ইলিয়াস বাবর :
সামনে ঝুলানো দেয়াল ঘড়িটার দিকে বার কয়েক তাকালেন রিয়াজ সাহেব। নামাজের বাকি আর বেশিক্ষণ নেই। তারউপর জরুরত সারার ব্যাপার আছে। তার আবার প্রথম কাতারে নামাজ না পড়লে দিলখোশ হয় না। হাজার হোক, ব্রাঞ্চের সিনিয়র লোকেরাই তো পয়লা কাতারে দাঁড়াবে, নাকি? জিবি ইনচার্জের বিরাট ঝামেলাপূর্ণ দায়িত্ব রিয়াজ সাহেব পালন করছেন, জুনিয়রেরা সেই হিসেবে বেশ সমীহও করে। এটা তাকে আনন্দ দেয়। কখনোবা বস-সুলভ অর্ডার-টর্ডার করা যায়, দাবি খাটানো অন্যায্য না; চেয়ারটাই বরং সেসব হোল্ড করে। বিরক্তি তার সীমা লঙ্ঘনের চরম পথে, কপালে দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষোভের ভাঁজ। এ্যা, এতক্ষণ লাগে? মানুষ কি ওখানে বসে থাকতে যায়? আল্লাহই জানেন, নাকি ঘুমায়ে গেল! চারপাশে খেয়াল করেন রিয়াজ সাহেব। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। তার এমন আজাইরা খিস্তি শুনবার সময় কারো নেই। অবশ্য বিড়বিড় করে মুখের ভেতর বলা এসব কথা কেউ শোনার কথাও না। তিনি জানেন, অনেক কথা করোটির ভেতর রেখে দিতে হয়। তা বের করে দিলে বরং বিপদ। প্রাইভেট ব্যাংকে চলে পেশাদারিত্বের খেলা। সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব দিয়ে, আন্তরিকতার মিশেল দিয়ে এখানে টিকে থাকতে হয়। কাস্টমার ইজ লর্ড, এ পেশাতেই বলা হয়; বলা হয় কি, বিদেশের কোন কোন ব্যাংকের সাইনবোর্ডে নাকি তাই লেখা আছে বড় বড় হরফে।
মাউজটা বারকয়েক ঘুরান্টি মারেন রিয়াজ সাহেব। ঘড়ি বলছে, এতক্ষণে যোহরের প্রথম জামাত শেষ। পেট তাগদা দিচ্ছে, খেতে হবে। দীর্ঘ দিনের এই চাকরি জীবনে কোন কলিগ বলতে পারবে না, রিয়াজ সাহেব একটু দেরিতে লাঞ্চ করেছেন, হাতে যত কাজই থাকুক। চাকরি করি কেন? নিজেকে শুধায় তিনি। ভেতর থেকে শুনতে পান, খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য। যদি ঠিক টাইমে খেতেই না পারি, কিসের কাজ, কিসের চাকরি! শাহ আলম সাহেব ঠিকই বলেন, “খাই-দাই কামাই, ঝি বাঁচলে জামাই!” কিন্তু আজকের কেসটা আলাদা। একে তো চেয়ারের ভার, তারউপর অফিস অর্ডার আছে, লকার সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করবেন জনাব রিয়াজ উদ্দিন। ম্যানেজমেন্ট মনে করে লকার সার্ভিসের মতো এনচিলারি ইনকামের সুযোগগুলো মিস করা যাবে না। বিনিয়োগে আর থাকে কত ব্যাংকের? নয়-ছয়ের যে ফিগার ঠিক করে দিয়েছেন দেশের মুরব্বি ব্যাংক, তাতে আসলে এনচিলারি ইনকামের পথ বের করা ছাড়া উপায়ও নেই। বছর শেষে লকারের সাইজ অনুযায়ী ভাড়া, ইনকামটা একেবারে মন্দ না। আসলে সময়টাই এখন উইন-উইন সিচুয়েশনের। কাস্টমার চাইবে তার লাভ, ব্যাংক চাইবে নিজের। দুই পক্ষের লাভালাভের হিসেবে প্রতিযোগীতার বাজার। কোন কোন টার্গেট লাগানো ব্যাংকের অফিসারেরা তো আবার লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বসে থাকেন, কিভাবে অন্য ব্যাংকের ভালো কাস্টমারদের ফুসলিয়ে বাগে আনা যায়। পারলে জামাই আদর করে! এসব মাথায় না নিয়ে পারেন না রিয়াজ সাহেব। তিনি পেটকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেন। মাস শেষে পাওয়া মোটা অংকের স্যালারিটার দিকে নজর দেন। মনকে প্রবোধ দেয়, সবুর করো, স্যালারি না ঢুকলে টাইমলী খাওয়া দূরে থাক এই চর্বিবহুল মাংসল পেটই থাকে কি না সন্দেহ!
জুনিয়রেরা বলে, রিয়াজ স্যারের এই এক অভ্যেস, মনিটরের দিকে চেয়ে থাকেন স্ট্যাচুর মতো। কথাটার সারসত্য পেয়ে আজ নিজেই চমকে যান তিনি। কোন কাস্টমার ব্যালেন্সটা জানতে চাইলেন বা টুকটাক লাভের হিসেব জিজ্ঞেস করে বা কোন স্টেটমেন্ট কিন্তু সারাক্ষণ মনিটরে তার কাজ কী? এবং খুব সন্তর্পনে রিয়াজ সাহেব আবিস্কার করলেন, এতে তার রাগ কমে! পেটের ভেতর থেকে সিগন্যাল আসছে, যাও বাপু ঝোলা ভরে এসো! পেটকে পাত্তা না দিয়ে রিয়াজ সাহেবের ভাবনায় উঁকি দিতে থাকে লকার বিষয়ক অতীতে ঘটা একটা মজার ঘটনা। ভেবে দেখলে আশ্চর্য লাগে, লকার খুলতে আসা লোকজন বেশ ধনবানই হয়। হ্যাঁ, যার কিছুই নেই তার আবার লকার লাগবে কেন? আর আসেন দুপুরের টাইমে, বলা চলে একেবারে পিক আওয়ারে। তারা লক্ষ্মী সুতারাং তাদের সময় দিতে হবে, তাদের সমাদর করতে হবে যথাযথভাবে। তো, এরকম দুপুরেই এক ভদ্রমহিলা এলেন তার লকার দেখবেন। চাবি দিয়ে রিয়াজ সাহেব লকার রুম দেখিয়ে দেন তাকে। এই ফাঁকে যোহরের নামাজ আর লাঞ্চ সেরে নেন তিনি। কম করে হলে এক ঘন্টা পরেও যখন মহিলার লকার থেকে বের হবার ছায়া দেখা যায় না, রিয়াজ সাহেব নিজেই একবার লকার রুমের দিকে যান। দরোজার ভেতর উঁকি দিয়ে যেটা দেখেন তিনি তাতে বেশ অবাকই হন। ভদ্রমহিলা স্বর্ণের বক্স খুলে বসে আছেন চেয়ারে। চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু! কোন দিকে খেয়াল নেই তার। এক মনে স্বর্ণ নাড়াছাড়া করছেন আর অশ্রু মুছছেন। এমন আচানক অভিজ্ঞতায় কেইবা আবেগ-আক্রান্ত না হয়ে পারে বলুন? রিয়াজ সাহেব নীরবে ফিরে আসেন নিজের টেবিলে। মনে পড়ে, ওই ভদ্রমহিলা যখন স্বামীকে নিয়ে লকার হিসাব খুলতে আসেন, বেশ আগ্রহী ছিলেন এমনতরো ভিন্নধর্মী সেবার খবর পেয়ে। কথায় কথায় ভদ্রমহিলার স্বামী জানালেন, স্বর্ণ চুরির কথা। দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবন তাকে দিয়েছে প্রচুর অর্থ, তাতে গ্রামে আলিশান প্রাসাদ গড়েছেন, ঢাকা শহরে কিনেছেন ফ্ল্যাট। কিন্তু নিজে খুব ছোট থেকে বড় হয়েছে বলে, তার কাছে অন্যের আনন্দ বেশ ভালোই লাগে। বউ তার স্বর্ণের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল। ফলে বছরে দুইবার দেশে আসার কালে কয়েক ভরি বাইশ ক্যারেটের খাঁটি সোনা ভদ্রলোক বউয়ের জন্য নিয়ে আসেন। তাতে বউয়ের চেহারা হয় দেখার মতো উজ্জ্বল, যেনবা ভরযৌবন ইলিশের চকচকে পেটি। এই আনন্দ ভদ্রলোকের এক কালের অভাব আর দুঃখবোধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় চোখের পলকে। মরমে খেলে যায় অনাবিল আনন্দের দখিনা বাতাস। কিন্তু এই খবর রাষ্ট্র হতে সময় লাগে না বেশি দিন। পুরো পাড়ায় রটে যায়, আমির হোসেনের (ভদ্রলোকের পাসপোর্ট নাম) বাড়িতে রয়েছে স্বর্ণের ডিব্বা। বউয়ের গায়েহাতে কিলবিল করে সোনার অলংকার। গতবার দেশে আসলে দূরে এক আত্মীয়ের বাসায় ছিল সে রাতে খাবার দাওয়াত। প্রবাসী কেউ দেশে থাকলে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় দাওয়াত পড়ে বেশি। খাওয়া-দাওয়ার পর অবশ্য কেউ কেউ একটা ভিসা ম্যানেজ করে দেয়ার বিষয়টা রাখঢাক না রেখেই বলে বসে। আমির হোসেনের দানের হাত বেশ চওড়া কিন্তু ভিসার ব্যাপারটা বারবার এড়িয়ে চলে। আরব দেশে সবাই লাইন করতে পারে না, টিকে থাকতে পারে না গরম আর কষ্টের সাথে পাঞ্জা দিয়ে, তখন দোষ পড়ে ওই ভিসা দেওনেওয়ালার। কী দরকার বাপু ভিসা দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক হালকা করার? বলা চলে নিজগুণে তিনি কঞ্জুস সাজেন ভিসার বিষয়ে। সবাইকে নিয়ে খেয়েদেয়ে, দেশ-বিদেশের গপসপ মেরে রাতের বয়স বেশ বাড়ন্তির দিকে গেলে বউসহ বাড়ির পথ ধরেন আনিস। আসলে দেশের মানুষ দেখলে, দেশের হাওয়া গায়ে লাগলে বেশুমার আনন্দ হয় তার; আনন্দেরা ঝরে পড়তে চায় কথা হয়ে, আড্ডার সুরত ধরে। সে রাতে সময় বুঝে বাড়িতে রাখা স্বর্ণ হাওয়া করে দেয় তক্কে তক্কে থাকা চোরের দল। বউকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে আনিস আবিস্কার করে, ঘরে লোহার সিন্ধুকে স্বর্ণ রাখলেও নিরাপত্তা নাই। কেঁদেকেটে বউ দোষ দেয় বেচারা স্বামীরই কাঁধে! বলেছিলাম না তাড়াতাড়ি ফিরতে? আমার মনে কেমন কু ডাক পাড়ছিল, হয়েছে তো; মনের আশা পুরালো এবার? আমার কত সাধের গয়না, কোন ছিনালের পুতেরা এমন করলো গো। এই বাড়িতেই আর থাকবো না আমি, বলেছিলাম না সবটাই হারামি এখানে, যতক্ষণ খেতে পায় ততক্ষন ভালো। খেয়েদেয়ে বাসন ফুটো করতে সময় লাগে না এদের… বউকে প্রবোধ দেয় আনিস, কিসমতে না থাকলে কে ঠেকায় বলো? কিছু স্বর্ণই তো গেল, নাকি? আমাদের কপাল তো আর নিয়ে যেতে পারেনি! আগামীবার আসার সময় ঠিকই পুষিয়ে দেবো, দেখিও। পড়শি কেউ কেউ থানা-পুলিশ করার কথা বলেছিল, সে দিকে যায়নি আনিস। সন্দেহভাজন দুয়েক জনের কথা বউ আরেঠারে বলতে চেয়েছিল বটে, স্বামীর বিশেষ সায় না পেয়ে আর আগায়নি। সেই কষ্টের দিনে ভাগিনা এনাম জানায়, স্বর্ণ আজকাল ঘরে রাখে নাকি কেউ? ব্যাংকের লকার সার্ভিস নাও, কিছু ভাড়ার বিনিময়ে বিপদ পার করে দাও ব্যাংকের গাঢ়ে! আইডিয়াটা মনে ধরেছিল আনিসের, তার স্ত্রীরও। পরের বার দেশে আসলে আনিস ব্যাংকের লকার সার্ভিসে রেখে আসে ভরি বিশেক স্বর্ণ। বউয়ের মন পড়ে থাকে স্বর্ণের বক্সে, বেউপায় তিনি আচমকা ব্যাংকের লকারেই খুঁজে নেন নিরাপত্তার বলয়। মাস বিরতিতে নিয়মিত দেখে যান লকারে রাখা অলংকার। গয়নাগুলো নাড়াছাড়া করলে আর্দ্র হয়ে আসে তার মন। চোখ হয়ে যায় অশ্রুসিক্ত। লকার রুমে ঢুকলে, স্বর্ণের বক্সটা হাতে নিলে ভদ্রমহিলার বুক হয়ে উঠে সাহারা মরুভূমি, চোখ তার বরিষার নদী!
ডেস্কে বসে এই বিরক্তির মধ্যেও রিয়াজ সাহেবের প্রয়াত বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা বলতেন, বুঝলি রিজু, মেয়েরা বিবাহে দেয়া স্বর্ণের কথা জীবনের শেষ দিনেও ভুলতে পারে না। তোর মা, দেখেছিস কথায় কথায় এখনো খোটা দিতে ছাড়ে না। সেই বিয়ের কালে, তাও তোর দাদা সেট মেলাতে পারেনি বলে ফর্দ থেকে তিন আনা স্বর্ণ কম কিনেছিল মোটে। দীর্ঘ সংসার জীবনে বহু অলংকার তোর মাকে কিনে দিলেও সেই তিন আনার খোটাটা জীবন থেকে গেলো না আমার! বাবার খেদটা বিবাহিত জীবনে এসে রিয়াজ সাহেবও টের পেয়েছেন বিভিন্ন সময়। একবার, ব্যাংকের চাকরি হবার আগে, ঘোর বিপদে বউয়ের কিছু স্বর্ণ বন্ধক রেখে মহাজন থেকে নিতে হয়েছিল টাকা। অবস্থা বেগতিক হতে থাকলে স্বর্ণ ফেরত আনা দূরে থাক, সুদাসলে তিনগুণ দেবার ভয়ে ও পথই আর মাড়ায়নি রিয়াজ সাহেব। ব্যাংকে চাকরির পর বউকে কত স্বর্ণ তিনি কিনে দিলেন অথচ এখনো সমানতালে খোটার উপর থাকতে হয় তাকে। কথায় কথায় বউ বলে, পাশের বাসার ভাবীর নতুন কেনা কানের দুলটা না যা সুন্দর হইছে! তোমার রেকর্ড তো বন্ধক দেয়ার, মানুষের হলো গিয়ে বউকে কিনে দেয়ার। দেখে শেখো কিছু। কিছু বলে বউকে রাগাতে যায় না রিয়াজ সাহেব। তাতে ভাত জাউ হয়ে যেতে পারে, বাসায় বেড়ে যেতে পারে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। স্বর্ণের প্রতি নারীর সহজাত দুর্বলতা থাকতে পারে তাই বলে স্বর্ণের বাজার দর যে পুরো দুনিয়ার অর্থনীতিকে ধাক্কা দিতে চায় মাঝেমধ্যে? আজব চিজ বটে। পেটে ক্ষিধের উৎপাত ভয়ানক আকার ধারণ করছে রিয়াজ সাহেবের। বেরসিক ভরদুপুরে ভদ্রমহিলার লকারে বসে কান্নার দৃশ্যের সাথে প্রয়াত বাবার স্বর্ণবিষয়ক কথাও পেটের জ্বালা মেটানোর মতো যথেষ্ট হতে পারে না আর। ইন্টারকমে একবার সেকেন্ড স্যারকে বলবে কি না বিষয়টা, বললেও তিনি কিভাবে নেন এই দোনোমনা ভাব রিয়াজ সাহেবকে একেবারে বেদিশা করে দেয়। ঝিম মেরে তিনি মনিটরের দিকে তাকান। এক গাল গালি উড়িয়ে দেন তিনি লকারে থাকা তার কাস্টমারের ঠিকুজিতে। বউ হলে আজ কপালে শনির দশা থাকতো তার, স্বর্ণের প্রসঙ্গের মতো এটাও সীমানার বাইরে উড়িয়ে মারতো গেইলের ছক্কা পেটানোর মতো করে। কিন্তু ভদ্রমহিলা তো সম্মানিত গ্রাহক, তিনি লক্ষী, তাদের বিষয়ে কোন অভিযোগ চলে না রে পাগলা!
দেরিতে নামাজ সেরে মনের উসখুস ভাবটা যেমন রিয়াজ সাহেবের যাচ্ছে না, তেমনি পেটও বোধহয় লেট সার্ভিস নিতে চাইছে না। গুড়ুরগুড়ুর করছে খালি। তবুও মহিলার আসার নাম নাই। ঘড়িতে তখন দুপুর ক্ষয়ে বিকেলের ঘরে বসে গিয়েছে রীতিমতো। কাঁচের ঘর থেকে সেকেন্ড স্যার কিছুটা আঁচ করতে পেরে নিজেই উঠে আসেন জিবি ইনচার্জের ডেস্কে। রিয়াজ সাহেব দাঁড়িয়ে সেকেন্ড স্যারকে বিস্তারিত জানাতেই স্যারের স্যারগিরি যেনে খাড়া হয়ে ওঠে। এ্যা, এটা কোন কথা হলো? চুল তো আর এমনে পাকে নাই আমাদের, কত দেখেছি এমন! কাস্টমারকে এভাবে ছেড়ে দেবেন আপনি ভাবতেই পারিনি রিয়াজ সাহেব, দ্রুত যান লকারে। অর্ডার করে টপাটপ নিজের কাঁচের ঘরে ঢুকে পড়েন সেকেন্ড স্যার। রিয়াজ সাহেবের এই এক সমস্যা, বিপদের সময়, বড় স্যারদের সামনে কোন কিছুই বুঝিয়ে বলতে পারেন না, গলা ভারি হয়ে আসে, তোতলাতে থাকে তার গলা। লকারের ব্যাংকের চাবিটা নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকেন রিয়াজ সাহেব। তাদের ব্রাঞ্চটা দুই ফ্লোর জুড়ে বিশাল স্পেচের। নিচের ফ্লোরে সেকেন্ড স্যারসহ জিবি, ক্যাশ, এডিসি ও আরডিএস ডিপার্টমেন্ট। উপরের ফ্লোরে ম্যানেজার স্যারসহ ইনভেস্টমেন্ট, ফরেন এক্সচেইঞ্জ ডিপার্টমেন্ট। উপরের ফ্লোরের এক কোণায় চমৎকার স্পেচ নিয়ে আছে লকার সার্ভিস। সিঁড়ির শেষে কাঁচের দরোজা টানতেই ওই ভদ্রমহিলা। তার মুখ জুড়ে প্রশান্তির বার্তা। ভদ্রতার খাতিরে রিয়াজ সাহেব ছোট্ট করে বললেন, আপনার হলো এতক্ষণে? যান, আমার ডেস্কের ওখানে বসুন প্লিজ। লকার রুমের দরোজা লাগিয়ে রিয়াজ সাহেব ডেস্কে আসতেই মহিলার কথারা যেন খই ফুটছে। বুঝলেন স্যার, সে তো থাকে বিদেশে। বিদেশীগো আবার শখ-আহ্লাদ একটু বেশি। সকালে সে কইলো, তোমারে দেখতে ইচ্ছা করতেছে ময়নার মা। তো দেখো! না, সে বিয়ের গয়না পিন্দায়ে দেখবো। কী আর করা স্যার, আপনাদের কষ্ট দিলাম আর কি! লকার রুমে গয়না পইরা তারে দেখাইলাম স্যার ভিডিওকলে। এই ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ বড় কাজের জিনিস স্যার। এক সময় কানে দিয়ে শুনাই সার, এখন মুখের সামনে নিলে দেখা আর শোনা দুটাই সারা। আল্লাহ চায়নাদের ভালো করুক, তাদের বুদ্ধিতে আজ দেশ-বিদেশ এক। বুঝলেন, আমাকে দেখেই ময়নার বাপ শান্তি। ঘর-বাড়ি ছেড়ে তো পরিবারের শান্তির জন্য বিদেশে থাকে বেচারা, তো এটুক করতে না পারলে হবে? রিয়াজ সাহেব মনিটরের দিকে তাকিয়ে তার কাজ করে যাচ্ছে আর ভদ্রমহিলার কথা শুনছে। জগতে কত রকমের মানুষ যে আছে! মনে মনে বলে রিয়াজ সাহেব। ভদ্রমহিলা আবারো শুরু করে, বুঝলেন স্যার, সে তো খুব খুশি লকারে স্বর্ণ রাখছি বলে। বিদেশে থেকেও নিশ্চিন্ত হয়ে আছে। লোকটা সরল, বুঝলেন। তবে ঘরের বাকি লোকেরা তারে সরল থাকতে দেয় না। হইছে কি, কেউ শান্তিতে থাকুক তা ঘরের লোকজনই চায় না স্যার। হিংসা, একেকটার মনে হিংসার আড়ৎ। তার মা-বোনেরা বলে, দিনকাল নাকি ভালো না। প্রবাসীর বউয়েরা কত কিছু করতেছে আজকাল। তবে আমার ময়নার বাপ কিন্তু ভালো মানুষ। আমার কথা শোনে। মা-বোনের কথা একটু শুনলে আমার অসুবিধা কী? ভাত-কাপড় পাচ্ছি, জেওরজাতিও। তারা বলুক, ওসব শুনলে আমার হাসি পায় স্যার। তবুও ভালো আছি, শোকর আল্লাহর। রিয়াজ সাহেবের মেজাজ গরমের উপর গরম হয়ে আছে কিন্তু ভদ্রমহিলার কথা শুনে মুডটা ইজি হয়ে আসে। তার প্রাণ খুলে উচ্চ স্বরে হাসতে ইচ্ছে করছে। পারে না, পেশা সেটা এলাউ করে না। আসলেই তো, মেয়েরা কথা পেটে রাখতে পারে না। গড়গড় করে ঘরের কথা পরকে বলে দেয়। তো, উনি যখন এতই পছন্দ করেন স্বর্ণগুলো বাড়ি রাখলেই পারেন; রিয়াজ সাহেব প্রস্তাবনার মতো করে বলে বসেন। না না স্যার, আমার শ্বাশুড়ি তাতে বেজার হবেন। তারা মনে করেন বউয়ের হাতে অত টাকা-পয়সা, স্বর্ণপাতি দিয়ে রাখলে পালাতে পারে অন্যের হাত ধরে। আমার ময়নার বাপ তো ভালো মানুষ, তার কথার বাইরে আমি যাবো? পাগলে পাইছে আমারে, সে কিন্তুক সরল মানুষ! আলগোছে একবার ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়াজ সাহেব মনিটরের দিকে নজর দেন পুরোদমে। অনেক কথা বলতে গিয়েও থেমে যান নিজের মতো করে। মনিটরে তাকিয়ে কাজ করতে থাকেন রিয়াজ সাহেব।
তিনি জানেন, এ-কথা বাসায় গিয়ে বলবেন সে পরিবেশও নেই; অমনি বউ তার খেকিয়ে উঠবে, দেখে শেখো। মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকেন রিয়াজ সাহেব। মনিটরে তাকিয়ে থাকলে তার রাগ কমে!
ইলিয়াস বাবর, গল্পকার