আ.ম.ম. মামুন : উন্মেষপর্বের উন্মথিত নান্দনিক বিভূতিকে স্বাগত জানিয়ে নয়, যে সময়টা আামদের ইতিহাসে সবচেয়ে আশ্চর্যের, যুগপৎ সুসময় ও দুঃসময়ের, সেই উত্তেজনাময়, স্বপ্নময় সৃষ্টিচঞ্চল দিনগুলোকে অনিবার্য অনুষঙ্গ করে যে কবির সচকিত উত্থান শিহরণ তুলেছিলো সর্বত্র, তিনি হেলাল হাফিজ (১৯৪৮-)। একটিমাত্র কবিতা- ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ দিয়ে স্বকালের সমস্ত দ্রোহ ও বিক্ষোভকে ধারণ করেছিলেন অপূর্ব শিল্পকুশলতায়। দুর্বিনীত যৌবন দিয়ে স্বকালকে শুদ্ধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। শুধু বিষয় আর ভাষার গৌরবে নয়, কবিতা যে শেষ পর্যন্ত শব্দোত্তর আরো কিছু তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে। এই একটি কবিতাই মুখরিত করেছিলো রাজপথ, জনপথ। কবিতার বাক্যসম্বলিত পোস্টারে-ব্যনারে-ফেস্টুনে ছেয়ে গিয়েছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়াল। ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
মনে পড়ছে, হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) কাব্যগ্রন্থের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে ১৯৯০ সালে একটি দৈনিকের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত ‘হেলাল হাফিজ: পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী’ শীর্ষক একটি লেখায় উপর্যুক্ত কথাগুলোই লিখেছিলাম।
আজ তিন দশক পর তার কবিতা পুনর্পাঠ করতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখি- হেলাল হাফিজ ওই একটি কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বক্ষে ধারণ করেই সগর্বে দাঁড়িয়ে আছেন এবং ‘মধুর অমরত্ব’ উপভোগ করছেন। এমন বাক্য লিখবার সময় যদিও বিস্মৃত হইনি অচল ‘প্রেমের পদ্য (১৯৯৫) ও ‘ভালোবাসো একশো বছর (১৯৯৬) নামে সুদৃশ্য কবিতা কার্ড এবং একটি কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলছি, কেঁদোনা’(২০১৯) প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত উল্লেখিত কাব্যগ্রন্থ এক অর্থে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’রই বর্ধিত সংস্করণ। তারই কোমল করুণ স্বর এখানে মুদ্রিত, অনুরণিত। হেলাল হাফিজ মানেই ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ আর ‘যে জলে আগুন জ্বলে।’ এ এক আশ্চর্য, অনুপম সৃষ্টি।
তিন দশক পর ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ পুনর্পাঠ আর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ পাঠে চিরচেনা অনুভূতির সাথে যুক্ত হয়েছে কোমল করুণ বেদনার মিষ্টি অনুভব। ইংরেজ কবি শেলি যেমনটি বলেছেন-
Our Sweetest songs are those
that tell of saddest thought.
হেলাল হাফিজের কবিতা যেন ঠিক তাই। উনসত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে একজন অশিক্ষিত অথচ চৈতন্যবান রিক্সাওয়ালার মুখে ‘এইসব পশ্চিমা হার্মাদদের খুন করলে পাপ নাই।’- এমন একটি পিলেচমকানো বাক্য প্যাসেঞ্জার কবির মর্মমূলে আঘাত করে। সারারাত অস্থির ভাবনা আর বিস্তর কাটাকুটির পর দাঁড় করিয়ে ফেলেন এক আশ্চর্য সুন্দর পঙক্তি-
‘কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্ত আজ বয়ে যায়।’ (নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, যে জলে আগুন জ্বলে)
কী আশ্চর্য সমন্বয়! অগ্নিশিখা আর অশ্রুবিন্দু। প্রেম আর দ্রোহ। ড. সৌমিত্র শেখর লিখছেন-‘প্রেমের সঙ্গে দ্রোহের এমন চমৎকার সম্মিলন বড় কবি না হলে করা সম্ভব না।’ এই কবিতা আমাদের কাব্যজগতে এক প্রিয় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে যেন। তৎকালীন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ‘চাকরি খোয়ানো আর ‘পত্রিকা বন্ধের আশঙ্কায়’ এই বিস্ফোরক কবিতা ছাপাতে রাজি হননি। তবে অভিনব এই কবিতা নিয়ে ভবিষৎবাণী করতে ভোলেননি- ‘তবে একটা কথা বলি- হেলালের আর কোনো কবিতা না লিখলেও চলবে। অমরত্ব ওর করায়ত্ত হয়ে গেছে।’ একই কবিতা নিয়ে বোহেমিয়ান কবি বেলাল চৌধুরীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ‘হেলাল, তোর জীবনে এরচে ভালো কবিতা তুই আর লিখতে পারবি না।’
‘অমৃত বাজার’ পত্রিকার সম্পাদক তুষার কান্তি ঘোষ একবার কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন-If Nayrul had written only his poem Bidrohi (The Rebel) he would have been famous.
এই একই বাক্য আমরা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ ও হেলাল হাফিজ সম্পর্কেও নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করতে পারি।
একজন কবির কোনো সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব নেই। একজন মেম্বার, চেয়ারম্যান কিংবা সংসদ সদস্যের যেমন সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র এ রকম কোনো দায়িত্ব কবিকে অর্পণ করে না। কিন্তু তাই বলে কবি সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো জীব নন। স্বকাল, স্বকালের রাজনীতি, সমাজনীতি, চারপাশের মানুষ, মানুষের অসংগতি, বিচ্যুতি কবিকে দারুণভাবে ভাবায়, তিনি নিজেই দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে, কলমে। হেলাল হাফিজও একাত্ম হয়েছেন মুক্তিকামী মানুষের সাথে। শব্দসৈনিক কবি মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেছেন-
‘মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দু:সময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই।’ (দু:সময়ে আমার যৌবন, যে জলে আগুন জ্বলে)
রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামে, লক্ষপ্রাণের বলিদানে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এলো। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, ভাঙাচোরা সড়ক-সেতু আর দেশ পুনর্গঠনের সময় হলো। কবি অস্ত্র সমর্পণের কথা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু যখনই প্রত্যক্ষ করলেন প্রকৃত মুক্তি এখনো ভার্জিন, সুদূর পরাহত, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে দুস্তর ফারাক, তখনই কবি পুনর্ব্যক্ত করলেন-
‘যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার। (অস্ত্র সমর্পণ, প্রাগুক্ত)
‘অন্য রকম সংসার’ (যে জলে আগুন জ্বলে) কবিতায় পুনর্বার যুদ্ধে যাবার ঘোষণা, দৃপ্ত শপথ-
এই তো আবার যুদ্ধে যাবার সময় এলো
আবার আমার যুদ্ধে খেলার সময় হলো।
‘ঘরোয়া রাজনীতি’ কবিতায় কবি ব্যক্তিগত প্রণয় আর সমষ্টিগত মিছিলকে একাত্ম করে তুলেছেন। ব্যর্থ প্রণয়কে সার্থক করে তুলতে তিনি প্রেয়সীকে রাজপথে নামার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন-
‘ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন
আগামী মিছিলে এসো
শ্লোগানে শ্লোাগনে হবে কথোপকথন
আকালের এই কালে সাধ হলে পথে ভালোবেসো
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো যদি
লাল শাড়িটা তোমার পরেই এসো।
ব্যক্তিপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, প্রণয় ও প্রতিবাদ, প্রেয়সী ও স্বদেশ সব একাকার করে তুলেছেন কবিতায়। শুধু কি স্বদেশ? না। কবি এক দিকে যেমন স্বকাল ও স্বদেশের প্রতিনিধি, তেমনি বিশ্ব নাগরিকও। ছোট্ট দুটি বাক্যে কী অসাধারণ ব্যঞ্জনায় বৈশ্বিক অস্থিরতা, যান্ত্রিক অভিঘাত ও দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করেছেন। কটাক্ষ হেনেছেন তীব্র তীক্ষ্ন ভাষায়-
নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বুঝ না! (অশ্লীল সভ্যতা, যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের কবিতা দ্রোহ ও প্রেমের নিখুঁত যুগলবন্দি। এক অপূর্ব সম্মিলন। তবে তার প্রেমের কবিতা দ্রোহের কবিতাকে ছাড়িয়ে অন্যরকম উচ্চতায় আসীন। বলা যায়, হেলাল হাফিজ আংশিক বিদ্রোহী পুরোটাই প্রেমিক। আপাদমস্তক প্রেমিক। ব্যর্থ বিরহী প্রেমিক। ছিমছাম সন্ন্যাসী। বাংলা কবিতার ‘কষ্টের ফেরিওয়ালা।’ দু:খ কষ্টকে মিশিয়ে দিয়েছেন রক্ত আর বাতাসের সাথে। বেদনাকে কতোটা বিস্তৃত করা যায়, কতোটা করুণ কোমল উপভোগ্য করে তোলা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিরহের এক একটি হীরকখ-কবিতা।
‘কিছু ভাঙচুর আর
তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল, টলমল
অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলত ভালোবাসা মিলনে মলিন হয় বিরহে উজ্জ্বল।’ (প্রতিমা, যে জলে আগুন জ্বলে)
মানব দেহের সত্তর ভাগ জলকে দু:খ বানিয়ে পৃথিবীর তিন ভাগ জলের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন হেলাল হাফিজ। দু:খ কষ্টকে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছেন- ‘আমি নিপুণ ব্লটিং পেপার। সব কালিমা, সকল ব্যথা ক্ষত শুষেই নেবো (উপসংহার)। সার্বক্ষণিক দুঃখযাপন, বেদনাকে উদযাপন করা হেলাল হাফিজের পক্ষেই বলা সম্ভব-
‘আমার দুঃখ আছে, কিন্তু আমি দুঃখী নই
দুঃখতো সুখের মতো নীচ নয় যে আমাকে দুঃখ দেবে।
(আমার সকল আয়োজন, প্রাগুক্ত)
দু:খকে জয় করা এই নীলকণ্ঠ কবি ভালোবাসাতেই নিজেকে সমর্পণ করেছেন। ভালোবাসাকেই নিয়তি মেনেছেন। ফলে বিরহ, বেদনা, ব্যর্থতা, কিংবা নিদারুণ প্রত্যাখান কোনো কিছুই তাকে প্রেমচ্যুত করতে পারেনি। আগুনে পুড়ে সোনা খাঁটি হয়। অগ্নিস্নানে মানুষ শুচি হয়। হেলাল হাফিজ এক ¯িœগ্ধ ব্যতিক্রম কবি যে, জলাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে নীলোৎপল হয়ে ফুটেছেন।
জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল
কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল। (কোমল কংক্রিট, প্রাগুক্ত)
মানুষ আসলে ভালোবাসাকেই সবচে বেশি ভালোবাসে। প্রথম প্রেম, দ্বিতীয় প্রেম বলে কিছু নেই। মানুষ যখনই প্রেমে পড়ে ওটাই প্রথম প্রেম। তাই তো প্রবল প্রত্যখানেও কবির দ্বিধাহীন উচ্চারণ-
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে। (প্রস্থান, প্রাগুক্ত)
কিংবা ‘তুমি জানো পাড়া প্রতিবেশী জানে, পাইনি তোমাকে
অথচ, রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে। (প্রতিমা, প্রাগুক্ত)
হেলাল হাফিজ বিরহী প্রেমিক। বিরহের যে এতো ব্যঞ্জনা থাকতে পারে, বেদনা যে এতোটা মধুর হতে পারে, কোমল উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে এক একটি মুহূর্ত হেলাল হাফিজ ছাড়া আর কে এমন করে বুঝিয়েছে? ভালোবাসা মরলেও পিছুটান কখনো মরে না। বারবার জানান দিয়ে যায় তার অস্তিত্ব, বড় বেশি বাজে তার দীর্ঘ শ্বাস, তুমুলভাবে ছড়িয়ে থাকে সারা না-থাকা জুড়ে।
তুমি জানো পাড়া প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে
অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে। (প্রতিমা, প্রাগুক্ত)
কিংবাÑ ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
আজ দেখি রাজ্য আছে, রাজা আছে শুধু তুমি অন্য ঘরে।’ (ইচ্ছে ছিলো, প্রাগুক্ত)
অথবা, ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়ে
দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রুষাহীন।
কেউ ডাকোনি তবু এলাম বলতে এলাম ভালোবাসি। (যাতায়াত, প্রাগুক্ত)
দু:খ, ব্যর্থতা, বঞ্চনা অবহেলা আত্মপ্রবঞ্চনা একাকিত্ব- প্রভৃতি শব্দের ভেতর তাকে চেনা যায়। তিনি নিজেই যখন বলেনÑ
আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই
আছে শুধু বিষাদের গহীণ বিস্তার। (আমার সকল আয়োজন, প্রাগুক্ত)
সেই কষ্ট বিষাদকে কতোটা বিস্তৃত করা যায় তারই প্রতীকী শিল্পশোভন প্রকাশ দেখি- ফেরিঅলা’ কবিতায়-
প্রেমের কষ্ট, ঘৃণার কষ্ট, নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট
ভুল রমনীর ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
তাসের খেলার দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
এ যেন কষ্টকে স্পর্শগ্রাহ্য, মূর্ত করে তুলবার শৈল্পিক প্রয়াস।
কবি আবুল হাসান বলেছিলেন- ‘মানুষ যদিও বিরহকামী কিন্তু, তার মিলনই মৌলিক।’ হেলাল হাফিজের প্রেমদর্শন ভিন্ন। তার মতে ‘মূলত ভালোবাসা মিলনে মলিন হয় বিরহে উজ্জ্বল’। তাইতো মিলনাত্মক নয়, বিরহাত্মক পঙক্তিতেই হেলাল হাফিজকে চেনা যায়। কবি তার প্রেমিককে প্রাত্যহিকতার তুচ্ছ ব্যবহারে মলিন করে তোলেননি। যে নারী তাকে সন্ন্যাসী বানিয়েছে, ছিন্নভিন্ন খাঁ খাঁ বিরান মানুষে পরিণত করেছেÑতার হাতেই তুলে দিতে চেয়েছেন ‘এই নে হারামজাদী একটা জীবন।’ জীবনোৎসর্গ করা এই নারীকেই ভেবেছেন উজ্জ্বল উদ্ধার ‘তোমার স্পর্শেই শুধু আমার উদ্ধার’। (দু:খের আরেক নাম)। এই নারীকেই কবি ‘শৈল্পিক তাবিজ’ আখ্যা দিয়ে আবার বলেছেন-
নারী তুমি বেশি কিছু নও-নিতান্ত শৈল্পিক তাবিজ
এতোদনি নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দু:খের আরেক নাম হেলাল হাফিজ। (দু:খের আরেক নাম, প্রাগুক্ত)
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ‘শৈল্পিক তাবিজ’ অধরা অনির্ণীতই বয়ে গেলো তার জীবনেÑনারী কি বৃক্ষ কোনো/ না কোমল শিলা/নারী কি চৈত্রের চিতা/ নিমীলিত লীলা, (অনির্মীত নারী, যে জলে আগুন জ্বলে)
আধুনিক বেশ ক’জন কবির কবিতায় মুদ্রিত কোনো কেনো নারী রীতিমত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। এ ধারার সূচনা গোবিন্দচন্দ্র দাস থেকে। তার সারদা, জ্যোৎস্না, কুসুম কুমারী কবিতার পঙক্তির পর পঙক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ তো আমাদের কিংবদন্তির প্রিয়তমা’র তকমা নিয়ে আছেন। বনলতা সেন ছাড়াও শেফালিকা বেগম, সুরঞ্জনা, সবিতা, অরুণীমা সান্যাল প্রমুখ তো আছেই। ব্দ্ধুদেব বসুর ‘কংকাবতী, বিষ্ণুদে’র অলকা বসু, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘অরুন্ধতী’র নাম ও মুখশ্রী কাব্যপ্রেমীদের মনে ও মগজে গুনগুন করে। হেলাল হাফিজ এ ধারায় আরো সাহসী, স্পষ্টভাষী। কোনো রাখঢাক ছাড়াই সবিতা মিস্ট্রেস, হেলেন; হীরনবালা কিংবা তনাদের মুদ্রিত করেছেন কবিতার সমৃদ্ধ শব্দে। কোনো আড়াল আবডালের মায়াবী পর্দা টানেননি। অকপট স্বীকার করে নিয়েছেন এইসব রমণীর সাথে কবির ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং অবস্থা ও অবস্থান।
ক. একবার তোমার নোলক, দুল হাতে চুড়ি
কটিদেশে বিছা করে অলংকৃত হতে দিলে
বুঝবে হেলেন, এ আঙুল ছলনা জানে না। (নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল, প্রাগুক্ত)
খ. জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুণ আরাম (অগ্নুৎসব, প্রাগুক্ত)
গ. কথাছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন পেয়েছি পেয়েছি। (একটি পতাকা পেলে, প্রাগুক্ত)
একাধিক কবিতায় মুদ্রিত এই হেলেন কবির প্রথম প্রেম। দীর্ঘ প্রণয় ও প্রতীক্ষার পর চূড়ান্ত পরিণতির দ্বারপ্রান্তে এসে হেলেনের অপ্রত্যাশিত উচ্চারণ-
‘আমি তো অন্য একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি’-হেলাল হাফিজকে একেবারে স্তব্ধ, নির্বাক করে দেয়। প্রথম প্রেমের এই নির্মম প্রত্যাখ্যান কবিকে বহু বছর অসুস্থ, অসংলগ্ন ও অস্বাভাবিক করে তুলেছিলো। হেলেন ছাড়াও কলেজ জীবনে রেলনাইন দিয়ে হাত ধরে হেঁটে চলা ‘শংকরী’ কিংবা স্কুলবেলার সাথী ‘সবিতা’র কথা কবি তার একাধিক সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতায় অকপট স্বীকার করেছেন। এ রকম আরও কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য তুলে ধরেছেন তরুণ প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ আলী তার ‘হেলাল হাফিজের কবিতা-ফুল ও ফুলকি’ গ্রন্থে।
এর বাইরে আরো একজন নারী হেলাল হাফিজের কবিতায় বিষের ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন-‘তনা’।
‘ভালোবেসে নাম দিয়েছি তনা
মন না দিলে/ছোবল দিও তুলে বিষের ফনা’ (প্রতিদান, বেদনাকে বলছি, কেঁদো না)
এই ‘তনা’ বাস্তবের কেউ না হলেও কবিতায় চিত্রিত নারীর কালনাগিনীরূপ চিনে নিতে ভুল হবার কথা নয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালে ‘অচল প্রেমের পদ্য’ নামের সুদৃশ্য কবিতা কার্ডে প্রকাশিত হবার পর এবং ২০০৩ সালে প্রকাশিত দেশের আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ‘ক’ বইসূত্রে পাঠকমাত্রই বুঝে নেন ‘বিষের ফনা’ তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ‘তনা’ মানে তসলিমা নাসরিন। কেন তিনি গোলাপের বদলে ‘বিষের ফনা’ তুলে দাঁড়িয়েÑজানতে পাঠক কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। ‘হেলাল হাফিজের সঙ্গে সম্পর্কটা ওভাবে শেষ হবে ভাবতে পারিনি কখনো’-তসলিমার এমন উচ্চারণ জানিয়ে দেয় তাদের যোগাযোগ, পরিচয় দীর্ঘদিনের। সেঁজুতির জন্য কবিতা চাইতে গিয়ে প্রথম পরিচয়। দুজনেই ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষ। তসলিমার বড় ভাই কবির সমবয়সী, বন্ধু। সেইসূত্রে তসলিমাদের বাসায় তার অবাধ যাতায়াত। তাছাড়া হেলাল হাফিজের ‘কবিতার বরপুত্র’ হয়ে ওঠা, আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা, সার্বক্ষণিক কবিতাযাপন করা, দুঃখপোষা, একাকী জীবন কাটানো, গৃহহীন কবির লাগাতার হোটেল বাস, বেকার জীবনে প্রেসক্লাবের কার্ডরুমে জুয়াখেলাকে জীবিকা করে নেয়া, তার উদারতা সব মিলিয়ে অন্যরকম এই মানুষটির প্রতি তসলিমার তীব্র আকর্ষণ ছিলো তবে সেটি ‘শ্রদ্ধাস্পদ দাদা’ ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে চাননি কোনো দিন।
তসলিমার সাথে হেলাল হাফিজের এই প্রেমানুভূতি ছিলো একপাক্ষিক। কবি নিজেই একাধিক আলাপচারিতা ও সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সেই তথ্য। রুদ্রর সাথে তসলিমার ঝগড়া ও বিচ্ছেদের দিনগুলোতে কলহ নিস্পত্তি করতে গিয়েই কবি জড়িয়ে যান প্রেমে। একরৈখিক টানে। সপ্রেম আবেগে ভেসে যাওয়া কবি গভীর মমতায় হাতটি টেনে নিয়েছিলেন নিজের হাতে। ‘হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিয়ো, রেখো।’ কিন্তু সে হাত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এক ঝটকায়, ঘৃণায়।
কবির কাতর আহ্বান-
কোনোদিন আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে
চলো যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই
যাবে? (অভিসার, বেদনাকে বলেছি, কেঁদোনা)
না। কবির এই এক পাক্ষিক কাব্যিক আহ্বানে সাড়া দেয়নি ‘তনা’। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কবি হতাশায় ডুবেছেন। গুমরে কেঁদেছেন। রুমালে সজল চোখ মুছতে মুছতে বলেছেন-
আমারে কান্দাইয়া তুমি
কতোখানি সুখী হইছো
একবার এসে কইয়া যাইও। (নীল খাম, বেদনাকে বলেছি, কেঁদোনা)
তসলিমাকে নিয়ে লেখা অন্য একটি কবিতা ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’তে তিনি লিখেছেনÑ
এক জীবনের সব হাহাকার বুকে নিয়ে
অভিশাপ তোমাকে দিলাম-
তুমি সুখী হবে
ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে, দেখে নিও খুব সুখী হবে। (ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে,
বেদনাকে বলছি কেঁদো না)
পুরাকালে ঋষি মুনীদের অভিশাপ শুনেছি ফলে যেতো। কিন্তু প্রেমে দগ্ধ চিরবিরহী একাকীত্বে লীন কবির অভিশাপে ‘নির্বাসিতা তনা’ কতোটুকু সুখী হয়েছেন- জানা না গেলেও হেলাল হাফিজ অন্য রকম সুখের সংসার গড়ে তুলেছেন এইসব বিরহ রোদনের উজ্জ্বল পঙক্তি রচনার মধ্য দিয়ে। প্রত্যাখ্যান আর ব্যথায় নীলকণ্ঠ হেলাল হাফিজের দ্বারাই বলা সম্ভব-
যদি যেতে চাও যাও
আমি পথ হব চরণের তলে
ফেরাবোনা, পোড়াবো হিমেল আগুনে। (পথ, বেদনাকে বলছি কেঁদোনা)
অথবা
তোমার হাতে দিয়েছিলাম অথৈ সম্ভাবনা
তুমি কি আর অসাধারণ? তোমার যে যন্ত্রণা
খুব মামুলী বেশ ধরেছো চতুর সুদর্শনা
আমার সাথে চুকিয়ে ফেলে চিকন বিড়ম্বনা। (লেনদেন, বেদনাকে বলছি কেঁদো না)
অনাদর, অবহেলা, নিঃসঙ্গতা, প্রত্যাখ্যান-এতসব নিয়েও তিনি দারুণ পরিপাটি গোছানো মানুষ। গৃহহীন সন্ন্যাসজীবন তার। ‘আসলে খুব গোছানো মানুষ তিনি। ইস্ত্রি করা শার্টপ্যান্ট পরবেন, চকচকে স্যান্ডেল পরবেন, আর একটি মোটা কাপড়ের ঝোলা থাকবে কাঁধে; ঝোলায় তার কলম, কিছু কাগজ, সিগারেটের পেকেট, সবই খুব সুন্দর করে গোছানো।’-তসলিমার উপর্যুক্ত বর্ণনার মধ্যেও একটা ম্যাসেজ, একটা সাজেশন আছে। হেলাল হাফিজই সেই ব্যতিক্রমদের একজন, যিনি অকৃতদার হয়েও ভীষণ-সংসারী, গৃহহীন হয়েও প্রতিদিন ‘ঘরহীন ঘরে’ ফেরেন। আর এটি সম্ভব করে তুলেছেন-কবিতাকে জীবনের সাথে একাত্ম আর একান্ত করতে পেরেছেন বলেই। শেষ পর্যন্ত এই কবিতাই তাঁর সব। তার জীবনযাপন আর কবিতাযাপন প্রায় সমার্থক।
পঞ্চাশের দশকের দু’জন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (১৯৩৪-২০০১) এবং আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৯৩৬-১৯৮৯) কবি ও কবিতাকে বিষয় করে উল্লেখযোগ্যসব কবিতা লিখেছেন। ওবায়দুল্লাহ তার ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ এবং আবু হেনা ‘কবি’, ‘কবির নিয়তি’, ‘আক্রান্ত গজল’, ‘কোনো কবির প্রতি’, ‘তেমন কোনো কবি নই’-প্রভৃতি কবিতায় কবি ও কবিতার অপরিহার্যতা, সুন্দরতা ও বিকল্পহীনতা কথা তুলে ধরেছেন। উত্তরকালে হেলাল হাফিজ কবি ও কবিতাকে মুদ্রিত করেছেন নানা মাত্রিকতায়। কবিতাকে অবিকল মানুষের অবয়ব ভেবে স্পর্শগ্রাহ্য করে তুলে বলেছেন-
কবিতাতো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে সেও বিবেক শাসিত
তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত। (উৎসর্গ, যে জলে আগুন জ্বলে)
মানুষের সীমাহীন দুঃসময়ে, মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, না বুঝে তবে কবি কবিতারই কসম খেয়ে বলেছেন, এবার তিনি আহত নয়, নিহত হবেন। দারুন শোধ নেবেন। কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। লিখিত হবার পরই কেবল কবিতারূপে দেখা দেয়। এই কবিতাকেই তিনি চিহ্নিত করেছেন নতুন বৈশিষ্ট্যেÑ
কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে
কবিতা এমন এক পিতৃঘাতী শব্দের শরীর
কবি তবু সযত্নে কবিতাকে লালন করেন
যেমন যত্নে রাখে তীর
জেনে শুনে সব জল ভয়াল নদীর। (কবি ও কবিতা, প্রাগুক্ত)
এই কবিতাকে তিনি নিয়িত মেনেছেন। চারপাশের মাুনষ, স্বজন প্রিয়জন এমনকি চির আরাধ্য প্রিয় নারী জাতিও কবিকে অবহেলায়, অনাদরে ছেড়ে গেছেন কিন্তু কবিতা তাকে ছাড়েনি। দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো কবিতা কবির শরীরে নিরাপদ আশ্রয় গড়েছে।
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে থাক
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক। (যুগল জীবন, যে জলে আগুন জ্বলে)
কবিতার মতো মহৎ শিল্পী বেঁচে থাকার আকুতি প্রকাশ করেছেন কবি।
মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর ঈশ্বর পাটুনিকে দিয়ে বলিয়েছিলেন ‘আামর সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ আর হেলাল হাফিজ তার জীবন খেয়ে বেড়ে ওঠা কবিতাকে আগামীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছেন-
আগামী তোমার হাতে
আমার কবিতা যেন
থাকে দুধে ভাতে। ( বাসনা, বেদনাকে বলছি কেঁদো না)
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) প্রকাশিত হবার ৩৪ বছর পর তার দ্বিতীয় মৌলিক গ্রন্থ ‘বেদনাকে বলছি কেঁদো না (২০১৯) প্রকাশিত হয়। এক মাসের মামুলী শ্রাবণকে তুচ্ছ করে পৃথিবীর তিন ভাগ সমান দু’চোখ যে কবির তার পক্ষেই কেবল এমন নামকরণ মানায়, শোভা পায়। এ যেন বিমূর্ত, ব্যথাহত বেদনাকে মূর্ত করে কাছে ডেকে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে বলছেন- ‘বেদনা তুমি কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
চৌত্রিশ বছরের নীরবতা ভেঙে চৌত্রিশটি কবিতার সাথে পিতার লেখা একটি কবিতা যুক্ত করে সাজিয়েছেন ্ কাব্যগ্রন্থ। ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’ ও স্রোতস্বিনী ভালোবাসা’ ছাড়া অবশিষ্ট সবকটি কবিতা ছোট কবিতা, যাকে আমরা অণুকবিতা বলতে পারি। চট করে চোখে পড়লে এগুলোকে কবিতার খন্ড বলে ভ্রম হবে। একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেই বুঝা যায়, বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা নিয়ে এক একটি বাক্য খচিত হয়ে আছে কালো অক্ষরে।
কবি যদিও একাধিক আলাপচারিতায় আমাদের জানিয়েছেন নীরবতার দিনগুলোতে কবি মারাত্মক আসক্ত ছিলেন ফেইস বুকিং আর চ্যাটিং এ। অ্যানড্রয়েডের স্ক্রিনে বিস্তারিত লেখার সুযোগ সীমিত তাই এ ব্যবস্থা। কিন্তু পাঠকমাত্রই বুঝে-বহুদূর না হাঁটলে, বিনিদ্র রাত না জাগলে, পথ আর পথিকের কষ্টকে একাকার করে না তুললে, জীবনোপলব্ধির অতলে ডুব না দিলে এ রকম মুক্তা তুলে আনা অসম্ভব।
সুতো ছিঁড়ে তুমি গোটালে নাটাই
আমি তো কাঙাল ঘুড়ি
বৈরী বাতাসে কী আশ্চর্য
একা একা আজও উড়ি। (ঘুড়ি, বেদনাকে বলছি কেঁদো না)
কিংবা তুমি আমার নি:সঙ্গতার সতীন হয়েছো! (সতীন, প্রাগুক্ত)।
‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবিতাজুড়ে যে নি:সঙ্গ একাকিত্ববোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন এ পর্বে তা যেন আরও সর্বগ্রাসী হয়েছে। তবে তা সংহত ও সংযত। কবিতা ইতিহাস কিংবা দর্শন নয়। কবিতায় অন্য রকম ইতিহাস মানবেতিহাস, দর্শন দুলে উঠে। হেলাল হাফিজ অযথা দুর্বোধ্য শব্দ বা বাক্যে তার কবিতাকে ভাবি করে তোলেননি। সহজ কথাকে সহজভাবে প্রকাশ করার অসাধারণ প্রতিভা তিনি অনায়াসে রপ্ত করেছেন।
আপনি আমার এক জীবনের যাবতীয় সব
আপনি আমার নীরবতার গোপন কলরব। (আপনি, প্রাগুক্ত)
কিংবা হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয়তো গিয়েছি হেরে
থাকনা ধ্রুপদি অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে। (জটিল জ্যামিতি) প্রাগুক্ত
তোমার জন্য সকল দুপুর
তোমার জন্য সন্ধ্যা
তোমার জন্য সকল গোলাপ
এবং রজনীগন্ধা। (অর্ঘ্য, প্রাগুক্ত)
কবিকে খুঁজো না তার জীবনচরিতে। আধুনিক কাব্যের বিশ্লেষণে এ কথা আর খাটছেনা। উদ্দেশ্যকে গোপন করে নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনায় নির্মোহ প্রকাশের মধ্যেই শিল্পের মূল্য নিহিত। এ সত্য মানলেও হেলাল হাফিজ সেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রমদের মধ্যে অগ্রগণ্য, যিনি কবিতা ও ব্যক্তি জীবনের মধ্যে কোনো আড়াল টানেননি। ব্যক্তিক হাহাকারকে একাকার করে তুলেছেন প্রতিটি কবিতায়।
‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ কাব্যগ্রন্থে নিজের চৌত্রিশটি কবিতার সাথে ‘পিতার পত্র’ নামে পিতার কবিতাটি যুক্ত করার গল্প বলতে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেনÑ কবিতাটি তাকে লেখা পিতার চিঠির একটি লাইন। শৈশবে মাতৃহারা কবি পিতা দত্ত হাইস্কুলের শিক্ষক খোরশেদ আলম তালুকদারের ¯েœহভালোবাসায় বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু পিতার দ্বিতীয় বিয়েতে ক্ষুব্ধ, হতাশ, অভিমানী কিশোর গৃহছাড়েন এবং লিখে উঠেন একটি ছোট্ট কবিতা।
জরায়ুর রক্তিম সৈকতে/পুনর্বার সাজালে জীবন…
একটি যুবক কেঁদে কেঁদে এল যৌবনের সোনালী আগুনে-
তারই প্রত্যুত্তরে পিতা তাকে লেখেন-
রেটিনার লোনা জলে তোমার সাঁতার
পিতৃদত্ত সে মহান অধিকার।’ (পিতার পত্র, প্রাগুক্ত,)
কবি হাসান হাফিজ তার একটি লেখায় (ভোরের কাগজ, ১৩.১২.১৯) উল্লেখ করেছেন যেখানে হেলাল হাফিজ দাবি করেছেন- এই দুঃখ তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত, যা কবি পরম যত্নে লালন করে চলেছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই দুঃখকষ্টকে কবি অবলীলাক্রমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রাণে প্রাণে-
তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ (ওড়না, প্রাগুক্ত)
কিংবা, তুমি কি জুলেখা, শিরি, সাবিত্রী নাকি রজকিনী?
চিনি, খুব জানি
তুমি যার তার, যে কেউ তোমার
তোমাকে দিলাম নাÑভালোবাসার অপূর্ব অধিকার। (অধিকার, প্রাগুক্ত)
কিংবা আমি তো কাচের নই
তবুও চৌচির হয়ে আছি (কৃষ্ণ পক্ষ, প্রাগুক্ত)
‘মানবানলে’ পুড়ে কবি খাঁ খাঁ বিরান হলেও শেষ পর্যন্ত কবির যাত্রা মানবমুখী। এই মানুষের প্রতিই তার পক্ষপাত ঘোষিত তার অপরিশোধ্য ঋণ।
‘আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে,
মানুষের কাছে এও আমার এক ধরণের ঋণ।
এমনই কপাল আমার
অপরিশোধ্য এই ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। (কবিসূত্র, প্রাগুক্ত)
আর সেজন্য কবি বলেছেন- সবাই জমায় টাকা
আমি চাই মানুষে জমাতে (সঞ্চয়, প্রাগুক্ত)
হৃদয়বৃত্তে বাঁধা কবি টাকার বদলে মানুষ জমান। তাই তো চরম নি:সঙ্গতার মধ্যেও কবি সমাবেশের কোলাহল উদযাপন করেন আর ভিড়ের ভেতর থাকেন একা, নি:সঙ্গ।
‘পতন দিয়ে পতন ঠেকানো’র দু:সাসহস নিয়ে যে কবি একদিন জলের উল্টো দিকে সাঁতার দিয়েছিলেন তিনিই তো বলবেন এমন চমকপ্রদ বাক্য-
‘রোদ্দুরে ভেজাবো তোকে শুকাবো বৃষ্টিতে। (লীলা, প্রাগুক্ত)
কিংবা, তোমাকে শোনাবো এক পরাজিত মানুষের বিজয় কাহিনি। (জয়, প্রাগুক্ত)
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থে ‘দুঃসময়ে আমার জীবন’, ‘অনির্ণীত নারী’, ‘অশ্লীল সভ্যতা’, ‘কোমল কংক্রিট’, ‘উপসংহার’ প্রভৃতি অণুকবিতার যে ঝলক আমরা দেখেছিলাম তারই সংহত ও সংযত প্রকাশ পরিব্যাপ্ত হয়েছে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’য়।’ সর্বমোট পঁয়ত্রিশটি কবিতার মধ্যে ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’, ‘¯্রােতসিনী ভালোবাসা’ ও ‘সুন্দরের ঋণ’, এই ত্রয়ী কবিতা ছাড়া বাকী সবগুলো অণুকবিতাÑযেগুলো গভীর ব্যাপক, ব্যঞ্জনা নিয়ে মুদ্রিত হয়েছে।
দুর্বিনীত যৌবনে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত কবি যুদ্ধে যাবার দৃপ্ত শপথে রাজপথে নেমেছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে স্বাধীন ভূমিতে ঘরে ফিরে কবি হতাশ, আহত এবং ক্ষুব্ধ। যে মৌলিক নির্মাণ চেয়ে সর্বস্ব উজাড় হলো, এতো এতো আত্মত্যাগ, তার বহু কিছুই অর্জিত হলো না। বরং অধরাই থেকে গেলো। সাধের সমাজতন্ত্র, প্রিয় গণতন্ত্র উধাও হয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অন্যায় অবিচারে ছেয়ে গেলো চারপাশ। সবচে বড় ক্ষতি- ‘মানুষ বুঝলো না মানুষকে, হলো না প্রেম মানুষে মানুষে।’ নারীকেই জীবনের উজ্জ্বল উদ্ধার ভেবে জীবনোধিক ভালোবাসায় প্রেমময় দুটি হাত বাড়িয়ে পেয়েছেন নিদারুণ প্রত্যাখ্যান, অবহেলা ও বঞ্চনা। উত্তারাধিকারসূত্রে পাওয়া দু:খবোধের সাথে যুক্ত হয়েছে একাকিত্ববোধের মধুর বেদনা। শেষবধি ‘কষ্টের ফেরিওয়ালা’ কবি দু:খযাপনেই মধুর নিয়তি মেনেছেন। তাই তো বিষাদের গহীন বিস্তারে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে বেদনা উদযাপনের এক অননুকরণীয় খেলা আয়ত্ত করে নিয়েছেন। এখন মানবানলে পুড়ে খাঁক হওয়া কবির নিজের নির্জনে দিন কাটে। নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ববোধর এক নীলাভ পর্দা কবিকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখে। কবি বিনিদ্র রাত জেগে বেদনাকে উপভোগ করেন।
‘কবিতার বরপুত্র’ হেলাল হাফিজ অনি:শেষ বেদনার নীলকণ্ঠ হয়ে যেন ফুটে আছেন বাংলা কাব্যের ‘অনিদ্র জলাশয়ে।’
সহায়ক গ্রন্থ :
১. হেলাল হাফিজ, যে জলে আগুন জ্বলে, অনিন্দ্য প্রকাশন, দ্বিতীয় মুদ্রণ, মার্চ ১৯৮৬
২. হেলাল হাফিজ, অচল প্রেমের গদ্য, ত্রয়ী প্রকাশন, ১৯৯৫
৩. হেলাল হাফিজ, বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা, দিব্য প্রকাশন, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০২১
৪. সম্পাদক রাম শংকর দেবনাথ, কষ্টের ফেরিওয়ালা, বিভাস, ২০০৪
৫. তসলিমা নাসরিন ‘ক’, প্রকাশক চারদিক, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০৩
৬. মোহাম্মদ আলী, হেলাল হাফিজের কবিতা ফুল ও ফুলকি, দিব্য প্রকাশ ২০২২
আ.ম.ম. মামুন, প্রাবন্ধিক
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, হাটাহাজারী সরকারি কলেজ