ফাহমিনা নুর
পুকুর পাড়ে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিল বকুলি। সকাল থেকে মনটা খারাপ। এই পড়ন্ত বিকেলে পুকুরের আশেপাশে কেউ নেই। এই পুকুরটা অন্যসব পুকুর থেকে একদম আলাদা, আকারে প্রায় দীঘির সমান। এখানে মানুষ নামে না। গরু, ছাগল, হাঁস কিছুই নামে না। কীভাবে নামবে! চারধারের পাড় পাহাড় সমান উঁচু। বসতবাড়ি থেকে দূরে, বিরান মাঠের মাঝে চারপাশে যেন দেয়াল তুলে বসে আছে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত এক রাজনন্দিনী। বসতবাড়ি থেকে দূরে বলেই হয়তো গৃহস্থালি ব্যবহার নেই। আশেপাশের জমি সহ এর মালিকানা মুন্সিদের কিন্তু তারা কেউ এখানে থাকে না। জমি বর্গা দিলেও এই পুকুর এমনিই পড়ে আছে। বকুলির মন উচাটন হলেই এখানে চলে আসে। তালগাছে হেলান দিয়েই সে ঘণ্টা পার করে দিতে পারে। এটা বকুলির প্রিয় জায়গা কিন্তু লোকমুখে শোনা যায় অন্যকথা, এটা নাকি অভিশপ্ত পুকুর। কোনও এককালে কোনও এক রাজা তার তিন বউকে একসাথে ডুবিয়ে মেরেছিল এখানে। গলায় শেকল বেঁধে ভারী পাথর জুড়ে তাদের ফেলে দেয়া হয়েছিল গহন গভীর জলে।
সাথে সিন্দুক ভরে দেয়া হয়েছিল সোনা, রুপা, হিরে, জহরৎ সহ তাদের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি। সেই সম্পত্তির লোভে অনেকেই ডুব দিয়েছিল। তারা কেউ ফিরে আসেনি। এই হলো বিয়ানি পুকুরের গল্প। কোন সে কাল, কোন সে রাজা কেউ বলতে পারে না। তা বলতে না পারুক মানুষ যে এখানে নামে না এ বরং ভালোই হলো। মানুষ ভয় পায়, ভয় পায় না কেবল কাছিম, মাছ, জলপোকা আর বকুলি। পরিষ্কার টলটলে জলে প্রাণের স্পন্দন তার মন ভালো করে দেয় কিন্তু আজ তার মন একটু বেশিই বিচলিত, কিছুতেই স্থির হচ্ছে না। সতেজ সবুজ , বিশাল আকাশ, নীলের মাঝে সাদার প্রলেপ, শেষ বিকেলের রোদ, কিছুই তাকে মুগ্ধ করতে পারছে না। সব ছাপিয়ে বিচ্ছেদের সূঁচ বিঁধেই যাচ্ছে অন্তরে। আজই কথা পাকা হলো। এই গ্রাম, আজন্মের অভ্যস্ত গ্রাম্য-জীবন, মা-বাবার কবর, ছোট দু’টি ভাই আর বিকলাঙ্গ বোনটিকে ছেড়ে তাকে যেতে হবে জীবনের তাগিদে নতুন জীবনে। ঢাকা শহরে এক বাড়িতে তার বাঁধা কাজ ঠিক হয়েছে। আকলিমা খালার মেয়ে রাহেলাবু গার্মেন্টেসে কাজ করে।
সে জানিয়েছে বড়জোর ছয় মাস, এর মধ্যেই কোন না কোন গার্মেন্টসে তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সে ভাবে, ঢাকা শহরে সে থাকতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। জীবনভর গ্রামেই কাটিয়েছে, শহুরে বাতাসে কি এরকম দম নেয়া যায়! আরো অনেক কথাই মনে আসি আসি করছিলো হঠাৎ সরসর শব্দে তার মনোযোগ ঢাকা শহর থেকে ছিটকে আছড়ে পড়লো পুকুরের পানিতে। ঠিক তার পাশ ঘেঁষেই এঁকেবেঁকে পানিতে নেমে গেল সাপটা। কলমিলতার ফাঁকে ফাঁকে আকুলি বিকুলি করে দ্রুত চলে গেল, যেন অনেক তাড়া। এই সাপের বিষ নেই, বকুলি জানে। তবুতো সে সাপ, দেখলে গা ঘিনঘিন করে। ঘিনঘিনে অনুভূতির জমিনে বলা নেই, কওয়া নেই কোত্থেকে উদয় হলো ফরিদ! ফরিদ মানে ফইজ্জা, গ্রহণের কালো-ছায়া। এই পুকুর পাড়েই তছনছ করেছিল বকুলির কৈশোর। জীবন স্তব্ধ হয়েছিলো। মুরুব্বিরা সমাধান দিলো তার সাথেই বিয়ে দিয়ে। বিয়ে তো? বিয়েই তো। একটা শরীরের উপর আরেকটা শরীরের, একটা জীবনের উপর আরেকটা জীবনের একচ্ছত্র মালিকানা।
এটাই নাকি বিচার! জমা নাই, কেবলই খরচের হিসাব। নারী জীবনের এই খরচের যেনো কোনো প্রতিকার নাই! সতেরো মাস ছিল সে ফরিদের ঘরে। নরক তার দেখা হয়ে গিয়েছে। তার কিছু ইয়ার-বন্ধু আছে, তাদের সাথে কখনো মদ খেয়ে, কখনো আড্ডা দিয়ে, কখনো এমনিতেই ঘরে এসে ছুতো ধরে গালিগালাজ, মারধোর, অত্যাচারের যত নমুনা আছে সবই চালিয়েছে। কখনো লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি মেরেছে যখন যেভাবে মন চেয়েছে। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নাই। মেরেও যেনো তার হাতের সুখ আর বকুলির জন্য এ যেন অমোচনীয় নিয়তি। একবারতো উপজেলা হাসপাতালেও ঘুরে এলো। অন্যদের কথা কী বলবে নিজের জ্যাঠা-ই উপদেশ দিয়েছে ফরিদের বিরুদ্ধে মুখ না খুলতে। প্রথম প্রথম অসহ্য যন্ত্রণায় প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও একসময় বকুলির তা সয়ে যায়। কিছুদিন পর এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো, বকুলি আবিষ্কার করে এত মার, এত অত্যাচার এসব বকুলির কাছে খুব কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠলো। মনের গোপন কুঠুরিতে সঞ্চিত হতে থাকলো এক অদ্ভুত সাধ। প্রতিটি আঘাত, শরীরে এঁকে দেয়া প্রতিটি নির্যাতনের চিহ্ন একসময় সুদ সমেত ফেরত দেয়ার গোপন অভীপ্সা। পুকুরপাড়ে বসে বকুলি নানান চিন্তার হাট বসায়। সেই হাটে বকুলি লাঠিতে তেল মাখায়, ছুরিতে শান দেয়, ফাঁসের দড়িতে গিঁট বাঁধে আর কথা বলে কলমিলতার সাথে। যত মার খায় বকুলির শক্তি তত বাড়ে, প্রস্তুতি তত এগোয়। কলমিলতার শলা-পরামর্শে তার মনের জোর বাড়ে। সময় এভাবেই যাচ্ছিলো চলে, হঠাৎ ঘটলো সেই অঘটন। বাজারের পেছনে সন্ধ্যার পর দু’টি চালাঘর নিয়ে বসে মদ, জুয়া আর নেশার আড্ডা। আড্ডা শেষে মোটরবাইক চালিয়ে বাড়ি ফেরে ফরিদ ওরফে ফইজ্জা। আসা-যাওয়ার পথে একটা লেভেল ক্রসিং পড়ে, রাতে সেখানে কোনো গার্ড থাকে না। চলাচলও খুব কম। সেদিন বোধয় নেশা একটু বেশি চড়েছিল নইলে অজগরের মত তেড়ে আসা ট্রেনটা সে দেখতে পায়নি কেন! ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে কিন্তু এই পরিণতিতো বকুলি চায়নি। এই মৃত্যু সে মেনে নিতে পারে না। ঋণ শোধ করতে না পারার হতাশা বকুলিকে অস্থির করে তোলে। তার মাথা এলোমেলো লাগে। কী নেই! কী হওয়ার কথা ছিলো, কী হলো না! তার সাধ মিটলো না, তার জীবনটা ছারখার করে কেউ কেমনে এমন সহজে অন্য দুনিয়ায় চলে যেতে পারে! এক একবার মনে হয় কবরেই আগুন লাগিয়ে দেয়, চোখের সামনে দেখবে দাউ দাউ করে ফইজ্জা জ্বলবে, তার হাড় জ্বলবে, মাংস জ্বলবে আর জ্বালা জুরাবে বকুলির। ক্ষমা সে করতে পারে না, একটা কৈশোর ছিন্নভিন্ন হওয়ার পর আর যে তা জোড়া লাগে না। ক্ষমা তাহলে করবে কোন শর্তে! বকুলি কোনোকিছু সুস্থিরভাবে চিন্তা করতে পারে না। গলা দিয়ে দানাপানি ঠিকভাবে নামে না। শরীর ভেঙে পড়ে, শরীরে অশান্তি। মনে অশান্তির ঝড়, বাইরে শীতল শান্ত। ভেতরে আগুনের শিখা, বাইরে শীতল বাতাস। বকুলির গা গোসলের ঠিক নাই, সাজসজ্জা নাই। চুলে চিরুনি চলে দাঁতভাঙা নরুণের মতো। তার বদলে যাওয়া কেউ নজর করে না তেমন, ভাবে বুঝি স্বামীর জন্য শোক করে। তার অন্তরে নজর দেয়ার মানুষ নাই, মানুষ থাকলেও দরদ নাই। তাই তার আচরণে গোলমাল কারো চোখে পড়লেও আমলে নেয় না।
আজ বকুলির মনে হাহাকার। ফইজ্জার কিছু পাওনা ছিলো, না নিয়ে চলে গেলো। এই ঋণ শোধ না করে বকুলি ঢাকা যায় কী করে ! মৃতরে আবার ক্যামনে মারা যায়! যার শ্বাস নাই তার ক্যামনে শ্বাসরোধ করা যায়! যে মাটির সাথে মিশে গেছে তারে কী করে আবার মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া যায়! কতকিছু ভাবে বকুলি কিন্তু কোনো কূল পায় না, পায় না খূঁজে কোনো সুরাহা। তবে কি ক্ষমা করে দেবে ! কিন্তু ফইজ্জাতো তাকে ক্ষমা করে নাই। চৌদ্দ বছরের কিশোরী ছিলো সে, রহমতো করে নাই! এই পুকুর সাক্ষী, খোদার আরশ সেদিন কেঁপে উঠেছিলো কিন্তু ফইজ্জার আত্মা কাঁপে নাই। তাই এই বিয়ানি পুকুরও তাকে বলে, “শোধ দে বকুলি, শোধ দে।” ক্ষমার পরামর্শতো পুকুর পাড়ের কলমিলতাও দেয় না, তারাও বকুলির কানে ফিসফিস করে, “শোধ দে বকুলি, শোধ দে। হাতের ডাণ্ডা দিয়ে হারামজাদার মাথাটা দুই ভাগ করে দে !” শেষবারের মত আজ কলমিলতার সাথে শলা করতে এসেছিলো । তখনি … ঠিক তখনি কেন ঘৃণার আবাদি জমিনে ফরিদ ফিরে এলো যেন জ্যান্ত কোনো মানুষ ! ফরিদ মানে ফইজ্জা, বিষের আকর, গ্রহণের কালো-ছায়া। ফরিদ মানে ঘায়ের পচনে কিলবিলে পোকা। ফরিদ মানে মৃত্যুর ছায়া, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, গভীর অবসাদ। সাপ গিয়েছে মাঝ পুকুরে তার পিছু পিছু ফরিদ কেন এলো! ফরিদের সাথে আসে কিলবিলে পোকা। এই পোকা বকুলির মগজ খায়। দুই হাতে মাথা চেপে বকুলি আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ ভেঙ্গে দুইখান হয়, দুইখান আকাশের মাঝখানে আগুন ঝিলিক দেয়। ভাঙা আকাশ জুড়ে উড়তে থাকে কলমিলতার মতো কিলবিলে অজস্র সাপ। শূন্য থেকে বকুলি লুফে নেয় মারণ লাঠি, তেল চকচকে মারণ লাঠি। কতদিন মনেমনে এই লাঠিতে তেল মাখিয়েছে বকুলি যেন এ এক দোনলা বন্দুক! লাঠি হাতে বকুলি পুকুরে নেমে যায়। সাপটাকে খোঁজে বকুলি, খুঁজতে খুঁজতে বকুলি বুক সমান পানিতে নেমে যায়। সাপ গিয়েছে আরো গভীরে, বকুলিও যায় গভীরে। বকুলি আজ ফরিদকে নিজ হাতে তার সমস্ত পাওনা বুঝিয়ে দেবে। লাঠির আঘাতে ফইজ্যার মাথা দুই ভাগ করে সে তিন রানীর সিন্দুকে ভরে রাখবে। সিন্দুকেই লুকিয়েছে সাপ, বকুলি জানে। বকুলিতো এ-ও জানে সেই সিন্ধুক নিয়ে কেউ পাড়ে ফেরে না।
বেলা যায়, বেলা গেলে সন্ধ্যাও পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে গ্রামের মানুষ টর্চ হাতে বকুলিকে খুঁজতে বের হয়।
ফাহমিনা নুর, গল্পকার