এখন সময়:রাত ৮:৫৪- আজ: শনিবার-১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৮:৫৪- আজ: শনিবার
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

দুপুর রঙের বৃষ্টি (পর্ব-৯)

রাজকুমার শেখ:

নোরিন ফুপু বেশ কয়েকবার তাকে ডেকে গেছে।  কিন্তু সে উঠবো উঠবো করে এখনো ওঠেনি।  আম বাগানে একটা মৌটুসী ডাকছে। ওকে ডাকবার সময় পুবের জানালাটা খুলে দিয়ে গেছেন।  বেশ ঠান্ডা বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে। নাজের চোখ আর খুলছে না। গতকাল ওর ফিরতে বেশ দেরিই হয়েছিল। মিনার বাড়ি থেকে বের হতে বেশ দেরি হয়। রমি ওকে কারবালা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। রমি ওকে একটা কী বলবো বলেছিল। ওর কথাটাও শুনতে চায়নি নাজ।

আজ থাক না রমি। আবার একদিন শুনবো।

আর কি তেমন করে বলা হবে তোমাকে? তুমি বড্ড দুরন্ত। তোমাকে ধরা যায় না। যেন বনের পাখি। এ ডাল ও ডাল করে বেড়াও।

রমি, রেগে যাচ্ছো!

আমি কার ওপর রাগ করবো?

কেন আমার ওপর।

দূর তোমার ওপর রাগ করা যায়?

রমি হাসতে থাকে।

ওদের লালবাগ গামী অটোটা বেশ শব্দ করে ছুটে চলে। রাস্তার পাশ ঘেঁষেই ভাগীরথী বয়ে চলেছে। জলজ গন্ধটা বাতাসে মিশে আছে। এখন সান্ধের আমেজ। রাস্তা ফাঁকা। নাজের রেশমঘন চুলে এখন রাত জোনাকির আনাগোনা। রমি মুগ্ধ না হয়ে ও পারছে না। নাজের জন্য সে সব করতে পারে। নাজকে কেমন অচেনা লাগে মাঝে মাঝে। ওর রুপের রুপোলি ছ’টায় ওর সব যেন পুড়ে যায়। সত্যিই নাজ সুন্দরী।

এমন সময় অটোটা শব্দ করে বাঁক নিলো। নাজ রমিকে চেপে ধরে। নাজের ভরাট বুক ওর গায়ে চেপে বসে। রমির কেমন শিরশির করে ওঠে গা। রমি নাজকে সরিয়ে দেয় না। নাজও সরে যায় না। মাতাল বাতাসে ও ভেসে থাকতে চায়। কারবালার কাছে আসতেই অটোকে থামতে বলে। নাজ নেমে যায়। রমিকে বিদায় জানিয়ে ও চলে আসে। রমির চোখের আড়ালে ও চলে যায়। রমির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আপনা থেকে।

 

 

না, আর একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। নোরিন ফুপু আবার ওকে ডাকে। এবারও না উঠলে একটা কিছু ঘটবে। নাজ ওঠে কলতলে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে ওর ঘরে চলে আসে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। আর একটু পরে গা ধুয়ে খেয়ে কলেজে বের হবে ও। চা খেতে খেতে বইগুলো গুছিয়ে নেয়। আজ তাড়া আছে। মৃণাল স্যারের ক্লাস মিস করা যাবে না। নোরিন ফুপু সকাল সকাল ওর জন্য রান্না করছেন। ও খেয়েই বের হবে। ওর বাড়ির সামনে থেকে অটো পাওয়া যায়। ফরাস ডাঙার ওপর দিয়ে সোজা চলে যায় বহরমপুর। বেশি সময় লাগে না। পাশে নদী। ওর এই সময়টা বেশ লাগে। কেমন ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। তারপর কলেজ। কলেজ শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে একুশ ধাপিতে বসে আড্ডা দেওয়া। চা খাওয়া। কেউ কেউ আবার সিগারেট ধরিয়ে টান দেয়। নাজ একেবারে এ সব সহা করতে পারে না। রমি হয়তো খায় সিগারেট। কিন্তু ওর সমনে খায় না কখনো। ও জানে এ সব নাজ পছন্দ করে না।

ও যখন বের হল কলেজ যাবার জন্য তখন আকাশে কৃষ্ণ কালো মেঘ জমছে। আজ গোমড়া মুখো হয়ে আছে আকাশ। নাজ অটো ধরে নেয়। অটো একটু এগোতেই বৃষ্টি শুরু হল। ঝুম বৃষ্টি। অটো একটু ধীরে চলে। বৃষ্টি এসে নাজের গায়ে পড়ছে। শীতল বৃষ্টির ছোঁয়ায় ওর গুন গুন করে গান করতে মন করছে। পাঠান পাড়াতে এসে অটো আটকে গেল। অটোর একটা কিছু হয়েছে। এ দিকে বৃষ্টি। নাজের  সঙ্গে আরও দুজন পেসেঞ্জার। ওরা উসখুস করছে। আজ আর মৃণাল স্যারের ক্লাস পাওয়া যাবে না। বহরমপুরের গোটা আকাশ জুড়ে মেঘ। আজ বৃষ্টি ছাড়বে বলে মনে হয় না। নাজ দূরে আম বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টি ঝরে পড়ছে গাছের পাতাতে। আজ ওর ভিজতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু ও তাহলে কলেজ যেতে পারবে না। আজ মিনা আসবে বলেছে।  রমির সঙ্গে আজ দেখা হবে না। ও কাজের চাপে আছে।

এই রুমঝুম বৃষ্টিতে ওর ভিজে চুলে কেউ যদি আলপনা আঁকে তাহলে নাজ তাকে নিষেধ করবে না। এমন সময় অটোটা ঠিক হয়ে যায়। অটোচালক ছেলেটা একেবারে ভিজে একসা। দেখে নাজের মায়া হয়। ও প্রায় দেখে বহরমপুরের বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে ওকে। ছেলেটির অটোতে নাজ কতদিন আসা যাওয়া করছে। ওর নাম জিগ্যেস করা হয়নি কোনো দিন। আবার অটো চলতে শুরু করেছে। বৃষ্টির জোর আরও বেড়েছে। আজ বৃষ্টি ছাড়বে বলে মনে হয়না।

ও যখন কলেজ পৌঁছাল তখন বেশ ভিজে গেছে নাজ। ওর এই অবস্থা দেখে মিনা ছুটে আসে।

আরে তুই তো ভিজে গেছিস।

আর বলিস না অটোতে উঠলাম আর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

চল কমন রুমে।

গিয়ে কী হবে?

একটু ঠিক করে নিবি।

বরং চল আজ দুজনে ভিজি।

তোর মাথা খারাপ হয়েছে।

বৃষ্টিতে ভেজা একটা মজায় আলাদা।

আবার কাব্য করছিস।

জীবন বড়ো ছোটরে মিনা। একটু একটু আনন্দ করা ভালো। আবার বৃষ্টি কবে হবে কে জানে।

তোর ওই হেঁয়ালিপনা ছাড়। চল হাবুর চা খাই। শীত শীত করছে।

আরে ভিজলাম আমি আর তোর শীত শীত করছে। কী হল মিনা? তোর মনে জ্বর বুঝি? না কোনো পেয়ারের মানুষ ঢুকে পড়লো মনে?

এই দেখ, তোকে কথা বলা মুশকিল। কোথাকার জল কোথায় নিয়ে যাস।

তাই বুঝি?

হুম।

দুজনে হেসে ফেলে। আজ কলেজে উপস্থিতি কম। বেশ ফাঁকা কলেজ। বৃষ্টি আজ থামবে বলে মনে হয় না। নাজ চুলগুলো ওড়না দিয়ে মোছে। ভিজে চুড়িদার ওর ভরাট বুক ফুটে ওঠেছে। কেউ কেউ ওদের পাশ দিয়ে গেলে সুন্দরী নাজকে দেখছে। ওর টানা টানা চোখে ঝিলের হাতছানি।  ওর রেশম ঘন চুলে বৃষ্টি লেপ্টে। ওর টিকালো নাকে বৃষ্টি লেগে। ও যেন বৃষ্টি দুপুরের গোলাপ পাপড়ি। ওর খুশবুতে ভরে গেছে গোটা কলেজ।  ওর রুপের তারিফ না করে পারা যায় না। ও হাসলে মনে হয় হাজার চুড়ি ভেঙে পড়ছে। কেমন যেন একটা শব্দ। মিনা ওকে দেখছিল।

মিনু, কী দেখছিস?

তোকে।

আমাকে!

হুম।

কী দেখলি?

তুই সত্যিই সুন্দরী।

ঠাট্টা হচ্ছে!

তোর মা তাহলে কত সুন্দরী ছিল। একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

মা!

কেন?

মাকে আমি কোনোদিনই দেখিনি। ফুপুমা আমাকে বড়ো করে তুলেছে।  আমাদের বাড়ি কেউ আসে না। মিনা,  আমি বড়ো একলারে।

নাজের চোখ দুটো কেমন ছলছল করে ওঠে।

তুই মন খারাপ করলি? মা নেই তো কী হয়েছে। অনেকের মা নেই। তাই বলে কি জীবন থেমে আছে। চল হাবুর দোকান। চা খাব।

তুই খুব চাখোর হয়েছিস।

কী করবো বল? এই বৃষ্টি বাদলা দিনে গলাটা একটু ভেজানো দরকার। চল তোর মন ভালো হয়ে যাবে।

দোকানে তেমন কেউ নেই। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বসে আছে হাবু। ওদের এই বৃষ্টির দিনে আসতে দেখে হাবু মনে হয় বিরক্ত হল। হাবু নাকি এ কলেজের ছাত্র ছিল। চাকরি বাকরি না পেয়ে চায়ের দোকান দিয়েছে। হাবু নাকি ভালো কবিতা লেখে। কলেজের অনেককে জানে সে কথা। হাবু চা করতে করতে কবিতা বলে। ও কাউকে শোনায় না। কখনো কখনো দোকান ফাঁকা থাকলে খাতা কলম নিয়ে বসে। নিয়মিত কবিতা লেখে। নাজ বেশ পছন্দ করে ছেলেটিকে। অবশ্য নাজ তাকে হাবুদা বলেই ডাকে। ও বেশ বৃষ্টি পড়া দেখছিল। ওরা আসতেই কেমন মুখ হয়ে গেল হাবুর। কে যেন এক থাপড়া মেরেছে। হাবুর কবিতা শেষ। মিনা চা করতে বলল বেশ কড়া করে। হাবু বলল, এ বৃষ্টিতে কেউ কলেজে আসে! তোমাদের আর কাজ নেই।

কী বল হাবুদা? কাজ আবার নেই। এখন না এলে তোমার এ বৃষ্টিতে চা খেত? চলতো সংসার?

মিনা বলে কথাটা।

দিদিমণি, সব সময় কি চা করতে ভালো লাগে?  মাঝে মাঝে একটু বিরতি দরকার।

হাবু চায়ের জল বসিয়ে দিল।

হাবুদা, একটা কবিতা হবে নাকি?

কবিতা কি যখন তখন ভালো লাগে? পরিবেশ দরকার। আর তোমরা কি ভালোবাসো কবিতা?

কেন বাসবো না।

বেশ জোর দিয়ে বলে মিনা।

হাবু বেশ অবাক হয়। কবিতার দাবি নিয়ে কেউ তার কাছে আসে না। আজ এই বৃষ্টির দিনে ওর মনটা নেচে নেচে উঠলো। এমন দুজন সুন্দরী তার কবিতা শুনতে চেয়েছে। ও যেন হাতের মুঠোয় আকাশ পেয়েছে। চা ছাঁকতে ছাঁকতে একটা কবিতা ও শুনিয়ে দেয়। নাজ বেশ অবাক হয়ে যায়। মানুষটির মধ্যে অনেক গুণ আছে। সামান্য চা দোকানি। অথচ তার মনের ভাবনার কত গভীরতা। হাবুর সঙ্গে ওদের বেশ ভাব হয়ে গেল। এর মধ্যেই বৃষ্টি ধরে এসেছে।  আর একবার করে ওরা চা খেল। চা খেতে খেতে গল্প জমে গেল হাবুর সঙ্গে। হাবু এখনো বে থা করেনি। ওর সংসারে শুধু মা ছাড়া কেউ নেই। চা থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে চলে যায়। দোকান ভাড়া লাগে।

নাজরা এক সময় হাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। বৃষ্টি আর পড়ছে না। রাস্তাতে লোকজন বের হয়েছে। ওরা হাঁটতে থাকে ভাগীরথীর পাশ ঘেঁষে যে রাস্তা চলে গেছে জমিদারি। ওখানে আর একটু বসে যে যার মতো ফিরবে। মেঘ সরিয়ে সূর্যের মুখটা দেখা যাচ্ছে।  বাতাস আছে।

তুই কবে যাবি আমাদের বাড়ি?

দেখি। তবে যাবো। কলেজ কবে ছুটি থাকছে সেদিন।

নাজ বলে কথাটা। মিনা আর ও হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। বেলা বয়ে যায়। এখন ওদের ফিরবার কোনো তাড়া নেই যেন। ওরা এক নতুন স্বপ্ন বুনছে আপন খেয়ালে। আজ বৃষ্টির নেশা নাজের মনে। যে বৃষ্টিতে তার গায়ের গন্ধ মিশে আছে।

 

রাজকুমার শেখ, গল্পকার, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে