প্রদীপ খাস্তগীর
সাহিত্য—শিল্প—সংষ্কৃতির নিয়মিত প্রকাশিত আমার কাছে ভালোলাগা কাগজগুলোর মধ্যে একটি ‘আন্দরকিল্লা’। ২৭ বছর ধরে বহমান আন্দরকিল্লা পাঠ করার একটি অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। আগেই স্বীকার করে নিই কাগজটি একটানে পড়ে ফেলার মত নয়। কেননা এতে এমন কিছু বিষয়—আশয় থাকে যেগুলো বারবার পড়তে বাধ্য হই এবং এই পুনর্পাঠ নিজেকে ঋদ্ধ করে। আন্দরকিল্লার সম্পাদক কবি ও লেখক মুহম্মদ নুরুল আবসার নভেম্বর সংখ্যাটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে রিভিউ লেখার অনুরোধ জানালে একটু ঘাবড়ে যাই; কারণ ভালো—মন্দ ও খাদ—নিখাদ বিবেচনার সক্ষমতার ঘাটতি আমার মধ্যে আছে। তবে ভরসা এটুকু তিনি আমাকে নিজের মতন করে লেখার তাগিদ দিয়েছেন।
এবারের সংখ্যাটি আমার কাছে অন্যরকম। এ সংখ্যায় বাংলা ও বাঙালির পরমাত্মীয় সদ্যপ্রয়াত ইংরেজ লেখক ও পন্ডিত উইলিয়াম রাদিচের ওপর ‘দু’টি সুখপাঠ্য লেখা রয়েছে। লেখা দু’টির লেখক মহীবুল আজীজ ও হোসাইন কবির। দু’জনই অধ্যাপক ও সরস লেখক। তাঁরা উইলিয়াম রাদিচকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন। লেখা দুটি জানান দেয়, ধ্যান—সৃজনে, মন—মননে রাদিচে কতটুকু বাঙালি ছিলেন। রাদিচে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের চেয়েও ঢের বেশি বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন।এ সংখ্যায় আফ্রো—আমেরিকান কবি ও লেখক বন্ডউইনের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কবি ও অনুবাদক মুজিব রাহমানের অনুসন্ধিৎসু লেখাটি এতই সিদ্ধ যে বর্ণ—বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঘৃণার উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। এবারের সংখ্যাটিতে বিদেশি সাহিত্যের আধিক্য রয়েছে।
ধ্রুপদি চীনা লোকসাহিত্যিক গাও শিৎপিয়ানাকে নিয়ে কবি হাফিজ রশিদ খানের বীক্ষণ একটি চমৎকার উপস্থাপনা। নোবেল বিজয়ী একমাত্র চীনা মনীষা স্বদেশে ব্রাত্যজন, অথচ
সমগ্র বিশ্বে তাঁর শিখা প্রজ্বলন। বিখ্যাত জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির বিশ্বসাহিত্যের একটি পরিচিত নাম। তাঁর শেহারাজাদে অনুবাদ করেছেন কবি ও অনুবাদক জ্যোতির্ময় নন্দী। আরব্য রজনীর একটি চরিত্র নিয়ে রচিত এই আখ্যাানটিকে নিপুণ অনুবাদ করে নিপুণভাবে জ্যোতির্ময় নন্দী ফুটিয়ে তুলেছেন। এটা ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্ব।
আঞ্চলিক উপন্যাস আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলী নিয়ে আহমেদ মাওলার গ্রন্থালোচনাটি একটি মৌলিক রচনার মতই স্বতন্ত্র লেখা। সলিমুল্লাহ খানের আদমবোমা নিয়ে মুহাম্মদ ইসহাকের গ্রন্থালোচনাটি পাঠককে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করে। মুসবার সুলতানার জাতীয় নেতা তাজউদ্দিনকে খোলা চিঠি এবং কবি আসাদ চৌধুরীকে নিয়ে মোস্তফা হায়দারের লেখা দু’টি সুখপাঠ্য। এই লেখাগুলো ভালোভাবে বুঝার জন্য বারবার পড়েছি। অন্যলেখাগুলোর মধ্যে যে ক’টি পড়েছি ওগুলো মনে রাখার মতো এবং তাও পুনর্পাঠ যোগ্য। অনেকেই ভালো কবিতা ও গল্প লিখেছেন; তাদের সম্ভাবনা বেশ উজ্বল। আমার মনে ভীষণ দাগ কেটেছে আলোকচিত্রী নাজমুল হুদার মুক্তিযুদ্ধের প্রদীপ স্মারক ঠাকুরগাঁওয়ের ভাস্কর্য চিত্রটি।
এই সংখ্যায় এমন একজন বিদেশি শিল্পীকে জানলাম যিনি আন্দরকিল্লা অন্তপ্রাণ। আজারবাইনী এই বিদুষিনী শিল্পীর নাম রামিনা সাদাতখান। শিল্পের ভুবনে তিনি আন্তর্জাতিক মানের। তিনি ‘আন্দরকিল্লা’র অনেক প্রচ্ছদের ¯্রষ্টা। চমৎকার তাঁর রঙের বুনন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন জামি ও আ.ম.ম. মামুন। দু’জনেই সরকারি কলেজের অধ্যাপক। ইংরেজি থেকে অনূদিত এই লেখাটিতে একজন ভিনদেশী আন্দরকিল্লাপ্রেমি শিল্পীর মন ও প্রাণের টান মূর্ত হয়ে উঠেছে।
প্রদীপ খাস্তগীর, কবি ও প্রাবন্ধিক