নিজামুল ইসলাম সরফী:
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম এখন দেশে-বিদেশে গবেষণা, সাহিত্যে, রাজনৈতিক দলসমূহের জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয় এবং অপরিহার্য হয়ে ওঠছে। তাঁর উপর রচিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক বই। বিশ্বের এ যাবৎকালের কোনো নেতা, রাষ্ট্রনায়কের ওপর এত বেশি সংখ্যক বই রচিত হয়নি। তাছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারের হত্যার প্রতিবাদে, দ্রোহে, ক্ষোভে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মতো জ্বলে ওঠে ছিলেন দেশ বিদেশের বহু কবি, ছড়াকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথা সাহিত্যিকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে লেখা এই পর্যন্ত দেশ-বিদেশে প্রায় ১৮ শতাধিক মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, শিশু একাডেমি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থা থেকে এসব বই প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিশ্বের খ্যাতিমান লেখকরা প্রচুর বই লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘যতোকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান…।’ কাজেই যুগ যুগ ধরে তাঁর কীর্তি নিয়ে চলবে গবেষণা, চলবে সাহিত্য সাধনা। ‘আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে/ তোমার বিচ্ছেদের সঙ্কটের দিনে/ আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে ব্যথিত/ করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে-/ রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে কেননা
জেনেছি/জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।’ আর কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় এভাইে বিধৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধু, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল/খুব ভালোবাসি/ রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের/একটি গোলাপ গতকাল আমাকে বলেছে/ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি…।’ কাজেই যুগ যুগ ধরে তাঁর কীর্তি নিয়ে চলবে গবেষণা, চলবে সাহিত্য সাধনা। ‘বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন রাজনীতির কবি’। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে লাখো মানুষের জনস্রোতে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া ‘ভাষণ’ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ এবং সর্বশ্রেষ্ট সাহিত্য বললে ভুল হবে না। জনমানুষের কবি, বাংলাদেশসহ তামাম দুনিয়ার মজদুর, শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও মুক্তির দিশারী। তাঁর সমপর্যায়ের বিশ্বমানের রাজনৈতিক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ। অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতটা শিল্প সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্রম বিকাশ ঘটেছে ততটা ঘটেনি বিশ্বের অপরাপর বড় মাপের নেতাদের নিয়ে। গতবছর বঙ্গবন্ধু’র জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে সারাদেশে ও সরকারি ভাবে যত বই প্রকাশিত হয়েছে তা এক কথায় অতুলনীয়। একজন নেতার ওপর পৃথিবীর আর কোন দেশে এত বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশ পায়নি। এই বইগুলো বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ওপর বেশ সংখ্যক বই চীনা, জাপানি, ইতালি, জার্মানি, সুইডিশসহ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি’ ‘বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু চর্চা’ শিরোনামে ১৯৯৮ সালে যে বইটি প্রকাশ পেয়েছিল তাতে বঙ্গবন্ধুর ওপর বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩৫০। আর বর্তমান ‘বঙ্গবন্ধু বিয়ষক গ্রন্থ’ বইটিতে এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ওপর আরও তিন শতাধিক বই প্রকাশ পেয়েছে। এ নিয়ে শুধুমাত্র ১৮০০ মৌলিক গ্রন্থ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশ পেয়েছে। চট্টগ্রামে থেকে ও অনেক মৌলিক বই বেরিয়েছে। যেমন সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর ‘বঙ্গবন্ধুকে জানো’, এমরান চৌধুরীর ‘ছোটদের বন্ধু বঙ্গবন্ধু’, গবেষক-সাংবাদিক মুহাম্মদ শামসুল হক লিখেছেন- ‘চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীরা’ ,এবং ‘স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায় বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য’’,বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ লিখেছেন- “বঙ্গবন্ধু তুমি অজর অমর” ও “দশ দিগন্তে বঙ্গবন্ধু”, রাজনীতিক কালাম চৌধুরী লিখেছেন ‘চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু’
কিন্তু বঙ্গবন্ধু একটি বহতা নদীর মতো, প্রতিদিন নিত্যনতুন রূপে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে তাঁকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন বই। বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুর উপর প্রকাশিত সর্বশেষ বইয়ের সংখ্যা কত এ হিসেব করা কষ্টসাধ্য। কারণ প্রতি দিনই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর ওপর বই বের হচ্ছে। এক কথায় বঙ্গবন্ধু বিশ্ব পরিম-লে এক অমূল্য সম্পদ। তাঁকে নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে গবেষণা হচ্ছে, তাঁর দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি, ভাষণ প্রভৃতি থেকে বিশ্ব নেতারা গবেষণা করে তথ্য উপাত্ত নিজেদের জীবনে, রাজনীতিতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োগ করছেন। এখানেই জাতির পিতার সার্থকতা। তিনি বিশ্ব রাজনীতিতে একজন দার্শনিক, শিক্ষাগুরু, পথপ্রদর্শক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালের লাইব্রেরিসহ, বাংলা একাডেমি লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ও বিভিন্ন জেলার লাইব্রেরি এবং কলকাতাসহ কয়েকটি দেশ থেকেও বঙ্গবন্ধুর ওপর বইয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এরপরও দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রকাশিত অনেক বই প্রকাশিত হচ্ছে নিরন্তর। প্রায় তিন শতাধিক প্রকাশনী বইগুলো প্রকাশ করেছে।
এর মধ্যে বেশি সংখ্যক বই প্রকাশ করেছে, বাংলা একাডেমি, আগামী প্রকাশনী, ইউপিএল, মওলা ব্রাদার্স, সময় প্রকাশনী, পারিজাত প্রকাশনী, পার্ল, অন্বেষা, অন্য প্রকাশ, হাক্কানী, পাঠক সমাবেশ, বর্ণায়ন, অনুপম, প্রতীক, মীরা প্রকাশনী, জাগৃতি, চট্টগ্রাম থেকে শৈলী প্রকাশন, আবীর, বলাকা, প্রজ্ঞালোক ইত্যাদি প্রকাশনী থেকে অনেক বই বেরিয়েছে অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় দেশে সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি একযোগে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমি ও আগামী প্রকাশনীও ইংরেজি ভাষায় এ সংক্রান্ত বই প্রকাশ করেছে। বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ ৯টি বই প্রকাশ করেছে। এই বইটি বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। মীরা প্রকাশনী থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা তদন্ত, ডেথ রেফারেন্স, সওয়াল জবাব, সাক্ষীদের জেরা ও রায় নিয়েই শুধু আবুল হোসেনের লেখা ৯টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। মীরা থেকে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে ২২টি । গত তিন বছরে একুশের গ্রন্থমেলায় বঙ্গবন্ধুর ওপর অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে, হবে ভবিষ্যতেও।বাংলাদেশ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধুর ওপর এত বই বের হয়েছে, তা তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর অপ্রকাশিত অনেক তথ্য বের হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। ফলে বঙ্গবন্ধুর ওপর বই প্রকাশনা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। আগামী প্রকাশনী থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর ৮০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইটি বিপুলসংখ্যক বিক্রি হয়েছে। প্রতি মাসেই অসংখ্য বই বের হচ্ছে জাতির পিতাকে নিয়ে। বাঙালি জাতির জন্য এটা সৌভাগ্য যে-বঙ্গবন্ধুর ওপর এত বই প্রকাশ পেয়েছে।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে যতটা দিন বদলের হাওয়া লেগেছে, ঠিক তার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন জাতির পিতার আদর্শ, অর্থাৎ তাঁর জীবন, সংগ্রাম কর্ম অনুসরণ, অনুকরণ করা। একই সাথে ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়া জনকের করুণ বিদায় দেশের সর্বশ্রেণির মানুষকে যেমনি শোকে মুহ্যমান করেছে তেমনি দেশে বিদেশের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আর এই ক্ষোভ, দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাহিত্যে। এর ফলে ‘জীবিত মুজিব’ অপেক্ষা ‘মৃত মুজিব’ রাজনীতিবিদের জন্য বিশেষ করে তাঁর আদর্শের অনুসারীদের জন্য যতটা উজ্জীবিত করে আন্দোলনে, সংগ্রামে, দেশ গঠনে, উন্নয়নে, জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে, ঠিক সমান চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সাহিত্যিকদের মধ্যেও। ‘আদর্শের যে মৃত্যু নেই’ এটা বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে প্রমাণিত।
নিজামুল ইসলাম সরফী
লেখক, সংগঠক, আয়কর আইনজীবী, চট্টগ্রাম