ইসমত চুখতাই
ভাষান্তর : জোতির্ময় নন্দী
লেখক পরিচিতি : উপমহাদেশের সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিন্দি-উর্দু সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল ইসমত চুগতাইয়ের জন্ম ১৯১৫ সালের ২১ আগস্ট ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে। বড় হয়েছেন প্রধানত রাজস্থানের যোধপুরে। সেখানে তাঁর বাবা ছিলেন একজন পদস্থ সরকারি আমলা। ইসমত ছিলেন বাবা-মায়ের দশ সন্তান (ছয় ছেলে, চার মেয়ে)-এর মধ্যে নবম। তাঁর একেবারে শিশুবয়সেই তাঁর বড় বোনদের বিয়ে হয়ে যায়; ফলত তিনি বেড়ে উঠেছেন মূলত তাঁর ভাইদের সঙ্গ-সাহচর্যেই, যেটা তাঁর স্বভাবে এবং লেখায় একটা খোলামেলা ভাব সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে বলে তিনি বার বার স্বীকার করেছেন। ইসমত যখন নিতান্ত কিশোরী, তখনই তাঁর বড় ভাই মির্জা আজিম বেগ চুগতাই একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক, এবং তিনিই তাঁর বোনের লেখিকা হয়ে ওঠার পেছনে প্রথম শিক্ষক এবং প্রেরণাদাতা হিসেবে কাজ করেছেন।
ইসমত চুগতাই সুপরিচিত তাঁর লেখায় অদম্য চেতনা এবং তীব্র নারীবাদী আদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর জন্যে। তাঁর ৩২তম জন্মদিনেই যখন ভারত স্বাধীন হলো এবং উপমহাদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হলো, তখন তাঁর আত্মীয়-স্বজন, মুসলিম বন্ধুবান্ধব, বন্ধুস্থানীয় লেখক-লেখিকাদের অনেকে পাকিস্তানে চলে গেলেও, তিনি নিজে কিন্তু ভারতেই থেকে গেলেন এবং রশিদ জাহান, ওয়াজেদা তাবাসসুম ও কুররাতুলাইন হায়দারের সঙ্গে মিলে উর্দু সাহিত্যে জন্ম দিলেন এক বিপ্লবী নারীবাদী রাজনীতি ও নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যবোধের। তাঁর লেখায় তিনি যৌনতার দিকে তাকিয়েছেন নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে, নিপুণভাবে তুলে এনেছেন নবযুগের ভারতে উদ্ভূত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের জীবনযাত্রাকে, এবং সমকালীন আরো বহু বিতর্কিত বিষয়কে। তাঁর উচ্চকণ্ঠ, আবেগদীপ্ত লিখনশৈলী তাঁকে তাঁর সমকালের তো বটেই, পরবর্তী কালের লেখক-লেখিকা, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও তাঁকে পরিণত করেছে এক অনুকরণীয় আদর্শে। ১৯৩৬-এ লাখনৌয়ে স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালেই ইসমত ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন প্রগতিবাদী লেখক সঙ্ঘ (প্রোগ্রেসিভ রাইটারস অ্যাসোসিয়েশন — পিডব্লিউএ)-এর প্রথম সভায় যোগ দেন। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের সর্বপ্রথম মুসলিম মহিলা বি.এ.বি.এড.। ১৯৪১-এ তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্য লেখক শহিদ লতিফকে বিয়ে করেন। বিবাহিত জীবনে তাঁরা দুটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন, এবং ১৯৬৭-এ শহিদের মৃত্যুর আগপর্যস্ত এই দম্পতি বহু চলচ্চিত্রে একসঙ্গে কাজ করেছেন।
লেখক হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনেও ইসমত ছিলেন সকল সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁর এক কন্যা এবং ভাইঝি বিয়ে করেছেন হিন্দুকে। ইসমতের নিজের ভাষায়, তিনি এসেছেন এমন এক পরিবার থেকে, যেখানে “হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সবাই একসাথে শান্তিতে বসবাস করে”। তিনি বলতেন, তিনি শুধু কোরানই পড়েন না, একই রকম খোলা মনোভাব নিয়ে গীতা আর বাইবেলও পড়েন। ১৯৯১-এর ২৪ অক্টোবর মুম্বইয়ে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে সেখানকার চন্দনবাড়ি মহাশ্মশানে দাহ করা হয়।
ইসমত চুগতাইয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী গল্প ‘লিহাফ’ (লেপ) প্রকাশিত হয় ১৯৪২-এ উর্দু সাহিত্য সাময়িকী ‘আদাব-এ-লতিফ’-এ। প্রকাশের পরপরই এ-গল্পে অশ্লীলতা ও ধর্মদ্বেষিতার অভিযোগ এনে লাহোর আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ক্ষমা প্রার্থনার বদলে এ-মামলায় লড়ারই সিদ্ধান্ত নেন ইসমত, এবং শেষপর্যস্ত বিজয়ীও হন। তাঁর আইনজীবী আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন যে, এ-গল্পে কোথাও সমকামিতার বা ধর্মবিরুদ্ধতার সরাসরি বা প্রত্যক্ষ কোনো উদাহরণ নেই, আর তাই তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগও আনা যেতে পারে না।
ভারতীয় উপমহাদেশের সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলোর অন্যতম যশস্বিনী কথাশিল্পী ইসমত চুগতাইয়ের পুরোনো একটি সাক্ষাৎকারের লিঙ্ক নিচে দেয়া হল। তাঁকে জানা আর বোঝার জন্যে তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে ১৯৯০-এ অনমোল রতন টিভি সিরিয়ালে নেয়া তাঁর এ সাক্ষাৎকারটি দেখে এবং শুনে নেয়া যেতে পারে।
কত সাধারণ, তুচ্ছ কারণে মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের, জীবন একেবারে বরবাদ হয়ে যেতে পারে, তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ এখানে অনূদিত এ গল্পটি। হিন্দি-উর্দু ‘ঘুঙ্ঘট’ গল্পটি এখানে ভাষান্তরিত করা হয়েছে ‘ঘোমটা’ নামে।]
সাদা জোছনা ছড়ানো চৌকিতে বকের পালকের চেয়েও সাদা চুলের দাদিকে একেবারে মর্মর পাথরের স্তূপ বলে মনে হচ্ছিল, যেন তার শরীরে রক্তের একটা ফোঁটাও নেই। তার হালকা সুরমা রঙের চোখের মণিতে পর্যন্ত সাদা বলয় দেখা দিয়েছিল,
আর তার জ্যোতিহীন চোখ খুললে বোঝা যাচ্ছিল, ভেতরে আলো যাওয়ার সব পথ বন্ধ। মোটা কাপড়ের পর্দায় ঢাকা জানলার আড়ালে ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে বসে থাকত সে। তাকে দেখে চোখে ধাঁধা লেগে যেত, যেন ভালো করে পেষাই করা রুপোর গুঁড়ো হাওয়ায় ভেসে আছে, যেন সাদা সাদা আগুনের ফুলকি ফুটে বেরুচ্ছে। তার চেহারায় পবিত্রতা আর কুমারিত্বের আলো ছিল। আশি বছরের এই কুমারীর গায়ে কখনো কোনো পুরুষ হাত দেয় নি।
তের-চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে দেখাত একেবারে একথোকা ফুলের মতো। কোমরের নিচে পর্যন্ত ঝুলে থাকা সোনালি চুল আর দুধে আলতা গায়ের রঙ। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আলতা উবে গেছে, অবশিষ্ট আছে শুধু দুধ। তাঁর রূপের খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, তার মা-বাবার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ভয় পেতেন, মেয়েকে কোনো জিন না উড়িয়ে নিয়ে যায়। কারণ তাকে এ পৃথিবীর জীবদের কেউ বলে মনে হত না।
তারপরও আমাদের আম্মার মামুর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। দুলহন যতটা ফর্সা, দুলহা মিয়া অতটাই কালির মতো গায়ের রঙ। গায়ের রঙের কথা বাদ দিলে, এমনিতে মায়ের মামু ছিলেন পুরুষালি সৌন্দর্যের ভালো নমুনা। কী সুন্দর বড় বড় স্বপ্নালু চোখ, তলোয়ারের ধারের মতো তীক্ষ্ণ খাড়া নাক আর মুক্তোকেও ম্লান করে দেয়া দাঁতের সারি। কিন্তু নিজের গায়ের রঙের ওপর সে ভীষণভাবে অখুশি ছিল।
বিয়ের বাগদান হয়ে যাওয়ার পর সবাই খুব ঠাট্টা করতে লাগল, “হায়, দুলহা হাত লাগালে তো দুলহন ময়লা হয়ে যাবে!”
“চাঁদে গ্রহণ লেগে যাবে!”
কালা মিয়া সে-সময়ে ছিল সতেরো বছরের গোঁয়ার গোবিন্দ, বিগড়ে যাওয়া, উদভ্রান্ত মনের ছোকরা। দুলহনের রূপ দেখে তার মনে এমন এক আতঙ্কের সৃষ্টি হল যে, সে রাতারাতি তার নানার ওখানে পালিয়ে গেল। চাপা গলায় সে তার সমবয়সীদের বলল, “আমি শাদি করব না!”
এটা ছিল সেই জমানা, যখন গলার স্বর উঁচু করলে জুতো দিয়ে পিটিয়ে দুরুস্ত করে দেয়া হত। একবার বাগদান হয়ে গেল সেটা ভাঙার কোনো অবকাশ ছিল না। নাক কাটা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
আর দুলহনের ত্রুটিটাই-বা কী ছিল! এটাই যে, সে ছিল সীমার বাইরের সুন্দরী। দুনিয়া সুন্দরের পাগল, আর তার বর সুন্দরের ওপর নারাজ! মস্করার একেবারে চরম!
“ওর খুব দেমাক!” চাপা গলায় বলল কালা মিয়া।
“কী করে বুঝলে?”
যখন কোনো প্রমাণ নেই কিন্তু একটা কথা চালু আছে যে সুন্দরীরা দেমাকি হয়, আর কালা মিয়া কারো দেমাক সহ্য করবে সেটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। নাকের ওপর মাছি বসাটাও সে বরদাশত করত না।
তাকে অনেক বোঝানো হল যে, মিয়া তোমার সঙ্গে নিকাটা হয়ে গেলে সে তোমারই সম্পত্তি হবে। তোমার হুকুমে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বলবে। বসালে বসবে, ওঠালে উঠবে।
কিছু জুতোও পড়ল আর শেষপর্যন্ত কালা মিয়াকে ধরে নিয়ে এসে শাদি করিয়ে দেয়া হল।
ডোমনিরা (ডোম জাতের মেয়েছেলেরা, যারা বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে নাচ-গান করে থাকে, কেউ কেউ বেশ্যাবৃত্তিও করে থাকে: অনু.) এসে নাচ-গান করে গেল। এর মধ্যে কয়েকটা ছিল ফর্সা কনে আর কালো বরের গান। এতে আবার কালা মিয়া ফুঁসে উঠল। ওপর থেকে কে যেন তার গায়ে বিঁধে যাওয়ার মতো করে কী-একটা বলল, আর তারপর সে একেবারে কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেল। কিন্তু কেউ তার এসব রাগ-ভয়কে গুরুত্ব দিল না। এগুলোকে মস্করাই ভেবে নিয়ে তারা বরকে টিপ্পনি কাটতে লাগল।
খাপখোলা তলোয়ারের মতো দুলহা মিয়া যখন দুলহনের কামরায় গিয়ে পৌঁছল, টকটকে লাল সব ফুলের মধ্যে আলুথালু অবস্থায় কনেকে বসে থাকতে দেখে বরের ঘাম ছুটে গেল। মাথায় খুন চেপে গেল দুলহনের সাদা ধবধবে রেশমি কোমল হাত দেখে।
কাঁপা কাঁপা হাতে মুখের ঘোমটা ওঠাতে গেলে মাথা নুইয়ে
ফেলল কনে।
“আচ্ছা তুমি নিজেই ঘোমটাটা খুলে দাও!”
দুলহন তার মাথা আরো নুইয়ে ফেলল।
“আমি বলছি, ঘোমটা খোলো!” বর বলল ধমক দিয়ে।
দুলহন আরো নুয়ে গিয়ে একেবারে দলা পাকিয়ে গেল।
“আচ্ছা জী, এত দেমাক!”
বর তার পয়ের জুতো খুলে বগলে চেপে নিল আর পেছনের বাগানের দিককার জানলাটা দিয়ে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে সোজা স্টেশনে, তারপর ট্রেনে চেপে যোধপুরে।
সে-জমানায় এত তালাক-টালাকের ফ্যাশন চালু ছিল না। শাদি হয়ে গেল তো ব্যাস্ হয়েই গেল। কালা মিয়া সাত বছরের জন্যে গায়েব হয়ে গেল বাড়ি থেকে। দুলহন এ সাত বছর শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ি আসা-যাওয়ার মাঝখানে ঝুলে রইল। মাকে টাকা-পয়সা পাঠাতে থাকল। ঘরের মেয়েছেলেদের জানা ছিল যে, কনে এখনো অস্পৃষ্ট থেকে গেছে। কথা চলতে চলতে পুরুষদের কানে পৌঁছে গেল। কালা মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল এ ব্যাপারে।
“ও দেমাকি!”
“কী করে বুঝলে?”
“আমি বলেছিলাম, ঘোমটা খোলো! সে শোনে নি।”
“আজব কথা তো! কে কবে শুনেছে যে, কনে নিজে নিজের ঘোমটা খুলেছে! সেটা তো তোমার খোলার কথা!”
“কক্ষণো না! আমি কসম খেয়েছি। ও নিজের ঘোমটা না খুললে চুলোয় যাক!”
“ওমা, আজব না-মরদ তো! দুলহনকে ঘোমটা খুলতে বলছ! তারপর তুমি তাকে নিজে নিজে আরো কী কী করতে বলবে! আস্তাগফিরুল্লাহ!”
গোরী বিবির মা-বাপ তাদের একমাত্র মেয়ের জন্যে চিন্তায় চিন্তায় ক্ষয়ে যেতে লাগলেন। মেয়েটার কী দোষ ছিল যে, বর তার গায়ে হাতও ছোঁয়াল না! এমন বাড়াবাড়ি তো কেউ কখনো দেখে নি, শোনেও নি।
কালা মিয়া নিজের মরদানির প্রমাণ হিসেবে রেন্ডিবাজি, লৌন্ডাবাজি, মুর্গিবাজি, কবুতরবাজি ইত্যাকার কোনো বাজি বাদ দিল না, আর গোরী বিবি ঘোমটার তলায় ধুমিয়ে ধুমিয়ে পুড়তে লাগল।
নানি আম্মার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় কালা মিয়া ঘরে ফিরে এল সাত বছর পর। এটাকেই উত্তম সুযোগ বিবেচনা করে বিবির সঙ্গে তার মিলন ঘটিয়ে দেয়ার আরেকবার চেষ্টা করা হল। গোরী বিবিকে আরেকবার কনেবউ বানানো হল। কিন্তু কালা মিয়া বলে দিল, “আমার মায়ের নামে কসম খেয়েছি, আমি ওর ঘোমটা খুলব না!”
সবাই গোরী বিবিকেও বোঝাল, “দেখ মেয়ে, সারা জীবনের কর্জ চুকাতে হবে। হায়া-শরম চেপে রেখে আর মন শক্ত করে তুমি নিজেই ঘোমটা ফেলে দিয়ো। এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ও তো তোমার স্বামী, তোমার মালিক। তার হুকুম মানা তোমার কর্তব্য। তোমার নাজাত তার হুকুম মানার মধ্যেই।”
আবার তাকে দুলহন সাজানো হল, শয্যা সাজানো হল, পোলাও-জর্দা পাকানো হল, আর দুলহা মিয়াকে দুলহনের কামরায় ঠেলে দেয়া হল। গোরী বিবি এখন একুশ বছরের উদ্ভিন্ন যৌবনা সুন্দরী। তার প্রতি অঙ্গে অঙ্গে যৌবন যেন ফুটে বেরুচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ভারী আর মন্থর। নিঃশ্বাস গভীর। সাতটা বছর সে এ মুহূর্তটার স্বপ্ন দেখে কাটিয়েছে। কমবয়সী মেয়েরা অনেক রহস্য জানিয়ে দিয়ে বুকের ধড়ফড়ি বাড়িয়ে দিয়েছিল।
দুলহনের মেহেদি রাঙানো হাত-পা দেখে কালা মিয়ার মাথায় জ্বিন চড়তে লাগল। তার সামনে তার দুলহনকে রাখা হয়েছে। চৌদ্দ বছরের না ফোটা কলি নয়, একুশ বছরের এক পূর্ণ প্রস্ফূটিত ফুল। মিয়ার জিভ দিয়ে লালা গড়াচ্ছিল। আজ নিশ্চয় রাত আর দিন মিলে এক আনন্দময় সন্ধ্যার সৃষ্টি করবে। তার অভিজ্ঞ দেহ গর্জন করছিল শিকারি চিতার মতো। এখনো পর্যন্ত সে দুলহনের চেহারা দেখে নি। অনেক দুষ্কর্মের মধ্যেও এই রসে ভরা দুলহনের চেহারার কল্পনা তার মনে কত রাতে করাত চালিয়েছে।
“ঘোমটা খোলো!” সে কাঁপা কাঁপা গলায় হুকুম দিল।
দুলহনের কড়ে আঙুলটাও নড়ল না।
“ঘোমটা খোলো!” খুব নরম আর কাঁদো কাঁদো গলায় আবার বলল সে।
নীরবতা নেমে এল…
“আমার হুকুম না মানলে আমিও আর মুখ দেখাব না।”
দুলহন একটুও টলল না।
কালা মিয়া ঘুঁষি মেরে জানলা খুলে পেছনের বাগানে লাফিয়ে পড়ল।
সেই রাতে চলে যাওয়ার পর সে আর কখনো ফিরে আসে নি।
অস্পৃষ্ট গোরী বিবি তিরিশ বছরপর্যন্ত অপেক্ষা করে রইল তার জন্যে। সবাই মরে হেজে গেল। এক বুড়ি খালার সাথে ফতেহপুর সিক্রিতে থাকার সময় খবর এল, দুলহা বাড়ি ফিরেছে।
দুলহা মিয়া অনেক নালা-নর্দমায় লুটোপুটি খেয়ে, অনেক রোগ-ব্যাধি বাধিয়ে জীবনের অন্তিম মুহূর্তে বাড়ি ফিরে এল। শেষনিঃশ্বাস ছাড়ার আগে সে মিনতি জানাল, গোরী বিবিকে বল আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে, সে যেন একবার আসে।
গোরী বিবি এসে থামের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সিন্দুক খুলে বের করে নিল একবারে জীর্ণ হয়ে যাওয়া তার বিয়ের কাপড় জোড়া। আধপাকা চুলে সোহাগের তেল ঢেলে ঘোমটা সামলে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর শিথানে গিয়ে দাঁড়াল।
“ঘোমটা খোলো!” কালা মিয়া মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
গোরী বিবির কাঁপা কাঁপা হাত ঘোমটা পর্যন্ত উঠে আবার নিচে পড়ে গেল।
কালা মিয়া ততক্ষণে মারা গেছে।
গোরী বিবি ওখানেই উবু হয়ে বসে খাটের পায়ায় আছড়ে চুড়িগুলো ভেঙে ফেলল আর মাথায় ঘোমটার বদলে টেনে নিল বৈধব্যের সাদা ওড়না।
জোতির্ময় নন্দী, কবি, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম