অজয় দাশগুপ্ত : বিষয়টা এমন হয়ে গেছে দেখবেন শুনবেন মানবেন কিন্তু বলতে পারবেন না। বলতে গেলেই নানা বিপদ। কথা হচ্ছে যদি বলার মতো কিছু না হতো কে বলতো? কা’রা বলতো? বলছি রাজনীতিহীন সমাজের রাজনৈতিক হালচালের কথা। এখন যারা ভোটে দাঁড়ান বিশেষত সরকারি দলের হয়ে তাদের জীবনে পরাজয় বলে কিছু নাই। যেভাবেই হোক জিতে বেরিয়ে আসে তারা। এই জয় কতটা ন্যায্য আর কতোটা গ্রহণযোগ্য তা জানলেও বলা যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। এটা তাঁর দুশমনেরাও স্বীকার করেন। বঙ্গবন্ধু আজীবন যে সংগ্রাম করে গেছেন তার মূল স্তম্ভ গণতন্ত্র। সে গণতন্ত্র কতোটা আছে বা নাই সে প্রশ্ন ও তোলা যায় না। সংবাদ পত্র কিংবা মিডিয়ার কাজ হচ্ছে সত্য কে সত্য হিসেবে তুলে ধরা। এই তুলে ধরার কাজটি কতোভাবে ব্যাহত হচ্ছে তার হিসেব কি আমরা রাখি ? এই যে কথায় কথায় বলছি শ্রীলংকা হবে না সেটা কিসের জোরে? বলে রাখা ভালো বাংলাদেশ শ্রীলংকা হবে এমন ভাবি না। তবে দু;স্বপ্ন বাস্তবতার চাইতেও ভয়ংকর। রাজা পাকসের পরিবার সে দেশটিতে জাঁকিয়ে বসেছিল। তামিল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার পরে খৃস্টান এবং মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন করে সে দেশে সিংহলিজদের একক আধিপত্য কায়েমের সময়কালে রাজাপাকসেরা ছিলেন পপুলার। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদের এটাই ধারা। একসময় হিটলার ও সাংঘাতিক পপুলার ছিলেন। কিন্তু আখেরে কী হলো? আজ প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে কূল পাচ্ছেন না। জনরোষে ছাই হয়ে গেছে তাদের বাড়িঘর।
বাংলাদেশে সে পরিস্থিতি তৈরী করার মো শক্তি ওৎ পেতে আছে। তারা দেশেবিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। দেশের চাইতেও বিদেশে এদের দাপট আর লম্ফনের কারণ এখানে দেশের আইন বা পুলিশ নাই। কিন্তু সবসময় আইন আর পুলিশের দরকার পড়বে কেন? রাজনীতি যদি সুষ্ঠুধারায় চলে এবং জনগণের মনের কথা বুঝতে পারে সমস্যা হবার তো কথা না। শেখ হাসিনার পপুলারিটি আর ইমেজের তলায় চাপা পড়া সরকারের বাকিরা কী করছেন ? জনগণের দোরগোড়ায় যারা তাদের কথা আসবে সবার আগে। তারা কি আসলেই জনগণের মনের ভাষা পড়তে পারেন? ইউনিয়ন লেভেলের কথা না হয় বাদ ই দিলাম। যখন মেয়রের মতো গুরুত্বপুর্ণ পদগুলো সামনে আসে তখন নিশ্চয় ই জনগণ এমন প্রার্থী চায় যার ইমেজ হবে ক্লিন। কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোন দল আছে যারা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন তাদের সব নেতা বা প্রার্থীর ইমেজ ক্লিন? সেটা যদি না পারেন প্রশ্নকে ভয় পাওয়া কেন? খবরে দেখলাম মাদক সংক্রান্ত খবর ছাপার পর ভোরের কাগজের বিরুদ্ধে আসন্ন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশান নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দশ কোটি টাকার মানহানি মামলা ঠুকেছেন। এটা তিনি করতেই পারেন। কিন্তু এই মামলা ঠুকলেই কি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমানিত হয়ে যাবে ? কারণ এই মানুষটির বিরুদ্ধে অভিযোগ এর আগেও হয়েছে। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের যে তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল তাতে তার নাম ছিলো। আর নিশ্চয় ই সে তালিকা কোন সংবাদপত্র বা মিডিয়া করে নি। তাহলে বিচার চাওয়াটা খালি মিডিয়ার বিরুদ্ধে কেন?
এট বলা যায় যে এতে প্রার্থীর হয়তো কিছুই হবে না। কারণ ভোট ভৌট গণনা বা রেজাল্ট বিষয়গুলো কীভাবে হয় বা কা’রা করেন তার ওপর অনেক কিছু নির্ভরশীল। আপাতত: আমরা যা দেখছি সহজ টার্গেট হলো মিডিয়া। এর কারণ বোঝা কঠিন কিছু না। মানুষের মুখ নানা কারণে বন্ধ। মানুষের মনে চাপের অন্ত নেই। গত কিছু মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে আর অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্মমধ্যবিত্তের অবস্থা জটিল। দেশে কথা হলেই বুঝতে পারি হাল হকিকত আর বাইরের চিত্র এক না। হিমশিম খাওয়া মানুষের ঘাড়ে দুটি মাথা নেই যে মুখ খুলবে। যা অল্প বিস্তর বলে তা মিডিয়াই বলে। এখন ছলে বলে কৌশলে যদি তাদের মুখ বন্ধ করা যায় তো তাহলেই রাস্তা পরিষ্কার। আমরা যেমন জানি মাদক চোরাচালান বা অবৈধ আয়ের কথা শীর্ষ নেতারা ও জানেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদের সাহেব ক দিন আগেই বলেছিলেন এদের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান সুস্পষ্ট। যদিও ইয়াবা বদি নামের একজন সে কবে থেকে বহাল তবিয়তে আছে এবং থাকবে।
বলছিলাম শ্রীলংকার কথা। যারা ভাবছেন সেদেশে শুধু অভাব আর নীতিহীনতার কারণে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তারা ভুল ভাবছেন। এর পেছনে সামাজিক অসন্তোষও একটা বড় কারণ। খবরে নিশ্চয়ই দেখেছেন মাহিন্দা রাজাপাকসের লোকজন মাঠে নামার চেষ্টা করেছি। ঠিক এরশাদ আমলের মতো। সেসব ভাড়াটিবা বাহিনী টেকেনি। তারা মার খেয়ে পালিয়েছে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। আজকে বাংলাদেশের যে সব ঘটনা দেশ বিদেশ তোলপাড় করে তোলে তার বেশীর ভাগই কিন্তু টাকা পাচার মাদক ব্যবসা আর নারী সংক্রান্ত। এই তিনটির একটিও দাপটহীন কোন ব্যক্তি করতে পারে না।
যারা করে তারা হয় নেতা নয়তো নেতার আর্শীবাদপুষ্ট। এই সত্যটা জানার পরও আমরা যাদের মামলা বা হামলা দিয়ে জোর খাটিয়ে নিজের সাধুতা প্রমাণ করতে দেখি তাদের জন্য আজ কেউ কেউ বিপদ পড়লেও একদিন দলই হয়তো পড়বে ঘোর বিপদে।
আমরা বিশ্বাস করি এবং করবো জনগণের চাইতে বড় কোন উৎস নাই। জনগণ আওয়ামী লীগের ভিত্তি ছিল এবং থাকবে। সে জায়গাটা যারা নষ্ট করেছে তাদের কী হাল সেটা বিএনপিকে দেখলেই বোঝা সম্ভব। আজকাল তাদের সিনিয়র নেতাদের কথা শুনলে মনে হবে পাগলের প্রলাপ। ভালো করে খেয়াল করলে বুঝবেন দীর্ঘকাল রাজপথহীন ক্ষমতাহীন থাকাতেই তাদের অনেকের মানসিক বা স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটা সরকারি দলের বেলায়ও প্রযোজ্য। বলাবাহুল্য এর কারণ জনবিচ্ছিনতা আর ওভার প্রাউড। এই দম্ভ কোন কালে কারো মঙ্গল ডেকে আনতে পারে নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো কোন জাতি বোবা কালা বা অন্ধ হয়ে বাঁচতে পারে না। উন্নতিও করতে পারে না। তাই সুষম বিকাশ আর উন্নয়ন টেকার জন্য এখন থেকে বলা কম, হজম শক্তি বেশির দিকে মনযোগী হওয়া উচিৎ। একই সাথে কিছু বললেই মামলা হামলার দিকে মনযোগী হবারও দরকার নাই। বরং জনগণকে সাথে রাখলে তারাই বলে দিবে কোনটা সাদা কোনটা কালো।
মিডিয়ার স্বাধীনতায় দেশ ও সমাজ নিরাপদ এই সত্য মানতেই হবে।
অজয় দাশগুপ্ত : সিডনী প্রবাসী, লেখক কলামিস্ট ও বিশ্লেষক