এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:০৬- আজ: সোমবার-২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:০৬- আজ: সোমবার
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

‘সোনার বাংলার’ সোনালী দিন

শাহানারা স্বপ্না

বলা হয়ে থাকে এককালে আমাদের এ দেশ ছিল ‘সোনার বাংলা’। ইতিহাসে আছে কি তার সোনালি প্রতিচ্ছবি? ইতিহাস মুছে ফেলে না কোন কিছুই। সেলুলয়েডের ফিতের মত মুড়ে কাল-গর্ভে জমা করে রাখে। সময়ের চিহ্ন ধরে চর্চা ও খোঁড়াখুঁড়ি করলেই বেরিয়ে আসে মাটির লুকানো মূল্যবান ধাতু সম্ভারের মত। জানার নির্ভেজাল উৎস হল  ইতিহাস, এজন্যই তা  কালের  দর্পণ। ইতিহাসের আলোয় খুঁজে ফিরি ‘সোনার বাংলার’ হারানো রূপ!

ইতিহাসের  দৃষ্টিতে  ‘সোনার বাংলা’:

’সোনার বাংলার’ উৎসের সন্ধান পেতে হলে শত শত বর্ষের যোজনব্যাপী পার হয়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের অন্ত:স্থলে, গভীর অর্ন্তমূলে। কাল পরিক্রমায় প্রাচীনকালের কথায়  সুলতানী ও মোগল যুগ সন্দর্শনে। কাল স্বাক্ষরিত ইতিহাসের আলেখ্য মতেÑ বাংলার সমৃদ্ধির ইতিহাস কিংবদন্তিকেও হার মানিয়েছিল। পরশপাথর স্বরূপ সেই সমৃদ্ধির ছোঁয়ায় নিজেদের ভাগ্য বদলাতে সারা বিশ্বের নানাদিক থেকে দলে দলে এসেছে এসেছে সেকালের ‘সোনার বাংলায়’।

 

 

এসেছে ইউরোপ, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের হাজারো দেশ থেকে। ’সোনর বাংল‘র নদীর কূলে কূলে ভিড় জমিয়েছিল আরব, পর্তুগিজ, ডাচ, ওলন্দাজ, ইংরেজ প্রভৃতি বণিকেরা। ’আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’ – এ প্রবাদ বাক্য  বাংলার জীবনে ফলেছিল অক্ষরে অক্ষরে! প্রাচীনকাল থেকে বাংলা ছিল ধন, সম্পদ, বিত্ত-বৈভব ও প্রাচুর্য্যে ভরপুর। বাংলা ছিল সুখ ও সমৃদ্ধির রাজ্য। এদেশের অজগ্র সুখ-সম্পদের কথা গল্পের মোড়কে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল রূপকথার মত। তখন বাংলার মানুষেরা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী, যারা পন্যের বিনিময়ে স্বর্ন-রূপা ছাড়া অন্য কিছুই নিতো না। প্রাচীন রোমানরা সমপরিমাণ ওজনের খাঁটি সোনার বিনিময়ে এই উপমহাদেশ থেকে খাঁটি রেশম কিনে নিয়ে যেতো বলে ইতিহাসের সূত্রে জানা যায়। নিজ চোখে সেই  ‘রূপকথার দেশ’ দেখার শখে ভ্রমণ করে গেছে  হাজারো পর্যটক। গল্পকথার কল্পদেশ  ভ্রমন শেষে ফিরে গিয়ে আশ্চর্য রমণীয় এ দেশের বর্ননা লিখে রেখেছেন তাদের লেখায়, আজ যা রূপকথার মতই শোনায়। তাইতো আমরা এখন জানতে পারছি,  এককালে  বাংলা কেমন সত্যিকারের ‘সোনার বাংলা‘ ছিল এবং তার  গৌরবও ছিল বিশ্বজুড়ে। ।

প্রাচীন যুগ : পূর্বকালের বঙ্গ গড়েছিল আদি দ্রাবিড় জাতি। কাল প্রবাহে তাদের সাথে সম্মিলন ঘটেছিল আরও অনেক জাতি-গোষ্ঠীর। সম্মিলিত সেই দ্রাবীড়িয়রাই ধীরে ধীরে সুসভ্য হয়েছিল, উন্নত সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়েছিল। তারা ছিল একান্তই শান্তিপ্রিয় ও কৌমপ্রিয় জাতি, যাদের উত্তরসূরী বাঙালি জাতি। এরাই গড়েছিল শৌয-বীর্যের গঙ্গারিডি রাষ্ট্র। শান্তি ও সুষ মার এক সমৃদ্ধশালী জনপদ। প্রাচীন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ, সোনারগাঁও, সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র, পু-্র, গৌড়, নবদ্বীপ, মুর্শিদাবাদ ছিলো বঙ্গ সীমানায় অর্ন্তভুক্ত। সুজলা সুফলা, শস্য শ্যামলা বঙ্গে প্রকৃতির দান ছিল অফুরন্ত। বাঙ্গলার  মঙ্গলকাব্যের কবি ভারতচন্দ্র সন্তানের মঙ্গল কামনায় অন্নপূর্ণার কাছে বর চেয়ে বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। জলে মাছ আর জমিনের  ফলে-ফসলে সুখী-সমৃদ্ধ ছিল বাঙালি জীবন, যুগে যুগে মাছে-ভাতে আর দুধে-ভাতেই থেকেছে। গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের দেশে খেতে বসে ‘ষোড়শ ব্যঞ্জ’নের ‘অষ্ট ব্যঞ্জন’ মাছের কথা ইতিহাসই বলছে, বলছেন প্রাচীন সাহিত্যিকরাও।  মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যেও রয়েছে বাঙালীর রসনা-বিলাসের প্রচুর তথ্য। কবি ঈশ্বরগুপ্ত লিখেছিলেন–” ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে  বাঙালী সকল,  ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল’।

 

সুলতানি যুগ:

বাংলার সাথে আরব বণিকদের বানিজ্য-যোগ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। ষষ্ঠ শতক থেকেই মুসলিম দরবেশ ও ইসলাম প্রচারকরা এদেশে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকেন। তাদেরকে খানকাকে এদেশের লোকেরা ‘যবন কেন্দ্র’ বলত- যেখানে সবাই একসঙ্গে খায়, প্রার্থনা করে। লখনৌতির শেষ রাজা লক্ষণ সেনের রাজদরবারেও তাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। লক্ষণ সেনের সভাপন্ডিত হলায়ূদ সেন সংস্কৃত ভাষায় ‘শেখ শুভোদয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন শেখ জালালুদ্দিন তাবরেজীর মৃত্যু এবং সুস্পষ্ট বর্ননা করেছেন মুসলমানদের আচার আচরন সম্পর্কে। গবেষক ড. এনামুল হক বলেছেন,-

‘শেখ শুভোদয়া’ গ্রন্থটি ১২০০ থেকে ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে লেখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন- ”  শেখ শুভোদয়া’ রচনার প্রায় চারিশত বৎসর পূর্ব হইতে বাংলার সহিত দরবেশদের পরিচয় ঘটে।” ২।

১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে  তুর্কী বীর ইখতিয়াউদ্দিন বখতিয়ার খলজী বাংলা জয় করেন। এরপর সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুসলিম শাসকেরা প্রায় আটশ’ বছর ধরে। তখন ভারত উপমহাদেশের ছিল স্বর্ণযুগ। বর্হিবিশ্বে ভারতের কদর ছিল আকাশচুম্বি। বিশ্বের সকল প্রান্তের লোকেরা চাকুরির জন্য ছুটে আসত এখানে। তখন  ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাই ছিল সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী।  দেশের অর্থনীতি চালিত হতো  ব্যবসা- বাণিজ্য থেকে। সুলতানি যুগে বাংলার ঐশ্বর্যের পাল্লা ভারী হতে থাকে। তেরো শতকে সুলতানী আমলে নগর শহরের পত্তন হয়। সেযুগে দাক্ষিণাত্যে দৌলতাবাদ  দিল্লির মতোই বড় শহর ছিল, রাজস্থানে যোধপুর শহর গড়ে উঠেছিল।  চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে পূর্ব আফ্রিকার সাথে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কের তথ্য ইবন বতুতা ও বারবোসার বিররণ থেকে জানা যায়।  মুলতান,

লাহোর, কারা, লক্ষ্মণাবতী ও খামবয়াত ইত্যাদি বড় বড় শহর , ইমারত ও সুদৃশ্য  প্রাসাদশ্রেণী  গড়ে উঠেছিল। এ সময়ে দিল্লির সুলতানগণ নানা রকম শিল্প, বাণিজ্য, জাহাজ এবং নৌশিল্পের প্রসার ঘটান।

”সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বাংলা প্রদেশের কমিউনিস্ট (সিপিএম)-দের ”ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ ধারা “ নামক একটি পুস্তিকায় সপ্তগ্রামসহ অন্যান্য বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যাতে বাংলার বানিজ্য ইতিহাস ধরা পড়ে : পর্তুগিজদের লেখা থেকে বাংলার বৈদেশিক বানিজ্যের উজ্জ্বল চিত্র পাওয়া যায়। সপ্তগ্রাম বন্দর থেকে বছরে পঞ্চাশটা জাহাজ চাল, কাপড়, চিনি ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে, মধ্যপ্রাচ্যে ও দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে যেত। বিনিময়ে আসত মসলা, ওয়ুধ, ও নানা ধরনের মণিমুক্তা। বাংলার বণিকদের নিজেদের জাহাজ ছিল। সুলতানরাও নিজেদের জাহাজে বানিজ্য করতেন। ৃ.গৌড়ের রাজদরবারে তুর্কি ও আরবী বণিকদের নাম পাওয়া যায়। পর্তুগিজ জোয়াঙ দ্য ব্যারোস বলছেন যে, বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্য গুজরাট ও বিজয় নগরের মিলিত বাণিজ্যের থেকে বেশি। এইসব পণ্য আসছিল বাংলার গ্রামাঞ্চল ও প্রধানত ভাগীরথীর পাড়ের ছোট্ট শহরগুলি থেকে।” ৩

 

মোগল যুগ:

পনের শতকে মোগল যুগে মহিমায় বিস্তার করে ভারতউপমহাদেশের  স্বর্নযুগ।  মোগল সম্রাটগন  শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বানিজ্য, বস্ত্রকেন্দ্র, চিত্র-স্থাপত্য, কাব্য-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে ভারতের ঐশ্বর্য-সুখ ও সমৃদ্ধিকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যান।  এ সময়ে বর্হিবিশ্বে সর্বক্ষেত্রে  ভারতের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।  বাদশাহদের পাল্লায় বসিয়ে ওজন করে মনি-মুক্তা বিলিয়ে দেয়া হতো, আমীর ওমরাহদের ঘরে গড়াগড়ি খেতো বহু মূল্যবান পাথর ও স্বর্ণ। বাংলার ঐশ্বর্য্য ও সমৃদ্ধি মোগল যুগে শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে মহীরুহে পরিণত হয়। তখনকার দরিদ্র লন্ডনের বৃটিশ লোকজনের মনে এমন বিশ্বাস ছিল যে, কোনো মতে একবার বাংলা মুলুকে পা রাখতে পারলেই কেল্লাফতে। বাংলার অজ¯্র সম্পদরাশি  তাদের চোখে জাগিয়ে তুলেছিল লালসার ঘোর। ষোড়শ শতকে আফ্রিকার সাথে ভারতের ব্যাপক বাণিজ্য সম্পর্কের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় বারবোসার বিবরণ থেকে। ওই সময় ক্যাম্বে থেকে ভারতীয় বস্তু ও মশলা বোঝাই জাহাজ আফ্রিকার মাকদাসাউ উপকূলে ভিড়ত। সেখান থেকে ওইসব জাহাজ দেশে ফিরত গজদন্ত ,মোম ও সোনা বোঝাই করে। আবদুল মওদুদ লিখেছেন- ”এডওয়ার্ড টেরি  বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের সময় ভারত ভ্রমণ করে বলেছেন- ‘নদীসমূহ যেমন সাগরে ছোটে, তেমনি স্বর্ণ-রৌপ্য সকল  দেশ থেকে এ রাজ্যে ছুটে আসে’। ফ্রান্সিস বার্নেয়ার  আরও তিন দশক পরে এ দেশ ভ্রমণ করে বলেছেন-’সোনা পৃথিবীর সব দেশ ঘুরে হিন্দুস্তানে এসে গ্রাস হয়ে যায়। ভারতের খ্যাতি কেবল চাউল, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রাচুর্যের জন্য নয়, রেশম, তুলা, নীল প্রভৃতি পণ্যের অপর্যাপ্ত সম্ভারের জন্যও বটে”। সতেরো শতকের পর্যটক ট্যাভারনিয়ার শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকায় বিশাল বিশাল জাহাজ তৈরি হতে দেখেছেন। তার বিবরণ থেকে জানা যায় সে যুগের জাহাজ শিল্পে বাংলা চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। পর্যটক নিকোলকন্টি বাংলায় এসে দেখেছেন বড় বড় জাহাজ তৈরি হতে। এসব জাহাজের কোন কোনটি বিশ থেকে পঁচিশ হাজার মণ মাল বয়ে নিত। তিনি ইউরোপে এত বড় জাহাজ কখনো দেখেননি বলে উল্লেখ করেছেন। বাদশাহ্ শাহজাহান, থেকে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সময়কাল  পর্যন্ত এ দেশের জাহাজ  ও নৌ শিল্পের উৎকর্ষতা প্রবাদে পরিনত হয়েছে। ‘সম্রাট শাহজাহান বলখের শাসনকর্তা নজর মুহাম্মদের নামে ১০৪২ হিজরী/ ১৬২১ খ্রীষ্টাব্দে এক পত্রে লিখেছেন-’বঙ্গের নৌপোতে সর্বক্ষণ এক হাজার যুদ্ধজাহাজ মজুদ থাকে, যার প্রত্যেক জাহাজে সত্তর-আশিজন নাবিকসহ তাতে বন্দুক, ছোট তোপ, গোলন্দাজ, তিরন্দাজে, শমশিরদার, বাদকদল, গুপ্তচর ও প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার আরও লোক থাকে। তাদের মোট সংখ্যা ৭০,০০০ হাজার। বাংলার কোষাগার থেকে যাদের প্রতিমাসে বেতন দেওয়া হয়। ৃ..দেশের পশ্চিমাঞ্চল সম্পর্কে আওরঙ্গজেব আমলের পর্যটক হেমিলটন লিখেছেন, বাদশাহর সামুদ্রিক যুদ্ধজাহাজগুলো ডান্দা রাজাপুরে অবস্থান করতে। যার প্রধান কমান্ডার ছিলেন সাইয়েদ খাঁ। চল্লিশ- পঞ্চাশ হাজার লোকের একটি নৌবাহিনী তার অধীনে মোতায়েন থাকত। সারা সমুদ্রোপকূল জুড়ে ( চার হাজার মাইল ব্যাপী ) হিন্দুস্তানের মালবাহী বড় বড় জাহাজ চলাচল করতে দেখা যেত।” ৫। জাহাজ নির্মানে বাংলার পর্যাপ্ত সেগুন গাছ ও অসংখ্য দক্ষ কারিগরের সমন্বয়ে দক্ষতার উচ্চশিখরে পৌঁছেছিল।  ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বানিজ্যিক কোম্পানিগুলো এদেশের জাহাজই অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিত। সাগরের বুকে ’সোনার বাংলার’  সওদাগরেরা জাহাজ বোঝাই মসলিন, রেশম, হীরা, কাগজ, লৌহশিল্প, সূতির গালিচা, লবণ, সোরা, লবঙ্গ, সুগন্ধি, এলাচ ইত্যাদি পন্যের সওদা নিয়ে দেশ-বিদেশের বন্দরে নোঙর করে ফিরতো। ষোড়শ শতকে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর ’চন্ডীকাব্যে’  লিখেছেন-

”এইসব শহরে যত সৈদাগর বৈসে ।

কত ডিঙ্গা লয়্যা তারা বানিজ্যায় আইসে।।

সপ্তগ্রামের বণিক কোথায় না যায়।

ঘরে বসে সুখ মোক্ষ নানা ধন পায় “। ৬।

বিশ্বের সব দেশের লোকদের কাছে  ঢাকার মসলিনই ছিল সেরা। ইউরোপীয় বণিকেরা  ঢাকা থেকে সরবতী, মলমল, অলবলি, তাঞ্জীব, তেরিন্দাম, নয়নসুখ, দুরিয়া, জামদানী প্রভৃতি মসলিন সংগ্রহ করত। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক  রকিব উদ্দিন লিখেছেন,-

-” বয়ন ও বস্ত্র শিল্পের জন্য ঢাকা জিলা বঙ্গের  শীর্ষস্থানীয় ছিল। প্রাচীন যুগে বেবিলনিয়া ও এশিয়ার চরম সভ্যতার দিনেও ঢাকাই মসলিন জগতের আদরনীয় হইয়াছিলÑ এই কথা ইউরোপীয় গ্রন্থকারগণ সানন্দে ম্বীকার করিয়াছেন। বাংলার শিল্প দ্রব্য প্রাচীন প্যালেস্টাইন বন্দরে প্রচুর পরিমানে রপ্তানী করা হইত। মসলিন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের অত্যন্ত প্রিয় বস্তু ছিল। এইজন্য দিল্লীশ্বর জাহাঙ্গীর মসলিন শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে অর্থ ব্যায় করিতেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাট আওরঙ্গজেবও মসলিনের উন্নতিকল্পে যথেষ্ট আয়াস স্বীকার করিয়াছিলেন। এমনকি  যাহাতে এই বস্ত্র বিদেশে না যাইতে পারে, এই জন্য রাজাদেশ প্রচার করিতেও কুন্ঠিত হন নাই। আরো দেখিতে পাওয়া যায় যে, মুসলমানদের আগমনের পূর্বে মুসলিন বস্ত্রের বিশেষ  কোন নির্দিষ্ট নাম ছিল না। তাঁহারাই বস্ত্রের সূক্ষèতা ও সৌন্দর্য্যানুসারে মসলিনকে ‘ঝুনা রং, সরকার আলী, খাসা, শবনম, আবরোচন, তরন্দাম, নয়নসুখ, বদনখান, সেরবন্দ, শরবতী, খানার দাশ, নন্দনশাহী, জামদানী, মলমলে খাস, জঙ্গলখান ইত্যাদি নামে অভিহিত করিয়াছেন”। ৭।

মোগল আমলে স্বর্ণ শিল্প অনন্য উচ্চতা লাভ করে। গহনা তৈরির ভারতীয় রীতির সঙ্গে মধ্য এশিয়া, পারস্য ও আরবীয় শিল্পশৈলীর সংযোগে এ শিল্পের অভাবনীয় উত্থান ঘটে। মোগল পৃষ্ঠপোষকতায় গহনার ‘এনামেলিং’ কৌশলটি ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। প্রচলিত রীতি-কৌশলের উন্নয়ন ছাড়াও তখন গহনা তৈরির বহু নতুন কৌশল উদ্ভাবিত হয়।‘কুন্দন’ তথা খাঁটি স্বর্ণে পাথর স্থাপনের নকশাটিও মোগল আমলে প্রসার পায়। পাথর খোদাই করে তাতে স্বর্ণ বসানোর রীতিটিও মোগলদের অবদান।

’জাদাউ’ পদ্ধতিতে নির্ধারিত ছাঁচে গলিত স্বর্ণ ঢালা এবং পরে তাতে রতœ যুক্ত করে পলিস করা গহনার কদর ছিল বেশী। । বহুল জনপ্রিয় ‘মিনাকারি’র কাজ ও ‘করনফুল ঝুমকা’রও ব্যাপক প্রচলন ঘটে মোগল আমলে।

সেকালের  সোনার বাংলার মানুষের প্রকৃতি :

সুখ-সমৃদ্ধির দেশের লোকদের মতই বাংলার মানুষেরা ছিল  খাঁটি মানুষ।  শতশত বছর ধরে বাংলার মানুষেরা সুখে সম্পদে থাকার ফলে তাদের চরিত্রে যাবতীয় সৎগুনাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল।  বাংলা মুলুকের প্রশস্তি গেয়েছেন সেকালের সমস্ত মানুষ। এখানকার  মানুষের ধর্মানুরাগ ও নৈতিক চরিত্রের প্রশংসা করেছেন এদেশ ভ্রমণে আসা বিদেশি পর্যটকগন। সুখী বাংলার সোনার  মানুষদের প্রকৃতি প্রসঙ্গে  ড. এম এ রহিম উল্লেখ করেছেন-”বাংলার মুসলমানদের কথা লিখতে গিয়ে পঞ্চদশ শতকের প্রথম পাদের  চৈনিক দূত মাহুয়ান বলেন- ‘তাদের আচার আচরনে তারা ছিলেন সহজ সরল’। অন্য একজন চৈনিক দূত সি, ইয়ং চাও কুঙতিয়েন লিখেছেন যে, ‘ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত গভীর ধর্মীয় অনুভূতি এবং সততা ও সরলতা প্রভৃতি গুণাবলী বাংলার মুসলমান সমাজের বৈশিষ্ট্য ছিল।  ৮।  কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম সেকালের সরল ও সততাপুর্ন মুসলমানদের নিখুঁত ছবি একেঁছেন তাঁর কাব্যে-

“ফজরের সময়ে উঠি      বিছায়ে লোহিত পাটি

পাঁচ বেড়ি করয়ে নামাজ”।ৃ

“বড়ই দানিশমন্দ     না জানে কপট ছন্দ

প্রান গেলে রোজা নাহি ছাড়ে।” – ( মুকুন্দরাম চক্রবর্তী- চন্ডীমঙ্গল ) ৯।

সমৃদ্ধ সোনার বাংলা:

সুলতানি ও মোগল আমলে শিল্প বানিজ্যের প্রসারের ফলে জনজীবনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। বাংলার আভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও বাজারে  একচেটিয়া স্বাধীনতা ছিল ব্যবসায়ীদের।  শিল্পী ও কারিগরেরা স্বাধীনভাবে তাঁদের পণ্য উৎপাদন করতে পারতেন, এবং সেই উৎপন্ন পণ্যগুলিকে তাঁরা স্বাধীনভাবে বিক্রিও করতে পারতেন। বাংলার নবাবেরা শিল্পোৎপাদনে এবং আভ্যন্তরীণ বাজারে তাঁদের সেই স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছিলেন। সেজন্যই  ব্যাবসা বানিজ্যে বিপুল প্রসার হতে বাধা পায়নি। বাংলার বৃহৎ জাহাজ, মসলিন, রেশম, লবন, সোরা, সূতি কাপড়, সুগন্ধি, লোহর অস্ত্র, চিনি, কাগজ, প্রশিক্ষিত যুদ্ধহাতি, স্বর্ণগহনা ইত্যাদি অর্থকরি পন্য প্রচুর পরিমাণে বাইরে রপ্তানি হতো। আভ্যন্তরীণভাবেও  সোনা, রূপো ও হাতির দাঁতের কাজ, শাঁখার, পিতল, কাঁসা ও ভরণের কাজ, লোহা ও কাঠের কাজ, বাঁশ ও বেতের কাজে বাংলার প্রতিটি গ্রামে দক্ষতার সাথে বোনা হত। বাংলার গ্রামীন সমাজের আর্থিক ভিত্তি মজবুত বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।  এ  যুগে বাংলায় বসবাসকারী বিদেশি বণিক, পর্যটক, পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে সবাই  তাঁদের লেখায় বাংলার অসংখ্য কারুকাজম-িত হস্তশিল্পের কথা উল্লেখ করেছেন।   নারায়নগঞ্জ, ঢাকা,  মুর্শিদাবাদ, বাঁকুডা ও বীরভূম পিতল কাঁসার কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। বাংলার কারিগর ও হস্তশিল্পীরা এক একটি বিশেষ কাজে বংশপরস্পরায় নিযুক্ত থাকতেন। সেজন্য তাঁদের তৈরি করা সামগ্রী অত্যন্ত উন্নত মানের হত।

উপসংহার: বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশের শিল্প সুষমা, পাঠাভ্যাস, নন্দন সৌন্দর্য, , সভ্যতা, ঐতিহ্য  শিক্ষা, সুরুচি ও সংস্কৃতির প্রথম আধুনিক ও বিশ্বজনীন প্রকাশ ঘটেছিল  মুঘল আমলে।  অজ¯্র কৃষিপণ্য, দেশজ কুটিরশিল্প সম্ভার, স্বয়ংসম্পূর্ণ   শিল্পবাণিজ্যে মিলে রচনা করেছিল সুখ- সমৃদ্ধির ‘সোনার বাংলা’। মোগল যুগে  মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে ভারতীয় অলংকারের কদর ছিল শীর্ষ পর্যায়ে। একটা প্রশস্ত, সমৃদ্ধ, সুবিন্যস্ত  ও সুবিস্তৃত অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের সুদৃঢ প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠেছিল।  এইসব  ব্যবসা বাণিজ্যে বাংলাদেশে প্রচুর অর্থাগম হতো।  জৌলুষপুর্ন  জীবন-যাপনের  অধিকারী ছিল বাংলার লোকেরা। ‘পর্যটক থার্নটন তার ভ্রমন কাহিনীতে লিখেছেন-

”হিন্দুস্তান সমৃদ্ধি ও পুর্ণতার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত ছিল এবং সম্পদের বিঝানায় বসবাস করছিল। এখানকার জমি খুবই উর্বর; তাতে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হতো। এখানকার বাগানগুলোতেও অনেক সুস্বাদু ফল-ফলাদি উৎপন্ন হতো। হিন্দুস্তানে প্রচুর দক্ষ ও যোগ্য কারিগর ছিল। যারা এখানকার কাঁচামাল থেকে এত সুন্দর ও এমন সুক্ষ্ণ জিনিস তৈরি করত, বিশ্বজোড়া যেগুলোর ছিল বিপুল চাহিদা। পাশ্চাত্য-প্রাচ্যের  সব দেশেই বিপুল আগ্রহে সেগুলো কেনা হত। হিন্দুস্তানের সূতা-কাপড় এত উন্নত ও পাতলা, এত দামি ও সুন্দর ছিল, পৃথিবীর কোথাও এর চেয়ে উন্নত কাপড় তৈরি সম্ভব ছিল না” ১০।

মুসলিম শাসনের প্রায় আটশ’ যুগ ধরে গড়ে উঠেছিল- ‘সোনার বাংলা- যার স্মৃতি আজ  ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে।

 

তথ্যসূচি :

 

২.  ড. মুহম্মদ এনামুল হক – মুসলিম বাংলা সাহিত্য, পৃষ্ঠা- ২৬,

মাওলা ব্রাদার্স -১৯৯৮।

৩. ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ ধারা, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি

(মার্কসবাদী ), পৃষ্ঠা- ৩৫,  পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি, ন্যশনাল বুক

এজেন্সি, কলকাতা-২০১৫ সংস্করণ। ( উদ্ধৃতি-  ড. মোহাম্মদ

হান্নান প্রাচীন বাংলায় মুসলিম আগম ‘, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৭২ )।

৪.  আবদুল মওদুদ – মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রূপান্তর,

পৃষ্ঠা- ৩৪, মওলা ব্রাদার্স-।

৫. মনযূর আহমাদ – ’সিন্ধু থেকে বঙ্গ’, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ৪৮১, ৪৮২।

৬. মুকুন্দরাম চক্রবর্তী   –   চন্ডীমঙ্গল ।

৭. রকীব উদ্দিন আহমদ – ‘বাংলার লুপ্ত শিল্প’। মুসলিম সাহিত্য

সমাজের মুখপত্র (বার্ষিকী )-  ‘শিখা’, ২য় বর্ষ, পৃষ্ঠা-২০২

(শিখা সমগ্র -১৯২৭- ১৯৩১ ) সংকলন ও সম্পাদনা- মুস্তফা

নুরুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, জুন-২০০৩ )।

৮.  ড. এম এ রহিম- বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস,

(১৫৭৬-১৭৫৭ ), ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭৩, ১৭৮,  অনুবাদ : মো:

আসাদুজ্জামান ও ফজলে রাব্বি, প্রকাশক- বাংলা একাডেমি-১৯৯৬।

৯  মুকুন্দরাম চক্রবর্তী- চন্ডীমঙ্গল।

১০. সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী, ভাষান্তর : ইমতিয়াজ বুরহান

‘হিন্দুস্তান:  ব্রিটিশ আগ্রাসনের আগে  ও পরে, প্রকাশনা’ –

বাতায়ন,  পৃষ্ঠা-১৫।

 

 

শাহানারা স্বপ্না, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না

শোয়েব নাঈম শব্দের মধ্যেই থাকে জীবনের আসল দর্শন। শব্দের কারণেই মানুষ হয় নির্বাসিত। এখন মঙ্গলের অমরতায় ঘামছে গ্রীষ্মের বৈশাখ মাস। মঙ্গল এই শব্দবোধে যতটা কল্যাণ

চীনের মতো আমাদেরও ভাবা উচিত

আমির হোসেন চীনে ফেসবুক, ই’নস্টাগ্রা’ম, ইউটিউব, গুগল, গুগল ম্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপ, এমনকি ক্রোম ব্রাউজারও ব্যান! শুরুতে শুনে বিরক্ত লাগলেও এখন বুঝতে পারছি- ওরা আসলে অনেক আগেই

গল্পশূন্য জীবনের ইতিকথা

আন্দরকিল্লা ডেক্স : আমাদের পূর্বপুরুষরা কৃষক ছিলেন, শ্রমিক ছিলেন। থাকতেন মাটির কাঁচা ঘরে। অর্থাভাবে-অন্নাভাবে কখনও-সখনও উপোসও করতেন। পরতেন মলিন পোশাকপরিচ্ছদ। আমাদের বাবারা চাইলেন আমরাও যেন

সংস্কার চাই : চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন

নিখিল রঞ্জন দাশ সম্প্রতি চট্টগ্রাম এম.এ. আজিজ স্টেডিয়ামকে আগামী ২৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারশনকে দেয়া হবে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজনে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের ৬০

চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার ঝড় তুলল মৈত্রেয়ীর জীবনে “মির্চা, মির্চা আই হ্যাভ টোল্ড মাই মাদার দ্যাট ইউ হ্যাভ কিসড মাই ফোরহেড'”

নহন্যতে উপন্যাসে মৈত্রেয়ী দেবীর এই উক্তি টি অবশ্যই পাঠকদের মনে আছে? মির্চা এলিয়াদ আর মৈত্রেয়ী দেবীর প্রেম কি শুধুই প্রেম ছিল নাকি সেই সাথে কিছু