এখন সময়:রাত ১২:৫৯- আজ: বুধবার-১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

এখন সময়:রাত ১২:৫৯- আজ: বুধবার
১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

আশ্চর্য মরণ

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

 

এসে গেল বিল্লালের আইসক্রিম-এর প্রচার গাড়ি। বিল্লালের আইসক্রিম-এর প্রচার গাড়ি লক্ষ্য করে সোজা চলে আসুন! বিল্লালের আইসক্রিম-এর প্রচার গাড়িতে পাচ্ছেন ছানা, দুধের চাঁছি, দুধের সর, নারকেল, কিশমিশ, কাজুবাদাম, কমলালেবুর রস আর সন্দেশ দিয়ে তৈরি স্পেশাল আইসক্রিম। ম-ার মতো নরম আর খাবার মতো মিষ্টি। বাজারে চল্লিশ টাকায় আইসক্রিম খেয়েছেন। এবার বিল্লালের গাড়িতে পাঁচটাকায় খেয়ে দেখুন! যেই স্বাদ সেই টেস্ট। একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করে। এছাড়া বিল্লালের প্রচার গাড়িতে দুধের সর কুলফি পাওয়া যায়…

গাঙের ধার ধরে মাইক বাজাতে বাজাতে পায়ে হেঁটে চলে আসছে বিল্লাল। মাথায় কাপড়ের একটা রোদ টুপি। পরনে ফুল প্যান্ট। রূপের বাগানের কাছে এলে মাস্টার সাত্তার তাকে ডাকলেন— বিল্লাল, শোন! তোর সাথে বসে গল্প করি।

বিল্লাল কাছে গিয়ে মাস্টার সাত্তারের সামনে বসে বলল— কী গল্প করবেন, করেন।

মাস্টার সাত্তার তাকে জিজ্ঞেস করলেন— এই রোদে, গরমে আইসক্রিমের ভারী ভ্যান টানতে তোর কষ্ট হয় না! আমার তো মনে হয়, কষ্ট হয়।

বিল্লাল বলল— কষ্ট তো হয়ই। কষ্ট হয় না তো গা দিয়ে ঘাম শুধু ঝরে?

— তা ঠিক। বলে মাস্টার সাত্তার বললেন— পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তার মধ্যে গরিব মানুষের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। গরিব মানুষের কষ্ট দেখে আমার খুব মায়া হয়। কিন্তু কী করব? কিছু করার নেই। আবার আমার মতো সবাই যদি এগিয়ে আসত, যাদের টাকা পয়সা আছে, তাহলে কিছুটা হলেও কষ্ট দূর করা যেত। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। সবাই গরিবের মেরে খেয়ে বড়োলোক হতে চায়। এদের মুখে ঝাঁটা মারা দরকার। এক বা দুই ঝাঁটা নয়; একাধিক ঝাঁটা।

মাস্টার সাত্তারের কথা শুনে বিল্লালের বুক গর্বে ভরে উঠল। সে বলল— আপনি হলেন সত্যিকারের এ্যাকটা ভালো মানুষ, আপনি হলেন সৎ মানুষ। আপনি গরিবের ভালোবাসেন, আপনি গরিবের বন্ধু।

মাস্টার সাত্তার বললেন— মানুষ হয়ে মানুষকে যদি ভালো না বাসবো তাহলে কাকে ভালোবাসবো? আমি পশু প্রেমে একদমই বিশ্বাসী নই; ওসব আমার ধাতে সয় না। আমি মানবপ্রেমী, আমি মানুষকে ভালোবাসি।

মাস্টার সাত্তারের কথাগুলো শুনতে শুনতে বিল্লাল বলল— আমাধের দ্যাশে য্যাতো বড়োলোক আছে তারা সব কবে যে ধ্বংস হবে! কবে যে মরবে! গরিব মানুষের তারা কুনুদিন ভালোবাসে না, গরিবের দিকে ঘুরে তাকায় না…

মাস্টার সাত্তার বললেন— ওভাবে কিছু ধ্বংস হয় না, ধ্বংস করতে হয় তবেই ধ্বংস হয়। ধ্বংস যেদিন করতে পারবি সেদিনই ধ্বংস হবে। নচেৎ কোনোদিনই ধ্বংস হবে না। যাইহোক, আজ কোনদিকে আইসক্রিম বেচতে গিয়েছিলি? মাস্টার সাত্তার জিজ্ঞেস করলেন।

বিল্লাল বলল— আজ বেনেখালির দিকে গেছিনু। বিক্রি ভালোই হল। আর অল্প ক’খানা আসক্রিম আছে। বেচতে বেচতে বাড়ি চলে যাবো।

মাস্টার সাত্তার তখন বললেন— আজ তাহলে তুই আর বসিস না, আইসক্রিম বেচতে বেচতে বাড়ি চলে যা! বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিবি!

বিল্লাল বলল— আর এ্যাকচিন বসি! আপনার কাছে বসতে খুব ভাল্লাগছে। ক্যাতো দামি দামি কথা শুনতে পাছি। বাড়ি চলে গ্যালে শুনতে পাবো?

— তাহলে বস! মাস্টার সাত্তার তাকে বসতে বলে দামি দামি আরও অনেক কথা শোনালেন। একসময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। সেইসময় তিনি মানুষের প্রচুর উপকার করেছেন, প্রচুর কাজ করেছেন। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছেন। কারও বাড়ি যদি খাবার না হয়েছে তো নিজের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, আটা নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছেন। কোনো মানুষের অসুখ করলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। রক্তের দরকার পড়লে রক্ত জোগাড় করে দিয়েছেন। বিনা পয়সায় চক্ষু অপারেশন ও রক্তদান শিবির করেছেন। আরও কতো সামাজিক কাজ তিনি করেছেন। কোনোদিন কারও কাছ থেকে একটা পয়সা নেননি, একটা পয়সা খাননি…

শুনতে শুনতে বিল্লাল বলল— আমাধের বাড়িতেই আপনি ক্যাতোদিন খাবার বহে দিয়েছেন! চাল, ডাল, আটা, গম বহে দিয়েছেন! আমার বাপ য্যাখুন অসুখ পড়েছিল, কুনু কাজ করতে পারছিল না…

 

— সেসব কথা তোর মনে আছে?

— তো মনে থাকবে না? সারাজীবন মনে থাকবে।

— মনে রেখেছিস শুনে খুব ভালো লাগল। কিন্তু অনেক মানুষই মনে রাখেনি; বিলকুল ভুলে গেছে।

বিল্লাল বলল— তারা অকৃতজ্ঞ, তারা বেইমান, তারা হারামি…

মাস্টার সাত্তার বারণ করলেন— থাক, মানুষকে গালি দিস না। মানুষকে গালি দিতে নেই। ওতে পরিবেশ খারাপ হয়।

বিল্লাল সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল। একটু পরে বলল— একটা আসক্রিম দিছি, খান! আপনাকে আসক্রিম খাওয়ান্যা আমার খুব শক! আপনি সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। আপনাকে এ্যাকটা-দুট্যা আসক্রিম খাওয়াবো তো কী হবে?

মাস্টার সাত্তার বললেন— আমি আইসক্রিম খাই না। কারণ, আমার ঠা-া লাগার ধাত আছে। আইসক্রিম খেলে ঠা-া লেগে গলা ব্যথা করতে শুরু করবে, কষ্ট পাবো। দিস না, খাবো না।

— এ্যাকটা খান! এ্যাকটা খাল্যে কিছু হবে না।

মাস্টার সাত্তার বিল্লালের আন্তরিক অনুরোধ আর এড়াতে পারলেন না। তিনি চুষে চুষে একটা আইসক্রিম খেলেন।

খাওয়া হয়ে গেলে বিল্লাল জানতে চাইল— আসক্রিমডা খাত্যে ক্যামুন লাগলো?

মাস্টার সাত্তার বললেন— তুই যে এত ভালো আইসক্রিম করিস আমাকে কোনোদিন বলিসনি! সত্যি যেই স্বাদ সেই টেস্ট! বাজারের চল্লিশ টাকার আইসক্রিমও তোর এ আইসক্রিমের কাছে ফেল। সত্যি বলতে কী, এত ভালো আইসক্রিম আমি জীবনে কোনোদিন খাইনি। আইসক্রিম খানা খেয়ে আমার মন ভরে গেল। পানির আইসক্রিম ভেবে আমি খেতে চাইছিলাম না। পানির আইসক্রিম খেলে ঠা-া লেগে যায়। এ আইসক্রিমে ঠা-া লাগবে না।

— সত্যি বলছেন! তাহলে আর এ্যাকখানা খান! বিল্লাল খুশি হয়ে বলল।

— না না, আর খাবো না; আর দিস না। মাস্টার সাত্তার বারণ করলেন।

কিন্তু বিল্লাল তাঁর বারণ শুনল না। আর একখানা আইসক্রিম দিল।

পরপর দু’খানা আইসক্রিম খেয়ে মাস্টার সাত্তার বললেন— স্কুল এখন ছুটি আছে, গরমের ছুটি চলছে। স্কুল খুলুক তো তোকে আমি একদিন বলব, তুই সেদিন আমাকে কুড়ি খানা মতো আইসক্রিম দিবি। আমার সহ-শিক্ষকদের নিয়ে গিয়ে খাওয়াব।

— ঠিকাছে। যেদিন লাগবে বুলবেন, আমি বরফ দিয়ে ভালো করে প্যাক করে দিব। আপনার যাথে দুন্নাম না হয় সেই ব্যবোস্তা করে দিব।

— ঠিক আছে, ঠিক আছে। মাস্টার সাত্তার তাকে বাহবা দিলেন। দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন— এ আইসক্রিম তুই কোথায় বানানো শিখেছিস?

বিল্লাল বলল— অন্ধপোদেশ থেক্যা বানান্যা শিকে এসেচি।

মাস্টার সাত্তার এরপর বললেন— আমাদের দেশে এ আইসক্রিম নেই। তোর বৌ-বাচ্চাকে আইসক্রিম বানানো শিখিয়ে দিস! তোর অবর্তমানে তারা যেন করে খেতে পারে।

বিল্লাল বলল— বৌ বানান্যা জানে। কিন্তুক অর যা শরীলের হাল তাথে আমার আগেই উ কবে—

— কেন, অসুখ নাকি?

— তিনমাস থেক্যা বিছ্যানে পড়ে নাই! দিনরাত শুদু বুক গ্যালো প্যাট গ্যালো! বুক গ্যালো প্যাট গ্যালো!

— তো ভালো কোনো ডাক্তার দেখাচ্ছিস না?

— তো ডাক্তার দ্যাখাচি ন্যা! বাড়িতে ডাক্তার দ্যাখান্যা কাগোচের গাদা লেগ্যা আছে। ডাক্তার দ্যাখাতে দ্যাখাতে আল্যা গেনু! ডোমকুল, ইসলামপুর, লালবাগ, বহরমপুর কুনু জাগায় ডাক্তার দ্যাখাতে বাদ থুইনি। ক্যাতো যে অক্ত পরীক্ষ্যা আর বুক, প্যাটের ছবি হয়েচে তার হিস্যাব নাই। য্যাখুন যে ডাক্তারের কাছে লিয়্যে গেলছি ত্যাখুনই সেই ডাক্তার অক্ত পরীক্ষ্যা আর বুক, প্যাটের ছবি করালছে।

মাস্টার সাত্তার তখন পরামর্শ দিলেন— তাহলে একবার কলকাতা নিয়ে গেলি না কেন? কলকাতায় অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার আছে, চিকিৎসা ভালো।

বিল্লাল বলল— কলকাতা লিয়্যে যাওয়ার কথা এ্যাকবার ভেবেচিনু। কিন্তুক লোক আভানে লিয়্যে যাত্যে পারিনি। আবার লিয়্যে যাত্যে পারতুক যিদি আমি কলকাতা চিনতে পারতুক। কলকাতা জীবনে কুনুদিন যাইনি না! শুদু কানে শুনেচি এই যা!

— সে কী! আমাকে বলিসনি! আমি যেতাম।

— আপনি মাস্টার মানুষ। আপনার সুমায় হবে কি হবে না বুলে বুলিনি।

— ভুল করেছিস! রোগী নিয়ে কেউ কলকাতা যাওয়ার কথা বললে আমি তাকে কোনোদিন না করি না। সময় না থাকলেও সময় বের করে নিই। যাইহোক, তোর রোগী কবে নিয়ে যেতে হবে? তুই যেদিন বলবি সেদিন যাবো। তবে খুব বেশি দেরি করিস না। যত তাড়াতাড়ি পারিস চল। কারণ, এদিকে দেরি করলে অসুখ সারতে দেরি হয়ে যাবে।

বিল্লাল বলল— আপনি যেদিন যাত্যে পারবেন সেদিন চলেন। আপনার দিনে দিন।

মাস্টার সাত্তার বললেন— আজ চল।

 

— আজ কখুন?

— বিকেল পাঁচটায়।

— চলেন। বিল্লাল সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল।এরপর সে বিক্রি না হওয়া আইসক্রিমগুলো বেচতে বেচতে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ঘরে ফিরে দেখল, তার স্ত্রী আয়েশা বিবি বুক, পেট চেপে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

বিল্লাল তার পাশে বসে ভেজা চোখ দুটো মুছে দিয়ে কপালে একটা চুমো খেয়ে বলল— আর কাঁদিস ন্যা, আজ বিক্যালে তোখে কলকাতা লিয়্যে যাবো। মাস্টার সাত্তারের সাথে কথা হলো। কলকাতায় অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার আছে, তুই ভালো হয়ে যাবি। আবার আগের মুতোন সব কাজ সুমান তালে করতে পারবি, সব খাবার খাত্যে পারবি, সিলাই ম্যাশিনে বসতে পারবি। আর তোর পাশে বসে আমিও সিলাই ম্যাশিনের ঘর্ঘর শব্দ শুনতে পারবো। সিলাই ম্যাশিনের ঘর্ঘর শব্দ শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। অন্য কাহুরির না, তোর সিলাই ম্যাশিনের শব্দ।

মসজিদের মাইকে অমনি টুং করে শব্দ হল। গ্রামের কোনও মানুষ মারা গেলে মসজিদের মাইকে সেটা ঘোষণা করে গ্রামবাসীদের জানানো হয়। তারপর মিনিট খানেক বাদে ঘোষণা শুরু করা হয়। অনেক দিনের পুরনো নিয়ম এটা। এরপর মিনিট খানেক বাদে ঘোষণা শুরু করা হল— একটি বিশেষ ঘোষণা, উপ্পাহারের মাস্টার সাত্তার কিছুক্ষণ হল ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন! তাঁর জানাজা কখন হবে এখনও জানা যায়নি। পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। ঘোষণাটি শেষ হল।

— না, তা হয় না! হতে পারে না! বিল্লাল চিৎকার করে কেঁদে ফেলল।

 

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস, গল্পকার, পশ্চিম বাংলা, ভারত

প্রাচীন বাংলার স্বচ্ছ ইতিহাস রচনায় তাম্র-শিলালিপি মুদ্রা ও প্রত্ন-ভাস্কর্য কতটা দরকারি

ড. আবু নোমান উৎস বা সূত্র যতটা স্বচ্ছ যৌক্তিক ও প্রায়োগিক হয় ইতিহাস তত বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এ কারণেই ইতিহাস রচনায় উৎসের ভূমিকা অত্যন্ত

আন্দরকিল্লার উদ্যোগে আনন্দ আড্ডা ও দুই কবির জন্মদিন পালন

রুহু রুহেল বিগত ১ জানুয়ারি ২০২৫ সন্ধ্যা ছয়টায় শিল্প, সাহিত্য ও সমাজভাবনামূলক কাগজ ‘আন্দরকিল্লা’র ২৭ বছরে পদার্পণ, দুই কবির জন্মদিন পালন, ‘আন্দরকিল্লা’র ডিসেম্বর সংখ্যার পাঠ

রাজা মহারাজাদের ‘হারেম’

বাবুল সিদ্দিক   ‘হারেম’ শব্দটি তুর্কি শব্দ। কেউ কেউ বলেন হারেম শব্দটি আরবি শব্দ হারাম থেকে এসেছে। যার অর্থ নিষিদ্ধ। সহজ ভাষায় হারেম অর্থ মহিলাদের

অরক্ষিত সময়ের গল্প

মনি হায়দার সে পাহারাদার, সুতরাং নারী ও রাত তার কাছে অতৃপ্তির আধার। গল্পটা একজন পাহারাদারকে নিয়ে অথবা  একজন পাহারাদারের গল্পও হতে পারে। গাছ গাছই, যে

রুয়েলিয়া, রুয়েলিয়া

শোয়ায়েব মুহামদ শাহানা বলে, বেলায়াত স্টুডিও থেকে কি ছবিটা তুমি নিতে পারছো? বেলায়াত এসেছে খানিক আগে, ট্রেনে। এসে জোহরের নামাজ শেষে গুটানো জায়নামাজ টেবিলে রেখে