এজাজ ইউসুফী
বলা হয় প্রাচীন আখ্যান থেকেই পরবর্তীকালে ইউরোপে উপন্যাসের রূপ বিকশিত হয়। পুঁজিবাদের উদ্ভব ও ধনতান্ত্রিক যুগের অগ্রসরমানতায় মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ এবং মধ্যযুগের সামগ্রিক সমাজ-জীবনের ভাঙনের ফলে যে খ-িত জীবনবোধের দেখা পাই তাকে ভিত্তি করেই মূলত ছোটগল্প বিকশিত হয়। বাংলা ভাষায় বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই ছোটগল্পের ধারা প্রবর্তিত হয়। তাই তাঁকে বাংলার ছোটগল্পের জনক বলা চলে। খ-জীবনের চিত্রকেই তিনি বিষয়-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করে গেছেন। ছোটগল্পের আঙ্গিক মেনেই তিনি চরিত্র সংখ্যা সীমিত করেছেন। কিন্তু মানব-মনের একটি যুক্তিসঙ্গত গল্পই বলার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমরা ছোটগল্প সম্পর্কে William Henry Hudson এর সেই বিখ্যাত উক্তির স্মরণ নিতে পারি। তিনি তাঁর An introduction of the Study of Literature গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেনÑ A short story must contain one and only to its logical conclusion with absolute singleness of Mathod. (তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট)
এই ভূমিকার অবতারণা করতে হলো সম্প্রতি প্রকাশিত সত্যজিৎ গবেষক আনোয়ার হোসেন পিন্টুর গল্পগ্রন্থ ‘বিজিত জ্যোৎস্না র দাহ’ পাঠ করে। আমরা পিন্টুকে চিনি মূলত সত্যজিৎ গবেষণায় নিরিত একজন মানুষ হিসেবে। বেশকিছু বাংলা ছোটগল্পের সিনেমা-স্ক্রিপ্ট তিনি করেছেন বলে জানি। তার নির্মিত শর্ট ফিল্ম ‘তৃতীয় বিশে^র ম্যাজিক’ কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর একটি অণুগল্পকে ভিত্তি করে নির্মিত।
যাক, আনোয়ার হোসেন পিন্টুর ‘বিজিতজ্যোৎস্না দাহ’ মোট ৮টি গল্পের সংকলন। গল্পগুলো হচ্ছে- ১. সামনে অন্ধকার, ২. আগন্তুক, ৩. উপহার, ৪. প্রকৃতি, ৫. রিক্ত-সুখ, ৬. সুখ পলাতক, ৭. চিলেকোঠার পৃথিবী ও ৮. বিজিত জ্যোৎস্নাদাহ। তার এই ৮টি গল্পের মধ্যে মানব-মনের বিচিত্র বোধ উঠে এসেছে। ঘর-
সংসারের মধ্যে থেকেও তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর অন্তর্গত হাহাকার বেশ বেদনাদায়ক। এরা আমাদের চারপাশের সমাজবদ্ধ চরিত্রগুলোরই শিল্পরূপ যেন। আজকের কথাসাহিত্যে বাঙালির নাগরিক মধ্যবিত্তশ্রেণির জীবনবোধ ও মূল্যবোধকে রূপায়ণে সচেষ্ট। অন্যদিকে, এতে বর্তমান নাগরিক জীবনের জটিলতা এবং তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও উঠে আসছে চেতনার অগ্রগামিতায়। ফলে, সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যের ভাষা অনিবার্য কারণেই জটিল হয়ে উঠছে। কিন্তু আনোয়ার হোসেন পিন্টু সে আধুনিক জটিল জীবন-ভাষ্য রচনায় কল্পিত অথবা দুর্বোধ্য আঙ্গিকে মনোযোগী হননি। তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ সহজ-সরল বর্ণনা ভঙ্গিকেই উপজীব্য করেছেন।
প্রথম গল্প ‘সামনে অন্ধকার’ এর পটভূমি তৈরি হয়েছে ধর্ষণের শিকার একটি মেয়ের বাবার প্রতিকার চাওয়াকে কেন্দ্র করে। কলেজ শিক্ষক রফিক সাহেব থানায় মামলা করতে এসে উপলব্ধি করেন যে, এটি ‘কী ভীষণ ও কী নিদারুণ কঠিন কাজ’। থানা-পুলিশ না করার জন্য স্ত্রী খাদিজার অনুরোধ উপেক্ষা করেই তিনি থানায় মামলা করতে আসেন তার মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষকসুলভ আদর্শকে ধারণ করে। অন্যায়ের প্রতিকার করতে। আবার তিনি তার অভিযোগ থানায় প্রকাশ্যে বলতেও দ্বিধান্বিত। চার দেয়ালের মধ্যে শুধু ওসি সাহেবকে বলতে চান মেয়ের আব্রু রক্ষায়। কিন্তু থানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে উদ্ঘাটন করেন-নষ্ট সময়ের চিত্র। তিনি বুঝতে পারেন থানার মধ্যে ওসি সাহেবও অসহায়। কারণ, পলিটিক্যাল পার্টির লিডারের এক পোষ্য নাসিম আলীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার ক্ষমতা তার নেই। রফিক সাহেব যখন পর্দার আড়ালে থেকে চেম্বারের মধ্যে নিন্ম পদস্থ কর্মকর্তার কক্ষে ওসির অদ্ভুত লড়াইয়ের বিষয়টি বুঝতে পারেন তখন তার আত্মসম্মান বাঁচানোর দাবি তার আত্মজা সাবিনার চোখের জলে মিইয়ে যায়। তিনি ওসি সাহেবের অসহায় গলা শুনতে পান-‘কিন্তু, তাই বলে নাসিম সাহেব যা খুশি তা-ই করবেন, সেটাতো টলারেট করা যায় না।’ আইনের আশ্রয় যারা দেবেন সাধারণ মানুষকে তাদের মধ্যেই ঢুকে পড়েছে সুবিধাবাদ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সাধারণ মানুষের অধিকার জিম্মি হয়ে গেছে কতিপয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের হাতে। “রফিক সাহেব কাঁপছেন। রাগে, না ভয়ে, না ক্ষোভে তা বুঝতে পারছেন না। মনে হলো, চেম্বারের ভেতরেও যা ঘটে গেল, তারও নাম ধর্ষণ। শেষতক রফিক সাহেবকে মধ্যবিত্তের করুণ পরিণতি মেনে তার মেয়ের কথাটিই মেনে নিতে বাধ্য হন- “কী দরকার! থাক না বাবা। এরকম তো কতই ঘটছে।”
‘আগন্তুক’ গল্পের ক্রমবধমান নগর ও সংশ্লিষ্ট মানুষের আন্ধা-চক্কর লক্ষ করি। এটিতে ৩জন মানুষের কথা আছে। সুমন, তার স্ত্রী মিলি এবং সুমনের বন্ধু হামিদ। সুমন বিয়ের পরই চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে চিফ এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। গাড়ি পেয়েছে। নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে। লেখকের ভাষ্যে-‘চাটগাঁর ম্যাপের এদিকটা এখন বড় বেশি নির্জন।’ অর্থাৎ নগর সম্প্রসারিত হচ্ছে শহরতলির দিকে। এরকম এক নির্জন দুপুরে ‘ঋজু মজবুত চেহারার কাঠিন্যে এবং গ্রীবায় নির্ভীক অনমনীয় এক সাহসিকতা যেন লুকিয়ে আছে। কোটরাগত দুচোখে রাতজাগা ক্লান্তি’ নিয়ে ডোরবেল বাজায় হাফিজ। মিলি দরজা খুলে দিলেও এই আগন্তুককে ঘিরে তার মধ্যে আতঙ্ক ও অস্থিরতা কাজ করে। আসলে উ™£ান্ত এই মানুষটি রাজনৈতিক কর্মী। পুলিশের তাড়া খেয়ে বন্ধুর নির্জন ফ্ল্যাটে আত্মগোপনের জন্য উঠেছে। ভয় কাটিয়ে এবং সুমনের আশ^াসে মিলি শান্ত হয়। জ¦রগ্রস্ত হামিদের ওষুধের ব্যবস্থা করে। এর মধ্যেই হামিদের প্রতি মিলির নারীসুলভ এক মায়া জন্মে যায়। মিলি যখন হামিদকে জিজ্ঞেস করে-‘শরীর এখন কেমন? সারাদিন তো কিছুই খেলেন না।’ তখন হামিদ মিলির কপালের ভাঁজ ও আনিন্দ্য সুন্দর তিনটি তিল লক্ষ করে বলে-‘আপনার মুখের তিলগুলো দেখতে খুব সুন্দর।’ বিপদগ্রস্ত এক মানুষের মধ্যে আমরা সৌন্দর্যভরা প্রেম-চেতনার দেখা পাই। মিলি অস্বস্তি ও দ্বিধা কাটিয়ে সপ্রতিভ উত্তর দেয়Ñ‘রাতে না খেয়ে থাকবেন না। হালকা কিছু খেয়ে আরেকটা ট্যাবলেট খেয়ে নেবেন।’
এর মধ্যে সুমন পতেঙ্গার একটি বাগানবাড়িতে হামিদের আত্মগোপনের ব্যবস্থা করে ফেলে। অন্যদিকে, হাজার অশান্তির মধ্যেও মিলির মনে হয় এতবড় ফ্ল্যাটে সে একা নয়। ভাবে মানুষটার আবার জ¦রটর আসেনি তো? সুমনের কাছ থেকেই মিলি জানতে পারেÑতার কঠিন অসুস্থতার সময় বিরল ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত তাকে দিয়েছিল হামিদই। মিলি দ্রুত শাড়ি পাল্টে বাগান বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে পুলিশ মাসুদকে ধরে নিয়ে গেছে। এবং প্রচ- মেরেছে। ‘আচমকা মিলির বুকের ভিতর দেওয়ালে কে যেন জোরালো হাতুড়ির আঘাতে ওকে ক্ষত-বিক্ষত করতে লাগল। কোনোক্রমে নিজেকে ধরে রাখল মিলি। এখনই ওকে বাড়ি ফিরতে হবে, সুমনের ফেরার আগেই। ফেরার পথটা তার মনে হয় বড় বেশি দীর্ঘ।’
‘উপহার’ গল্পটি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিপর্যয়ের পরিসরে রচিত। শিক্ষা একটি জাতির মূল শক্তি। এর শেকড় গভীর না হলে জাতির মেরুদ- দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে বহুমুখী শিক্ষা ও শিক্ষার বিপণন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। শিক্ষার সাধারণ লক্ষ্য হচ্ছে, জাতীয় ও ব্যক্তিক পর্যায়ে মানসিক-নৈতিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যবোধ তৈরি করা। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন-
সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদের উচ্চশিক্ষাকে আলাদা করে দেখার তেমন সুযোগ আছে বলে মনে করি না। আমরা গোড়ায় নষ্ট করে ফেলেছিল। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে গেল। এই বিভক্তি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। ব্রিটিশ আমলে দুর্বল অবস্থায় এই বিভক্তি ছিল। পাকিস্তান আমলে কিছুটা ছিল বটে। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর বিভক্তিটা একেবারে শক্ত অবস্থায় চলে আসে।
(দৈনিক বাংলা, একমুখী শিক্ষার বহুমুখী পথ, ১১ আগস্ট ২০২৩)
তাই বলতে হয় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সত্যিই উদ্বেগজনক ও মারাত্মক। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়। আমরা একটি রিপোর্ট দেখতে পারি-
স্কুল-কলেজে ৯৭ শতাংশই বেসরকারি। বাকি ৩ ভাগ সরকারি। এই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অসাধু ও বেপরোয়া শিক্ষকদের কাছে রীতিমতো জিম্মি শিক্ষার্থী-অভিভাবক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শ্রেণিকক্ষের আদলে কোচিং সেন্টারগুলোতেই চলছে পাঠদান। শ্রেণিকক্ষ হয়ে পড়েছে গৌণ।
(মুসতাক আহমদ, বেপরোয়া কোচিং বাণিজ্যে নাভিশ্বাস শিক্ষার্থীদের, যুগান্তর, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
ছোট্ট একটি গল্প ‘উপহার’। তার জন্য আমাকে এত বড় ভূমিকা দিতে হলো। তার কারণ এই ছোটগল্পটি আমাদের সামনে বড় একটি সংকটকে উপস্থাপন করেছে বলে। ‘উপহার’ গল্পটি একজন মায়ের বুকে চেপে রাখা দীর্ঘশ^াসের গল্প। একজন স্বামী ছাড়া মায়ের আকুতি। এবং তার সন্তানকে ঘিরে স্বপ্নবোনার। উগ্র রাজনীতির সমর্থক ও ক্যাডার আসাদ। মায়ার সঙ্গে ঘটনাচক্রে তার ঘাটছড়া বাঁধা। কিন্তু তাদের সন্তান অর্কের আকিকার টাকা দিয়েই মায়াকে তার স্বামীর কুলখানি করতে হয়। আসাদ স্বপ্ন দেখতেন অর্ক ডাক্তার হবে। স্বামীর এই অন্তিম ইচ্ছাপূরণের জন্য মায়া তাকে একটি ভালো কোচিং সেন্টারে ভর্তি করায়। এই কোচিং সেন্টারে পড়লেই নগরীর একটি নামকরা স্কুলে ভর্তির সুযোগ ঘটে। কারণ, এই কোচিং সেন্টার চালায় ঐ স্কুলের একজন ক্ষমতাবান শিক্ষিকা সীমা আন্টি। তাই এই শিক্ষিকাকে তুষ্ট করার প্রতিযোগিতা চলে অভিভাবকদের মধ্যে। কিন্তু মায়ার যেখানে সংসার চালানোই কঠিন সে কীভাবে দামি সব উপহার সীমা আন্টিকে দেবে? লেখকের ভাষায়- ‘অনেক আশা নিয়ে মায়া তাই শামিল হয়েছে এই অসম দৌড়ে। কারণ ভর্তির ব্যাপারে সীমা আন্টির ক্ষমতা অনেক। তাঁর সব ছাত্র-ছাত্রীই সচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তান, তাঁরা নানা উৎসবে-অনুষ্ঠানে সীমা আন্টিকে নানা উপহার দেয়। বিশেষ করে তাঁর জন্মদিনে তো বটেই। তখন নাকি প্রতিযোগিতা পড়ে যায় গার্ডিয়ানদের মধ্যে। এ জাতীয় কোচিং থেকে স্কুল পর্যন্ত প্রায় সর্বত্র চলে এ ধরনের কম্পিটিশান।’ তাই মায়ার সঙ্গে আর্থিক দুর্বলতার কারণেই ওসব মায়েদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। বরং কোচিং সেন্টারের ফি দেয়া হয় না। তাই মায়ার দিকে তাকালে সীমা আন্টির উচ্ছল হাসি হারিয়ে যায়।
প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে আসাদ মায়াকে ‘অসম্ভব সুন্দর, দামি একখানা শাড়ি উপহার দিয়েছিল।’ কিন্তু মায়া সেটি পরেনি, আসাদের অনুনয় সত্ত্বেও। মায়ার মনে ছিল যেদিন আসাদের জন্য দামি কাপড় কিনতে পারবে- সেদিনই সেটি পরবে। কিন্তু ভাগ্যে সহায়ক ছিল না। শাড়িটি তাই পড়েই ছিল ট্রাংকের তলায়। সেটিই সীমা আন্টির এবারের জন্মদিনে উপহার হিসেবে নিয়ে যায়। শাড়ির প্যাকেট হাতে পেয়ে সীমা আন্টি ভারি খুশি। কারণ, তিনি অর্কের মায়ের কাছ থেকে এমন দামি উপহার আশাই করেননি। লেখকের ভাষায়- “আরো অনেক কথাই বুঝি বললেন সীমা আন্টি। সেসব কিছুই কানে গেল না মায়ার। দুচোখ ভরা জল নিয়ে মায়া সীমা আন্টির হাত ধরে কোনোক্রমে বলল, ‘অর্ক যেন আপনার স্কুলে চান্স পায়’।”
আনোয়ার হোসেন পিন্টুর অন্যতম সেরা গল্প ‘প্রকৃত প্রকৃতি’। এর নামের মধ্যেই একটি গূঢ় অর্থ আছে। ‘প্রকৃত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, আসল, বাস্তবিক, কিংবা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। অন্যদিকে, ‘প্রকৃতি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, বাইরে জগৎ, আচার-আচরণ ইত্যাদি। এই গল্পটির অভ্যন্তরে উপর্যুক্ত কথাগুলোর রূপায়ণ দেখা যায়। গল্পটির ভেতরে যাওয়ার আগে আমাদের একটু মনোদর্শনের প্রেক্ষাপট বিচার করতে হবে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো মানুষের মনকে দেহ থেকে একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবেই দেখতেন। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতির কারণে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে। এটি আমাদের মন-সম্পর্কীয় বহু রহস্যই উদ্ঘাটন করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই মনোবিশ্লেষণত্ব কিংবা মনঃসমীক্ষণ গোটা বিশ^কে আন্দোলিত করে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞানের জন্ম দেন। ফ্রয়েডের পর মনোবিশ্লেষণ নিয়ে অভাবনীয় কাজ করেন কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং, এরিকসসহ অনেকেই। এই আবিষ্কার শুধু মনোবিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি বিশে^র শিল্পসাহিত্য ও সমাজ-ভাবনার ওপর বিশাল প্রভাব বিস্তারী হয়ে ওঠে। এই আবিষ্কার মানুষকে ভাবতে শেখায় সে শুধু ‘অমৃতের সন্তান’ নয়- এমন কী যুক্তিবাদীও নয়। মানুষ আসলে কিছু জৈবিক প্রবৃত্তি এবং আবেগ দ্বারা চালিত যে নিজের বিষয়ে অন্ধ। ফলে, মানব-মনের অন্তরালের অনেক গোপন রহস্য তা তুলে ধরে। ফ্রয়েড মানব-মনের অবচেতন অংশের ক্ষণিকটা উন্মোচন করে দেখান।
‘প্রকৃত প্রকৃতি’ গল্পের ভেতরে মানব-মনের নানা জটিল সমীকরণের কথা লুক্কায়িত আছে। গল্পটির দুইটি দিক আছে। ১. এটি একটি সাধারণ গল্পমাত্র। যে কেউ এর আস্বাদ নিতে পারেন। ২. এটি দুজন মানুষের পার্থিব বাসনা-ঊর্ধ্ব সম্পর্কের এক জটিল-গভীর ভাবের প্রকাশও বটে। গল্পের ফরিদ মামা এবং শাশুড়ি মা আনোয়ারা তাদের দুরকম জীবন সত্ত্বেও দুজন নিজেদের মধ্যে এক অপার্থিব ভাব-ঐক্য গড়ে নিয়েছেন। যা সাহানা তথা সানুর সহ্য হয় না। ‘সর্ব শরীর দিয়ে খড়ি উঠেছে। কাশফুলের মত একমাথা সাদা চুল তেলহীন, যেন পানিশূন্য। হাওয়ায় উড়ে এলোমেলো। কী রকম বাউ-ুলে! এরকম চেহারার কোনো মানুষের দিকে তাকালে কেমন একটা অস্বস্তি হয় সাহানারার। সাহানা একজন সাধারণ গৃহবধূ। সংসার আর কন্যার পড়াশোনার দেখভাল এবং স্বামীর ব্যস্ততার মধ্যে সুখের অন্বেষণকারী এক নারী মাত্র। কিন্তু তার শাশুড়ি আনোয়ারা স্বামীহারা, ব্যস্তপুত্র, সংসারমুখী পুত্রবধূকে নিয়ে একটি বাস্তব জগতের অভিযাত্রী। কিন্তু কবি আনু সমাজকর্মী। তার অন্তর্জগতের সবটাই শূন্য। আর এই শূন্যতা ভরাট করতে সমাজের চোখে বিচিত্র স্বভাবের মানুষ ফরিদকে ভীষণ পছন্দ করে। যে স্বভাবের কারণে আনুর ফরিদকে ভালো লাগে তার সঙ্গ উপভোগ করে- সেখানে সাহানা “আসলে মানুষটার ওই উস্কোখুস্কো, অপরিষ্কার চেহারার জন্যে নয়, এই অদ্ভুত কথা বলার ধরনের জন্য বোধহয় মানুষটাকে ভালো লাগে না সাহানার।”
সাহানার কাছে অবাক লাগে তার শাশুড়ি আনোয়ারা বেগমকে দু’দ- চোখের দেখার জন্য ফরিদ মামার ইচ্ছেটা এখনো মারা যায়নি! যেখানে ট্রাফিক জ্যামের জন্য ঢাকার রাস্তায় বেরোলে সাহানার হাঁসফাঁস লাগে সেখানে এই বৃদ্ধ লোকটি কী করে সপ্তাহে দু-তিন দিন সাভার থেকে ঢাকার মগবাজার আসা-যাওয়া করে! বিচিত্রও বটে। সাহানা তার স্বামী বোরহানকে অভিযোগ করে-‘তাই বলে এখন আমার সংসারে ঢুকে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।’ লোকটা তার শাশুড়িকে যেন সম্মোহিত করে রেখেছে। সাহানা ফরিদ মামাকে দূরত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাঁকে বিদায় করার কথা বললে ফরিদ বলেন, ‘তাতে তেমন কি আর অসুবিধে, হাঁক পড়লেই ডাক শোনা যায় সাভারে।’ সাহানা বুঝতে পারে না তাদের সাদামাটা কথার ভেতর অত হাসির কী আছে? সেভাবে ‘আর এই তুচ্ছ কথাগুলো বলার জন্যে এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে দেখা দিতে আসেন, সেই সাভার থেকে এই মগবাজার! অসহ্য। বিরক্তিকর।’ সাহানা শেষতক হাঁপিয়ে যান। কিন্তু ‘জুতো ছাড়ারও অবকাশ নেই যেন আনোয়ারার। ঘরে ঢোকার মুহূর্তে পরিচিত চৌকাঠে হোঁচট খান। ওই জীর্ণশীর্ণ চেহারার মানুষটাকে দেখে আনোয়ারার শরীরে এখনও এত আবেগ ঢেউ তোলে!’
ফরিদ ও আনোয়ারার মধ্যে ফলের বিচি দাঁতহীন মাড়ি ও জিব দিয়ে আলাদা করার অভ্যাস আছে। দুজনকেই দেখি বিচিগুলোকে নখ দিয়ে খুঁটতে। খুঁটে খুঁটে গুঁড়ো করে ফেলতে। সাহানার কাছে এটা অসহ্য বদভ্যাস। সে ফরিদ মামাকে তার বিরক্তির কথা তুললে তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা যায় না! বরং দাঁত বের করে হেসে বললেন-‘আজকাল ফল খাওয়ার সময় বিচিগুলোকে যে ফেলতে ইচ্ছে করে না। চোখের সামনে রেখে বড় দেখতে ইচ্ছে করে।’ আমরা বুঝতে পারি এই বিচিগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে আরেক জীবনের উন্মেষ। শুধু যথাযথ স্থানে পুঁতে দিলেই হয়। অন্যদিকে, আনোয়ারার অভিমত হচ্ছে-‘এটা করতে কেন ইচ্ছে হয় সেটা আমি বুঝতে পারি, ফরিদ। দেখ, এ বয়সে আসতে আসতে আমরা কত খোলস, কত আবরণ ঘসিয়ে এলাম।’ আনোয়ারা ফের বলতে থাকে-‘জান, একটা প্রচ- জোরে ঘুরে চলা চাকায় একটা বাধ্য নাট-বল্টুর মতো আটকে আছি…। একদিন দেখবে চাকার গা থেকে নাটবল্টুও খসে পড়ে গেছে। জীবন তো এরকমই। এখানে এসে তুমি যখন বকবক করো-সেই মহাস্থান গড়ে যাওয়ার কথা, সেই কবিতা লেখার কথা বল, তখন আমার কী মনে হয় জান? বেঁচে থাকার পথে বড় বড় ঘটনাগুলো আসলে বাইরের খোলস।’ আনোয়ারা আরো বলেন, ‘আবরণ খষালে জীবনটা আরো পরিষ্কার দেখা যায়।’ ফরিদ যে হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সেটাই জীবনকে দেখা। কিন্তু তার বৌমার সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই। সাহানাকে দোষ দিয়েই বা লাভ কী? কারণ, সাহানার অপরিপক্ব মন এই ষাটোর্ধ্ব দুই মানুষের অন্তর্গত মনস্তত্ত্বের তল খুঁজে পাবে না। কিন্তু এ দুজনের এসব বিচিত্র ও দর্শনাক্রান্ত কথার ভেতরে ভেতরে সাহানার ভাবনার জগতে নতুন উপলব্ধি ঘটে-সে আর ফরিদ মামার ওপরে রাগ করতে পারে না।
‘রক্ত-সুখ’ এক নিঃসন্তান দম্পতির গল্প। ফরিদা অপারেশন থিয়েটারের নার্স। সাহেদ কী চাকরি করে তা পরিষ্কার জানা না গেলেও ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, কালার টিভি এবং সম্প্রতি কেনা হোন্ডা মোটরবাইক নিয়ে সচ্ছল মধ্যবিত্ত সংসার বলা যায়। কিন্তু দুজনের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়ার পরও মসৃণ ও নির্ঝঞ্ঝাট সংসারে ‘কোথায় যেন একটা শূন্যতা কাঁটার মতো বিঁধে থাকতো।’ তাদের বিয়ের দীর্ঘ চৌদ্দ বছর কেটে গিয়ে বিষয়টি এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। নিঃসন্তান হয়ে সাহেদ ও ফরিদা যে কত সুখী, তারাই সব সময় সেটাই প্রমাণ দিয়ে চলে। সন্তানহীনতার কষ্ট তাদের বর্ণগন্ধময় যৌথজীবনে দাঁত ফোটাতে পারেনি। এখানেই কী সাহেদ ও ফরিদা জিতে যায়?
গবেষণায় জানা যায় যে, বেশির ভাগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে নিঃসন্তানতাকে একটি ট্র্যাজেডি হিসেবে দেখা হয়। এর সঙ্গে ঐসব দম্পতির মানসিক পীড়ন-যন্ত্রণা এবং শোক জড়িয়ে যায়। তারা নিজেদের ভেতরকার কষ্টের লক্ষণগুলোকে অনুভব করতে পারে। যা একজন শোকগ্রস্ত ব্যক্তির অভিজ্ঞতার মতো। এতে করে ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত ও মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। এছাড়াও সামাজিক কটাক্ষের শিকার হন এরা। বন্ধ্যত্ব যে মানসিক বিকার তৈরি তার কারণ পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্ব প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অন্যতম আকাক্সক্ষা। সেই ইচ্ছে পূরণ না হলে রাগ, বিষন্নতা, উদ্বেগ, ভয়, জড়তা, হিংসার উদ্রেক ঘটে। মহিলারা এর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। গর্ভধারণের অক্ষমতার জন্য নারীরা নিজেকে বেশি দায়ি মনে করে। ফলে, তার মধ্যে একধরনের অপরাধবোধের জন্ম নেয়। পারিবারিকভাবে বিছিন্নতার অনুভূতি হয়। যেসব দম্পতি বন্ধ্যত্বের শিকার তারা যৌন-জীবনে ইরেক্টাল ডিসফাংশনে ভুগতে পারে। এইসব নানাবিধ বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টর জীবনকে মারাত্মকরূপে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এ রকম একটি সূক্ষ্ম মানসিক অসুস্থতার চিত্র আমরা এই গল্পে দেখতে পাই। সাহেদের বন্ধু জাফরের দুটো মেয়ে। এ নিয়ে জাফরের টেনশন খুব। এ নিয়ে সাহেদ ও ফরিদার কিছু উক্তি তুলে ধরা যাক-
১. সাহেদ বলে-‘ওরকম বলতে নেই। ছেলে মেয়ে থাকা না-থাকার নয়, ব্যাপারটা হলো বেঁচে থাকা বা সংসারধর্ম। এটাও এক জাতের শিল্প।’
২. ফরিদার উক্তি-‘জাফর ভাইয়ের মেয়েটা যা পাকা! কোনো দিন শুনবে, ওই বখাটে ছেলেটার হাত ধরে পালিয়ে গেছে।’
৩. সাহেদ আঁতকে ওঠার ভঙ্গিতে বলে-‘ইস্, কি লজ্জা।’
৪. ফরিদা বলে-‘বল, আমি বেশ বুঝতে পারছি। কম বয়সে অমন গ-গোলে জড়িয়ে প্রেগনেন্সি নিয়ে পরে অনেকেই অ্যাবরশন করাতে আসে, আমি জানি।’
৫. শাশ^ত ঋতুচক্রের মতো সাহেদ ও ফরিদার সংসারে একটি কথাই ঘুরে চলেছে তা হলো-‘আমরা ভালো আছি।’
৬. ফরিদা বলে-‘আচ্ছা, ধরো জাফরের ভাগ্যে সত্যি তেমন কিছু যদি হয়, চেনা মুখ দেখাবে কী করে।’
উপর্যুক্ত উক্তিগুলো থেকেই আমরা বুঝতে পারি এরা কখনো ঈর্ষা, কখনো বেদনা, কখনো অপরের প্রতি সহানুভূতি, কখনো আত্মদ্বন্দ্বের শিকার। তারা ভাবছে ভালো আছে। কিন্তু কোথাও শিকড় কাটা-যন্ত্রণা লুকানোর অদম্য চেষ্টা আছে। কিন্তু তা নানামুখী ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু পাঠক অন্তঃশীলায় এদের গভীর বেদনার সঙ্গী হন।
গল্পে যখন অর্থনৈতিকভাবে অভাবগ্রস্ত হয়ে ফরিদার ভাই শওকত তাদের সংসারে সপরিবারে উপস্থিত হন, তখন তা তাদের অন্য এক সমস্যার সম্মুখীন করে। তাদের ‘জটিলতাহীন সংসারে, নিজের নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে দু’জনে ফিরে আসার পর, যেহেতু তৃতীয় কোনজনের উপস্থিতি নেই, তারা যেভাবে ইচ্ছা, যেমন খুশি, সংগ্রহ করে নিতে পারে সুখের আরক। তা মানসিক, জৈবিক বা প্লেটোনিক যা কিছু হতে পারে। ঘরের মধ্যে তাদের বাক্যহীন হাঁটাচলা, চোখে চোখে সম্ভাষণ, আলিঙ্গন, চুম্বন, শয়ন, রমণÑসবই এমন মসৃণতায় সহজতায় ম-িত যে, তা আর বলার নয়।’ কিন্তু শওকত, তার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে এসে তাদের সেই কাচের ঘর ভেঙে দেয়। শওকতের ‘অর্থনৈতিক অসুখের গন্ধ’ তাদের নাকেও এসে ধাক্কা দেয়। বাজার থেকে ফিরে সাহেদ দেখে তার অতিসাধের পোড়ামাটির ঘোড়াটি ভেঙে চৌচির। সাহেদ দাঁতে দাঁত ঘষেও বলে-‘ঠক আছে। মাটির তো একদিন ভাঙতোই। তা তুমি ব্যথা পাওনি তো?’ সাহেদ হতাশা নিয়ে দুই ভাই বোন খোকন ও ডলির রস গড়ানো মিষ্টির বাটি নিয়ে ছুটে বেড়ানো কিংবা টেবিলে মাংসের টুকরো নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া দেখে। ফ্রিজে রাখা বড় কোকের বোতল সাবাড় করে খোকনের গলা ব্যথা ও জ¦র নিয়ে অশান্ত হলেও মুখে বলে-‘আহা, বাচ্চারা একটু দুষ্টু না হলে ভালো দেখায় না, শওকত ভাই।’
এ রকম নানা অনুষঙ্গের মধ্যদিয়ে গল্পটি এগিয়ে যায়। বাচ্চাগুলোর আচরণে তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ। ফরিদা চাপা স্বরে শুধু বলে-‘ওদের শুধু জন্মই দিয়েছে ভাবি, কোনো শিক্ষাই দেয়নি।’ কড়া মন্তব্য করতে গিয়ে ফরিদার ভাই বলে থমকে গিয়ে শুধু বলে-‘ঠিক বলেছে, মা হওয়া মুখের কথা নয়।’ সাহেদকে ফরিদা যখন বলে শওকত ভাইয়ের কিছু টাকার দরকার। বাড়ি ভাড়া, খোকনের স্কুলের মাইনে বাকি। সাহেদ হেসে বলে-‘তা এর জন্য এত চিন্তা কিসের! তবে, শওকত ভাই কথাটি আমাকে বললেই পারতেন, কালই দিয়ে দিতাম। নিজে পাওয়ার চাইতে অন্যকে দেওয়ার সুখ আরো বেশি, তাই না?’ ফরিদা অবাক হয়ে ভাবে-‘নিজে পাওয়া’ বলতে সাহেদ ঠিক কী বোঝাতে চাইলো? দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের দাম্পত্য জীবনে সুখের সন্ধানই করে গেছে দুজন। কিন্তু ফরিদার মনে সংশয় দলা পাকিয়ে ওঠে। সাহেদকে প্রশ্ন করে-‘আচ্ছা, সুখেরও তো অসুখ হতে পারে, পারে না?’
‘সুখ পলাতক’ গল্পে ‘ফেমিনিন সাইকোলজি’ অর্থাৎ নারীর মনস্তত্ত্ব উঠে এসেছে। চল্লিশোর্ধ্ব নারীর মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। নারী এ সময় নিজের মুখোমুখি হয়। ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে যায়। সংসারে খানিকটা অবসর পাওয়া যায়। নিজের দিকে ফিরে তাকাবার সময় হয়। এ সময় তার ব্যক্তিসত্তায় পরিবর্তন ঘটে। তার শারীরিক ও মানসিক এই পরিবর্তনকালে সে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সময় নারীদের ফিমেল হরমোন ‘এস্ট্রেজেন’-এর নিঃসরণ ঘটে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে-এই বয়সের ৮০ ভাগ নারীই অসুখী বোধ করে। একাকিত্ব, বিষন্নতা, সন্দেহ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। স্বামীর প্রতি অবিশ্বাস বাড়ে এবং সে অন্য কোনো সম্পর্কে (ইনফ্যাচুয়েশন) জড়িয়ে পড়ছে কিনা তা নিয়ে তুমুল মনোদ্বন্দ্বের পড়ে যায়। এমন কি নিজেও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়তে পারে স্বামীর অবহেলা নোটিশ করলে। কারণ-
As both men and women grow into middle and older ages, gain more life expirience, and feel more secure, They often become more comfortable expressing a fuller range of emotions, including thoseÑfor me especially-they have long suppressed. But there’s no getting around the fact that women have different emotional perceptions-based on brain circuitry and functionÑare at the heart of many interesting misunderstandings.
(They famale brain.’ Page-133, by Louann Brigendine, Broadway books, New York. 1952.) গবেষণায় আরো দেখা গেছে মহিলাদের অবসাদের মাত্রা বহুমুখী। এটা মেয়েরা জিনগতভাবে এবং তাদের বয়ঃসন্ধিকালেই বিষন্নতা অর্জন করে। যেসব মেয়েদের পারিবারিক বিসাদগ্রস্ততার ইতিহাস আছে তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি হয়। অনেকেই ক্লিনিকে আসে মূলত পারিবারিক সম্পর্কে ফাটল ধরার কারণে।
গল্পে দেখা যায় ছায়া ও মায়া দুইবোন। ছায়া বড়জন, মায়ার সঙ্গে তার কথোপকথনে বের হয়ে আসে ছায়ার আত্ম-উদ্বেগের কথা। মায়া যখন বড় বোন ছায়াকে লক্ষ করে বলে-‘কী দারুণ লাগছে তোকে। কে বলবে তোর বয়স পঞ্চাশ? যা-ই বল, দারুণ রেখেছিস নিজেকে।’ তার উত্তরে ছায়া বলে-‘কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বুড়িয়ে যাচ্ছি রে। ঘরের মানুষটা তো আজকাল বুড়ি বলে ডাকে।’ ছায়া আরো বলে-‘তোর জামাইবাবুর এখনো টনটনে শরীর, চাবুকের মতো। চলাফেরায় বিদ্যুৎগতি। তাকে বুড়ো বললে মানাবে।’ আমরা গল্পের অন্দরমহলে প্রবেশ করে জানতে পারি ছেলে কলেজে পড়ছে। একমাত্র মেয়েটার বিয়ে হয়ে স্বামীর সাথে কানাডায় থাকে। সব ঠিক আছে। কিন্তু ছায়ার মনে শান্তি নেই। তার স্বামী ‘কেশব বাড়ি ফিরলেই এখনো যেন হাজারটা বাতি জ¦লে ওঠে।’ আর সেটাই ছায়ার ইদানীং কেন জানি ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছায়ার বার্ধক্য লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে। অথচ কেশব মধ্য-পঞ্চাশে পৌঁছেও এখনও যেন মধ্য যৌবনে। ইদানীং তার প্রবল আদরে ছায়া হাঁপিয়ে ওঠে। তালে তাল মেলাতে পারে না।
এরকম এক ক্লান্তিকর সময়ে তাদের ঘরে কাজ করতে আসে স্বামী-পরিত্যক্ত পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটি মেয়ে। প্রথম দিকে ছায়ার মনে কোনো সন্দেহ না থাকলেও ছোটবোন মায়ার একটি কথা তাকে তীব্রভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়। মায়া বলে‘তুই জোর করে বাধা দে। জামাইয়ের তাতে যা মনে হয় মনে করুক। ওই কাজের মেয়েটা রাখিস না।’ মায়া আমতা আমতা করে বল‘জামাইবাবু ভালো লোক। তবে বিয়ে ভাঙা মেয়ে সে। যে বাঘ, একবার রক্তের স্বাদ পেয়েছে।’
অনেকদিন পর ছায়া তার ছোটবোনের বাসায় সন্ধ্যাটা কাটাতে এসেছিল। কিন্তু মায়ার কথায় তার মধ্যে সন্দেহের কালো মেঘ উদিত হয়। সঙ্গে একরাশ দুশ্চিন্তা। দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে ছায়া। যেন বোনের কথাগুলো সত্যি প্রমাণ করতে কাজের মেয়ে জবা দরজা খুলতে দেরি করে। দেখতে পায় জবার ‘কপালে সিঁদুরের টিপ থ্যাবড়ানো।’ সে আরো অবাক হয়, রাতে স্নান করছে কেশব! অবিন্যস্ত বিছানার দিকে তাকায় ছায়া, বালিশের পাশ থেকে সন্তর্পণে চুড়ির ভাঙা টুকরো আর চুলের কাঁটা, লম্বা একগাছা চুল যেন মায়ার আশঙ্কাকে সত্যি করে তোলে।
ছায়া গভীর বিষাদে ডুবে যায়। জবা কিছুই নিয়ে পালিয়ে যায়নি। তবু তার মনে হতে থাকে তার সর্বস্ব খোয়া গেছে। ‘মেঝেয় পড়ে থাকা ভাঙা চুড়ির টুকরোটা থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারে না ছায়া।’
‘চিলেকোঠার পৃথিবী’ ব্যর্থ প্রেমের প্রতীকী গল্প। গল্পের চরিত্র হাসান তার ছেলে অর্ককে নিয়ে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ব্যর্থ হয় বার বার। গল্পকার ঘুড়ি ওড়াতে না পারার প্রতীকী ছায়ায় হাসানের প্রথম জীবনের প্রেম সুবর্ণাকে না পাওয়ার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন চমৎকারভাবে। ঘুড়ি ওড়াতে না পারা তার জীবনের হাজারো অকৃতকার্যতার সঙ্গে আরেকটি পালক যুক্ত করে। তার স্ত্রী মিতা খোঁচা দিয়ে তার ব্যর্থতাকে উন্মোচিত করে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে-‘বাল্ব লাগাতে পার না, ছেলের খাতায় একটা ছবি আঁকাতে পার না, সাইকেল চালাওনি কোনোদিন, সাঁতার জান না! ছি ছি, বলো না কাউকে।’
এরকম একটি সময়েই যেন ‘একেবারে গোত্তা খেয়ে ছাদের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়লো ঘুড়ি। পিতা-পুত্র নির্বাক হয়ে সেই পতনের দিকে তাকিয়ে রইলো।’ হাসান ছেলেকে সান্ত¡না দিয়ে বলে বৃষ্টি থামলে ঠিকই ঘুড়িকে সে আসমানে ওড়াবেই। কারণ, ঘুড়িটার সঙ্গে তার আত্মসম্মান আর ব্যক্তিত্বের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু হাসান অনেক চেষ্টাতেও ঘুড়িটাকে ওড়াতে পারলো না। বরং সেটি কিছু দূরে উড়ে সুবর্ণদের হলুদ বাড়িটার চিলেকোঠার কার্নিশে গিয়ে পড়ে। সুবর্ণা চিলেকোঠার সরু লোহার সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গিয়ে ঘুড়িটা হাতে নেয়। ঝাঁকুনি দিয়ে উড়িয়ে দেয় ঘুড়িটা। হাসান প্রাণপণে সুতো টানছে। হু হু করে উপরে উঠে যাচ্ছে ঘুড়ি। গল্পকার একজন অক্ষম মানুষের চিত্র এঁকেছেন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতীকে। সমাজে এরকম হাজারো ডিজেবল হাসানের দেখা পাওয়া যায়। আমরা দেখতে পাই অক্ষম, বুদ্ধিবৃত্তিক, মানসিক ও শারীরিক বিকাশরহিত একজন পুরুষের স্বীকৃত অক্ষমতার মধ্যেও তার প্রেম সুর্বণার প্রতি সে সংবেদনশীল। এই অক্ষমতা তাকে সামাজিকভাবে দুর্বল করে দিলেও প্রেমের উপলব্ধির ক্ষেত্রে সে কোনো সীমানায় আবদ্ধ নয়।
আনোয়ার হোসেনের নামগল্প ‘বিজিত জ্যোৎস্না দাহ’। মূলত ৩টি চরিত্রকে কেন্দ্র করে বড় পরিসরে এই গল্পের প্লট গড়ে উঠেছে। জ্যোৎস্না তার স্বামী ইমরান এবং জ্যোৎস্নার সন্তানের অবৈধ বাবা জাফরকে কেন্দ্র করে এই গল্পের আখ্যান তৈরি হয়েছে। মূলত জ্যোৎস্নার মাতৃত্বের তীব্র আকাক্সক্ষা এবং তা নিয়ে তার অন্তর্গত মনস্তত্ত্বের চিত্রকে রূপায়িত করতে চেয়েছেন গল্পকার।
প্রথম থেকেই জ্যোৎস্নার মধ্যে আমরা এক ধরনের নেতিবাচক আক্রোশ লক্ষ করি। জ্যোৎস্না ও ইমরানের সম্পর্ক শুধু দায়িত্ব পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দরকারি কথা ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোনো ধরনের বাক্যালাপ চলে না। এটা যেন একটি অভ্যাস। এই অভ্যাসের দড়ি জ্যোৎস্নার গলার ফাঁস। এতে জ্যোৎস্না মরে যাচ্ছে। গল্পকার লেখেন-‘মাঝে মাঝে জ্যোৎ¯œার মনের গোপন ইচ্ছা আক্রোশে প্রবল এক বাঁকা হিং¯্রতা হয়ে যেন আশপাশের মানুষগুলোকে সাপের মতোই ছোবল মারতে চায়। তার ইচ্ছা যেন ভয়ঙ্কর এক দাহ। তাকে পোড়ায়। যন্ত্রণা দেয়। হিং¯্র করে তোলে।’
তারপরও জ্যোৎস্নার এই ফাঁসের দড়ি ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সে বলে‘আমি মরতে চাই না আমি বাঁচতে চাই।’ তার এই ডিপ্রেশনের কারণ সন্তানহীনতা। ইমরান তাকে সন্তান দিতে অক্ষম। তার মনে হয় স্বামী অভ্যাসের সংসারে ঠান্ডা পশুর মতো তার চাপাশে ঘোরে। সে তাকে কখনোই আলোর পথ দেখাতে পারবে না। তার ভাবনায় ‘আর একট শিশ্ন? জ্যোৎস্নার ছেলে কি মেয়ে! কিন্তু কেউ নেই। যদি তার রক্ত দিয়ে গড়া কেউ থাকতো এ সংসারে, তছনছ করে ফেলতো সব সাজানো জিনিস। এই তেতলা ফ্ল্যাটকে সারাক্ষণ জাগিয়ে রাখতো অক্লান্ত দাপাদাপিতে। তাহলে হয়তো জ্যোৎস্নার বুকের ভয়ঙ্কর ইচ্ছেটাও ঠান্ডা মিঠে নরম কড়া ইচ্ছেগুলোও দপদপ করে একে একে নিভে যেত।’
জ্যোৎস্না নিশ্চিত হয় ইমরানের কারণেই সে সন্তানের মা হতে পারছে না, এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বচসা হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় ‘হ্যাঁ, এ ফাঁস আমি ছিঁড়বই। পরিপূর্ণতার স্বাদ আমি পাবই। আমি বাঁচতে চাই। আমার রূপ-যৌবন কারুর ভয়ে আমি নষ্ট করব না।’ জ্যোৎস্নার এই ডিপ্রেশন গভীর থেকে গভীরতর হয়। এখানে একটি উদ্ধৃতি দিতে চাই মহিলাদের বিষাদগ্রস্ততা নিয়ে। যা গল্পের জ্যোৎস্নার জীবনের সঙ্গে প্রযুক্ত হতে পারে
Women are more suscepetible to depression. Women are more likly to fall in to depression becouse they often blame themselves for the negative Situation that they are in. A study has concluded that the female brain activates emotion When they feel pain.’
(50 Intriguing phychological facts about women, Internet.)
এখানে আমরা দেখতে পাই জ্যোৎস্নার বিষাদ তার মধ্যে বিশাল এক বিরূপ জগৎ তৈরি করেছে। এই পরিণতির জন্য নিজেকেই দায়ী করে ‘না, কিছু নেই জ্যোৎস্নার। সব আছে, কিন্তু কিছু নেই। তাই, সে যেন এ বাড়িতে থেকেও নেই। একটা ক্ষুধা আছে চারপাশে। আকাশের মেঘে মেঘে, তারায়-তারায়, গাছের পাতায় আলো-ছায়ায় আর ঘরের দেয়ালে দেয়ালে সেই ক্ষুধার ছায়া পড়ে। তখন হঠাৎ হিম হয়ে যায় জ্যোৎস্নার শরীর। সে যেন মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করে রোমকূপে।’ কিন্তু তারপরও অসম্ভব রূপবতী জ্যোৎস্না ইমরানকে ও তার সংসারকে দুপায়ে মাড়িয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে বলতে পারে না। সে বলতে পারে না ‘আর কেউ আসুক তার কাছে। তার দেহে সঞ্চারিত করে দিক আরেকটা প্রাণ। সার্থক হোক জ্যোৎস্নার রূপ-যৌবন। নিজের মধ্যে আরেকটা প্রাণের দাপাদাপিতে সে আবার নতুন করে বেঁচে উঠুক।’
এ রকম হাজারো প্রশ্ন-উত্তর তৈরি করে জ্যোৎস্না সন্তান কামনায় ইমরানের মুখের ওপর বলে দেবে ‘আগের কথা ভেবে লাভ নেই… তোমার অক্ষমতার কথা কে জানতো তখন?’ গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদে গল্পকার আমাদের আড়ালে জানান যে, জ্যোৎস্না পৌঁছে গেছে তৃপ্তির এক উচ্চতম শিখরে। দুঃসাহসী জ্যোৎস্না আরেকটি প্রাণকে তার নিজের দেহের মধ্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছে। আমরা তখনো জানি না তার মধ্যে এই বীজ কে কর্ষণ করেছে। তা গল্পের শেষাংশে জানা যায়।
ইমরানের সন্তান জন্ম দেয়ার অক্ষমতা জ্যোৎস্নার মনে প্রচ- ঘৃণার জন্ম দেয়। এই বৈবাহিক বন্ধনকে তার কাছে ফাঁস বলে মনে হয়। কারণ, সে শুধু যৌনতা নয়; মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চায়। এভাবেই তার জীবনে জাফরের আবির্ভাব ঘটে। সে ভাবে কার জন্য তার এই অতৃপ্তি। কার জন্য তার এই নিঃস্ব একক জীবন? কার জন্যেই বা অভ্যাসের ফাঁস খুলে মনের মধ্যে ভয়ংকর ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেয়ার একটা সাংঘাতিক আগ্রহ?’ এর ফলে জ্যোৎস্না দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। এবং জাফরের সন্তান ধারণ করে। সে নিজেই প্রশ্ন করে। একাজ করে সে ভুল কিছু করেনি ‘একটা অক্ষম মানুষকে নিয়ে আমি সারাজীবন খুশি থাকতে পারছি না।’ এই আত্মক্রন্দন থেকে সে উচ্চারণ করে ‘শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবলেই জীবন সার্থক হয় না।’ সে আইনের প্রসঙ্গও উত্থাপন করে। ‘কিন্তু তুমি অনেক দিন আগেই আমার কাছে ছোট হয়ে গেছ। ভুলে যেও না যে, আইনের সাহায্য নিলে এক কথায় আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি।’ জ্যোৎস্না যে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে সন্তান নিয়েছে তাতে আইনের চোখে সে দোষী নয়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘বাংলাদেশের আইনে দ-বিধি ৪৯৭ ধারা মতে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জন্য পুরুষের পাঁচ বছর সশ্রম, বিনাশ্রম এবং অর্থদ- ইত্যাদি সাজা হতে পারে। কিন্তু আইনে নারীর কোনো শাস্তির কথা নেই। হয়তো জ্যোৎস্না সেজন্যই বলতে পারে ‘আইনের ওপরে আর কিছু নেই।’ কারণ, ইসলামী শরীয়ত মতে ‘নিজের সন্তান থাকা নারীর নিরঙ্কুশ অধিকার, যদি তার স্বামী, পুরুষত্বহীনতা, বন্ধ্যাত্ব বা ইচ্ছার অভাবের মাধ্যমে তার অধিকার পূরণ করতে অক্ষম, তার শরীয়তের অধীনে তালাকের জন্য ফাইল করার ক্ষমতা রয়েছে। (ছঁড়ৎধ, ইন্টারনেট)।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে জ্যোৎস্না একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের পর ‘কিন্তু কঠিন সোপান পেরিয়ে জ্যোৎস্না পৌঁছে গেছে তৃতীয় এক উচ্চতম শিখরে।’ জ্যোৎস্না এতবড় একটি খবর নিজের মধ্যে চেপে রাখার মেয়ে নয়। তাই হ্যাঁ, মনের এই কথাগুলো জ্যোৎস্না একদিন জানিয়ে দেবে ইমরানকে। সম্ভব হলে আজই। রূঢ় একটা আঘাত লাগুক তার বুকে। সে ভেঙে পড়–ক কিংবা জ¦লে উঠুক। এতে কিছু যাবে আসবে না জ্যোৎস্নার।’ এটাই সত্যিকার নারীর অন্তর্গত মনস্তত্ত্ব। এ বিষয়ে নারীরা খুবই আবেগপ্রবণ বলা যায়।
One of the most striking aspects of women’s phychology is ther emotional processing, Women are often regarded as being more attuned to thire emotion then men. (Wikipedia)
এই আবেগের কারণেই সে ইমরানের ভালোত্বকে গ্রহণ করতে পারে না। তার মধ্যে সন্দেহ ইমরান সবকিছু বুঝেও ভান করছে। তার এই অতি আবেগী মনের জন্য তার সন্তানের জন্মদাতা জাফরকেও পুড়িয়ে মারতে চায়। আর সেটা ‘রূপের কিংবা বুক নিংড়ানো কামনার আগুনে নয়। অন্য আর এক আগুনে, এক ভয়ংকর সত্য ঘোষণা করবার ক্ষিপ্ত ইচ্ছায়।’ কারণ, জাফর তার পিতৃত্বের অধিকার ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। জ্যোৎস্নার মনের এই ভয়ঙ্কর আবেগ ইমরান আর জাফরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সে দুঃসহ যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে তার সন্তানকেও বাদ দেয় না‘হঠাৎ যেন আগুনের শিখা কাঁপে ওর চোখের তারায়। হিং¯্র দৃষ্টিতে দেখে খোকনকে। মাতৃত্বের কথা ভুলে যায়। ওর ঘুম ছোটানো কামনার কথাও এখন তার মনে থাকে না। যেন ওই ছোট্ট মানুষটাই দায়ী তার এই অসহায় অবস্থার জন্য। এখন কী করবে জ্যোৎস্না?’ সে নিজেকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। বাস্তবতা নয়; আবেগই তাকে আজ এখানে একা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জ্যোৎস্না হাঁপায়। দীর্ঘ নিঃশ^াস ফেলে। কারণ, এই কর্ম তাকে অন্তরে কুরে কুরে খায়। সে তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
জ্যোৎস্নার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হতে শুরু করে। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানুষ সাধারণত ডিলিউশন কিংিবা হ্যালুসিনেশনে ভুগতে পারে। এ ধরনের রোগের মূল কারণ ভুল ধারণা, অবান্তর চিন্তাভাবনা, অকারণ সন্দেহ, বিভ্রান্তি, বিড়ম্বনা ইত্যাদি। জ্যোৎস্না এই মনোবৈকল্যের শিকার। এটা হয়েছে তার অস্বাভাবিক মানসিক চাপ থেকে। যার ফলে তার মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত আচরণের কথা লেখক গল্পে তুলে ধরেছেন। এজন্য তার মধ্যে আগ্রাসী আচরণ লক্ষ করা যায়। এটা তার অবৈধ গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। ফলে সে এক জটিল প্রতিকূলতার মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। একাকিত্ব এবং বিষণতার কারণে তা চূড়ান্ত রূপ লাভ যা তার মধ্যে তীব্র উদ্বেগ তৈরি করেছে।
জ্যোৎস্না-পূরাণকথার (ভারতকথা) অনুসারে আর্যদের সময়ে আট প্রকার বিবাহের কথা জানে না। মনুসংহিতার (৯/১৬৭) শ্লোকমতে জানে না ‘ক্ষেত্রজ’ সন্তান ধারণে ভারতীয় রমণীদের স্বাধীনতার কথা। ‘ক্ষেত্রজ’ মতে “অপুত্র মৃতব্যক্তির স্ত্রী, ব্যাধিযুক্ত ভর্তার স্ত্রী, অথবা ক্লীবের স্ত্রীর নিয়োগ প্রথাতে যে সন্তান তাহাকে ক্ষেত্রজ পুত্র কহে।” অর্থাৎ স্ত্রী কিংবা তার পরিবারের সম্মতিতে অন্যের দ্বারা গর্ভধারণ করা যায়। জ্যোৎস্না ইমরানের বন্ধ্যাত্বের কারণে জাফরের সন্তান ধারণ করেছে। কিন্তু তার রক্ষণশীলতা এবং দীর্ঘদিনের লালন করা ধর্মীয় আর্কিটাইপের কারণে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়েছে। একদিক অনাস্বাদিত মাতৃত্বের জন্য সে ব্যাকুল। এবং পূর্বপরিচিত জাফরের বীর্য ধারণ করে সন্তান জন্মদানে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে তার মনোজগতে একটা কল্পিত মিথ্যা তাকে বিভ্রান্ত করে। তাই জাফরের সঙ্গে আলাপে সে জানায়Ñ‘আমি, খোকন তার কাছে আমরা দুজনই তো দুটো জ¦লন্ত মিথ্যা!’ এই মিথ্যা থেকে সে পালাতে চায়। সে বলেÑ‘ওকে ইমরানের কাছে ফেলে আমি একা কোথাও দূরে কোথাও চলে যাব…।’ জ্যোৎ¯œার সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে যখন ইমরান বলেÑ‘হবেই তো! আমিও ছোটবেলায় খুব দুষ্ট ছিলাম।’ ইমরানের একথায় জ্যোৎ¯œা চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার মনে হয় সিরসির করে কী যেন তার গা বেয়ে উঠছে। আরশোলা নাকি শীতের পোকা? সে ভয় পায়। চমকে ওঠে খুব। সে আর ইমরানের সামনে বসে থাকতে পারে না। একটি মিথ্যা তার চোখের সামনে অল্পে অল্পে রূপালি চাঁদের মতো সত্য হয়ে উঠছে! সে ভাবেÑ‘কিন্তু ইমরান বোধহয় সব পারে! কী অলৌকিক ক্ষমতায় সে সৃষ্টি করেছে এক আশ্চর্য পরিবেশ! একটা মিথ্যা, যা মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, তাকে কী ক্ষমতায় বশ করে নিজেকে পূর্ণ করে তুলেছে ইমরান লৌকাতীত মহিমায়। আর জাফর? নিজে? যে ফাঁস একদিন গলা থেকে খুলে সে মুক্তি চেয়েছিল, তা খুলতে গিয়ে বাঁধন আরো দৃঢ় হলো। আরেকটি মানুষের গলায় সেই এক ফাঁস পরিয়ে তাকেও যেন মৃত্যুর পথ দেখিয়ে দিল জ্যোৎ¯œা। ইমরানের মতো খোকনের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সোহাগ জানাবার সাহস কিংবা অধিকার, যে কোনোটাই নেই জাফরের।’ বন্ধ্যাপুরুষ ইমরান কী লোকলজ্জার ভয়ে কৃত্রিম পিতৃত্ব মেনে নিচ্ছে? নাকি অকৃত্রিম পিতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে খোকনের মধ্যে? এটা জ্যোৎ¯œা বিশ^াস করতে পারে না। শুধু ভাবে ইমরানের মধ্যে আরো কিছু আছে যা তার বোধগম্য নয়। কোনো চেষ্টা করেই জ্যোৎ¯œা তার সন্ধান পায় না। তাদের দুজনের মধ্যে এই বেমানান শিশুটি যে কোনো সময় ইমরানকে ভয়ংকর মূর্তিতে আবির্ভূত করতে পারে। আর কোনো কথা ভাবতে পারে না জ্যোৎ¯œা। সে তারপর অন্য ঘরে চলে যায়।
আনোয়ার হোসেন পিন্টুর ‘বিজিত জ্যোৎস্নার দাহ’ গল্পগ্রন্থের আটটি গল্পই বলা হয়েছে আটপৌরে ভাষায়। আপাত কোনো জটিলতা তৈরির চেষ্টা গল্পকার করেননি। তিনি বর্ণনামূলক আখ্যান বেছে নিয়েছেন। প্রতটি গল্পে চরিত্রের সংখ্যা বেশি নেই। গল্পকারদের চেতনা-প্রবাহ রীতি কিংবা জাদুবাস্তবতার ধারা কোনোটিই তিনি গ্রহণ করেননি। কিন্তু গল্পগুলো মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে সামাজিক ও ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ক্ষরণের চিত্র ধরা পড়ে। প্রতিটি গল্পের প্লট আলাদা। আজকের পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজের সর্বক্ষেত্রে পচন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের অস্তিত্বের সংকট ঘনীভূত। আনোয়ারের অনুসন্ধানী কলম সমাজের বিশেষ কিছু চরিত্রকে ধরার চেষ্টা করেছে। একদিকে সমাজের বৈষম্য-অসাম্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের টিকে থাকার লড়াই। অন্যদিকে নারী-পুরুষের জৈব-জীবন ও মানসিক দ্বন্দ্বের যে চিরকালীন রূপ ও রসায়ন তাকে খুলে দেখানোর চেষ্টা লক্ষ করি। গল্পকার নৈর্ব্যক্তিকভাবে চরিত্রগুলো রূপায়ণ করেছেন। কিন্তু কিছু চরিত্র যেন তার মনস্তত্ত্বের অন্তর্জগৎকে উন্মোচিত করে। তার গল্পের মূল সুরকে এভাবে চিহ্নিত করা যায়-
১. সরল বাক্য নির্মাণ। ২. কাব্যিক ও চিত্রধর্মী। ৩. আত্মকথনের চেতনা। ৪. ফ্লাশব্যাকের ব্যবহার। ৫. মনোবিকলন। ৬. মুক্তির আকাক্সক্ষা। ৭. অসমাপ্ত পরিণতি। ৮. দাম্পত্য সম্পর্কের টানপড়েন। ৯. নারীর মনস্তাত্ত্বিক জাগরণ। ১০. মানুষের অসম্পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য।
প্রথম গল্প ‘সামনে অন্ধকার’-এ একজন ধর্ষিত কন্যার বিচারপ্রার্থী শিক্ষক বাবার মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ কেউ আছে সমাজে। এখানে বিচার চাওয়া আবারো ধর্ষণের নামান্তর মাত্র।
দ্বিতীয় গল্প ‘আগন্তুক’-এ আমরা দেখি একজন ফেরারী আসামির প্রতিও নারী মনের মাতৃত্ববোধ জাগরূক।
তৃতীয় গল্প ‘উপহার’-এ আমাদের নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিপর্যয় ঘটে গেছে তার এক করুণ রেখা অংকন করা হয়েছে।
চতুর্থ গল্প ‘প্রকৃত প্রকৃতি’-এ পড়ন্ত বয়সের দুই মানব-মানবীর অন্তর্নীল রহস্যঘেরা এক জগৎ যেখানে আরেক নারী পৌঁছোতে পারছে না।
পঞ্চম গল্প ‘রিক্ত সুখ’-এ আপাত সুখী এক নিঃসন্তান দম্পতির সাজানো সংসারে ভাঙন ধরায় এক আত্মীয় পরিবারে উপস্থিতি।
ষষ্ঠ গল্প ‘সুখ-পলাতক’-এ আমরা দেখি এক সুখী দম্পতির ঘরে স্বামী পরিত্যক্ত এক যুবতীর আগমনে বিশ^াস ভঙ্গের কারণ ঘটেছে।
সপ্তম গল্প ‘চিলেকোঠার পৃথিবী’-তে আমরা দেখি সব মানুষ স্বাভাবিক সক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না, একজন ভীতু মানুষ যেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে অকৃতকার্যতার স্বাক্ষর রেখে যান।
শেষ গল্প ‘বিজিত জ্যোৎস্নার দাহ’-এ একজন নিঃসন্তান নারীর সন্তান কামনায় তার স্বামীর ক্লবিত্বের (বন্ধ্যাত্বের) কারণে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। এবং তৎপরবর্তীকালের মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত তার মনোবিকলন কিংবা তার সিজ্রোফ্রেনিক মানসিকতার উত্থান ঘটায়।
গল্পকার আনোয়ার হোসেন পিন্টু তার গল্পের চূড়ান্ত সমাপ্তি টেনে দেন না। তবে একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে রাখেন। তিনি সংকেতের মাধ্যমে পাঠক-মনের জানালা খুলে দেন। ছোটগল্প নিয়ে লেখা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত চরণের মতোই-
“অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ।”
এজাজ ইউসুফী, কবি ও সম্পাদক- লিরিক