরুষের মতো স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচÐ পৌরষদীপ্ত। নারীরা শ্যামল প্রকৃতির মতো সরল, শ্রমবতী ল²ীমন্ত লাবণ্যময়ী। সেখানে ‘মাতৃস্তন হবে শিশুর শহর’। যে মানচিত্রে মানুষ আবার সংঘবদ্ধভাবে বর্ষা ও বসন্ত উদযাপন করবে নির্বিঘেœ। গতিমান জীবনের গান গাইবে প্রতিনিয়ত। যেখানে যন্ত্রের অভিঘাত থাকেব না। ‘মৌলিক মুখোশ’ পরিহিত মানুষ ছোবল মারবে না। এমনই এক সাম্যের, সম্পদের, আনন্দের পৃথিবীতে ‘মানুষের মানচিত্র’ অঙ্কন করার স্বপ্ন রুদ্রকে আমৃত্যু তাড়িত করেছে। কাতর ও জেদী করেছে। রুদ্র সেই জীবনস্বপ্নের ‘বেভুল বাউল’।
আধুনিক বাংলা কবিতাকে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ঢেলে সাজাবার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। কবিতাকে নবতর প্রতিষ্ঠা প্রসারের অঙ্গীকার নিয়ে কাব্য মাঠে নেমেছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। প্রচলিত অভিজাত ভাষার ক্রিয়াপদ অক্ষুণœ রেখে লোকজ শব্দের মিশেলের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করেছেন বাংলা ভাষার প্রাণশক্তি। এ প্রসঙ্গে আমরা পঞ্চাশ দশকের দুজন কবিÑসৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) ও আল মাহমুদ ( ১৯৩৬-২০১৯) এর নাম স্মরণে নিতে পারি। উভয়ের কবিতায় গ্রামবাংলার লোকজ উপকরণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরাণের গহীন ভেতর’ (১৯৮০) সনেটগুচ্ছ লোক বাংলার ঐতিহ্যচেতনায় সমৃদ্ধ। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের লোক ভাষা ও বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ নরনারীর চিরন্তন প্রেম প্রকাশে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
তোমার খামছির দাগ এখনো কি টকটকা লাল
এখনো জ্বলন তার চোৎকার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান। (পগভি-৬)

অপর দিকে আল মাহমুদ লোকজ নন্দিত কবি। তার কবি মানস জন জীবনের গভীরে প্রোথিত। তাঁর ট্রেডমার্ক কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিনে লোকজ শব্দের ব্যবহার করেছেন প্রধানত স্মৃতিকাতর, নর-নারীর দৈহিক কামনা-বাসনা, কামচেতনা কখনো লোকজ প্রকৃতির অনুষঙ্গ আর কিঞ্চিৎ সাম্যবাদের আবেগতাড়নায়।
দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূল্যধন
বিবসন হও যদি নারী দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না। (সো কা-১)

তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন কর যৌবন জরদ। (সো কা-১০)

আমরা লক্ষ্য করেছি উপর্যুক্ত উভয় কবির কবিতায় সমাজ জীবনের উত্তাপ ও আলোড়ন সেখানে অনুপস্থিত। সংঘবদ্ধ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়নি। কিন্তু এখানেই রুদ্র ব্যতিক্রম। এইসব নিগৃহীত, নির্যাতিত প্রবঞ্চিত দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের যাপিতজীবন সংশ্লিষ্ট নানা উপাদানে সাজালেন তাঁর পুরো কাব্যগ্রন্থে ‘মানুষের মানচিত্রের’ ৩২টি কবিতা।
লোকজ উপাদান ও সেই সব মানুষের বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার শ্রমজীবী মানুষের মুখের ব্যবহৃত ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের আর্তনাদ ও প্রতিবাদ। জীবনের দাবি ও সংগ্রামের ভাষা। উন্মোচিত করেছেন সমাজের প্রকৃত চেহারা।
তালাক হয়েছে তার আশ্বিনের শেষ দিন অপর বেলায়
অকারণে। লোকে বলে- সোয়ামির দিকে তার ছিল না নজর
পাড়া-বেড়ানিয়া মাগি যার তার ঘরে গেছে সন্ধা কি ফজরÑ
অপরাধ বড়ো তার, পাথর ভেঙেছে সেÑযে মাটির ঢেলায়। (মানুষের মানচিত্র-১০)

সংগ্রামী, হার না মানা এই নিগৃহীত নারী আত্মহত্যা করে নয়, বেঁচে থেকে জীবনের শেষটা দেখে যেতে চেয়েছে।
ঘোলাটে জোন্সার রাতে দড়ি হাতে যায়নি যে গাবগাছ তলা
এনড্রিন ভালোবেসে পরান জুড়োতে তার হয় নাই সাধ।
বেঁচে থেকে জীবনের পঁচাগলা অন্ধকারে নিয়েছে সে স্বাদ
জীবনেরÑজীবন দেখুক এক মানুষের অন্ধকারে জ্বলা (মা মা-১০)

কবিতা গল্প নয়। গল্পোত্তর আরো কিছু। মানুষের মানচিত্রের কবিতাগুলোর ভেতর রয়েছে এক ধরনের গল্পবলার ঢং। দক্ষিণবঙ্গের মানুষÑ মাঝি, জেলে, চাষা, চৌকিদার, বেদেনি, বেশ্যা, মুচি, নিকোরি নানা শ্রেণির মানুষের চালচিত্র তুলে এনে সমাজ জীবনের ভেতর বাইরের একটা সম্যক চিত্র মুদ্রিত করেছেন। রুদ্র নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেনÑ ‘ছোটগল্প ও কবিতার বিভেদ ঘুচিয়ে আমি এক ধরণের নতুন রচনা উপহার দিতে চাই, যা সহজে পাঠক-শ্রোতার কাছে পৌঁছুবে।’ মানুষের মানচিত্রের এক একটি কবিতা যেন অসমাপ্ত জীবনের কাহিনি।
নি¤েœাক্ত কবিতাটিতে নারীকণ্ঠে নিদারুনভাবে বলিয়ে নিয়েছেন তার গভীর বেদনার কথা, জীবনের ক্ষয়-ক্ষতি-ক্ষরণের কথা। একজন সোমত্ত নারী, প্রতারক প্রেমিক কর্তৃক নিত্য প্রতারিত এই সমাজেÑ
কাঞ্চা গাছে কোপ দিয়ে চলে গেছে পোড়ামুখি রসিয়া নগর
কে আর আসবে বলে! কি কোরে বা এঁটো ফলে খেতে দেবো তারে?
নোতুন শাড়ির রঙ অবেলায় জ্বলে গেল সাবানের ক্ষারে
কে দেবে শুকনো ফুলে নিশিরাতে মরমের গহিন আদোর। ( মা মা-২৮)

এই বেদনাবোধ থেকে আরেক সরলা যুবতী প্রেমিকের কাছ থেকে আদায় করে নিতে চায় প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়নÑ তারপরেই কেবল সমর্পিত হবে সেÑ
যদি তুমি কথা দাও কার্তিকের অনটনে দেবে না তালাক,
তোমার বুকের নিচে আমি তবে ভূমি হবো, হবো এক নদী,
হৃদয়ের জল দিয়ে ভেজাবো তোমার কূল আমি নিরবধিÑ
তোমার জবান যদি সত্য হয় তবে তার বাসনা জ্বালাক। (মা মা-১২)

জীবন নির্বাহের সবকটি দ্বার যখন রুদ্ধ ভয়াল দারিদ্র গ্রাস করে সংসার সুখ স্বপ্ন তখনই নারী সর্বনাশের সিঁড়ি বেয়ে নামে পাতালে-অন্ধকারে। সমাজ তার পিঠে মারে বেশ্যার ছাপ। বারাঙ্গনা যে নারীদের বীরাঙ্গনায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন রুদ্রÑ
একদিন শরীর জানায়ে দিলো পেটে তার আরেক জীবনÑ
কার শিশু? হয়তোবা ডালিমন জেনেছিলো কার ছেলে পেটে
কে তার রসের জাউ অসময়ে বিনা দামে খেয়ে গেল চেটে।
প্রশ্নহীন। কালো চোখ তার যেন মেঘে ঢাকা ঈশানের কোণ (মা মা-২৬)

এই ডালিমনরা নির্যাতিত নারী-প্রতিনিধি। পতন থেকে নারী পতিতা। অধ:পতিত পুরুষের জন্য অভিধানে কোন শব্দ মুদ্রিত হয়েছে? সীমাহীন দায়দেনা, সংসারে পঙ্গু বাবা, অকর্মণ্য স্বামী তবু নারী স্বপ্ন দেখে। দেখতে হয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা বৈষম্যের শিকার ক্ষুধাপীড়িত নারীর আর্তনাদÑ
নেশায় ঘোলাটে চোখ, টলতে টলতে যায় বুকের বাসনা
অন্ধকারে শাড়ি খোলে কারো বোন, কারো বধূ, কারোবা জননী।
দেহের আগুন নয়, ক্ষুধার আগুনে পোড়া এই সব বুক,
জীবনের মংসে এক বিষফোড়া, জীবনের গভীর অসুখ। ( মা মা-১৮)

সমাজের এইসব নিগৃহীত, প্রবঞ্চিত মানুষগুলোও আবার সুযোগ বুঝে অত্যচারী হয়ে ওঠে স্বগোত্রের অধস্তনদের ওপর। এ যেন মামলায় হেরে গিয়ে ঘরে এসে বউ পেটানোর মতো পুরুষালি স্বভাব। নারী যেন সর্বশ্রেণীর শোষণের নির্যাতনের সামগ্রী।

চাষাটার ওই দোস, রোজরাতে চাই রাত গতরের সুখ।
সারাদিন ক্ষেতে খাটে, পেটভরা খিদে নিয়ে ফিরে আসে ঘরে
তার খেদ ঝাড়ে শেষে হাড্ডিসার পোলাপান মাগিটার পরে!
ফুটো চালে উঁকি দেয় রোদ, বৃষ্টি আর চাঁদের বেহায়া মুখ। (মা মা-২৫)

সমাজ তথা গোটা বিশ্ব আজ স্বল্প সংখ্যক লোক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাদের স্বার্থের লোভের শিকার সাধারণ মানুষ। গরিবের রক্তপানি করা পরিশ্রমে তাদের সম্পদের পাহাড় জমে। শ্রমিকশ্রেণি রয়ে যায় পারিশ্রমিকহীন। শ্রমিকের হাড্ডি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, মালিকের দেহে ক্রমাগত কাড়ে মেদ ও মাংস।

উপরে যে আছে তার বাড়ছে প্রশাখা ডাল-পাতা ফল-ফুল
নিচের তরুটি আর বাড়ে নাকো দিনে দিনে খসে তার দেহ।
এমনি নিয়ম নাকি, ওরা বলেÑনিয়তির এরকমই ¯েœহ
ভালোরা উপরে থাকে, অধমের চিরকাল ভেঙে যায় কূল। (মা মা-৫)

এই অভাব অনটন, না পাওয়ার বেদনা আর ক্ষুধা দারিদ্র্যের আড়ালে গ্রামীণ জীবনে ফল্গুধারা মতো বয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটেছে কিছু কবিতায়। লোক জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা কিছু প্রথা, সুখ দু:খের চিত্র বর্ণিত হয়েছে চমৎকারভাবে।
কুটুম এসেছে ঘরে, সাঁচি পান সাজো বউ রুপোর কাটায়।
চিড়ে মুড়ি আছে কিছু? নয়তো বাতাসা দাও সাথে নারকেল।
একেবারে খালি মুখ, আর কি সেদিন আছে, আহারে আকাল!
শ্রাবণের বানের নাহান ভেসে গেছে সবÑহায়রে সুদিন । (মা মা-৬)

আত্মীয় আসলে তার সমাদার, যতœআত্তি করা গ্রাম বাংলার মানুষের চিরদিনের নিজস্ব রীতি। তীব্র অভাব, অনটন আকাল কোনো কিছুতেই আপ্যায়নে কমতি নেই গ্রামীণ জীবনে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার এটাই এক বৈশিষ্ট্য। গল্পবলার ঢঙে বর্ণনা করে চলেছেন জীবনের সুখদু:খের না বলা কথা। ‘অনেক কবিতায় আছে ছোটগল্পের চমক এবং বিদ্যুৎস্পর্শ। আমরা ভুলিনা হরিপদ মুচি ও তার বউটিকে তার বউয়ের ওপর লেপ্টে থাকা কামুক দারোগটিকে আমরা সর্বত্র দেখি; আমরা ভুলিনা সার্কাসের মেয়ে ডালিমনকে অথবা আশ্বিনের শেষ দিনে তালাক হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটিকে।’ মানুষের মানচিত্র জুড়ে এইসব নিগৃহীত বঞ্চিত মানুষের হাহাকারই শুধু প্রকাশ করেনি রুদ্র, তাদের জেগে ওঠবার, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে গর্জে ওঠার বজ্র কণ্ঠও ধ্বনিত করেছেন।

থামা, খানকির পোলা তোর ইলানবিলা থামা, মানুষের ঢল
দ্যাখ নোনা দইরার মতো কূল ভেঙে কেমন গজায়ে ওঠে।
কেমন শিমুল দ্যাখ, রক্তজবা কি রকম রাঙা হয়ে ফোটে।
খুনের বদলে খুন, জুলুম চালালে নেবো জুলুমে বদলÑ (মা মা-৩২)

পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়া, চিরবঞ্চিত মানুষগুলোকে সংঘবদ্ধভাবে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন রুদ্র। সমাজের মুনাফাখোর, ভÐ প্রতারক মজুদদারদের টেনে হেঁচেড়ে ভূমিতে নামিয়ে আনতে বঞ্চিত মানুষের জেগে ওঠা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

চোপ। ওই হালা জাউরার পুত, খবিশ জবান তোর থামা,
কি ভাবিস, চোখের সামনে মুলা ঘুরায়ে নাচায়ে পাবি পার?
টাকা দিয়ে রক্ত ধুবি? ধুলোয় ঢাকবি লাশ? স্মৃতি স্বপ্ন আর
বুকের আগুনে দিবি পানি? ইটের বদলে দিবি ফাঁকি, ঝামা?

তারপর জুলুমবাজদের সুখের খোয়াব কেড়ে নিয়ে গড়ে তুলবেন আঘ্রাণের দেশÑযেখানে স্বপ্নের শিমুল ফোটে বারোমাস, কোকিল ডাকবে, রাঙা মউমাছির মতো প্রেমিরা বুকে ধরে রাখবে মধুর চাক প্রেমিকের জন্য। এই ক্ষুধা অন্ধকার জীবনের মুখে দাঁড়িয়ে নারীরা স্বপ্ন দেখে নতুন দিনের।
এবার আঘ্রাণ মাসে কিনে দেবো তাঁতে বোনা লাল পেড়ে শাড়ি
চাষের মৌসুমে যদি খোরাকির ধার-দেনা অধিক না হয়
তবে দেবো নাকফুল, গেরস্থ বউরা যেমন গড়ায়।
বলে রাখি, দুটো মাস একটু আদটু থাকো বাজারের তাড়ি। (মা মা-৩০)
বিরূপ পরিবেশেও কবি আশাহত নন, স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে এ জমাট আঁধার দূর হবে। নতুন প্রজন্ম হবে প্রচÐ সাহসী, তেজোদীপ্ত, এস.এম. সুলতানের ছবির পুরুষদের মতোÑ
তোমার জমিনে দেব এইবার ঘাড় শক্ত মানুষের বীজ,
শত আঘাতেও যেন সে মানুষ কিছুতেইড না নোয়ায় ঘাড়।
আমাদের রক্ত মাংস পুঁজি করে দেবো তারে আমাদের হাড়
তবু যেন কোনোদিন পরতে না হয় তারে ভাগ্যের তাবিজ। (মা মা-৩০)

গ্রাম বাংলার নিগৃহীত, বঞ্চিত মানুষের জীবনচিত্র আঁকতে গিয়ে রুদ্র বিস্মৃত হননি বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য সমসাময়িক রাজনীতি ও গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের কথা। শোষণ বঞ্চনার দীর্ঘপথ অতিক্রম করে বাঙালি স্বাধীন জীবন পেলেও সহজেই ভুলে বসে আছে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি।

পাখি তার ইতিহাস, জন্মের ঠিকানা ভুলে, ভুলে তার বাসা
বাহারি খাঁচায় বোসে ভিনদেশি গান গায় পরের জবানে
বিড়ালের শিশু যেন দুধ খায় বড়ো সুখে বাঘিনীর বানেÑ
পরনে দাঁড়ায় এসে ইতিহাস শব্দহীন, অতীতের ভাষা। (মা সা-২৪)

অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনকে ‘শকুন’ আর ‘কালোমেঘ’ আখ্যায়িত করে বলছেনÑ
ওড়ে আকাশে শকুন। উত্তর দিগন্ত ঘিরে কালো মেঘ ভাসে
কেউ কি বেহুলা নেই স্বপ্নবান কোনো এক তরুণ বেদেনি?
স্বজন রক্তের কাছে, স্বজন হাড়ের কাছে দায়বদ্ধ ঋণী?
কেউ কি বেহুলা নেই, হাড়ের খোয়াব নিয়ে বৈরী জলে ভাসে?? (মা সা-১৬)

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রুদ্র নবম শ্রেণির ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধ আর যুদ্ধপরবর্তী নানা উত্থান পতন রুদ্রকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে, দ্রোহী করে তুলেছে। ‘উপদ্রæত উপকূলে’র সেই বাক্য আমাদের মনে পড়বে নিশ্চয়Ñ ‘জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরনো শকুন।’ যুদ্ধ পরবর্তী শঠতা, স্বার্থপরতা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং সামরিক সেনা ছাউনির ভিতর বেড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধের পরাজিত শক্তি তার মাঝে স্বজন হারানোর কষ্টে রুদ্র ধিক্কার দিয়ে ওঠেনÑ

উপরে তাকাও দ্যাখো ওই মুখ চেনো তুমি এই যে মানুষ?
শকুনের মতো চোখ, ঠোঁটে রক্ত কালো, শুকনো জমাট রক্ত
দেখো লেগে আছে দ্যাখো শিশুর মগজ-মাংস, কুমারীর লজ্জা।
আর দ্যাখো একজন যুদ্ধের মানুষ কী বিমর্ষ রুগ্ন, ¤øান। (মা মা-২২)

‘মানুষের মানচিত্রে’র মূল্যায়নে রুদ্র’র জীবনীকার তপন বাগচির মতটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেনÑ‘এ কাব্যের প্রায় সকল কবিতার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এক প্রাণস্পর্শী চেতনাধারা, যেন বাংলাদেশের মানচিত্রের গরিব থেকে উঠে আসা এক পর্যটক এবং বর্ণনা করে তার দীর্ঘ ভ্রমণের বিবরণ।….এইসব চালচিত্র আমাদের পরিচিত, তবুও যেন এসব এমন নগ্নভাবে আমরা দেখিনি। এসব আর্তি ও কান্না, চিৎকার ও গর্জন আমরা এত কাছ থেকে শুনিনি। আমাদের মর্মমূলে বিধে যায় বাংলাদেশের গহীন গ্রামগুলোর গোঙানির শব্দ।’
‘সুন্দরতম শব্দবলির সুন্দরতম বাণীবিণ্যাস’ কবিতার ও সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ। কবিতা শব্দোত্তর আরো কিছু। যথার্থ শব্দ বিন্যাসের ভেতর একজন কবিকে, কবি স্বভাবকে চিনে নেয়া যায়। মানুষের মানচিত্রে তরুণ রুদ্র এমনসব লোকজ শব্দের সন্ধান দিয়েছেন যার সুপ্রযুক্ত ব্যবহারে সত্যিই জেগে উঠেছে বাংলা কবিতার নতুন প্রাণশক্তি।
আন্ধার, আকাল, অতিথি, আজদাহা, আগলাবি, আনবাড়ি, আল , আল বিছানা, আজাব, কান্দে, কৈতর, কিষাণ, কাতলামাছ, কাঞ্চা, কুটুম, কেতাব, কলিকাল, কলাবতী, কাতরায়, কিনার, খিলিপান, খিল, খোরাকি, খোয়াব, খানকি, খবিশ, গাঙ, গোলা, গতর, ঘাই, ঘোলায়, ঘুন, চোপ, চোতমারানি, ছাপায়ে, জোষ্টি, জাউরা, জবান, জিরান, ঝামা, টলেনা, নাহর, নকল, নাগর, নিকেরি, নাচন, নহর, নালা তেলের জাব, তুষের, তাতানো, তাবৎ, ভাগো, তয়, ত্যানা, দুয়ার, দুইরা, দরিয়া, দরোদ, দোহাই, ধুতরা, ধলা, ধোয়ো, পরান, পাথালি, প্যাঁক, প্যাঁচ, পচানি, পোড়াকপালি, পোয়াতি, ময়মন্ত, পোলা, বাউরি, বেদেনি, বেয়াড়া, বুলি, ঝাঁটা, বান, বয়রা, বাইদ্যা, বেশ্যা, ভাতার, মরদ, মোয়াল, মউমাছি, মাগি, মালিকা, মাদল, মাগ, যৈবন, বেজাতি, রাত্তির, লিলুয়া, লোহু, শান, শরান্ত, সিন্দুর, সমন, সোয়ামী, সেয়ানা, সই সোহাগি, সুরুজ, হালা, ইশকুল, ইলাবিলা, উজান, বাউল, বেভুল, ফের, লাথি, সাঁঝ, সুত, উথালি, হালের।
সমকালীন কবিদের মধ্যে আধুনিকতার নামে ছন্দ-উদাসিনতা লক্ষ করা গিয়েছিলো। কবিতার শিল্পসৌন্দর্য বিচারে এই কবিকে শুভ সংবাদ বহন করে না। এখানেও রুদ্র ¯িœগ্ধ ব্যতিক্রম। রুদ্রের ছন্দসচেতা বোদ্ধা পাঠককে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। এ প্রসঙ্গে শিল্প সমালোচক সুশান্ত মজুমদারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
“সত্তরের কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছন্দ-সচেতন কবি। তার বেশিরভাগ কবিতা লেখা অক্ষরবৃত্তে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ হিসেবে মানুষের মানচিত্রর কবিতাগুলো ধরা যেতে পারে। সব কবিতা বিশ চরণ ও বাইশ মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্ত। বইয়ের স্বীকারোক্তিতে রুদ্র নিজেই বলেছেনÑ‘বিশ চরণ আর বাইশ মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্তে এই বই-এর কবিতাগুলো লেখা হয়েছে। কয়েকটি কবিতার ইচ্ছাকৃতভাবে অমিল রেখেছি।’
গেল বছরের দেনা/এ বছল নিয়ে গেল/খোরাকির ধান
এই সনে দেনা হবে/আরো হালের বলদ/ গাই যাবে ব্যাঁচা,
কার্তিকের অনটন/সংসারে ডাকবে ঘোর/অভাবের প্যাঁচা।
মহাজন ভালো লোক/দেনার বদলে দেবে/ নাড়ি ধরে টানÑ
(সম্বিল অক্ষরবৃত্ত ৮+৮+৬, মা মা-৫)
উপমা চিত্রকল্প আর রূপকের যথার্থ প্রয়োগ মানুষের মানচিত্রের কবিতাগুলোকে ভিন্ন মাত্রায় ব্যঞ্জিত করেছে। কয়েকটি উদাহরণÑ
চিত্রকল্প : ১. ভাঙা গাঙপাড়ে তবু কালো মেয়ে স্বপ্ন খোঁজে জো¯œাহীন চাঁদে
শুটকির গল্প আসে, জোয়ারের জলে ভাসে পরানের দুল। (মা মা-১১)
২. মরা নদীটির পাড়ে এক শংখচিল কাঁদে। দুপুর গড়ায়
কে যেন আকাশে ভাঙে একরাশ শাদা-কালো মেঘের শিমুল (মা মা-১)

উপমা : ১. কাতলা মাছের মতো ঘাই মারে বুকে। (মা মা-২)
২. চিরকাল স্বপ্ন তবু জেলের নৌকার মতো জীবন ভাসায়। (মা মা-১১)
৩. দিঘির জলের মতো কালো এক শিশু দেবে তবে নেই মানা (মা মা-১২)
৪. উজান গাঙের মতো কোমরের ঝাঁক। (মা মা-২১)

রূপক :
১. এমন ফোটা ফুলÑ কদম ফুল তুয়ে কেউ পরবাসে যায়? (মা মা-৪)
২. পরবাসে যাবা মাঝি, মনে রেখো ভরা গোলা রেখে গেছ ঘরে। (পূর্বোক্ত)
৩. ভরা বসন্তের দিনে এ মধুর চাক তুমি ভেঙোনা মৌয়াল। (মা মা-১২)
৪. নোতুন শাড়ির রঙ অবেলায় জ্বলে গেল সাবানের ক্ষারে। (মা মা-২৮)
৫. কাঞ্চা বাঁশে কোপ দিয়ে চলে গেছে পোড়ামুখি রসিয়া নাগর। (পূর্বোক্ত)
৬. কে তার রসের জাউ অসময় বিনা দামে খেয়ে গেলো চেটে। (মা মা-২৬)
অসাধারণ সব উপমা, চিত্রকল্প-রূপক নির্মাণের পাশাপাশি মানুষের মানচিত্রের প্রায় প্রতিটি কবিতায় অন্ধকার শব্দের ইচ্ছাকৃত ব্যবহার কবিতাগুলোকে বিশিষ্ট প্রদান করেছে। এ যেন জগৎ ও জীবনের তাবৎ অন্ধকারকে চিহ্নিত করে আলোতে রূপান্তরের এক শৈল্পিক প্রয়াস।

১. জীবনের চাদ্দিকে হাতড়ায় মািঝÑআলো নেই, শুধু অন্ধকার (৩নং)
২. আর যেই চোর থাকে দেহের ভেতর, শরীরের অন্ধকারে (৭ নং)
৩. বেঁচে থেকে জীবনের পচাগলা অন্ধকারে নিয়েছে সে স্বাদ। (১০ নং)

বানানরীতি :
রুদ্র’র কবিতার যারা নিবিষ্ট পাঠক, তারা জানেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কবি গড়ে নিয়েছিলেন নিজস্ব বানানরীতি। বাংলা ভাষায় মূর্ধন্য ‘ণ’ এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ না থাকায়, বাংলা বানানে তিনি সংষ্কৃত ব্যাকরণের বিধি অনুসরণ করেননি। সর্বত্রই ‘ন’ ব্যবহার করেছেন। উচ্চারণের সুবিধার্থে তিনি কিছু দ্বি-অক্ষর বিশিষ্ট অসমাপিকা ক্রিয়ায় ও-কার (ে া) ব্যবহার করেছেন। কোলে, কোরে, বোসে)। উচ্চারণকে প্রাধান্য দিয়ে অনেক শব্দে দীর্ঘ-ঈকার এর বদলে হ্রস্ব-ইকার ব্যবহার করেছেন। অনুচ্চারিত ্য-ফলা বর্জন করেছেন (সন্ধা, বন্ধা) শব্দ মধ্যের ঃ বর্জন করেছেন (দুস্বপ্ন, অতপর, নিশব্দ)।
ভাষাকে সহজ করার লক্ষ্যে রুদ্রের এই পরীক্ষা নীরিক্ষা টিকবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। তবে তিনি যে নতুন কিছু করার পক্ষে আপোসহীন, নিবেদিতপ্রাণ আর নিত্য নিরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন তার স্বাক্ষর বহন করে উপর্যুক্ত বানানরীতি। মানুষেল মানচিত্রের উদ্ধৃতিতে রুদ্র’র বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমৃত্যু তাঁর কবিতায় মানুষের ভুল বোধে, ভুল চেতনায় শব্দের হাতুড়ি পিটিয়ে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। সংঘবদ্ধ শ্রমজীবী মানুষ, যাদের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন রুদ্র, তারা আজো শোষণের শেকলে বন্দী। জীবনের গভীর অসুখে আক্রান্ত। জর্জরিত মস্তিষ্কে, লাবণ্যহীন শরীরে নিয়ন্ত্রিত স্বপ্নের মধ্যেও রুদ্র যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্নে কাতর হন, তা আজো আমরা পাইনি। সমাজে রাষ্ট্রে আন্দোলনে রুদ্র তার পক্ষকে নির্দিষ্ট করে গেছেন। কেনো দ্বিধাদ্ব›দ্ব, বিভ্রান্তি রাখেননি। রুদ্র ছিলেন ‘শেকড় সন্ধানী আর বিশ্বাসে অটল এই প্রজন্মের প্রভা।’
মানুষের মৌলিক পরিচয়Ñমানুষ অপরাজিত। শ্রমজীবী মানুষের পরাজয় নেই। জয় তার সুনিশ্চিত। শুধু সে পথ দীর্ঘ আর কণ্টকাকীর্ণÑএই যা। যারা আমাদের শোষণ করছেন, গ্রাস করছেন দিগি¦দিক, যাদের নিমর্মতার সীমা নেই, জুলুম অত্যাচার অশ্রæতপূর্ব, সেই প্রবঞ্চক মহাজনরা একদিন নিমূর্ল হবে। হবে এই জন্য যে, তারা ও তাদের শোসকরা জানে না এই ‘উপদ্রæত উপকূল’ এ ওদের ‘মৌলিক মুখোশ’ তুলে নিয়ে ‘ছোবল’ হানার জন্য ‘মানুষের মানচিত্র’ আঁকার জন্য, ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম, দাবি উত্থাপনের জন্য, যে রুদ্র জন্ম নেয় সে রুদ্র মৃত্যুতে হারায় না, শুধু বহুভাগে ভাগ হয়ে যায়।’ (রণজিৎ বিশ্বাস, রুদ্রের মৃত্যুতে অনুভূতির একটি দুটি) মানুষের মানচিত্রে বহুভাগে ছড়িয়ে পড়া রুদ্রের মৃত্যু নেই। কেননা, একজন স্বপ্নবান মানুষ, যিনি ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি সাংস্কৃতিকে লালন করেন, সাধারণের মাঝে বেঁচে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, সক্রিয় থাকেন সৃজন কর্মেÑ তিনি চিরঞ্জীব।
তথ্যসূত্র :
১. মানুষের মানচিত্র, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, সব্যসাচী প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৮৪
২. রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, জীবনীগ্রন্থ, তপনবাগাচি, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৮
৩. শ্রেষ্ঠ কবিতা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, হিমেল বরকত সম্পাদিত, হাওলাদার প্রকাশনী, ২০১৭
৪. রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, স্মারকগ্রন্থ, হিমেল বরকত সম্পাদিত, অক্ষর প্রকাশনী, ২০১৫
৫. বাংলাদেশের কবি ও কবিতা, শহীদ ইকবাল, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৭

আ.ম.ম মামুন, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

 

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে