আলম খোরশেদ :
তাঁর কথা প্রথম শুনি স্বয়ং পিতৃদেবের মুখে। একই এলাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ দুজনেই, তদুপরি লতায় পাতায় কীরকম যেন আত্মীয়ও। এই নিয়ে একধরনের চাপা গর্বও ছিল তাঁর মনে। আমার কৈশোরেই একজন মেধাবী সিএসপি অফিসার ও জাঁদরেল আমলা হিসেবে দেশময় হাসনাত আবদুল হাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। পিতার হয়ত অবচেতন ইচ্ছে ছিল পুত্রও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করুক, তাই সুযোগ পেলেই অবরে-সবরে তাঁর কীর্তি ও যশের কথা পাড়তেন আমার কাছে। পিতার মুখে এসব শুনে শুনেই কিনা জানি না, উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে আমি প্রথমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্র আর ইংরেজি সাহিত্যকে বেছে নিই, যার মধ্যে প্রথমটি ছিল হাসনাত আবদুল হাইয়ের নিজেরই অধীত বিষয়। পরে অবশ্য পরিবারের চাপে অর্থনীতি না পড়ে ভর্তি হতে হলো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, একেবারে বিপরীত মেরুর বিষয় যন্ত্রকৌশলে। ততদিনে সাহিত্যের ভূতটা মাথায় ভালোভাবেই চেপে বসে গেছে। তাই শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যবিষয় শিকেয় তুলে নিজেই যখন একপর্যায়ে সাহিত্যের পিচ্ছিল বারান্দায় পা রাখলাম, তখন জানতে পেলাম হাসনাত আবদুল
হাই শুধুমাত্র দক্ষ আমলা কিংবা অর্থনীতিবিদই নন, একজন বিখ্যাত, বহুমুখী লেখকও বটেন। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি মিলে তখনই তাঁর বেশ ক’টা বই বেরিয়ে গেছে। ফলে দ্রুতই তিনি যেন আমার একরকম আত্মার আত্মীয়ও হয়ে উঠলেন।
১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে, চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে এসে, একবার স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমিতে কী একটা অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল, ঠিক মঞ্চের সামনেই তাঁর নাম উৎকীর্ণ রয়েছে, এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী হিসাবে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক থাকাকালীন মূলত তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় এই শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনখানি। এই সংবাদে তাঁর প্রতি আমার আগ্রহের পারদ একলাফে একেবারে শীর্ষে পৌঁছুল। এর কয়েকবছর পরই জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার ইদসংখ্যায় তাঁর সুবিখ্যাত সুলতান উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়ে দেশব্যাপী হৈচৈ ফেলে দিল। আমি তখন উচ্চশিক্ষার্থে প্রবাসী, থাকি বিশ্বশিল্পের রাজধানী নিউ ইয়র্ক শহরে। তাই পত্রিকাটি সংগ্রহ করে উপন্যাসখানি পাঠ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। সত্যি বলতে কী, এর আগে বাংলার বিখ্যাত চিত্রকর লাল মিয়া তথা এস এম সুলতান সম্পর্কে সামান্য কিছু গল্পগাছা শুনেছিলাম মাত্র, সম্প্রতি প্রয়াত আমার এক প্রিয় কলেজশিক্ষকের কাছে। আর জানতাম, আমাদের চলচ্চিত্রকার বন্ধু তারেক মাসুদ অনেকদিন ধরে লেগে আছে এই সুলতানের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজে। হাসনাত আবদুল হাইয়ের অত্যন্ত আকর্ষণীয়, আদ্যন্ত সুখপাঠ্য উপন্যাসটি পড়েই সুলতানের বিচিত্র, বিস্ময়কর শিল্পীজীবন ও শিল্পভাবনার সঙ্গে বিশদ পরিচয় লাভের সুযোগ হয় আর সবার মতো আমারও।
কাকতালীয়ভাবে এর কয়েকমাস বাদেই তারেক মাসুদ তার সম্প্রতি-পরিণীতা মার্কিন জীবনসঙ্গিনী ক্যাথরিনকে নিয়ে নিউ ইয়র্কে এসে হাজির, সঙ্গে তার সদ্য শেষ-করা দীর্ঘপ্রতীক্ষিত সেই ছবিখানি: আদমসুরত। নিউ ইয়র্কে আমার তৎকালীন সহ-আবাসিক, অগ্রজপ্রতিম বন্ধু সলিমুল্লাহ খান তখন ঝটপট তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর একটি কক্ষে ছবিটির প্রদর্শনীর আয়োজন করে ফেলেন। সেই প্রদর্শনীতে শহরের দেশোয়ালি সংস্কৃতিজনদের বেশকিছু চেনামুখ, যেমন সাহিত্যিক দম্পতি জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত-পূরবী বসু, নাট্যজন মুজিব বিন হক, আলোকচিত্রী নাসির আলি মামুন, চলচ্চিত্রকর্মী মাহমুদ হক, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর গবেষক মাসুদ হাসান টিঙ্কুসহ আরও অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন মনে আছে। আমার স্মৃতিতে হাসনাত আবদুল হাইয়ের সুলতান উপন্যাসটি পাঠের ঘোর ও অভিঘাত তখনও তরতাজা, তাই তারেকের ছবিটি যেন আরও বেশি করে ভালো লেগেছিল সেদিন, এতটাই যে, আমি এর কিছুদিনের মধ্যেই আদম সুরত: দিকনির্দেশনার চলচ্চিত্র নামে একখানা নাতিদীর্ঘ আলোচনাই লিখে ফেলেছিলাম তার, দেশের কোনো একটি কাগজে যেটি ছাপা হয় অচিরেই। তো, এরপর থেকে প্রবাসে বসেই তাঁর যখন যে বই বা লেখা পাওয়া যেত, পড়েছি গোগ্রাসে। বিশেষ করে মনে পড়ে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত দুর্দান্ত ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনী আন্দালুসিয়া এবং অবশ্যই ১৯৯৫ সালে সেই একই ইদ সংখ্যা বিচিত্রাতেই আবার প্রকাশিত তাঁর আরেক শিহরন-জাগানো জীবনী-উপন্যাস নভেরার কথা।
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, দেশের ও কলকাতার অনেক তাবড় তাবড় লেখক-শিল্পীর সঙ্গে ততদিনে আমার চেনাজানা ও ঘনিষ্ঠতা হলেও, এহেন আত্মার আত্মীয় হাসনাত আবদুল হাইয়ের সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেখা হল মাত্র বছর চারেক আগে, চট্টগ্রামের একুশে বইমেলাতে, একটি সাহিত্যসভায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে, একেবারে একই মঞ্চের মাঝখানে। সেদিন তিনি অনুষ্ঠানের পর আমাদের শিল্পকেন্দ্র বিস্তার পরিদর্শনে আসেন আমার সঙ্গে এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেন আমাদের প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তনের ইতিহাস, বর্তমানের যাবতীয় কর্মকা- ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন-পরিকল্পনার কথা, এবং সেগুলো টুকেও নেন তাঁর নোটবইয়ে। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তিনি একজন বিরল ব্যতিক্রমী মানব যিনি কেবল দক্ষ প্রশাসকই নন, দরদি মনের অধিকারী একনিষ্ঠ শিল্পপ্রেমিকও বটে, যাঁর রয়েছে জীবন ও জগতের প্রতি প্রগাঢ় কৌতূহল এবং সর্বোপরি দেশ, সমাজ ও মানুষের প্রতি দুর্নিবার দায়। সেই ধারণাটিই আরও পাকাপোক্ত হল, এর পরের বছর বইমেলা চলাকালীন একটি সকাল ধানমন্ডির সুসজ্জিত গৃহাভ্যন্তরে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত, শিল্পিত সান্নিধ্যে বেশ কিছুটা সময় সস্ত্রীক কাটিয়ে এসে। বহুবছর বিদেশে কাটানোর ফলে এবং আমার বিশেষ আগ্রহের কারণে সেখানে ক’জন ভিনদেশি শিল্পী,
সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর বাড়িতে যাওয়ার এবং তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে দেখেছি তাঁদের বসতঘর আর কাজের গোটা পরিম-লটি কীরকম বই, শিল্পকর্ম, ব্যতিক্রমী আসবাব, দুর্লভ কারু-ঐশ্বর্যে সাজানো আর সুরুচির ¯িœগ্ধতায় ঘেরা থাকে প্রায়শই। অনেকদিন পর হাসনাত আবদুল হাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ঠিক যেন সেই অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিটিই হল আমার। তিনতলার বিশাল, সুপরিসর ফ্ল্যাটের প্রায় পুরোটাই বইয়ে ঠাসা; দেয়ালগুলো সব বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্মে শোভিত; সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যময় আসবাবপত্র আর দেশবিদেশ থেকে সংগৃহীত নানাবিধ মূল্যবান কারুশিল্পের ঐশ্বর্যময় উপস্থিতিতে ঋদ্ধ! আর এই অনুপম সা¤্রাজ্যে একাই রাজত্ব করেন এক অশীতিপর সাহিত্য ও শিল্পের স¤্রাট, হাসনাত আবদুল হাই যাঁর নাম।
তাঁর জন্য নিজের একটি অনুবাদগ্রন্থ উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটি তিনি আগ্রহভরে দেখলেন, সেটা নিয়ে সোৎসাহে আলোচনা করলেন, গোটা বাড়ি ঘুরিয়ে তাঁর বইয়ের বিপুল ও সমৃদ্ধ সংগ্রহ দেখালেন, নিজের সাম্প্রতিক কিছু গ্রন্থ নিয়ে কথা বললেন; শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর লেখা বিশালায়তন একটি মহাগ্রন্থ দেখে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ি! এরই মধ্যে তিনি ঘরের এক কোনায় রক্ষিত কফিমেশিনে নিজেই কফি বানিয়ে এনে আমাদের দিলেন, তার সঙ্গে যুক্ত হল অন্তঃপুর থেকে আগত সুস্বাদু জলখাবার। একপর্যায়ে তিনি তাঁর সংগ্রহের শিল্পকর্মগুলো ঘুরিয়ে দেখালেন এবং আক্ষেপ করে জানালেন, কিছুদিন পূর্বে কর্কটরোগে প্রয়াত তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে অধিকাংশ চিত্রকর্মই বিক্রি করে দিতে হয়েছে সস্তায়। বিদায় নিয়ে আসার সময় তিনি তাঁর নিজের লেখা বেশ কিছু বই তো উপহার দিলেনই, সঙ্গে সুদূর চিলে থেকে আনা এবং খোদ পাবলো নেরুদার বাড়ি থেকে কেনা, বাঁধাই করা কবির প্রতিকৃতিশোভিত একটি মূল্যবান পোস্টারও দিলেন আমাদের শিল্পকেন্দ্র বিস্তার-এর জন্য।
হাসনাত আবদুল হাইয়ের আরেকটি বড় গুণ, তিনি বয়সের তাছে পরাস্ত হতে রাজি নন মোটেও। তাই এই ছিয়াশি বছর বয়সেও সমান সচল, সক্রিয় এবং উৎসুক। আমাদের বয়েসীদের মধ্যেও অনেকে যেখানে একালের প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে না পেরে পিছিয়ে পড়ছেন ক্রমাগত, সেখানে হাসনাত হাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে নিয়ত হালনাগাদ করে চলেছেন। কম্প্যুটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সবকিছুতেই তিনি সমান তৎপর, এতটাই যে, এমনকী ফেসবুকিংয়েও তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলাটা ঠিক সহজ নয়। প্রায় প্রতিদিনই তিনি কোনো না কোনো স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন তাঁর ব্যক্তিগত দেয়ালে; কখনো বিশ্বের ব্যতিক্রমী উপন্যাসরাজি নিয়ে, কখনোবা বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে, আবার কখনো বিশ্বরাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ; আর কিছু না হোক বিভিন্ন তরুণ লেখক-কবি তাঁকে যেসব বই উপহার দেন, তিনি সেগুলো খুঁটিয়ে পড়ে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে জানান অন্তত। সেদিন আমার দেওয়া বইখানারও একটি আন্তরিক পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে যথারীতি পোস্ট করেছিলেন তিনি অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই।
তারপর তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল, করোনাকালে, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে, বলাইবাহুল্য অনলাইনে, আমাদের বিস্তার আয়োজিত এবং এই লেখকের উপস্থাপনায় সাহিত্যালাপের আসর পা-ুলিপি করে আয়োজন এর দ্বিতীয় পর্বে। আমাদের এই অনুষ্ঠানটি হত জনপ্রিয় ভিডিও মিটিং প্রোগ্রাম জুম এর প্লাটফর্মে। তাঁর চেয়ে তরুণতর অনেকেই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে সাহসী ও সক্ষম না বলে আমাদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের প্রস্তাব এড়িয়ে গেছেন সভয়ে, কিন্তু তিনি সেটি লুফে নেন এবং দিব্যি ভালোমতন হোমওয়ার্ক করে অনুষ্ঠানের দিন নির্ভুলভাবে হাজির হন আমার কম্প্যুটারের পর্দায়। সেদিন অনেক কথার এক ফাঁকে তিনি তাঁর দুয়েকটি স্বপ্নের কথাও বলেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল সংগীত ও নাটকের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে দুখানি গ্রন্থ রচনার; আরেকটি ছিল তাঁর আত্মজীবনীর বাকি খ-গুলো দ্রুত শেষ করার, তবে তা বাংলা ভাষায়, প্রথম দুটি খ-ের মতো ইংরেজিতে নয়। আমরাও চাই তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ হোক শুভস্য শীঘ্রম। সেই সঙ্গে আরও চাই, তিনি, হাসনাত আবদুল হাই, একজন যথার্থ রেনেসাঁস-পুরুষ, শতায়ু হোন, এবং তাঁর স্বর্ণপ্রসূ লেখনীর স্বর্ণাভ ফসলে আমাদের সাহিত্যের গোলাঘরখানি ভরে তুলুন কানায় কানায়।
আলম খোরশেদ: অনুবাদক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক