ড. সালাহউদ্দীন আইয়ুব : যশোবতী ইদানীং সাক্ষাৎ চম্পক ঈশ্বরী। তাঁহাকে নামান হইল। হাজার হাজার স্ত্রী শরীর তাঁহার পায়ের কাছে গড়াইয়া পড়িতেছে…কত শাঁখা তাঁহার পায়ের কাছে লাগিতেছে…তিনি দৌড়াইয়া চিতায় উঠিলেন…অগ্নিসংযোগ করা হইল, শাঁখা কড়ি স্বর্ণালংকার উড়িল। লেলিহান শিখায় গৃহাভিমুখী সুখপক্ষীর দল ছত্রাকার, কোনোটি বা বিমোহিত হইয়া চিতার মধ্যে নিশ্চিহ্ন। অন্তর্জলী যাত্রা [১৯৬২] ২০১১ : ৩৮
তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র অনেক অংশ পড়ার সময় আমার নিজেরই হৃদয়টা গর্বে উঁচু হয়ে যায়। ..দোস্ত, তুমি তো জানো আমি প-িত নই, কিন্তু বঙ্গজননীর ভাষা যে আমার মধ্যে এত অফুরন্ত ঐশ্বর্য দিয়ে রেখেছেন, তার কোনো হুঁশই আমার ছিল না।
রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ১৮৬০
এক.
অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৬২) উপন্যাসে একটা বুড়া লোককে নায়ক, এবং এক ক্ষুদে বালিকাকে বুড়ার বৌ (নায়িকা) হিশেবে দেখানোর পরিকল্পনায়, ‘পারভার্শন’ না থাকলেও ইষৎ “মস্করা” থাকতে পারে। মস্করাই হোক বা রুচিবিকার, বালিকা যশোবতীসীতারাম নামক ঐ বৃদ্ধের নবপরিণীতা বালিকাবধূ এ
উপন্যাসের মূল নায়িকা। কমল-উদ্ভাবিত এই ‘সতী’ বালিকার গল্প পড়ে আধুনিক পাঠক রোমাঞ্চিত, বিচলিত বা বিক্ষুব্ধ হতে পারেন, কিন্তু সতীমঙ্গল-কথার লোকরঞ্জক উপাখ্যান শুধু ভারতে কেন, পাশ্চাত্ত্যেও সুপরিচিত; একসময় সতীকথার খুব আদর ছিল ইউরোপে। রামচন্দ্রের কনিষ্ঠভ্রাতা লক্ষ্মণের সামান্য তরবারির আঘাতে, অসতর্ক অবস্থায়, ‘বীরচূড়ামণি’ মেঘনাদ নিহত হবার পর সিন্ধুতীর-অভিমুখে সুবর্ণ-শিবিকাসনে উপবিষ্টা, সালংকারা, ‘সাধ্বী সতী প্রমীলা সুন্দরী’র সহমরণ যাত্রা, এবং পুণ্যতোয়া ‘মহাতীর্থে’ অবগাহন, গুরুজনে প্রণাম, বিদায়-গ্রহণ ও সব শেষে ‘রতœ-আভরণ’ বিতরণের পর সানন্দে চিতায় আরোহণ‘চিতায় আরোহী সতী (ফুলাসনে যেন), বসিলা আনন্দমতি পতি-পদতলে; প্রফুল্ল কুসুমদাম কবরী-প্রদেশে’এই যে বিষয়, এটি মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ই শুধু নয়, নানা ভাষার ইউরোপীয় সাহিত্যেও একটা পরিচিত থিম।
আঠার শতকের শেষ দিকে (১৭৭৩ খৃ.) জার্মান সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের ভরা জোয়ারের কথা কে না জানে। জার্মান দেশেরই রাইননদীর তীরে, এক অপরূপ সূর্যাস্তবেলায়, পাথর-বাঁধা উত্তরীয়তে গন্ডদেশ মুড়ে ভারতবর্ষীয়প্রমীলা বা যশোবতীর মতো বিশুদ্ধ সতীনারীর অনুকরণে আত্মাহুতি দানের পূর্বে, ছাব্বিশ বছর বয়স্কা জার্মান রোমান্টিক বিদূষিণী কবি ক্যারোলিনযিনি সংস্কৃত ভাষা শুধু জানতেনই না, সংস্কৃতে কবিতাও লিখেছেনভারতবর্ষের প্রমীলা-যশোবতীদের পতিভক্তির রোমান্স বর্ণনা করেছেন এভাবে (Sati, the Blessing and the Curse 1994: 56, 68-69):
অঙ্গখানি তার রতœ-আভরণে ঢাকা
সিঁদুর পরা বধূর মত সজ্জায়
যায়, সিদ্ধুতটে, ঐ হিন্দুনারী
লুটায়, অনলের ক্রোড়ে, মৃত্যু-বিলাসিনী,
স্বামীসঙ্গ-লিপ্সু ব্যাকুল নহলি যৌবনা
নি:সংশয় নির্ভয়েস্তব্ধ তাই সব বাদ্য, বেহাগ।
প্রাচীন এই ব্রত জানে প্রেমের অর্থ, জানে
এই ব্রতেই প্রেমের মুক্তি, বিচ্ছেদের যাতনা উধাও,
মৃত্যু অমান্য করে দুই আত্মার বন্ধন এতেই পায় অমরতা;
বিচ্ছেদের কি বা সাধ্য এ-মিলনে বিঘœ ঘটায়
যখন ফেলে আসা জীবনের শিথিল প্রেমের শিখা
অমোঘ এই মৌনে মিলে মিশে একাকার।
মৃত্যু তো প্রেমেরই মধুর উৎসব
ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ সব জোড়া দেয় মৃত্যু:
মরণ? সে তো জীবনের উচ্চতম তুঙ্গে আরোহণ
ক্যারোলিনের এই কবিতায় কার কথা, কোন্ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত? উচ্চশিক্ষিত, প্রেমে-অসফল, সংস্কৃতবিদ এক শ্বেতাঙ্গিনী রোমান্টিক কবির? না কোনো নিচুশ্রেণীরএকালে যার নাম ‘সাবঅলটার্ন’ বা নি¤œবর্গহিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারতীয় রমণীর? কমলকুমারের ‘সতী’ যশোবতীও কি এরকম নি¤œ শ্রেণী বা বর্গের সাবঅলটার্ন রমণীযার সহমরণ-প্রতিজ্ঞার মধ্যে দিয়ে পতিভক্তি ও নারীসত্তার, এজেন্সি ও সাবজেকটিভিটির রূপগুলো ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে?
সীতরাম নামক বৃদ্ধ ‘ব্রাহ্মণে’র সঙ্গে বালিকাবধূ (‘ব্রাহ্মণ’কন্যা) যশোবতীর সম্পর্ক, গঙ্গাতীরে দু’জনের রাত্রিযাপন ও তার শ্মশানঘাটের ভীতিকর শূন্যতায় সেই সম্পর্কের বিবর্তন, এবং চ-াল বৈজুনাথের উপস্থিতি, আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ ও বৈজুর ধারাবাহিক সাহচর্যে সেই সম্পর্কের রূপান্তর (ও অনিবার্য পরিণামের কথা) বিবেচনায় রাখলে যশোবতীকে একটা ভারতবর্ষীয় প্রাচীন সংস্কার-কুসংস্কারের হতভাগ্য বলি বলা যাবে না। কুলরক্ষার তাগিদ বশত তার পিতার উৎসাহে এবং ব্রাহ্মণদের সহায়তায়চ-াল বৈজু বলবে, ব্রাহ্মণদের চক্রান্তেমাতৃহীনা যশোবতীর বিয়ে হয়েছে বটে, কিন্তু বিবাহ-পরবর্তী যশোবতীকে নিষ্ক্রিয় পুত্তলিকা বলা যায় না। যশোবতীর ব্যক্তিত্ব আছে, ‘এজেন্সি’ ‘সাবজেকটিভিটি’ আছে (একালের তত্ত্বীয় পরিভাষা ধার করে বলছি), মৃত্যু-পথযাত্রী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সঙ্গে তার বিবাহ হওয়ার সামাজিক কারণ, ধর্মীয় যুক্তি ও আসন্ন পরিণাম সম্পর্কে সে পূর্ণমাত্রায় সচেতন: মরণোন্মুখ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণপতির সঙ্গে তার বিবাহ ও সহমরণ নিয়ে চ-াল বৈজুর মারাত্মক ঠাট্টা ও পুন: পুন: কটাক্ষ অগ্রাহ্যকারী ‘সতী’ যশোবতীর এই সচেতন, শা¯-¿শোভন, সতী-শোভন পতিভক্তিকে এক সাবঅল্টার্নী অনাথিনীর অন্ধ কুসংস্কার বলা চলে না।
গঙ্গাতীরের নির্জন নিশীথপ্রহরে বিবসনা যশোবতীকে বলিষ্ঠদেহী বৈজুনাথ নানান প্রকার ভাব ও মারফতির কথা শুনিয়েছে অনেক; অশীতিপর বৃদ্ধের সঙ্গে সত্যসত্যই বিবাহ ঘটার পর থেকে এই ‘কনে বউ’কে একটা ‘অর্থব’ বৃদ্ধের সঙ্গে খামোখা চিতায় উঠে পুড়ে মরার ভয় দেখিয়ে এসেছে এই বৈজু। যশোবতীকে এই ভীতিকর শ্মশানঘাট থেকে অর্থাৎ শ্মশানঘাটে অথর্ব বৃদ্ধের সঙ্গে তার আসন্ন ও সুনিশ্চিত মৃত্যুর ব্রাহ্মণ্য চক্রান্ত থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার আশ্বাসও বৈজু দিয়েছে বার বার। এত কিছুর পরও ব্রাহ্মণকন্যা যশোবতী বলে, ঐ ‘অথর্ব বৃদ্ধই’ তার ‘স্বামী’, তার আরাধ্য দেবতা; সেই স্বামী যাকে সে “কর্ত্তা” নামে ডাকে। রক্তিম পূর্ণিমার আলোয়, কোটালের বানে ভেসে-যাওয়া ব্রাহ্মণ বৃদ্ধকে দেখা মাত্রই, উন্মত্ত গঙ্গার স্রোতে উন্মাদিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে সহমৃত্যু-বরণের সময়েও ব্রাহ্মণকন্যা যশোবতীর কণ্ঠে বার বার ঐ “কর্ত্তা” ডাক শোনা যায়।
বিয়ের আগে যশোবতী ছিল ব্রাহ্মণসমাজের বলতে পরি পিতৃতন্ত্রের অবজেক্ট মাত্র; কিন্তু বিবাহোত্তর যশোবতী অবজেক্ট নয়, ‘সাবজেক্ট’, অর্থাৎ উপন্যাসে সংঘটিত প্রধান ঘটনার কর্তা, তার নিয়ন্ত্রক। রূপ কানোয়ারের মত তরবারি নিয়ে কেউ তাকে চিতায় ফেলেনি বা সহমরণে বাধ্য করে নি; নিজের ইচ্ছাতেই যশোবতী, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বালিকাবধূ, সহমরণে সংকল্পবদ্ধ। শ্মশানঘাটে যে-বালিকা সহমরণের প্রতিজ্ঞা করছে, তার সীমাবদ্ধতা আছে অবশ্যই, কারণ তা তার উনিশ-শতকী সমাজ, পরিবার, সংস্কার-কুসংস্কার দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু বিশ-একুশ শতকের শিক্ষিত আধুনিক ব্যক্তির মতামত, বিচার-বিবেচনা কি ওসব প্রভাব থেকে মুক্ত? আমেরিকার তরুণ-তরুণীদের সবাই মনে করে তারা ইনডিপেনডেন্ট অর্থাৎ তাদের ধ্যান-ধারণা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই স্বাধীন; তাদের স্বপ্ন, আকাঙক্ষা, বিশ্বাস সবই তাদের নিজস্ব ইচ্ছা বা চিন্তাপ্রসূত। এই আজগবি কথা যদি সত্য বা সম্ভবপর হতপ্রত্যেকের চিন্তাধারা তাদের নিজস্ব, ইনডিপেনডেন্ট তাহলে ‘ইউনাইটেড স্টেইটস্’-এর অস্তিত্ব থাকত কি? সবাই যদি স্বাধীন বা স্বতন্ত্রমতি হয়, তাহলে মার্কিনদেশের ছেলে-মেয়েদের কথাবার্তা, আচরণ, চিন্তাপ্রকৃতি পরীক্ষা-পত্রে উত্তর, বক্তব্য বা আলোচনার ধরন সকলের একরকম কেন? কেন এদেশের দরিদ্রতম ব্যক্তিটিও তার দারিদ্র্যের কারণ জানতে চায় না বা জানতে অনাগ্রহী? কেনই বা তরুণ-তরুণীরা রাজনীতি বিষয়ে এতো অনবহিত এবং নিরুৎসাহী? ‘স্বাধীন’ হলে তো প্রত্যেকের মতামত ‘স্বতš’¿ হওয়ার কথা, সেই স্বাতন্ত্র্য কই? সরকার, পুলিশ বা মিলিটারি তো তাদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করছে না, তবু তা নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ ‘একরকম’ কেন?
নিয়ন্ত্রিত বা ‘একরকম’ হতে বাধ্য, কারণ তা নিয়ন্ত্রণ করে বিনোদন ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি: সিনেমা-টেলিভিশন, বিজ্ঞাপন কোম্পানি, বড় বড় কর্পোরেশনগুলো এদের সবাইকে ‘ইনডিপেনডেন্ট’ করে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং সেজন্যেই পৃথিবীর বৃহত্তম ক্যাপিটালিস্ট সমাজে বা শ্রেণীকক্ষে স্বাধীন চিন্তার অস্তিত্ব নাই। থাকতে পারে না, থাকলে ক্যাপিটালিজম অচল। ‘স্বতন্ত্র’ চিন্তাধারা-সম্পন্ন ‘ইনডিপেনডেন্ট’ বা স্বাধীন নাগরিকের ধারণা আমেরিকার সব চাইতে কার্যকর বর্তমান দুনিয়ায় প্রচলিত তাবৎ ধর্মের তুলনায় শতগুণ শক্তিশালী প্রকা- সাংস্কৃতিক মিথ। যশোবতীর ‘পতিভক্তি’ ব্রাহ্মণোদ্ভাবিত ‘পৌরাণিক’ প্রত্যয় বটে, কিন্তু সেই বিশ^াস বা ধারণার মধ্যে ‘ইনডিপেনডেন্স’ নামক স্বাধীন মার্কিন নাগরিকের এই ‘আধুনিক’ মিথটা অনুপস্থিত। স্বাধীন মনুষ্য বলতে হুমায়ুন আজাদের মতো কবিরা যা কল্পনা করে থাকেন, তার অস্তিত্ব কোনো ‘সমাজে’ নেই এবং তা কোনো ‘সমাজে’ থাকতে পারে না। এটাই তো সোশিওলজির বর্ণপরিচয়, সমাজতত্ত্বের প্রাথমিক কথা: সমাজে বসবাসকারী মানুষ, সমাজের বাসিন্দা হবার কারণে, সমাজের কাছে দায়বদ্ধ অর্থাৎ পরাধীন (সমাজ, রাষ্ট্র, আইন প্রভৃতি “পর”-এর অধীন) । তার মানে, সমাজে যে-মানুষ ‘ইনডিপেনডেন্ট’, সে হয় পাগল (সমাজের আইন তার ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য), অপরাধী (সমাজের আইন যে ভঙ্গ করেছে), অথবা সক্রেটিস (সমাজের আইন বা ব্যবস্থা বদলাতে যিনি কৃতসংকল্প)। এই তিনজনের সংখ্যা, প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ পর্যন্ত, সব সমাজেই কম।
কাজেই যশোবতীর পতিভক্তি ও সহমরণাভিলাষকে দেখতে হবে তার বর্ণ, জাত ও বংশের পটভূমিকায়। সতী যশোবতীর পরিচয় হলো সে সাবঅলটার্ন বা নি¤œবর্গীয় হলেও, জাত্যভিমানী ব্রাহ্মণকন্যা। সে পুত্তলিকার মত জড়বস্তু নয়, তার সাবজেকটিভিটি আছে: তার “জাত”-এর নিচের কাউকে (যেমন বৈজু) সে মনুষ্য ধরে না। নারীবাদী তাত্ত্বিক সমালোচকেরা পুরুষতন্ত্রী ডিসকোর্সে ‘সুষুপ্ত বা নিশ্চিহ্ন’ নারীর কণ্ঠস্বর উদঘাটন করতে চান; পুরুষবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ‘বিলুপ্ত’ নারীর নিজস্ব আবেগ, নিজস্ব বাসনা ও নিজস্ব পরিচয়ের উন্মোচন তাঁদের লক্ষ্য। ব্রাহ্মণ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এই ঘরানার সুবিখ্যাত তাত্ত্বিক। সতীর আত্মত্যাগ নিয়ে বহুদিন আগে গায়ত্রী চক্রবর্তী একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন ÔCan the Subaltern Speak?: Speculations on Widow-Sacrifice’ (1985)| এই প্রশ্নের জবাবে কমলকুমার হয়ত বলতেন, Yes she can, Of course she does: কমলকুমারের নায়িকা যশোবতীর উক্তিগুলো কি তাই প্রমাণ করে না? যেমন
[যশোবতী] : “কেনে গো, আমি আছি;” “আমায় তো ভগবান এনেছেন তোমায় বাঁচাবার জন্যে গো” (পৃ. ৪৩)
“তোমার যদি কিছু হত, আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দিতুম” (পৃ. ৪৪)
“এ জীবন গেল, কি হয়েছে? আবার জন্মাব, আবার ঘর পাতব” (পৃ. ৪৫)
“ছিঁ গো, তুমি ছাড়া কে” (পৃ. ৪৫)
“এখন থাম, তুমি তার কথা বল না” (পৃ. ৪৬)
[বৈজুকে যশোবতী]: “তোমার…. তোমার মনে কি কোনো মায়া-দয়া নেই”;
“তুমি কি ওঁকে [বৃদ্ধপতি সীতারামকে] মেরে ফেলতে চাও? তোমার মনে কি ভগবান এতটুকু মায়া মমতা …(পৃ. ৫২)
[বৈজু] : “তুমি কি ভাবো ওই ঘাটের মড়া তুমার সোয়ামী”
[যশোবতী]: “হ্যাঁ, স্বামী” (পৃ. ৫৫)
বৃদ্ধ সীতারামকে নিয়ে বৈজু চ-ালের ঠাট্টার প্রতিবাদে সতী যশোবতীর নি:সংশয়, নির্ভীক ও সুস্পষ্ট জবাবটিতে, কমলকুমার বলেন, ‘সমগ্র বিশ্বের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ছিল, এ স্বীকারোক্তির অখ- তৈল ধারাবৎ পতিভক্তিতে কাল বিমর্দ্দিত হইল; স্পন্দন গতি যাবতীয় দ্রব্য সকলের আর প্রয়োজন নাইচন্দ্র সূর্য অচিরাৎ দায়মুক্ত’ (কমলকুমার [১৯৬২] ২০১১ : ৫৫)।
‘ঘাটের মড়া’ নিয়ে এরকম শাণিত ও অপ্রত্যাশিত উত্তরে (“হ্যাঁ, স্বামী”) স্তম্ভিত বৈজু বলে যায় যে, যশোবতীর এহেন পতিভক্তি ‘মানুষ’ নামক ‘এক অচিন গাছে’র প্রলাপ, যা অবাস্তব ও ‘মিথ্যা’। ‘মিথ্যা’ হলেও সেই মিথ্যা অথবা মিথ জাত্যভিমানী যশোবতীর নিজস্ব, যার ভিত্তি যশোবতীর বর্ণ, জাত-বংশ ও অষ্টাদশ পুরাণযার সবই তার কাছে সত্য। যশোবতীর ধারণা-বিশ^াস স্বাধীন বা স্বয়ম্ভূ নয়, এ-জাতীয় কোনো ধারণাই তা হয় না। যশোবতী কেন, এই পৃথিবীর আধুনিকতম ব্যক্তিটিও যেআর কিছুর না হলেওঅন্তত ‘অবচেতনে’র ক্রীতদাস, সিগমুন্ড ফ্রয়েড তা এক শতাব্দী পূর্বে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দুই.
মৃত্যু বাঙালির নিকট বড় আদরের, মৃত্যুকে…কেমন ভালবাসিতে হয় ইহাই তাহার সাধনা…। আমাদের হৃদয়েতে এই তত্ত্ব থাকে, ইহা বঙ্গীয় লোকমতি! আমাদের অস্তিত্ব মৃত্যুতে ফাৎনা মনস্কতা, কমলকুমার মজুমদার [১৯৭২] ২০০৯ : ১৬৪-৬৬
এ সময় সতীদাহ প্রথা ইংরেজরা উচ্ছেদে কৃতসংকল্প হয়, নিজের দেশে বুড়ীদের লিঞ্চ প্রথা বন্ধ হইয়াছে….। লালবিহারী দে গোবিন্দ-সামন্ততে সতীদাহর বর্ণনা চমৎকার দিয়াছেন মৃত্যুকে গ্রহণ। …গেজেটিয়ার ও ইংলিশ করসপনডান্স…ঐ গেজেটিয়ার মধ্যে, ২৪ পরগণার যেখানি, তাহাতে …যতদূর তারিখ মনে পড়ে, ১৮৩৮ অবধি পুলিশ-সাক্ষাতে সতীদাহ হইয়াছে…এবং ইন্ডিয়ান এন্টিকুয়ারীতে ১৮৭২/৭৫ মধ্যে ফাৎনা মনস্কতা, কমলকুমার মজুমদার [১৯৭২] ২০০৯ : ১৬৯-১৭০
‘ফাৎনা মনস্কতা’ নামের যে প্রবন্ধ থেকে এসব উদ্ধৃতি, তা অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৬২) উপন্যাসের দশ বছর পরে কৃত্তিবাস (১৯৭২) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সতীদাহ ও সহমরণ সম্পর্কে কমলকুমারের সেন্টিমেন্টাল দৃষ্টিভঙ্গি দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে (“পুলিশ-সাক্ষাতে সতীদাহ হইয়াছে”) এত সুস্পষ্ট যে তা নিয়ে বিতর্ক অসম্ভব। সহমরণ একটি ভারতবর্ষীয় ধারা এবং এটি, গুপ্ত-যুগোত্তর যাজ্ঞবল্ক্যাদির অষ্টাদশ পুরাণ-শাসিত ভারতবর্ষে, একটি বিচারোর্ধ, যুক্তি-তর্কের অতীত, প্রত্যয়: এই আবহমান বা চিরায়ত প্রত্যয়কে কমলকুমার, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য়, কথকতার শিল্পে উত্তীর্ণ করতে প্রয়াসী। বৃদ্ধ সীতারামের মৃত্যু ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র প্রতিপাদ্য নয়ব্রাহ্মণোদ্ভাবিত হিন্দুধর্ম এবং বৈজুর লোকধর্মের সংঘাতও এর বিষয় না। এর প্রতিপাদ্য যশোবতীর সহমরণ, অর্থাৎ আবহমান বা চিরায়ত ভারতবর্ষীয় ‘সতী’র রিপ্রেজেনটেশন। অষ্টাদশ পুরাণ-সম্মত পতিব্রতা রমণীর সতীধর্ম ও সহমরণ-অভিলাষের চিত্রকর্ম-সদৃশ চিত্রায়ন কমলকুমারের লক্ষ্য । চিত্রায়নের বিষয় বাদ দিলে, সতীকথা দেশী-বিদেশী সাহিত্যে নতুন কিছু না । ইউরোপীয় কল্পনাকে এই ‘সতী’ যে বহুকাল ধরে দখল করে রেখেছে, ক্যারোলিনের পূর্বোক্ত জার্মান কবিতাটি তার একটি দৃষ্টান্ত; জার্মানদেশীয় রিচার্ড ভাগনারের অপেরাতেও ‘সতী’র উপস্থিতি লক্ষণীয় (Sati, the Blessing and the Curse 1994: 65): ওয়ালহালার যজ্ঞে যদি আমার যাত্রা না হয়
তুমি কি জানো আমার গন্তব্য তবে কি?
কামনার ধরাতল, মায়ার এই ভূভাগ, ছেড়ে
আমি চলে যাব, চিরতরে,
খিল তুলে দিয়ে পিছনের দরোজায়:
দেখ ঐ দেখ বিদূষিণী যায়
পবিত্রতম এক দেশে, যেখানে
কোনো কামনা নেই, নেই মায়া,
জগত-পরিক্রমার যেখানে সমাপ্তি
জন্ম-জন্মান্তরের আবর্ত থেকে মুক্ত
অনন্তের পুণ্যতীর্থে।
তুমি কি জানো কোন্ পুণ্যে আমার এই প্রাপ্তি?
এই অর্জন গভীর-গভীরতর দুর্ভোগের
এই অর্জন নিবিড়-নিবিড়তর দহনের
খোলা চোখ দিয়ে অসীম মহাজগতের
সকল রহস্য আজ, আমি, দেখে ফেলেছি
একটি অবুঝ শিশুও যে-আগুনে ভয় পায়, সেই আগুনে একটি জীবন্ত নারী যশোবতীর মতো কুমারী বালিকা ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দেয়, এই আশ্চর্য অথচ সত্য ঘটনাটি সকল অহিন্দু ও ইউরোপীয় নর-নারীকে বহু শতাব্দী যাবৎ বিস্মিত করে রেখেছে। সতীদাহ বিষয়ে ইউরোপীয় কৌতূহল ও বিস্ময়বোধসতীর সহমরণে ক্যারোলিন কিংবা ভাগনারের ঔৎসুক্য প্রধানত রোমান্টিক আগ্রহপ্রসূত। মেঘনাদবধ কাব্যের নবম সর্গ, যার মূল ঘটনা প্রমীলা সুন্দরীর সহমরণ, এক্ষেত্রে মোটেও ব্যতিক্রম নয় (অর্থাৎ একইরকম রোমান্টিক)।
ইউরোপিয় সাহিত্যের গভীর অনুরাগী মাইকেল মধুসূদনের ‘প্রমীলা সুন্দরী’ ইউরোপিয় কল্পনার ‘রোমান্টিক সতী’; মেঘনাদবধ কাব্যে প্রমীলা সুন্দরীর সহমরণের দীর্ঘ বর্ণনাও, এই বিশেষ কারণে, জার্মান বা ইউরোপীয় অর্থে রোমান্টিক। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় যশোবতীর সহমরণ-দৃশ্য, আমার বিবেচনায়, মেঘনাবধ কাব্যের নবম সর্গে প্রমীলা সুন্দরীর সহমরণ আখ্যানের আদলে নির্মিত হয়েছে। সাহিত্য থেকে সাহিত্যের জন্ম হয়এক লেখা থেকে আরেক লেখার উৎপত্তি ঘটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমারের প্রিয় “মাইটি” লেখক, বলে গেছেন। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র সূত্র বা উৎস মধুসূদনের প্রমীলা সুন্দরী; চব্বিশ পরগণার ‘গেযেটিয়ার’-এ এর সোর্স খুঁজতে যাওয়া নিরর্থক। সাহিত্য থেকে সাহিত্য জন্মায় বলে একাদশ শতকের ডিউক নবম উইলিয়াম-রচিত ‘ত্রুবাদুর কাব্য’ কিংবা দান্তের, এয়োদশ শতকী, ‘ডিভাইন কমেডি’ আকাশ থেকে আবির্ভূত হয় নাই; শরৎ-সাহিত্য থেকে মানিক-সাহিত্যের যদিও তার মর্মবস্তু শরৎ-সাহিত্যের বিপরীতজন্ম হয়েছিল। জীবনানন্দের কবিতায় সাধু ক্রিয়াপদের প্রয়োগ এবং বাক্রীতিতে সাধু-চলিতের মিশ্রণ, আলোক সরকারের মতে, “কমলবাবুর ভাষারীতি, ভাষাবিন্যাসের অন্যতম সূত্র”।
মধুসূদনের ‘প্রমীলা’ কমলকুমারের মডেল হলেও দু’জনের সতী-চিত্রায়নে বড় একটা তফাত আছে। মেঘনাদবধ কাব্যের ‘প্রমীলা’ একটি পৌরাণিক চরিত্র, প্রমীলার পৌরাণিকতায় সাধারণ পাঠকেরও সংশয় ঘটেনা; কিন্তু কমল-প্রকল্পিত ‘যশোবতী’ পৌরাণিক চরিত্র নয়, ঐতিহাসিক চরিত্রও না। তবে, যশোবতীর ইতিহাস-ভিত্তি না থাকলেও, ‘যশোবতী’কে যেন আমরা ‘ঐতিহাসিক’ বা ইতিহাস-ভিত্তিক মনে করি এটাই কমলকুমারের সংগোপন অভিপ্রায়। উপন্যাসের নানা জায়গায় ঔপন্যাসিকের ‘ঝটিতি’ অনুপ্রবেশ, মন্তব্য বা খোঁচা ও দাম্ভিক কটাক্ষে তাঁর গোপন বাসনা গোপন থাকে না। তাঁর এই সংগুপ্ত ইচ্ছার সঙ্গে কথাশিল্পী বঙ্কিমচন্দ্রের কমলকুমারের অন্যতম প্রিয় লেখকঅভিপ্রায়ের মিল আছে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলোর ঐতিহাসিক ভিত্তি সামান্য; বঙ্কিম তা ভালো করেই জানতেন, উপন্যাসের ভূমিকাতে তা জানিয়েছেনও কখনো কখনো। কিন্তু সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র এ কথাও ভাল করেই জানতেন যে, দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), মৃণালিনী (১৮৬৯) বা রাজসিংহ (৪র্থ সং, ১৮৯৩) পড়তে গিয়ে তাঁর অনুরাগী পাঠকেরা শুধু ‘উপন্যাস’ পড়বে না, পড়ে নেবে হিন্দু-মুসলমানের ‘ইতিহাস’ও । সুকুমার সেন বঙ্কিমের উপন্যাসে ‘ইতিহাসে’র কিছু পাননি, কিন্তু বঙ্কিমী রোমান্সের মুগ্ধভক্ত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বঙ্কিমের উপন্যাসসমূহের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন ‘ইতিহাসে’র সার্টিফিকেট। এ ধরনের authoriation বা সার্টিফিকেট-প্রদানের কাজটা অবশ্য রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু করেছিলেন। উপন্যাস লেখায় ছুতায় ‘ইতিহাস’ উদ্ভাবন করার প্রয়াস নতুন কিছু নাকমলকুমার তো বটেই, তাঁর আগে-পরে আরো অনেকে তা করেছেনকিন্তু বিশুদ্ধ ‘উপন্যাস’ কে বিশুদ্ধ ‘ইতিহাস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কৃতিত্ব একা বঙ্কিমচন্দ্রের।
বঙ্কিমের ‘কপালকু-লা’র (১৮৬৬) সঙ্গে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র শেষ দৃশ্যের গভীর ও অনিবার্য সাদৃশ্য সত্ত্বেও কমলকুমারের সতী যশোবতীর (স্বপ্নে-সম্পাদিত) সহমরণ-দৃশ্যের সূত্র বঙ্কিম কিংবা লালবিহারী দে নয়, তা সরাসরি মধুসূদন থেকে গৃহীত। কমল-মধুতে পার্থক্য যাই থাক, সতী প্রমীলা ও সতী যশোবতীর রূপায়নে মধুসূদন ও কমলকুমার দু’জনের অন্তঃপ্রেরণাই রোমান্টিক। আজকের দিনে ‘সতী’র কথা উঠলে রূপ কানোয়ারের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক, কিন্তু যেহেতু কমলকুমার প্রধানত শিল্পী, সতীর প্রেজেন্টেশনই প্রথমত আলোচ্য। কমলকুমারের সতী-কথা, সতীর রূপায়ন, সতীর রিপ্রেজেন্টেশনএ সবকে শিল্প-সাহিত্যের একটা বহু পুরাতন ডিসকোর্সের অংশ হিশেবে দেখা আবশ্যক।
তিন.
বাঙালি পাঠকের কাছে ‘সতী’ কোনো নতুন শব্দ বা ধারণা নয়। ‘সতী’র জন্যে হরিচরণ খুলতে হয় না, তবু খুলেছি যেহেতু আমার লেখার দায় আছে। ‘সতী’র অর্থ, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষে’র মতে, “সাধ্বী, পতিব্রতা”। সতী স্ত্রী মানে “পতিব্রতা স্ত্রী”। “সুশীলা”, “ভক্তবৎসলা” অর্থে বাংলায়, মেঘনাদবধ কাব্যে, ‘সতি’ (হ্রস্ব-ইকার) শব্দের প্রয়োগ দেখিয়েছেন হরিচরণ। অমরকোষ নামক সংস্কৃত অভিধানে ‘সতী-সাধ্বী-পরিব্রতা’একার্থবোধক শব্দ। পুরাণ অনুসারে সতীর সতীত্ব হল, “সাধুস্ত্রীর বা দক্ষকন্যা সতীর ভাব বা ধর্ম; সতীধর্ম, পাতিব্রত্য”। মোটকথা ‘সতী’ শব্দের এমন কোনো আভিধানিক অর্থ নেই যা বাঙালির অজ্ঞাত।
কিন্তু ‘সতী’ যেহেতু শুধু শব্দ নয়, বরং ব্রাহ্মণ-উদ্ভাবিত ধর্ম ও অষ্টাদশপুরাণের অনুষঙ্গ-বহুল একটা ধারণার উদ্বোধকও, তাই ‘সতী’ নিয়ে বিজাতীয় ‘ফেরেঙ্গ’দের প্রায়ই গলদঘর্ম হতে দেখা যায়। ইংরেজিতে to commit Sati to perform Sati এ ধরনের কথা বা expression সুপরিচিত। এই এক্সপ্রেশন, বলা বাহুল্য, `to commit suicide’ `to commit murder or homicide’ এর অনুরূপ। শুধু যে এক্সপ্রেশনের সাদৃশ্য তাই নয়, ‘সতী’ শব্দের সঙ্গে হত্যা, আত্মহত্যা, অপরাধ ইত্যাদি অনুষঙ্গ জড়িত করে পাশ্চাত্ত্য প-িতবর্গ তাঁদের পা-িত্যের পরিচয় প্রদান করে থাকেন। “টু কমিট্ সুইসাইড” আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু “টু কমিট সতী” আমাদের মতো বাঙালির কানে অদ্ভুত শোনায়। “সতী করা” আবার কি কথা? “রূপ কানোয়ার সতী করেছে”এরকম উদ্ভট কথা কি কেউ শুনেছে? ইংরেজিতে কিন্তু তাই লিখতে হয়, কেননা ইংরেজিতে ‘সতী’ হল ‘খুন’ রাহাজানি’ ‘আত্মহত্যা’ ‘ডাকাতি’ প্রভৃতি অপরাধকর্মের মত একটি act-কর্ম’। আবার ব্যাকরণগত অর্থেও ‘টু কমিট সতী’: এই তিনটি পদে ‘কমিট’ ক্রিয়াপদটির ‘কর্ম’ (object) যা ইংরেজি ও আরবি সিনট্যাক্সে ক্রিয়ার পরে বসে এবং সংস্কৃত ভাষায় বিভক্তিযোগে নির্দেশিত হয়হল ‘সতী’। ‘সতী’ যে ‘সহমরণ’-বরণের মত একটা ‘কর্ম’ নাসতী সহমরণে যেতে পারে, না-ও যেতে পারে কিংবা, গিয়ে থাকলেও চিতা দেখে ভয়ে পালাতে পারে যেরকম অতীতে, সাহেবদের সহযোগিতায়, পালিয়েছিল কেউ কেউঅর্থাৎ ‘সতী’ মানে যে ‘সহমৃতা’ নয়, ‘সতী’ যে পতিব্রতা হিন্দু রমণীর বিশেষণ মাত্র, এটা ইউরোপীয়দের বোঝানো কঠিন। ‘সতী’ এবং ‘সহমরণ’ তাদের কাছে এক। ইংরেজরা আগে সতীকে ‘সাটী’ (Suttee) লিখত, এখন পরিচিত বানানে (Sati) লিখলেও মুখের উচ্চারণ অপরিবর্তিত (অর্থাৎ লেখে Sati, কিন্তু উচ্চারণ করে Suttee)। হিন্দু রমণীর ‘আত্মহত্যা’র ধারণা মাথায় থেকে যাওয়ায়সতী-সহমরণ ইত্যাদির শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক ভিত্তি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হওয়ার পরও ইংরেজের দৃষ্টিতে সতী-সাটী-সুইসাইড সমার্থক, অভিন্ন। সতীবিদেশীয় দৃষ্টিতে যার অর্থ চিতার অগ্নিতে হিন্দু রমণীর আত্মহত্যাইংরেজের চোখে আত্মহত্যার (suicide) একটা বীভৎস পদ্ধতি। আত্মহননের মত সহমরণও, অতএব, ইংরেজের বিচারে, একটি জঘন্য অপরাধ।
ইবনে বতুতার (মৃ. ১৩৬৯) ইষৎ পূববর্তী মার্কো পোলোর (মৃ. ১৩২৪) সময় থেকে, ১৮২৯ সালে ইংরেজি আইনে সতীদাহ নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, ইউরোপীয় লেখক-পর্যটকেরা ভারত সফরের যত কাহিনী বা বিবরণ লিখেছেন, তার মধ্যে অন্তত একটি পরিচ্ছেদ বরাদ্দ থাকত ‘সতী’র জন্যে (জন স্ট্রাটন হ’লি ১৯৯৪ : ৩)। ইউরোপীয়দের কাছে সতীদাহ একইসঙ্গে ত্রাস, ঘৃণা, আবার বিস্ময়ের উদ্রেককারী। জ্বলচ্চিতারোহণে হিন্দুরমণীর আশ্চর্য সাহস দেখে শে^তাঙ্গ ইউরোপীয় পর্যটক-পর্যবেক্ষকদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। এই বিস্ময়বোধও অতীব প্রাচীন। বহু পূর্বেকার গ্রীসের লোকেরা এই সতীদাহের কথা জানত; এরিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডার দি গ্রেট এটি দেখেছেন (খৃস্টপূর্ব ৩২৬ খৃ.); গ্রীসদেশীয় মেগাস্থিনিসের ই-িকা নামক বিলুপ্ত গ্রন্থ থেকে পরবর্তীকালের প্লিনি প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা খ-িত ও বিক্ষিপ্তভাবে যেসব উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে সিন্ধু নদীতটে দৃষ্ট হিন্দুরমণীর সহমরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতকে (১৪৯৯ খৃ.) ইতালিয় পর্যটক হিরোনিমো দি সান্টো স্তেফানো সতীদাহকে ভারতের ‘হিন্দু রমণীদের মধ্যে প্রচলিত সাধারণ প্রথা’ হিশেবে উল্লেখ করেছেন। ইতালির আরেক পর্যটক লুডভিক দি ভারথিমা (১৫১০ খৃ.) প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সতীদাহের বিশদ, ধারাবাহিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। ষোল শতকের গোড়ায় রচিত এই বৃত্তান্তে সহমরণের চূড়ান্ত ঘটনাটি ছাড়াও সহমরণ-গামী ‘সতী’রমণীর সাজ-সজ্জা, বসন-ভূষণ, ক্যারোলিন-মধুসূদনের ‘রতœ-আভরণ’, এবং সহমরণ-অনুষ্ঠানে সমবেত দর্শনার্থীদের পোশাক-পরিচ্ছেদ ঢাক-ঢোল নৃত্যবাদ্য কাঁসরঘন্টা হরিধ্বনি শঙ্খধ্বনি ইত্যাদি যাবতীয় তথ্যের উল্লেখ আছে। বস্তুত সহমরণ-অনুষ্ঠান, লুডভিকের বর্ণনা অনুযায়ী, এক আনন্দঘন কার্নিভাল, এক উল্লাসমুখর বর্ণাঢ্য উৎসব। লুডভিক অবশ্য এ-ও বলেছেন যে, “শয়তান-সদৃশ বস্ত্র পরিধানকারী কতিপয় ব্রাহ্মণ, নিরীহ অবলা রমণীদের ধরিয়া আনিয়া, প্রজ¦লন্ত চিতায় উঠাইয়া দিত; চিতার অগ্নিতে কোনো রমণীর দেহ তখন-তখনই দগ্ধ, ভষ্মীভূত, না হইলে সেই রমণীর সংসারের লোকজন তাহাকে বেশ্যামাগী বলিয়া গালি দিত”।
অবশ্য ইটালির জেনোয়াবাসী আরেক পর্যটক, লুডভিকের বিপরীতে, সতীরমণীর পতিভক্তি, সাহস-সংকল্প ও আত্মোৎসর্গের ধর্মীয় আকাক্সক্ষাকে বড় করে দেখিয়েছেন (১৬২৬ খৃ.)। সতী-পতœীর ‘সহমৃতা’ হবার এই প্রত্যয়, তাঁর বিবেচনায়, পতির সঙ্গে একাত্ম, ও একাঙ্গ, হবার আন্তরিক বাসনাপ্রসূত। ইতালিয় পরিব্রাজক নিকোল ডি কন্টির (১৪৯২ খৃ.) মনে হয়েছে, “সহমরণ-সংকল্পের সহিত সহমৃতা রমণীর যশোলাভের আকাক্সক্ষা, বিশেষত তাহার শ^শুরগৃহের লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়বর্গের নিকট আত্মত্যাগের স্মরণীয় কীর্তি স্থাপনের গূঢ়ৈষণার সম্পর্ক রহিয়াছে”।
তারপরও নিকোল কন্টি একথা জোর দিয়ে বলেন যে, হিন্দুরমণীর সহমরণ ব্রাহ্মণদের কারণেই এবং হিন্দুসমাজের ব্রাহ্মণ-বিধাতারাই সহমরণের জন্যে দায়ী। তাঁর কথা হলো, ব্রাহ্মণেরাই বিধবা নারীর কাছে তার স্বামীহীন জীবনকে হয় তুচ্ছ, নিকৃষ্ট, ঘৃণিত করে দেখায় অথবা তারাই বিধবার কাছে তার বৈধব্যদশাকে অসহ্য, অবাঞ্ছিত করে তোলে। বিধবা রমণীর জীবন বিধবাদের কেউ কেউ, মনে রাখা উচিত, যশোবতীর মত বালিকাও রকম ঘৃণিত ও অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে বলেই সে সহমরণ নামক আত্মহত্যায় প্রলুব্ধ হয়। ডি কন্টি বলেন যে, “যদি কোনো রমণী সহমরণে প্রথমে রাজি হইয়া পরে পস্তায়, ব্রাহ্মণগণ তাহাকে জোরপূর্বক ধরিয়া আনিয়া চিতায় নিক্ষেপ করিয়া থাকে”। কখনো কখনো রোমান্টিকতার রং চড়ালেও, ডি কন্টি ও অন্যদের কাছে “সহমরণ একটি নির্মম অত্যাচার”।
পর্তুগীজ পর্যটকেরা বলেন যে, হিন্দু রমণীদের সুখ্যাতি-লাভের আকাক্সক্ষা তাদের সহমরণ-প্রবৃত্তি বা প্রণোদনার পশ্চাতে কার্যকর। টমি পাইরেস (১৫১২ খৃ.) লেখেন, সম্পন্ন গৃহের উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরমণীরাই ‘সতী’ হয়, অর্থাৎ তারাই সহমরণে যায়। ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণ ও জোরপ্রয়োগের কথা টমি পাইরেসও বলেছেন; ব্রাহ্মণদের চাপ সত্ত্বেও কেউ কেউ চিতায় ঝাঁপ দিতে রাজি হয় না, সেই উদাহরণও দিয়েছেন তিনি। ব্রাহ্মণের আদেশ অমান্যকারী, সহমরণে-অনিচ্ছুক, এ-ধরনের বিধবাদের যাদের কেউ কেউ, যেমন বলেছি, নিতান্ত বালিকা মাত্রবাকি জীবন কাটাতে হয় ‘মন্দিরের বেশ্যা’ হয়ে। পর্তুগীজ পর্যটকদের অভিমত হলো, সহমরণ এবং সতীত্বের খ্যাতি পরস্পর-সম্পৃক্ত। দোয়ার্তে বারবোসা (১৫১৪ খৃ.) লিখেছেন, ভারতীয় সমাজে নিচু জাত বা বর্ণের হিন্দু রমণী স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হবার আগাম ঘোষণা দিয়ে জাতে ওঠার চেষ্টা চালায় এবং সেভাবে শ্বশুরবাড়িতে নিজের ‘দাম’ বাড়াতে সক্ষম হয়। অন্যান্য রমণীও, ওর দেখাদেখি, সহমরণে উৎসাহী হয় এবং তারাও একই প্রক্রিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে নিজেদের দাম বাড়ায়।
পিয়ের সনারেতের সুমুদ্রিত, অলংকৃত ও বহুপঠিত ভ্রমণকথায় সহমরণকে ‘ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পিয়ের সনেরাত-লিখিত কাল্পনিক রোমান্টিক কাহিনীতে দেখা যায়, যার জন্যে ‘সতী’ জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করে প্রাণবিসর্জন দেয়, সে লোকটি ছিল মনুষ্যের ছদ্মবেশধারী একজন দেবতা। ফলে ঐ সতীরমণীর বাহ্যত দৈহিক মৃত্যু হলেও, মনুষ্যরূপী দেবতার আশীর্বাদে সে তক্ষুণি অমরত্ব লাভ করে। পিয়ের সনারেতের চিত্তাকর্ষক উপাখ্যান ইউরোপীয়দের উন্মাদ করে ছাড়ে, তাদের কল্পনালোকে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র শেষ দৃশ্যের মত ‘কোটালের বান’ নেমেছিল একদা: সনারেতের অনুকরণে বহু সতীমঙ্গল-কথা রচিত হয়। মুশকিল হচ্ছে, সনারেতের ‘সতী’ প্রচলিত অর্থে ‘সতী’ তো ছিলই না, অনেকটা বারাঙ্গনাই ছিল। তা হলেও, পিয়ের সনারেত দেখাতে চেয়েছিলেন যে, যে-সমাজে একটা সামান্য নারীর এত মহিমা, সেই সমাজকে ইউরোপীয়দের খাটো করে দেখা অনুচিত। পিয়ের সনারেতের সুরে সুর মিলিয়ে দুই ইতিহাসবেত্তাও ঘোষণা দিলেন এই মর্মে যে, “ভারতবর্ষের নীচকুলোদ্ভূত ছোটজাত রমণীর মধ্যেও প্রেম ও পতিভক্তি দুর্লভ নহে”। এভাবে, ধীরে ধীরে, ‘সতী’ আর বাস্তব কোনো নারী থাকল না, হয়ে উঠল এক পৌরাণিক চরিত্র। এসব সতী-বিবরণ ষোল-সতের শতাব্দীর, অর্থাৎ এগুলো হচ্ছে তথাকথিত ‘রেনেসাঁসে’র সময়কার ইউরোপিয় সতী-ভাবনা।
তারপর, এনলাইটেনমেন্ট তথা অষ্টাদশ শতকে, ফরাশি ভলটেয়ার চিতার অনলে দগ্ধ ভারতীয় সতীর দুর্ভোগ নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় বিশেষ পান নি; ‘বিশ্বকোষ’ বইতে “সতীদাহ নামে প্রচলিত একটি অযৌক্তিক ভারতীয় প্রথা”র সমালোচনা করেই ভলটেয়ার ক্ষান্ত হন। তবে জার্মান রোমান্টিক চিন্তাবিদ ও সুলেখক য়োহান গটফ্রিড হার্ডারযাঁর উদ্দীপক রচনা ও তত্ত্ব আজও ফোকলোর চর্চা-গবেষণার প্রেরণাস্থল ছিলেন ‘ভারতীয় কুসংস্কারের’ (তাঁর শব্দ) কঠোর সমালোচক। হার্ডার বলতে চান যে, হিন্দুধর্মাবলম্বী সমাজে দয়া-মায়া ও করুণার মনুষ্যশোভন প্রবৃত্তি নিঃশেষিত ও একেবারে বিলুপ্ত হওয়ার পরিণামেই জন্ম হয়েছিল সতীদাহের মত একটি নির্মম কুপ্রথা। দুই কারণে, হার্ডারের মতে, হিন্দু রমণী সহমরণে যায়: এক) সতীত্ব-পাতিব্রত্যের একটা মিথ্যা কুসংস্কারের অন্ধ অনুসরণ; দুই) মৃত্যুকে একটা শাস্তি এবং প্রায়শ্চিত্ত হিশেবে গণ্য করার শোচনীয় প্রবৃত্তি। ব্রাহ্মণদের দায়ী করে হার্ডার বলেন যে, ওদের কারণেই এই কুসংস্কার এত বলবতী। হার্ডার বলেন, কপট ব্রাহ্মণেরা প্রতি যুগে এই প্রকৃতিবিরুদ্ধ প্রথায় বর্ণযোজনা করে এসেছে; পরজীবনে পুরস্কার ও মোক্ষপ্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে তারাই প্রলুব্ধ করেছে নিরীহ মেয়ে মানুষদের। নারী-নিধনে হিন্দু পুরুষদেরই লাভ, এতে জোর বাড়ে তাদেরই হার্ডার বলেন; নারীর জীবনের চেয়ে পুরুষের জীবনের মূল্য বেশিব্রাহ্মণ-উদ্ভাবিত সহমরণ প্রথার মধ্যে দিয়ে এই ক্ষতিকর বিশ্বাসই, হার্ডারের মতে, সামাজিক স্বীকৃতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা অর্জন করেছে। সহমরণকে যদি ‘পতিপ্রেম বা পতিভক্তির পরাকাষ্ঠা’ বলেও ধরে নেয়া হয় তর্কের খাতিরে হার্ডার বলেনতবু ‘যে-সতীদাহের ভিতর এত শঠতা, ভ-ামি ও চক্রান্ত তা নীতির কোন্ মানদ-ে সিদ্ধ হয়’? নীতি-নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে হার্ডারের সতীদাহÑবিরুদ্ধ অভিমত মহাকবি গ্যেটে সমেত পরবর্তী অনেক ইউরোপিয় লেখককে প্রভাবিত করেছিল। ইউরোপীয় কল্পনায়, হার্ডারের প্রভাবে, ‘সতী’ হয়ে উঠল এক সাহসী, কিন্তু চিরদুঃখিনী, নারীর প্রতীক।
আদর্শ ‘সতী’তে উত্তীর্ণ হয়ে হিন্দু বারবনিতা অমরত্ব অর্জন করেছে মহাকবি গ্যেটের একটি কবিতায়। কবিতাটির কথাবস্তু এরকম: প্রেমের ক্ষেত্রে মনুষ্যের কতটা অগ্রগতি হল, তা পরীক্ষা করার জন্যে জিসাসের মত এক দেবতা অবতীর্ণ হলেন দক্ষিণ ভারতের একটি নগরীতে। নানা জায়গায় সারাদিন ঘোরাফেরার পর নগরের উপকণ্ঠে এক দরিদ্র বারাঙ্গনার কুঁড়েঘরে, তারই আমন্ত্রণে, দেবতা আতিথ্য গ্রহণ করলেন। সে নারী ছিল মন্দিরের নটিনী; প্রেম-ভালবাসা, আদর-সোহাগ সে কখনো পায় নি, এসব কি জিনিশ তা সে জানতই না। দেবতার চুম্বনে বিগলিত হয়ে নারীটি কেঁদে উঠল, তার দু’চোখ ভরে নামে অশ্রুধারা, কেননা চুম্বনের এই অভিজ্ঞতা তার প্রথম। তার গ্রীবায় দেবতার কোমল স্পর্শ এই অন্ত্যজ অবলার অন্তঃকরণে তৈরি করে দিয়ে যায় এক অজ্ঞাত প্রেম ও অনুরাগের স্থায়ী ক্ষত। অত:পর নিজেদের অজান্তেই তাদের দেহ নিঃসাড় হয়ে পড়ে, পলকে ফুরিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুদ্র ও সংক্ষিপ্ততম রজনী। কুঁড়েঘরের বেড়া ভেদ করে প্রবেশ করল প্রভাতের নির্মল সূর্যালোক, রাতের অতিথিটি তখনো বারাঙ্গনার বাহুডোরে বাঁধা, কিন্তু তার চক্ষু হিম-শীতল, শরীর নিরুত্তাপ, নিস্পন্দ, প্রস্তরবৎ। বাহুডোরের বাঁধন উপেক্ষা করে মৃত্যু কখন তার মনের মানুষকে ছোবল দিয়ে গেছে বারাঙ্গনা জানতে পারে নি; ক্রূর নিয়তির এই নির্মম ঠাট্টায়, শোকে, অসহ্য দুঃখে বারাঙ্গনার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। দাহকৃত্যের জন্যে শবদেহটিকে যখন তোলা হলো চিতার উপর, শোকে-দু:খে উন্মত্তা বারাঙ্গনা ব্রাহ্মণদের বাধা ও নিষেধ অগ্রাহ্য করতে ক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রজ্বলন্ত চিতার লেলিহান শিখায়। দুঃখিনীর এই নির্মল প্রেমাবেগ ও নিঃশঙ্ক আত্মহননে অভিভূত হয়ে মনুষ্যরূপী অমৃতের পুত্র উঠে বসলেন চিতায় এবং সমাগত ব্রাহ্মণদের লজ্জিত ও স্তম্ভিত করে তিনি, ঐ ‘মিলন-অভিলাষিণী’ বরপ্রাপ্তা বারাঙ্গনা সমেত, অদৃশ্য হলেন উর্ধ্বলোকে, অমরায়।
সতী নিয়ে এই আখ্যানমূলক কবিতাটি লেখার আগে গ্যেটে পিয়ের সনারেতের পূর্বোক্ত আখ্যানটি পড়েছিলেন; তাঁর ডায়েরিতে তার উল্লেখ আছে। তবে সনারেনেতের মতো মহাকবি গ্যেটে ‘মন্দিরের সেবাদাসী’দের নিয়ে আরেকখানা রোমান্স লেখেন নি। মহাকবির এই বারাঙ্গনা জিসাসের নারী-শিষ্য ম্যারি ম্যাগডালিনের মডেলে কল্পিত। এই ম্যারির সঙ্গে জিসাসের মধুর সম্পর্কের মানবিক কাহিনী দুই সহ¯্র বছর ধরে খৃষ্টধর্মীয় ক্যাথলিক ফেরকার পুরোহিতবর্গ লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও তাড্যান ব্রাউনের মতো জনপ্রিয় লেখকের ‘দা ভিঞ্চি কোড’ (২০০৩) নামক জনপ্রিয় উপন্যাসের কারণেবর্তমানে দুনিয়ার পাঠকদের কাছে সুপরিচিত।
ইউরোপীয় সাহিত্যকর্মে সতী-চরিত্র যে ভাবে রূপায়িত হয়েছে, তাতে আমরা দুটো বিষয় লক্ষ করে থাকব: এক) প্রজ্বলন্ত চিতায় উঠে হিন্দুরমণীর আত্মহনন নিয়ে ইউরোপীয় লেখক-পর্যটক-শিল্পীদের বিস্ময়ের শেষ নেই (এর ফলে তাঁদের সতী-চরিত্র হয়ে ওঠে রোমান্টিক); দুই) একটা জীবন্ত নারীর এ-ধরনের সহমরণ যেহেতু ইউরোপিয় বোধবুদ্ধির অতীত, সেজন্যে যে-ব্রাহ্মণসমাজ এই নিষ্ঠুর প্রথার উদ্ভাবক ও সমর্থক, তার কঠোর সমালোচনা করে সহমরণ-বিরুদ্ধ জনমত সৃষ্টিকে ইউরোপিয় লেখকবৃন্দ নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছিলেন। ‘সহমরণ কখনই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়’ অথবা ‘নিজের ইচ্ছায় সতীরা কখনোই আগুনে ঝাঁপ দেয়নি’এরকম কিছু নিঃসংশয়ে ‘প্রমাণ’ করতে পারলে ইউরোপিয়েরা খুশি হতেন, কিন্তু তা তাঁরা প্রমাণ করতে পারেন নি। হিন্দুরমণীর সহমরণ রমণীদের ইচ্ছাবিরুদ্ধ এটা সকল ক্ষেত্রে প্রমাণ করা যায়নি বলেই (কেননা ইংরেজ ও ইউরোপদেশীয় ব্যক্তিরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ‘সতী’র স্বত:প্রবৃত্ত সহমরণ-দৃশ্যের সাক্ষী, প্রত্যক্ষদর্শী) যশোবতীর মতো সহমরণ-অভিলাষী ‘সতী’দের নিয়ে ইউরোপিয়দের বিস্ময়ের ঘোরও কাটে নি।
চার.
জার্মানির কবি ক্যারোলিন, ভাগনার, সনারেত কিংবা মহাকবি গ্যেটের বর্ণনায় ‘সতী’ মোটের ওপর একটি রোমান্টিক চরিত্র। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় ‘সতী’ যশোবতীর রূপায়নও তাই, অর্থাৎ তা রোমান্টিকঐতিহাসিক নয়। তার মানে, ইউরোপীয় সাহিত্যে রূপায়িত ‘রোমান্টিক’ সতীকে এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিস্ট তত্ত্বের অনুসরণে প্রাচ্য-বিদ্বেষী অর্থাৎ ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’ বলে খারিজ করে দেয়া চলে না, কারণ তা হলে কমলকুমারের সতী যশোবতী এবং মাইকেল মধুসূদনের সতী প্রমীলাকেও “ওরিয়েন্টালিস্ট” বলে বর্জন করতে হয় (যদিও ওরিয়েন্টাল মধুসূদন-কমলকুমারকে “ওরিয়েন্টালিস্ট” আখ্যা দেয়া হাস্যকর)।
ইউরোপীয়দের মধ্যে যাঁরা ‘সতী’কে রোমান্টিক করে তোলেননি ক্যারোলিন বা ভাগনারের মতো যেমন কোনো কোনো পর্তুগীজ লেখক তাঁরা সতীকে চিত্রিত করেছেন বীরাঙ্গনা রূপে। কিন্তু ‘সতী’কে বীরাঙ্গনা হিসেবে দেখাও তো রোমান্টিক, নয় কি? রাজপুতানায় রাজপুত রমণীদের সহমরণ উনিশ শতকী বঙ্গসাহিত্যে জনপ্রিয় বিষয়বস্তু। চিতোরের পদ্মিনীকে নিয়ে রঙ্গলাল ও ক্ষীরোদপ্রসাদ থেকে শুরু করে হরিপদ, এমনকি নীহাররঞ্জন গুপ্ত পর্যন্ত, অনেকে অসংখ্য কাব্য, গল্প, নাটক লিখেছেন। কিন্তু রাজপুতানার সহমরণ বা সেখানকার পদ্মিনীদের ক্ষাত্রধর্ম-প্রাণিত ‘জহরব্রত’ আর ভাগিরথী তীরবর্তী অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র-পুরাণাদি নির্দেশিত বাঙালি অবলার সহমরণ যে এক জিনিশ না, সাম্প্রতিক কালের নারীবাদী গবেষণায় তা সুপ্রমাণিত।
পদ্মিনীর অগ্নিতে আত্মহত্যা বা ‘জহরব্রতে’র ঘটনাকে বঙ্গদর্শনের (১৮৭২) সময় থেকে ঐতিহাসিক বা অথেনটিক মনে করা হয়ে থাকে। ধরে নেয়া হয় যে, ভাটকবিদের কাব্যগাথার ভিত্তিতে রচিত রাজস্থান (১৮২৯) বইতে কর্নেল টড অনেক রং চড়ালেও, এ বইতে আলাউদ্দিন খিলজীর লোলুপদৃষ্টির কারণে পদ্মিনীর আত্মহত্যার যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, এবং যে কাহিনী রঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান (ও সেরকম আরো বহু উপাখ্যানের) উপজীব্য, সেই ঘটনা সত্য-সত্যই রাজস্থানের চিতোর-এ সংঘটিত হয়েছিল। অনেকের দৃঢ় বিশ^াস, রঙ্গলালের উপাখ্যানে জহরব্রতী ‘সতী’-পদ্মিনীর রূপায়ন রোমান্টিক, অতিশয়িত বা আদর্শায়িত হলেও, তার ভিত্তি ঐতিহাসিক। ‘সতীরাণীর পুণ্যকাহিনী’-রূপে পরিচিত ‘পদ্মিনী উপাখ্যানে’র (১৮৫৮) পদ্মিনী হচ্ছে সেই রমণী যার রূপের আগুনে দেওয়ানা হয়ে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী ‘চিতোর ঘেরিল আসি হয়ে ক্ষিপ্তমতি’:
তথাপি পদ্মিনী সতী সতীত্ব-রতন
না দিলেন যবনেরে, করি প্রাণপণ
পদ্মিনী অত:পর ‘দুরাত্মা যবনে’র হাত থেকে নিজের ‘সতীত্ব-রতন’ রক্ষার প্রতিজ্ঞায় খাঁটি রাজপুত বীরাঙ্গনার মত নিজেকে ‘অগ্নিগ্রাসে’ নিক্ষেপ করেন। কিন্তু কীর্তিমান ঐতিহাসিক, দারাশিকো-জীবনীকার, ডক্টর কালিকারঞ্জন কানুনগো দুটি মৌলিক গবেষণা-লব্ধ তুলনামূলক প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করেছেন যে পদ্মিনীর জহরব্রতের এই জনপ্রিয় কাহিনী (কমলকুমারের যশোবতীর মতো) একটা গল্প মাত্র: “পদ্মিনী উপাখ্যান ও তাহার ঐতিহাসিকতা” এবং “পদ্মাবত কাব্য এবং পদ্মিনীর অনৈতিহাসিকতা”।
পদ্মিনীর মত কমলকুমারের যশোবতীও কল্পনাপ্রসূত এবং তা, পূর্বে আলোচিত ক্যারোলিন-ভাগনারের পাশ্চাত্ত্য ‘সতী’র মত, আগাগোড়া ‘রোমান্টিক’ । তবে ভারতবর্ষের ‘সতী’, সতীদাহ, সহমরণের ইতিহাস কমলকুমারের অজ্ঞাত ছিল না। সতীদাহ সংক্রান্ত যেসব তথ্য, বিবরণ, রিপোর্ট পাওয়া যায়, তার সবটা না হলেও কিছু কিছু তিনি দেখেছেন। পাঠকমাত্রেই জানেন যে, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র আকর্ষণীয় চরিত্র চ-াল বৈজু যশোবতীর সতীধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-কৌতুকে মুখর বৈজু যেহেতু শ্মশানঘাটে মড়া পোড়ায়, সেজন্যে যশোবতীর মত একটা বালিকার সহমরণ সংকল্প দেখে সে বিমূঢ়, ক্রুদ্ধও। সতীদাহ নিয়ে স্বর্ণলোভী ব্রাহ্মণেরা যেসব চক্রান্ত করে (চিতার উঠিয়ে দিয়ে রমণীর গা থেকে সোনা চুরি), তার সবই বৈজু জানে, দেখে এসেছে। দু’দিন পর, বুড়ার অক্কাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই, যশোবতীর কোমল দেহখানি চিতায় তুলে বৈজুকেই পোড়াতে হবে, এটাই বৈজুর দু:খ।
চ-াল বৈজুর স্বগতোক্তি, নানান ঠাট্টা ও যশোবতীর সঙ্গে তার কথোপকথনে সতীদাহ-সংক্রান্ত বিবিধ খুঁটিনাটি তথ্য উঠে আসে, যা কমলকুমার কিছুটা লালবিহারীর ‘গোবিন্দ সামন্ত’, কিছুটা ইতিহাস থেকে আহরণ করেছেন। কিন্তু যশোবতীকে মধুসূদনের প্রমীলা সুন্দরী ও ইউরোপীয় রোমান্টিক ‘সতী’র আদলে গড়তে গিয়ে কমলকুমারকে সতীদাহ-সহমরণের অপ্রীতিকর ইতিহাস ও ঐতিহাসিক বিবরণ উপেক্ষা করতে হয়েছে। সতীদাহের প্রাচীন ইতিহাস না হয় বাদ দিলাম; আমরা জানি যে, গেজেটে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছাড়াও ‘ইন্ডিয়ান মিরর,’ ‘সমাচার দর্পণ’ ও অন্যান্য সাময়িকপত্রে সতীদাহের বিবরণ এবংবিয়ে-শাদী, স্কুল-প্রতিষ্ঠা, কলেজ-উদ্বোধন, ঘটকালির কেরামতিতে অশীতিপর বৃদ্ধের পুনরায় দ্বার-পরিগ্রহের সংবাদের পাশাপাশি সহমরণের খবরও তুচ্ছ, মামুলি ঘটনার মত নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁকে কমলকুমার ‘ফাৎনা মনস্কতা’তে (১৯৭২) ‘একজন সেরা সাহিত্যিক’ বললেও ঠিক পছন্দ করেন না (ব্রজেনবাবুর যুক্তিশীলতা, নিñিদ্র তথ্যনিষ্ঠার কারণে হয়তবা) তাঁর বাংলা সাময়িক পত্র (২-খ-, ১৯৪৮) ও সংবাদপত্রে সেকালের কথা (২-খ-, ১৯৪৯-৫০) প্রভৃতি গ্রন্থে সতীদাহের সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু কিছু বিবরণ সংকলন করেছেন। সে সব উনিশ শতকী সংবাদপত্রের কথা থাক; বিংশ শতাব্দীতে, ১৯১৩ সালে প্রকাশিত, কুমুদনাথ মল্লিকের সতীদাহ (১৯১৩) বই থেকে সতীদাহের কয়েকটি বিবরণ উদ্ধৃত করি:
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দ্বিতীয় সংস্কৃত শিক্ষক রামনাথ উলাগ্রামে সংঘটিত…একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। …উলা নিবাসী মুক্তারাম মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হইলে তাঁহার ১৩ জন স্ত্রী সহমৃতা হয়েন। তাঁহার আর একটি পতœী সহমরণের জন্যে প্রস্তুত হইয়া …যখন চিতা সমীপে মন্ত্রোচ্চারণ করিতেছিলেন, তখন তাঁহার হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হওয়ায় তিনি পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁহার পুত্র, মাতার এই অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ ঠেলিয়া চিতায় নিক্ষেপ করিলেন (সতীদাহ ১৯১৩ : ৭২)
সময়ে সময়ে একসময়ে একসঙ্গে এত স্ত্রী সহমৃতা হইতেন যে, ২০ বা ২৪ হাত প্রশস্ত চিতাতেও স্থান সংকুলান হইত না। …এক উদ্দমে দগ্ধ না হইলে পুনঃ পুনঃ আয়োজন করিয়া একই সতীকে পুড়াইয়া মারা হইত। (সতীদাহ ১৯১৩ : ৭৩)
বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যার যুগী, জোলা ও বৈষ্ণবগণের মধ্যে সতীকে মৃতপতির সহিত [জীবন্ত] সমাহিত করিবার প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধরণত গঙ্গা … তীরে একটি গর্ত্ত খনন করিয়া তাহার তলদেশে …মৃতদেহ রক্ষা করা হইত। অতঃপর সতী, ¯œানান্তে, ঐ গহ্বরে অবতরণ করিয়া স্বামীর মস্তক ক্রোড়ে লইয়া বসিতেন। … পরে … ঐ সমাধিতে মৃত্তিকা নিক্ষিপ্ত হইত। ঐ নিক্ষিপ্ত মৃত্তিকা সতীর সানুদেশ পর্যন্ত উত্থিত হইলে অনেকগুলি কোদালির সাহায্যে শীঘ্র শীঘ্র ঐ সমাধি মৃত্তিকাপূর্ণ করিয়া বন্ধ করা হইত। (সতীদাহ ১৯১৩ : ৭৯-৮০)
তখন বাঙ্গালা দেশে সতীদাহের বহুল প্রচার ছিল। দূরদূরান্ত হইতে, এমন কি ১৫-১৬ দিনের দূর পথ হইতে গঙ্গায় মৃতদেহ বহন করিয়া আনা হইত ও তথায় সতীদাহ সম্পন্ন হত। এই দূরপথ পদব্রজে অতিক্রম করিবার কালে সতী চিতাসজ্জার কাষ্ঠ ভিক্ষা করিতে করিতে আসিতেন। (সতীদাহ ১৯১৩ : ৭৬-৭৭)
হরিনাথ শর্ম্মার মৃত্যুতে তাঁহার অষ্টমবর্ষীরা বালিকা স্ত্রী সহমৃতা হয়েন। যখন স্বামীর মৃত্যু সংবাদ আসিল, তখন ঐ বালিকা পাড়ায় ছোট ছোট বালিকার সহিত খেলা করিতেছিল। ইহার কিছুক্ষণ পূর্বে বালিকা তাহার অত্যাচারী খুড়ীর নিকট তিরস্কৃতা হইয়া মরণে কৃতসংকল্পা হইয়াছিল। এক্ষণে এইরূপে মৃত্যুর সুযোগ প্রাপ্ত হইয়া সে আত্মীয়স্বজনের কোনো কথাই না শুনিয়া সহমরণের জন্য প্রস্তুত হইল। কথিত আছে বালিকা চিতায় স্বামীদেহ আলিঙ্গন করিয়া শয়ন করিবা মাত্র তাহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়াছিল। (সতীদাহ ১৯১৩ : ৭১)
কমলকুমার বই পড়তেন পাবলিক লাইব্রেরিতে; তিনি এ বই, কুমুদনাথের সতীদাহ (১৯১৩), পড়েন নি বিশ^াস হয় না। তবে সীতাদাহের এসব ভয়ঙ্কর বিবরণ দিয়ে কমলকুমারের কাজ নেই। শুধু এসব কেন, সতীদাহ সম্পর্কে জানার জন্যে কমলকুমার লালবিহারী দে-র গোবিন্দ সামন্ত (১৮৭৪) পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন; কিন্তু সেই ‘গোবিন্দ সামন্ত’ বইয়ের দি সতী শীর্ষক ১৮-তম পরিচ্ছেদে পাবেন যে, রাঢ়ার কাঞ্চনপুর-নিবাসী রামধন মিশ্রের সদ্যবিধবা মাতাকে, অগ্নিসংযোগের পরমুহূর্তে চিতার উপর থেকে ভয়ানক চীৎকার করে পালাতে চাইলে, “বাঁশ দিয়ে চেপে ধরে” পোড়ানো হয়েছিল। সতীদাহ বা সহমরণ নিয়ে লালবিহারী দেক্যারোলিন, ভাগনার বা কমলকুমারের মতোরোমান্টিকতা করেন নাই; সতীদাহ-দৃশ্যকে তিনি, ঐ পরিচ্ছেদেই, একটা suicide (পৃ. ১১৮) এবং রামধনের মাকে “ব্রাহ্মণ্য কুসংস্কারের হতভাগ্য বলি” (পৃ. ১২২) হিশেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এসব ফ্যাক্ট উপেক্ষা করার কারণ ‘ইতিহাস’, কমলকুমারের বিবেচনায়, এ ধরনের বাহ্য ‘ফ্যাক্ট’ এবং বেহুদা ‘বাস্তব’ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এ-জাতীয় বাস্তব (factual reality) তো অনিত্য, মায়া (illusion), কাজেই তা ‘অবাস্তব’ (মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণও অর্জুনকে একথাই বুঝিয়েছিলেন)। চ-াল বৈজু, আর্য্যব্রাহ্মণের সূক্ষ্ম অষ্টাবিংশতীতত্ত্বে বুৎপত্তি না থাকায়, ‘চিতাগ্নির মধ্যে বীৎভস অঙ্গ’ দেখে সেই প্রত্যক্ষ ঘটনাকেই মনে করে বাস্তব, কিন্তু বাস্তব তো তা নয়, কেননা প্রজ্জ্বলন্ত চিতার “মেদ গন্ধ, নিষ্ঠুর অগ্নি ও তাহার দাহিকা শক্তি” এইসব, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র মতে, “আমাদের দেওয়া নাম ও বাস্তবতা” (পৃ. ৪০) মাত্র: আসল বাস্তব তো দৃশ্যমান চিতায় নেই, তা অন্যত্র, তা অন্যকিছু (এবং তা ফেরেঙ্গদের মতো চ-াল বৈজুরও বোধগম্যতার অতীত)। আসল বাস্তব তো ‘অন্তরীক্ষের সহনশীলতা’ ও তার ‘হিরণ্যকোষের সহজতত্ত্ব’ (পৃ. ৩৯)। আসল বাস্তব তো মিলনের মধুর ‘আনন্দ’, যে ‘আনন্দের মধ্যে প্রণাম’, যে ‘প্রণামের মধ্যে পুষ্পের রহস্য’, যে রহস্যের মধ্যে উদাত্ত, রূপময় সরল রেখা (পৃ. ৪০)। আসল বাস্তব তো ‘ভবের পাগল’ চ-াল বৈজুর বোঝার কথা নয়, তা কেবল প্রতিপ্রাণা সরল ব্রাহ্মণবালিকা যশোবতীই বোঝে, কেননা তার আত্মা দেহকে ভালোবাসেসেই দেহ আবার, ব্রাহ্মণের তত্ত্ব-অনুযায়ী, আত্মার অনুগামী, অনুরাগীওএবং এই “বিচ্ছেদশীল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের গুণে” ইতিহাসের বাহ্য, factual, বাস্তব যশোবতীর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব। তার পক্ষে ‘সতী’ হওয়া সম্ভব।
যশোবতী জানে যে, যে-বৃদ্ধ সীতারামের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে, তার মৃত্যু আসন্ন; যে-কোনো মুহূর্তে সেই বৃদ্ধ এই ‘নশ্বর’, তুচ্ছ, অনিত্য ও অতি-ব্যক্ত জগত পরিত্যাগ করে “মহাব্যোমে বিরাট শূন্যতায়, চক্ষুহীন জিহ্বাহীন স্তব্ধতায়… অব্যক্ত হইবেন”। দু-দিন বাদে বৃদ্ধের মৃত্যুর অর্থ যশোবতীরও মৃত্যু; বৃদ্ধের সঙ্গে তার সহমরণের নিমিত্ত, তারই চোখের সম্মুখে, গঙ্গা-তীরের শ্মশানঘাটে, চিতাসজ্জা চলছে। নিজের জীবনের এই ভয়ঙ্কর উপসংহারের কথা জেনেও ‘সতী’ যশোবতী সহমরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, অটল; জাগ্রত স্বপ্নে একবার সে সহমরণে চলেও যায় (যা উপন্যাসে যশোবতীর প্রথম সহমরণ হিশেবে বিবৃত)। এবং যশোবতীর সহমরণ দিয়েইগঙ্গাতীরের চিতায় না হোক, গঙ্গাজলে তো বটেইএই উপন্যাসের সমাপ্তি।
‘সতী’ যশোবতীর পতিভক্তি কোনো চাপ বা সংস্কার দ্বারা প্রভাবিত নয়, বরং তা স্বাভাবিক, স্বতোপ্রণোদিত, বিশ্বাসপ্রসূত, বিশুদ্ধ: এটাই দেখাতে চায় ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। অস্বাভাবিক-কে ‘স্বাভাবিক’, ব্যতিক্রমকে ‘নিয়ম’, হিন্দুরমণীর স্বেচ্ছায় সহমরণের মত ‘অ-সাধারণ’ ঘটনাকে সাধারণ বা নৈমিত্তিক ঘটনারূপে উপস্থাপনের সফলতায় নিহিত এ-উপন্যাসের “টেক্সচ্যুয়াল পলিটিক্স”। যশোবতীর সংকল্প সকল হিন্দু নারীর সংকল্প, তার পতিভক্তি সকল পতিব্রতা নারীর ত্যাগ, আত্মবিসর্জনের প্রতীকএককথায়, বাঙালি বালিকা ‘যশোবতী’তে সর্বকালীন ভারতীয় ‘সতী’র আবহমান চরিত্র মূর্ত, প্রতিবিম্বিত এই হল ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র অন্তর্লীন মেটাফিজিক্স।
কোনো সমকালীন ঘটনা নিয়ে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ লিখিত হয় নি; এর পরিপ্রেক্ষিতযা বৈজুর মুখে (ইস্ট ই-িয়া) কোম্পানি ‘মা’-র উল্লেখ ও বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ কৃষ্ণপ্রাণের ইংরেজ-শাসন ও পুলিশভীতি থেকে অনুমেয়সতীদাহ-উত্তর, অর্থাৎ ১৮২৯-পরবর্তী, উনবিংশ শতাব্দীর কলিকাতা। যশোবতীর বালিকা সুলভ ‘হি হি’ হাসি শুনে তার প্রতি অক্ষম বৃদ্ধের তাৎক্ষণিক ক্রোধ ও তাচ্ছিল্য এবং ঘটনাক্রমে, বৈজুর সঙ্গে যশোবতীর সম্পর্ক না ঘটলে, অন্তর্জলী যাত্রা হয়ত আধুনিক উপন্যাসের বদলে একটি অপাঠ্য ধর্মীয় কাহিনী হত; কিন্তু বৈজুর কারণে সেই ফাঁড়া কেটে যায়। সমকালের প্রগতিশীল বিদ্বৎসমাজ, সাম্যবাদী, নারীবাদী, কিংবা মধ্যবিত্ত-শ্রেণীর চাকরিজীবী ‘ছোটলোকে’রা হিন্দু ধর্ম, সংস্কার-কুসংস্কার, সতী-সতীত্ব সম্বন্ধে কি ধারণা পোষণ করে কমলকুমার ভাল করেই জানতেন। জানতেন বলেই এতে তিনি, ওসব ধারণার বিপরীতে বা প্রতিক্রিয়ায়, ভারতবর্ষের বিশুদ্ধ অতীত, বিশুদ্ধ ধর্ম, বিশুদ্ধ ঐতিহ্য উদ্ভাবনে ব্যাপৃত।
‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় সতীর ডিসকোর্স তাই কাউন্টারÑডিসকোর্স; ‘সতী’র রিপ্রেজেন্টেশনও এখানে কাউন্টার-রিপ্রেজেন্টেশন; কেননা, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, সতী-মাহাত্ম্য বর্ণন ও সহমরণের ‘রোমান্টিকায়ন’, আর খোলনলচে-সমেত ‘আধুনিকতার প্রত্যাখ্যান’ একই কথা। প্রগতিশীল সমকালের বিপরীতে কমলকুমারের পশ্চাৎমুখী, ও সচেতনভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, অবস্থান তাই বৈপ্লবিক। কাহিনী-কিংবদন্তী, ফোকলোর, এমনকি ফ্যানাটিক কুসংস্কারও যে বৈপ্লবিক হতে পারে, ‘অনাধুনিক’ বিষয়ে রচিত এই ‘আধুনিক’ উপন্যাস তারই উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
আধুনিকতার বিরোধী বা প্রতিপক্ষ বলেই কমলকুমারযাঁকে আমি “তাত্ত্বিক” কথাশিল্পী মনে করি (মানিকও তাই)তথাকথিত ‘উত্তর-আধুনিক’ মুহূর্তে তিরিশের আধুনিকত্বপন্থী কবিদের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। আমরা জানি যে তিরিশের ‘আধুনিক’ কবিতা সম্পর্কে যা বলার কথা তা বহু আগেই বলা হয়ে গেছে; তিরিশি ‘আধুনিক’ সাহিত্যের ভাষ্য-ব্যাখ্যান যে অসাধারণ গদ্যে বুদ্ধদেব বসু সম্পন্ন করেছেন, তাকে আর ‘উন্নত’ করার উপায় নেই। কিন্তু সৃজনীক্ষমতায় তিরিশি আধুনিকদের সমকক্ষ, কিন্তু সচেতনভাবে প্রাচীনপন্থী, কমলকুমারের সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্যচিন্তা নিয়ে অনেক কথা এখনও বলার আছে।
তিরিশি সাহিত্যে ছিল ‘অনিকেত চেতনা’র ‘ওভারডোজ’; কমলকুমারের প্রধান অবসেশন ‘মৃত্যু’। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় গীতা-পাঠ ও ‘গঙ্গানারায়ণ ব্রহ্মে’র কীর্তনে যে-‘মৃত্যু’র মহিমা কীর্তিত হয়েছে, তা তিরিশি কবিদের বিদেশি ‘মৃত্যুচেতনা’ নয়। কমলকুমারের ‘মৃত্যু’ অষ্টাদশপুরাণ-শাসিত ভারতবর্ষের একটি পুরাতন প্রত্যয়। এই প্রত্যয় বা ধারণার সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ‘বাঙলার কাব্য’ (১৯৪০) বইতে আছে, যদিও কমলকুমারের সপ্রতিভ, বর্ণময়, চিত্রকল্পবহুল, ‘উচ্চবর্ণীয়’ মায়াবাদ আর যাই হোক নাই হোক হুমায়ূন কবির-কথিত ‘নিষ্ক্রিয় মনোবৃত্তি’ নয়। আধুনিকতার সক্রিয় প্রত্যাখ্যান ও পৌরাণিক অতীতের সচেতন উদ্ভাবনকে নিরাসক্ত বৈরাগ্য, পলায়নবাদ, বা ‘হিন্দুমানসের অবনতি’ বলা যায়- না।
উৎসনির্দেশ:
কমলকুমার মজুমদার ([২০০২] ২০১১)। উপন্যাস সমগ্র (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-সম্পাদিত)। কলিকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।
কমলকুমার মজুমদার (২০০৯)। প্রবন্ধ সংগ্রহ (রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রশান্ত মাজী-সম্পাদিত; ভূমিকা: উদয় নারায়ণ সিংহ)। কলিকাতা : চর্চাপদ পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড।
সুব্রত রুদ্র, সম্পাদিত (১৯৮২)। কমলকুমার: রচনা ও স্মৃতি। কলিকাতা : নাথ পাবলিশিং।
রফিক কায়সার (১৯৮১) । কমলপুরাণ। ঢাকা : প্যাপিরাস প্রেস।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৫)। পদ্মিনী উপাখ্যান। কলিকাতা : হিতবাদী ইলেকট্রিক যন্ত্রে মুদ্রিত।
কুমুদনাথ মল্লিক (১৯১৩) সতীদাহ। কলিকাতা : শিশুপ্রেম।
John Stratton Hawley, ed. (1994). Sati, the Blessing and the Curse: The Burning of Wives in India. Nwe York: Oxford University Press.
Lata Mani (1998). Contentious Traditions: The Debate on Sati. Berkeley: University of California Press.
লালবিহারী দে ([১৮৭৪] ১৯০৮)। Govinda Samanta or the History of a Bengal Rai“at (গোবিন্দ সামন্ত)। London: Macmillan & Co.
হুমায়ূন কবির ([১৯৪০] ২০১২)। বাঙলার কাব্য। ঢাকা : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
ড. সালাহউদ্দীন আইয়ুব
সাহিত্য সমালোচক, গবেষক ও শিকাগো স্টেট ইউনির্ভাসিটির, (ইউএসএ) ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক
ইমেইল : msalahud@csu.edu