নাজমুল টিটো
রবীন্দ্রনাথের বাঁশি
অন্তঃপুরের কোণের ঘরে বসে স্লেটের উপর লেখা “গহনকুসমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে।”
এ দুটি পঙ্ক্তির মধ্যে যে বাঁশি কবি গুরু বাজানো শুরু করেছিলেন, পরবর্তী জীবনে সে বাঁশিকে তিনি বহু বিচিত্রতর করেছেন।
# কবির কাব্য সাধনার উন্মেষ মূলত সন্ধ্যাসংগীত কাব্যে জায়গা করে নেয়া পদ্যগুলোর মধ্য দিয়েই। কিশোর কবি এই উন্মেষ পর্বে বাঁশি হাতে নিয়ে বলছেন,
(১)“জন্মিয়া এই সংসারে কিছুই শিখি নি আর
শুধু গাই গান।
স্নেহময়ী মার কাছে শৈশবে শিখিয়াছিনু
দু- একটি তান।
শুধু জানি তাই,
দিবানিশি তাই শুধু গাই।
শতছিদ্রময় এই হৃদয়-বাঁশিটি লয়ে
বাজাই সতত-
দুঃখের কঠোর স্বর রাগিনী হইয়া যায়,
মৃদুল নিশ্বাসে পরিণত।
Í———————-
শান্ত দেহ হীনবল, নয়নে পড়িছে জল,
রক্ত ঝরে চরণে আমার,
নিঃশ্বাস বহিছে বেগে, হৃদয়-বাঁশিটি মম
বাজে না বাজে না বুঝি আর।”
[গান সমাপন, সন্ধ্যাসংগীত]
# এরপর প্রভাতসংগীতে এসে কবির বিকাশোন্মুখ মন অপরিণত ভাবনা নিয়ে অপরিস্ফুট রচনায় প্রবৃত্ত হন। যেখানে বাঁশির সুরে অনন্ত জীবন, অনন্ত মরণ, প্রতিধ্বনিত হয়।
(২)“জগৎ-অতীত আকাশ হইতে
বাজিয়া উঠিবে বাঁশি,
প্রাণের বাসনা আকুল হইয়া
কোথায় যাইবে ভাসি।”
[আহ্বানসংগীত, প্রভাতসংগীত]
(৩)“ভাসিতে ভাসিতে শুধু দেখিতে দেখিতে যাব
কত দেশ, কত মুখ, কত-কী দেখিতে পাবো।
কোথা বালকের হাসি,
কোথা রাখালের বাঁশি,
সহসা সুদূর হতে অচেনা পাখির গান।
কোথাও বা দাঁড় বেয়ে
মাঝি গেল গান গেয়ে,
কোথাও বা তীরে বসে পথিক ধরিল তান।”
[পুনর্মিলন, প্রভাতসংগীত]
(৪)“এই বিশ্বজগতের
মাঝখানে দাঁড়াইয়া
বাজাইবি সৌন্দর্যের বাঁশি,
অনন্ত জীবনপথে
খুঁজিয়া চলিব তোরে
প্রাণমন হইবে উদাসী।”
[প্রতিধ্বনি, প্রভাতসংগীত]
(৫)“দিত দেখা মাঝে মাঝে, দূরে যেন বাঁশি বাজে,
আভাস শুনিনু যেন হায়।
মেঘে কভু পড়ে রেখা, ফুলে কভু দেয় দেখা,
প্রাণে কভু বহে চলে যায়।
আয় তুই কাছে আয়, তোরে মোর প্রাণ চায়,
তোর কাছে শুধু বসে রই
দেখি শুধু, কথা নাহি কই।
ললিত পরশে তোর পরানে লাগিছে ঘোর,
চোখে তোর বাজে বেণুবীণা-
তুই মোরে গান শুনাবি না?”
[সমাপন, প্রভাতসংগীত]
# ছবি ও গানের কবিতাগুলি কবির বয়ঃসন্ধিকালের লেখা। এ সময়ে কবির কামনার বাঁশি কেবল সুর খুঁজছে না, আলো আঁধারির রূপও খুঁজতে শুরু করে।
(৬)“গহন বনের কোথা হতে শুনি
বাঁশির স্বর-আভাস,
বনের হৃদয় বাজাইছে যেন
মরণের অভিলাষ।
বিভোর হৃদয়ে বুঝিতে পারি নে
কে গায় কিসের গান,
অজানা ফুলের সুরভি মাখানো
স্বর-সুধা করি পান।
Í——————–
মাথায় বাঁধিয়া ফুলের মালা।
বেড়াইব বনে বনে।
উড়িতেছে কেশ, উড়িতেছে বেশ,
উদাস পরান কোথা নিরুদ্দেশ,
হাতে লয়ে বাঁশি মুখে লয়ে হাসি
ভ্রমিতেছি আনমনে।”
[জাগ্রত স্বপ্ন, ছবি ও গান]
(৭)“কেহ বা দোলায় কেহ বা দোলে,
গাছতলে মিলে করে মেলা,
বাঁশি হাতে নিয়ে রাখাল বালক
কেহ নাচে-গায়, করে খেলা।”
[গ্রামে, ছবি ও গান]
(৮)“অতি দূরে বাজে ধীরে বাঁশি,
অতি সুখে পরান উদাসী,
অধরেতে স্খলিতচরণা
মোদিরহিল্লোলময়ী হাসি।
অতি দূর বাঁশরির গানে
সে বাণী জড়িয়ে যেন গেছে,
অবিরত স্বপনের মতো
ঘুরিয়ে বেড়ায় কাছে কাছে।”
[সুখের স্মৃতি, ছবি ও গান]
(৯)“চলো দূরে নদীর তীরে,
বসে সেথায় ধীরে ধীরে
একটি শুধু বাঁশরি বাজাও।
আকাশেতে হাসবে বিধু,
মধু কন্ঠে মৃদু মৃদু
একটি শুধু সুখেরই গান গাও।”
[মাতাল, ছবি ও গান]
(১০)“দূর মরীচিকা-সম ওই বন-উপবন,
ওরি মাঝে পরান উদাসী-
বিজন বকুলতলে পল্লবের মরমরে
নাম ধরে বাজাইছি বাঁশি।
সে যেন কোথায় আছে সুদূর বনের পাছে
কত নদী-সমুদ্রের পারে,
নিভৃত নির্ঝর তীরে লতায় পাতায় ঘিরে
বসে আছে নিকুঞ্জ-আঁধারে।
সাধ যায় বাঁশি করে বন হতে বনান্তরে
চলে যায় আপনার মনে,
কুসমিত নদীতীরে বেড়াইব ফিরে ফিরে
কে জানে কাহার অন্বেষণে।”
[মধ্যাহ্নে, ছবি ও গান]
# কড়ি ও কোমল কবির নবযৌবনের রচনা। এ সময়ের রচনায় যৌবনের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে নবরূপে যোগ হয় মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি। সে উপলব্ধি প্রকাশে কবির বাঁশিতে ওঠে নতুন সুর।
(১১)“হেতা হতে যাও, পুরাতন।
হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে
আবার বাজিছে বাঁশি,
আবার উঠিছে হাসি,
বসন্তের বাতাস বয়েছে।
Í————————-
বাতাস যেতেছে বহি,
তুমি কেন রহি রহি
তারি মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস।
সুদূরে বাজিছে বাঁশি,
তুমি কেন ঢাল আসি
তারি মাঝে বিলাপ-উচ্ছ্বাস।”
[পুরাতন, কড়ি ও কোমল]
(১২)“এ কি ঢেউ-খেলা হায়,
এক আসে, আর যায়,
কাঁদিতে কাঁদিতে আসে হাসি,
বিলাপের শেষ তান
না হইতে অবসান
কোথা হতে বেজে উঠে বাঁশি।”
[নূতন, কড়ি ও কোমল]
(১৩)“কী ভাবে সে গাইছে না জানি,
চোখে তার অশ্রুরেখা
একটু দেছে কি দেখা,
ছড়ায়েছে চরণ দুখানি।
তার কি পায়ের কাছে
বাঁশিটি পড়িয়া আছে-
আলোছায়া পড়েছে কপোলে।
মলিন মালাটি তুলি
ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি
ভাসাইছে সরসের জলে।”
[যোগিয়া, কড়ি ও কোমল]
(১৩)“বাজিতেছে উৎসবের বাঁশি
কানে তাই পশিতেছে আসি,
ম্লান চোখে তাই ভাসিতেছে
দুরাশার সুখের স্বপন;”
Í————————
ওর প্রাণ আঁধার যখন
করুণ শুনায় বড়ো বাঁশি,
দুয়ারেতে সজল নয়ন,
এ ভরা নিষ্ঠুর হাসিরাশি।”
[কাঙালিনী, কড়ি ও কোমল]
(১৪)“দূর হতে আসিতেছে, শুন কান পেতে-
কত গান, সেই মহা-রঙ্গভূমি হতে
কত যৌবনের হাসি, কত উৎসবের বাঁশি,
তরঙ্গের কলধ্বনি প্রমোদের ¯্রােতে।”
[ভবিষ্যতের রঙ্গভূমি, কড়ি ও কোমল]
(১৫)“বাঁশরী বাজাতে চাহি, বাঁশরী বাজিল কই?
বিহরিছে সমীরণ, কুহরিছে পিকগণ,
মথুরার উপবন কুসুমে সাজিল ওই।
বাঁশরী বাজাতে চাহি, বাঁশরী বাজিল কই?
Í—————————————-
একা আছি বনে বসি, পীত ধড়া পড়ে খসি,
সোঙরি সে মুখশশী পরান মজিল সই।
বাঁশরী বাজাতে চাহি, বাঁশরি বাজিল কই?
Í——————————————
কবি যে হল আকুল, এ কি রে বিধির ভুল,
মথুরায় কেন ফুল ফুটেছে আজি লো সই?
বাঁশরি বাজাতে গিয়ে বাঁশরী বাজলো কই?”
[মথুরায়, কড়ি ও কোমল]
(১৬)“দূর হতে বায়ু এসে চলে যায় দূর-দেশে
গীত-গান যায় ভেসে, কোন্ দেশে যায় তারা।
হাসি, বাঁশি, পরিহাস, বিমল সুখের শ্বাস, মেলামেশা বারো মাস নদীর শ্যামল তীরে;
কেহ খেলে, কেহ দোলে, ঘুমায় ছায়ার কোলে বেলা শুধু যায় চলে কুলুকুলু নদীনীরে।
Í—————————————-
বনের মর্মের মাঝে বিজনে বসরী বাজে,
তারি সুরে মাঝে মাঝে ঘুঘু দুটি গান গায়।
ঝুরু ঝুরু কত পাতা গাহিছে বনের গাথা,
কত-না মনের কথা তারি সাথে মিশে যায়।”
[বনের ছায়া, কড়ি ও কোমল]
(১৭)“কত রাত গিয়েছিল হায়,
বসেছিল বসন্তের বায়,
পুবের জানালাখানি দিয়ে
চন্দ্রালোক পড়েছিল গায়;
কত রাত গিয়েছিল হায়,
দূর হতে বেজেছিল বাঁশি,
সুরগুলি কেঁদে ফিরেছিল
বিছানার কাছে কাছে আসি।”
[শাস্তি, কড়ি ও কোমল]
(১৮)“হৃদয় কেন গো মোরে ছলিছ সতত,
আপনার ভাষা তুমি শিখাও আমায়।
প্রত্যহ আকুল কণ্ঠে গাহিতেছি কত
ভগ্ন বাঁশরিতে শ্বাস করে হায় হায়!”
[হৃদয়ের ভাষা, কড়ি ও কোমল]
(১৯)“রাখাল ছেলের বাঁশি বাজে
সুদূর তরুছায়,
খেলতে খেলতে মেয়েটি তাই
খেলা ভুলে যায়।”
[খেলা, কড়ি ও কোমল]
(২০) কবির উন্মেষপর্বের বিভিন্ন কবিতায় বাঁশিকে এ যাবত উপমা, রূপক, অলংকার বিচিত্ররূপে ব্যবহার হতে দেখেছি। এই প্রথম বাঁশি তার আপন মহিমায় একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতার শিরোনামে মুখ্য ভূমিকায় হাজির হলো। এখানে বাঁশি তার বঁধুর হাসি চুরি করে প্রাণের প্রাণে ভেসে যায়। এতে পাঠক শ্রোতার বুঝতে বিলম্ব হয় না এ বাঁশি কে বাজায়?
বাঁশি
“ওগো, শোনো কে বাজায়!
বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়। অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি চুরি করে হাসিখানি,
বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায়।
ওগো শোনো কে বাজায়!
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে, বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে। যমুনারই কলতান কানে আসে,কাঁদে প্রাণ, আকাশে ওই মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়। ওগো শোনো কে বাজায়!”
[বাঁশি, কড়ি ও কোমল]
(২১)“ওই বাঁশিস্বর তার আসে বার বার
সেই শুধু কেন আসে না!
এই হৃদয়-আসন শূন্য যে থাকে,
কেঁদে মরে শুধু বাসনা।”
[বিরহ, কড়ি ও কোমল]
(২২)“ওগো এত প্রেম-আশা প্রানের তিয়াষা
কেমনে আছে সে পাসরি!
তবে সেথা কি হাসে না চাঁদনী যামিনী,
সেথা কি বাজে না বাঁশরী!”
[বিলাপ, কড়ি ও কোমল]
(২৩)“দুটি ফোঁটা নয়নসলিল
রেখে যায় এই নয়নকোণে।
কোন্ ছায়াতে কোন উদাসী
দূরে বাজায় অলস বাঁশি,
মনে হয় কার মনের বেদন
কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে।
সারাদিন গাথি গান
কারে চাহে, গাহে প্রাণ,
তরুতলের ছায়ার মতন
বসে আছি ফুলবনে।”
[সারাবেলা, কড়ি ও কোমল]
(২৪)“ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে!
আমার ঘরে কেহ নাই যে
তারে মনে পড়ে যারে চাই যে!
তার আকুল পরান বিরহের গান
বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে!
Í——————————
ওই বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায়,
আমি কেন থাকি হায় রে!”
[গান, কড়ি ও কোমল]
(২৫)“নীরব বাঁশরিখানি বেজেছে আবার।
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্তকাননমাঝে বসন্তসমীরে!
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত!
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে
পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত!।”
[গীতোচ্ছ্বাস, কড়ি ও কোমল]
(২৬)“কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে
বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়,
সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে-
শরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আডালে।”
[স্তন, কড়ি ও কোমল]
(২৭)“অজানা হৃদয়েবনে উঠেছে উচ্ছ্বাস,
অঞ্চলে বহিয়া এলো দক্ষিণবাতাস,
সেথা যে বেজেছে বাঁশি তাই শুনা যায়,
সেথায় উঠেছে কেঁদে ফুলের সুবাস।”
[অঞ্চলের বাতাস, কড়ি ও কোমল]
(২৮)“বেলা বহে যায় চলে- শান্ত দিনমান,
তরুতলে ক্লান্ত ছায়া করিছে শয়ন,
মুরছিয়া পড়িতেছে বাঁশরির তান,
সেঁউতি শিথিলবৃন্ত মুদিছে নয়ন।”
[কল্পনামধুপ কড়ি ও কোমল]
(২৯)“কেন গো এমন স্বরে বাজে তবে বাঁশি,
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া,
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি
পুলকে যৌবন কেন ওঠে বিকশিয়া!”
[কেন, কড়ি ও কোমল]
(৩০)“মিছে হাসি, মিছে বাঁশি, মিছে এ যৌবন,
মিছে এই দরশের পরশের খেলা
চেয়ে দেখো, পবিত্র এ মানবজীবন,
কে ইহারে অকাতরে করে অবহেলা!”
[পবিত্রজীবন, কড়ি ও কোমল]
(৩১) “ বাঁশি শুনি চলিয়াছে,
সে কি হায় বৃথা অভিসার!
বোলো না সকলি স্বপ্ন, সকলি এ মায়ার ছলন-
বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে, সে স্বপন কাহার স্বপন?
সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার?”
[চিরদিন কড়ি ও কোমল]
(৩২)“কড়ি ও কোমল” কাব্যের সমাপনী পদ্য ‘শেষ কথা’র মধ্যেও বাঁশি এক বিশেষ স্থান অলংকৃত করে আছে।
“মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে,
সে কথা হইলে বলা সব বলা হয়।
কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে তারি পাছে পাছে,
তারি তরে চেয়ে আছে সমস্ত হৃদয়।
শত গান উঠিতেছে তারি অন্বেষণে,
পাখির মতন ধায় চরাচরময়।
শত গান ম’রে গিয়ে নতুন জীবনে
একটি কথায় চাহে হইতে বিলয়।
সে কথা হইলে বলা নীরব বাঁশরি,
আর বাজাব না বীণা চিরদিন তরে।
সে কথা শুনিতে সবে আছে আশা করি,
মানব এখনো তাই ফিরিছে না ঘরে।
সে কথায় আপনারে পাইব জানিতে,
আপনি কৃতার্থ হব আপন বাণীতে।”
[শেষ কথা, কড়ি ও কোমল]
# মানসীতে এসে কবির কাব্য রচনায় কড়ি ও কোমলের চেয়ে ভিন্ন আরেক নতুন কাব্যরূপের প্রকাশ পেতে শুরু করে। যা পূর্বতন রচনাধারা থেকে স্বতন্ত্র। এখানে কবির সঙ্গে এসে যোগ দেয় একজন শিল্পী। সেই শিল্পীর বাঁশিও ছড়াতে থাকে স্বতন্ত্র সুর।
(৩৩)“চারি দিক হতে বাঁশি শোনা যায়,
সুখে আছে যারা তারা গান গায়-
আকুল বাতাসে, মদির সুবাসে,
বিকচ ফুলে,
এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ
আসিলে ভুলে?”
[ভুল, মানসী]
(৩৪)“বাঁশি বেজেছিল, ধরা দিনু যেই
থামিল বাঁশি-
এখন কেবল চরণে শিকল
কঠিন ফাঁসি।”
[ভুল-ভাঙ্গা, মানসী]
(৩৫)“যে জন চলিয়াছে তারি পাছে সবে ধায়,
নিখিল যত প্রাণ যত গান ঘিরে তায়।
সকল রূপহার উপহার চরণে,
ধায় গো উদাসিয়া যত হিয়া পায় পায়।
যে জন পড়ে থাকে একা ডাকে মরনে,
সুদূর হতে হাসি আর বাঁশি শোনা যায়।”
[ক্ষণিক মিলন, মানসী]
(৩৬)“এখনো সে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে।
এখনো প্রেমের খেলা
সারানিশি, সারাবেলা-
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে।”
[একাল ও সেকাল, মানসী]
(৩৭)“আমলা-শামলা-স্রোতে ভাসাইলি এ ভারতে,
যেন নেই ত্রিজগতে হাসি গল্প গান-
নেই বাঁশি, নেই বঁধু, নেই রে যৌবনমধু,
মুচেছে পথিকবধূ সজল নয়ান।”
[শ্রাবণের পত্র, মানসী]
(৩৮)“এরই মাঝে ক্লান্তি কেন আসে,
উঠিবারে করি প্রাণপণ!
হাসিতে আসে না হাসি, বাজাতে বাজে না বাঁশি
শরমে তুলিতে নারি নয়নে নয়ন।”
[পুরুষের উক্তি, মানসী]
(৩৯)“সব মিলে যেন বাজাইতে চায়
আমার বাঁশরি কাড়ি,
পাগলের মত রচি নব গান,
নব নব তান ছাড়ি।”
[সুরদাসের প্রার্থনা, মানসী]
(৪০)“মর্মবেদন আপন আবেগে
স্বর হয়ে কেন ফোটে না?
দীর্ণ হৃদয় আপনি কেন রে
বাঁশি হয়ে বেজে ওঠে না?”
[প্রকাশবেদনা, মানসী]
(৪১) “ওগো, ভালো করে বলে যাও।
বাঁশরী বাজায় যে কথা জানাতে
সে কথা বুঝায়ে দাও।
যদি না বলিবে কিছু, তবে কেন এসে
মুখপানে শুধু চাও!
তবে ভালো করে বলে যাও।
আঁখিতে বাঁশিতে যে কথা ভাষিতে
সে কথা বুঝিয়ে দাও।
শুধু কম্পিত সুরে আধৌ ভাষা পুরে
কেন এসে গান গাও?”
[ভালো করে বলে যাও, মানসী]
(৪২)“এমনি সুদূর বাঁশি শ্রবণে পশিতে আসি,
বিষাদকোমল হাসি ভাসিত অধরে,
নয়নে জলের রেখা এক বিন্দু দিত দেখা,
তারি ’পরে সন্ধ্যালোকে কাঁপিত কাতরে-।”
[আমার সুখ, মানসী]
# সোনার তরীতে লেখা কবিতাগুলোর পটভূমি সম্পর্কে কবির নিজ মুখেই শোনা যাক,“মানসীর অধিকাংশ কবিতা লিখেছিলুম পশ্চিমের এক শহরে বাংলা-ঘরে। কিন্তু সোনার তরীর লেখা আরেক পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের নদীতে নদীতে গ্রামে গ্রামে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, এর নূতনত্ব চলন্ত বৈচিত্র্যের নূতনত্ব। শুধু তাই নয়, পরিচয়ে অপরিচয়ে মেলামেশা করছিল মনের মধ্যে। বাংলাদেশকে তো বলতে পারিনে বেগানা দেশ; তার ভাষা চিনি, তার সুর চিনি।” তাই সোনার তরী কাব্যের বাঁশি ছড়ায় ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে ভরপুর গ্রাম বাংলার নদী বায়ু জল ও মানুষের জীবনচিত্রের চেনা সুর।
(৪৩)“নূতন-জাগা কুঞ্জবনে
কুহরি উঠে পিক,
বসন্তের চুম্বনেতে
বিবশ দশ দিক।
বাতাস ঘরে প্রবেশ করে
ব্যাকুল উচ্ছ্বাসে,
নবীন ফুলমঞ্জরির
গন্ধ লয়ে আসে।
জাগিয়া উঠি বৈতালিক
গাহিছে জয়গান,
প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে
বাঁশিতে উঠে তান।
শীতলছায়া নদীর পথে
কলসে লয়ে বারি-
কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে-
চলিছে পুরনারী।
কাননপথে মর্মরিয়া
কাঁপিছে গাছপালা,
আধেক মুদি নয়ন দুটি
ভাবিছে রাজবালা-
কে পরালে মালা!”
[সুপ্তোত্থিতা, সোনার তরী]
(৪৪)“তাই আজি শুনিতেছি তরুর মর্মরে
এত ব্যাকুলতা; অলস ঔদাস্যভরে
মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র লয়ে; বেলা ধীরে যায় চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তরমাঝে; শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জানবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন; মুখে নাহি বাণী।
দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি-
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন স্তব্ধ মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো।”
[যেতে নাহি দিব, সোনার তরী]
(৪৫)“সুন্দর সাহানারগে বংশীর সুস্বরে
কী উৎসব হয়েছিল আমার জগতে,
যেদিন প্রথম তুমি পুষ্পফুল্ল পথে
লজ্জামুকুলিত মুখে রক্তিম অম্বরে
বধূ হয়ে প্রবেশিলে চিরদিনতরে
আমার অন্তর-গৃহে- যে গুপ্ত আলয়ে
অন্তর্যামী জেগে আছে সুখ-দুখ লয়ে,”
[মানসসুন্দরী, সোনার তরী]
(৪৬)“দিবস অবশ যেন হয়েছে আলসে।
আমি ভাবি আর কেহ কী ভাবছি বসে।
তরুশাখে হেলাফেলা
কামিনীফুলের মেলা,
থেকে থেকে সারাবেলা
পড়ে খ’সে খ’সে।
কী বাঁশি বাজিছে সদা প্রভাতে প্রদোষে।
[ভরা ভাদরে, সোনার তরী]
(৪৭)“যে সুর তুমি ভরেছো তব
বাঁশিতে
উহার সাথে আমি কি পারি
গাহিতে?
গাহিতে গেলে ভাঙিয়া গান
উছলি উঠে সকল প্রাণ,
না মানে রোধ অতি অবোধ
রোদনা।
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না।”
[প্রত্যাখ্যান, সোনার তরী]
(৪৮)“শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি,
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
পুষ্পের মতো সংগীতগুলি
ফোটাই আকাশভালে-
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসার-ধুলিজালে।
অতি দুর্গম সৃষ্টিশিখরে
অসীম কালের মহাকন্দরে
সতত বিশ্বনির্ঝর ঝরে
ঝর্ঝর সঙ্গীতে,
স্বরতরঙ্গ যত গ্রহতারা
ছুটিছে শূন্যে উদ্দেশ্যহারা-
সেথা হতে টানি লব গীতধারা
ছোটো এই বাঁশরিতে।”
[পুরস্কার, সোনার তরী]
(৪৯)“এ আকাশ, এ ধরণী, এই নদী- ‘পরে
শুভ্র শান্ত সুপ্ত জোৎস্নারাশি! কিছু নাহি
পারি পরশিতে, শুধু শূন্যে থাকি চাহি
বিষাদ ব্যাকুল। আমারে ফিরায়ে লহো
সেই সর্বমাঝে, যেথা হতে অহরহ
অঙ্কুরিছে মুকুলিছে মঞ্জুরিছে প্রাণ
শতেক সহগ্ররূপে, গুঞ্জরিছে গান
শতলক্ষ সুরে, উচ্ছ্বসি উঠিছে নৃত্য
অসংখ্য ভঙ্গিতে, প্রবাহি যেতেছে চিত্ত
ভাব¯্রােতে, ছিদ্রে ছিদ্রে বাঁজিতেছে বেণু;
দাঁড়ায়ে রয়েছ তুমি শ্যাম কল্পধেনু;
তোমারে সহগ্র দিকে করিছে দোহন
তরুলতা পশুপক্ষী কত অগণন
তৃষিত পরানি যত; আনন্দের রস
কতরূপে হতেছে বর্ষণ, দিক দশ
ধ্বনিছে কল্লোলগীতে।”
[বসুন্ধরা, সোনার তরী]
# চিত্রা কাব্যটি রবীন্দ্রনাথের পরিণত পর্বের রচনা। জোড়াসাঁকোতে বসে চিত্রার কবিতাগুলো রচনা করলেও এর সঙ্গে কবির পূর্ববঙ্গের প্রকৃতিনির্ভর স্মৃতিই ছিল মুখ্য পটভূমি। পূর্ববঙ্গের সেই সব স্মৃতি ও অভিজ্ঞতালব্ধ দার্শনিক জ্ঞানের নান্দনিক চিত্রপট আঁকতে কবি তাঁর প্রতিকী চরিত্র বাঁশিতেই নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছেন বারবার।
(৫০)“হে মৌনরজনী! পা-ুর অম্বর হতে
ধীরে ধীরে এস নামি লঘু জোৎস্না¯্রােতে,
মৃদুহাস্যে নতনেত্রে দাঁড়াও আসিয়া
নির্জন শিওরতলে। বেড়াক ভাসিয়া
রজনীগন্ধার গন্ধ মদির লহরী
সমীরহিল্লোলে; স্বপ্নে বাজুক বাঁশরি
চন্দ্রলোকপ্রান্ত হতে; তোমার অঞ্চল
বায়ু ভরে উড়ে এসে পুলকচঞ্চল
করুক আমার তনু; অধীর মর্মরে
শিহরি উঠুক বন; মাথার উপরে
চকোর ডাকিয়া যাক দূরশ্রুত তান;
সম্মুখে পড়িয়া থাক্ তটান্তশয়ান,
সুপ্ত নটিনীর মতো নিস্তব্ধ তটিনী
স্বপ্নালসা।”
[জ্যোৎস্নারাত্রে, চিত্রা]
(৫১ “সুখদুঃখনীরে
বহে অশ্রুমন্দাকিনী, মিনতির স্বরে
কুসুমিত বনানীরে ম্লানমুখী করে
করুণায়; বাঁশরির ব্যথাপূর্ণ তান
কুঞ্জে কুঞ্জে তরুচ্ছায়ে করিছে সন্ধান
হৃদয়সাথিরে; হাত ধরে মোরে তুমি
লয়ে গেছ সৌন্দর্যের যে নন্দনভূমি
অমৃত আলয়ে।”
[প্রেমের অভিষেক, চিত্রা]
(৫২)“সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত, তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণœ তরুচ্ছায়ে দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তত্ত্ববায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি। ওরে তুই ওঠ্ আজি;
আগুন লেগেছে কোথা?কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ-জনে? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে শূন্যতল?”
—————————————-
সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি মাঝে বহুকাল করিয়াছি বাস সঙ্গিনী রাত্রিদিন; তাই মোর অপরূপ বেশ,
আচার নূতনতর তাই মোর চক্ষে স্বপ্নাবেশ
বক্ষে জ্বলে ক্ষুধানল। যেদিন জগতে চলে আসি, কোন্ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি। বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত্রি চলে গেল একান্ত সুদূরে
ছড়ায়ে সংসারসীমা। সে বাঁশিতে শিখেছি যে সুর তাহারি উল্লাসে যদি গীতশূন্য অবসাদপুর
ধ্বনিয়া তুলিতে পারি, মৃত্যুঞ্জয়ী আসার সংগীতে কর্মহীন জীবনের এক প্রান্ত পারি তরঙ্গিতে
শুধু মুহূর্তের তরে, দুঃখ যদি পায় তার ভাষা,
সুপ্তি হতে জেগে ওঠে অন্তরের গভীর পিপাসা স্বর্গের অমৃত লাগি- তবে ধন্য হবে মোর গান,
শত শত অসন্তোষ মহাগীতে লভিবে নির্বাণ।”
[এবার ফিরাও মোরে, চিত্রা]
(৫৩)“কত শুনিয়াছি বাঁশি কত দেখিয়াছি হাসি,
কত উৎসবের দিনে কত যে কৌতুক।
কত বরষার বেলা সঘন আনন্দ-মেলা,
কত গানে গাহিয়াছে সুনিবিড় সুখ।”
[স্নেহস্মৃতি, চিত্রা]
(৫৪)“তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায়,
কাঁপিছে বক্ষ সুখের ব্যথায়,
তীব্র তত্ত্ব দীপ্ত নেশায়
চিত্ত মাতিয়া উঠে।
কোথা হতে আসে ঘন সুগন্ধ,
কোথা হতে বায়ু বহে আনন্দ,
চিন্তা ত্যজিয়া পরান অন্ধ
মৃত্যুর মুখে ছুটে।”
[অন্তর্যামী, চিত্রা]
(৫৫)“ফিরিবে না, ফিরিবে না-
অস্ত গেছে সে গৌরবশশী,
অস্তাচলবাসিনি উর্বশী!
তাই আজ ধরা তলে বসন্তের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কার চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস মিশে বহে আসে, পূর্ণিমানিশীথে যবে দশ দিকে পরিপূর্ণ হাসি
দূরস্মৃতি কোথা হতে বাজায় ব্যাকুল-করা বাঁশি-
ঝরে অশ্রুরাশি।
তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে-
অয়ি অবন্ধনে।
[উর্বশী, চিত্রা]
(৫৫)“একদা সুক্ষণে
আসিবে আমার ঘরে সন্নত নয়নে
চন্দনচর্চিত ভালে রক্তপটাম্বরে,
উৎসবের বাঁশরীসংগীতে।”
[স্বর্গ হইতে বিদায়, চিত্রা]
(৫৬)।“মোর অঙ্গে অঙ্গে যেনআজি বসন্ত-উদয়
কত পত্র পুষ্পময়।
যেন মধুপের মেলা
গুঞ্জরিছে সারাবেলা,
হেলাভরে করে খেলা
অলস মলয়।
ছায়া আলো অশ্রু হাসি
নৃত্য গীত বীনা বাঁশি,
যেন মোর অঙ্গে আসি
বসন্ত-উদয়।
কত পত্রপষ্পময়।”
[উৎসব, চিত্রা]
(৫৭) “আজি নির্মলবায় শান্ত উষার
নির্জন নদীতীরে
ম্লান-অবসানে শুভ্রবসনা
চলিয়াছে ধীর ধীরে।
তুমি বাম করে লয়ে সাজি
কত তুলিছ পুষ্পরাজি,
দূরে দেবালয়তলে উষার রাগিণী
বাঁশিতে উঠিছে বাজি
এই নির্মলবায় শান্ত উষায়
জাহ্নবীতীরে আজি।”
[রাত্রে ও প্রভাতে, চিত্রা]
(৫৮)“চারি দিক হতে বাজিয়া উঠিল
শতকৌতুক হাসি।
শত ফোয়ারায় উছসিল যেন
পরিহাস রাশি রাশি।
—————————–
—————————–
অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে
বাজিতে লাগিল বাঁশি।
বিজন বিপুল ভবনে রমনী
হাসিতে লাগিল হাসি।”
[সিন্ধুপারে, চিত্রা]
পূর্ববঙ্গের পতিসরের (নওগাঁ জেলার আত্রাই থানায় অবস্থিত) গ্রাম্য ছোট্ট নাগর নদীতে বোট বেঁধে চৈত্রের দুঃসহ গরমে বোটের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে নিবিড় দৃষ্টিতে দেখা নদী তীরের অনগ্রসর জনজীবন, গোয়ালভরা গরু, ধানের খড়, বিচালির স্তুপ, ধানকাটা খেত ধূ ধূ প্রান্তর ছুঁয়ে দূরাগত বাঁশির সুরের যে স্পষ্ট স্মৃতি কবি ধারণ করে রেখেছিলেন নিরলংকৃত ভাষায়, ওগুলোই চৈতালির কাব্যের মূলধন।
(৫৯)“যাহা-কিছু বলি আজি সব বৃথা হয়,
মন বলে মাথা নাড়ি- এ নয়, এ নয়।
————————————
————————————
মৌন মূক মূঢ়-সম ঘনায়ে আঁধারে
সহসা নিশীথরাত্রে কাঁদে শত ধারে।
বাক্যভারে রুদ্ধকণ্ঠ, রে স্তম্ভিত প্রাণ,
কোথায় হারায়ে এলি তোর যত গান।
বাঁশি যেন নাই, বৃথা নিশ্বাস কেবল-
রাগিণীর পরিবর্তে শুধু অশ্রুজল।”
[মৌন, চৈতালি]
কবির হৃদয় আকাশে আজ ঘনঘোর মেঘ; তারই মাঝে বিদ্যুতের বিদীর্ণ রেখায় অন্তর ছিন্ন করে কী যেন দেখাতে চায়? আজ সবই যেন বৃথা অশ্রুজল। হারিয়ে গেছে গান, রাগিনী, বাঁশির সুর।
(৬০)“পরান কহিছে ধীরে-হে মৃত্যু মধুর,
এই নীলাম্বর, এ কি তব অন্তঃপুর !
————————————
————————————
তুমি মোরে ডাকিতেছ সর্ব চরাচরে।
প্রথম মিলনভীতি ভেঙেছে বধূর
তোমার বিরাট মূর্তি নিরখি মধুর।
সর্বত্র বিবাহবাঁশি উঠিতেছে বাজি,
সর্বত্র তোমার ক্রোড় হেরিতেছি আজি।”
[মৃত্যুমাধুরী, চৈতালি]
এই নিলাম্বরের অন্তঃপুরে মৃত্যুও যেন মধুর। যেখানে বিবাহবাঁশির হর্ষসুরে নববধূর প্রথম মিলনভীতি কেটে যায় গভীর শিহরণে।
# কণিকা কবির তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির এক অনবদ্য সৃষ্টি। ‘আদিরহস্য’ কবিতায় বাঁশি, ফুঁ আর বংশীবাদক এই তিনের সেরা সমন্বয়ে অনবদ্য সুর সৃষ্টির কৃতিত্ব নিজে এককভাবে দাবি না করে অন্যের অবদানের যথাযোগ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদানের নীতিশিক্ষামূলক বাণী প্রচারের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
(৬১) “বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব,
কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব।
ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি-
যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।”
[আদিরহস্য, কণিকা]
# সরল ভাষায়, নিপুণ ছন্দে গাঁথা, গল্প শোনানোর ছলে কবিতা লেখার নবলদ্ধ স্টাইলটি উদ্ভাবন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “কথা ও কাহিনী” কাব্যগ্রন্থে। এখানেও বাঁশি এসেছে যথার্থ অনুষঙ্গ হয়ে।
(৬২)“বর্ষ তখনো হয় নাই শেষ,
এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা।
বাতাস হয়েছে উতলা আকুল,
পথতরুশাখে ধরেছে মুকুল,
রাজার কাননে ফুটেছে বকুল
পারুল রজনীগন্ধা।
অতি দূর হতে আসিছে পবনে
বাঁশির মদির মন্দ্র।
জনহীন পুরী, পুরবাসী সবে
গেছে মধুবনে ফুল-উৎসবে-
শূন্য নগরী নিরখি নীরবে
হাসিছে পূর্ণচন্দ্র।”
[অভিসার, কথা]
(৬৩)“কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকি বেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মুলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি-
এল তখন একশো রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হোরিখেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
——————————–
——————————–
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালিতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কু-লেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালিতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।”
[হোরিখেলা, কথা]
(৬৪)“নিশীথ-রাতে আকাশ আলো করি
কে এল রে মেত্রিপুরদ্বারে !
‘থামাও বাঁশি’ কহে, ‘থামাও বাঁশি-
চতুর্দোলা নামাও রে দাসদাসী।
মিলেছি-আজ মেত্রিপুরবাসী
মেত্রিপতির চিতা রচিবারে।
মেত্রিরাজা যুদ্ধে হত আজি,
দুঃসময়ে কারা এলে দ্বারে?’
‘বাজাও বাঁশি, ওরে, বাজাও বাঁশি’
চতুর্দোলা হতে বধূ বলে,
‘এবার লগ্ন আর হবে না পার,
আঁচলে গাঁঠ খুলবে না তো আর-
শেষের মন্ত্র উচ্চারো এইবার
শ্মশান-সভায় দীপ্ত চিতানলে।’
‘বাজাও বাঁশি, ওরে, বাজাও বাঁশি’
চতুর্দোলা হতে বধূ বলে।
[বিবাহ, কথা]
(৬৫)“মাড়োয়ার-দূত করিল ঘোষণা,
‘ছাড়ো ছাড়ো রণসাজ।’
রহিল পাষাণ-মুরতি-সমান
দুর্গেশ দুমরাজ।
বেলা যায় যায়, ধূ ধূ করে মাঠ,
দূরে দূরে চরে ধেনু-
তরুতলছায়ে সকরুণ রবে
বাজে রাখালের বেণু।
‘আজমীর গড় দিলা যবে মোরে
পণ করিলাম মনে,
প্রভুর দুর্গ শত্রুর করে
ছাড়িব না এ জীবনে।
প্রভুর আদেশে সে সত্য হায়
ভাঙিতে হবে কি আজ!’
এতেক ভাবিয়া ফেলে নিশ্বাস
দুর্গেশ দুমরাজ।
[পণরক্ষা, কথা]
# কল্পনা কাব্যে প্রাচীন ভারতের প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র্য, পুরাণ, জনজীবন ও আত্মজীবনের গভীর উপলব্ধির বর্ণনায় শব্দ ও ভাষা ব্যবহারে কবি সংস্কৃত ধাঁচকে আধুনিকতার ছাঁচে ফেলেছেন। এ পর্বের কবিতায় বাঁশি শব্দের সমার্থক হিসেবে মুরলী, বেনু, বাঁশরি প্রভৃতির যথোপযুক্ত ব্যবহার লক্ষণীয়।
(৬৬)“আনো মৃদঙ্গ, মুরজ, মুরলী মাধুরা,
বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধূরা-
এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী
ওগো প্রিয়সুখভাগিনী !
কুঞ্জকুটিরে, অয়ি ভাবাকুললোচনা,
ভূর্জপাতায় নব গীত করো রচনা
মেঘমল্লার-রাগিণী।
এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী !”
[বর্ষামঙ্গল, কল্পনা]
(৬৭)“তুলি মেঘভার আকাশ তোমার
করেছ সুনীলবরনী।
শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল
তোমার শ্যামল ধরণী।
স্থলে জলে আর গগনে গগনে
বাঁশি বাজে যেন মধুর লগনে,
আসে দলে দলে তব দ্বারতলে
দিশি দিশি হতে তরণী।
আকাশ করেছ সুনীল অমল,
স্নিগ্ধশীতল ধরণী।”
[শরৎ, কল্পনা]
(৬৮) “ আজ যদি দীপ জ্বালে দ্বারে
নিবে কি যাবে না বারে বারে?
আজ যদি বাজে বাঁশি গান কি যাবে না ভাসি
আশ্বিনের অসীম আঁধারে
ঝড়ের ঝাপটে বারে বারে?”
[ঝড়ের দিনে, কল্পনা]
(৬৯)“দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু-
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু।
কয়েক বসন্তে তারা আমার যৌবনকাব্যগাথা
লয়েছিল পড়ি।
কণ্ঠে কণ্ঠে থাকি তারা শুনেছিল দুটিবক্ষোমাঝে
বাসনা-বাঁশরি।”
[বসন্ত, কল্পনা]
# চৈতালি-কাল থেকে রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনায় যে বিষন্নতার ভাব আচ্ছন্ন করে তা কণিকা, কল্পনা, কথা, কাহিনী পেরিয়ে ক্ষণিকার কবিতা ও বাঁশির সুর পুনরায় ভারমুক্ত চনমনে হয়ে হয়ে উঠে।
(৭০) “কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান,
কোথায় পাবি প্রাণ?
যেথায় সুখে তরুণ যুগল
পাগল হয়ে বেড়ায়,
আড়াল বুঝে আঁধার খুঁজে
সবার আঁখি এড়ায়,
পাখি তাদের শোনায় গীতি,
নদী শোনায় গাথা,
কত রকম ছন্দ শোনায়
পুষ্প লতা পাতা-
সেইখানেতে সরল হাসি
সজল চোখের কাছে
বিশ্ববাঁশির ধ্বনির মাঝে
যেতে কি সাধ আছে?
হঠাৎ উঠে উচ্ছ্বসিয়া
কহে আমার গান-
সেইখানে মোর স্থান।”
[যথাস্থান, ক্ষণিকা]
(৭১)“আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি
সুসভ্যতার আলোক,
আমি চাই না হতে নববঙ্গে
নবযুগের চালক।
আমি নাই বা গেলেম বিলাত,
নাই বা পেলেম রাজার খিলাত,
যদি পরজন্মে পাই রে হতে
ব্রজের রাখাল বালক
তব নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে
সুসভ্যতার আলোক।
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে,
যারা গুঞ্জা ফুলের মালা গেঁথে
পরে পরায় গলে,
যারা বৃন্দাবনের বনে
সদাই শ্যামের বাঁশি শোনে,
যারা যমুনাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে
শীতল কালো জলে-
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে।”
[জন্মান্তর, ক্ষণিকা]
(৭২)“শুক্লসন্ধ্যা চৈত্র মাসে
হেনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে-
আমার বাঁশি লুটায় ভূমে,
তোমার কোলে ফুলের পুঁজি।
তোমার আমার এই-যে প্রণয়
নিতান্তই এ সোজাসুজি।”
[সোজাসুজি, ক্ষণিকা]
(৭৩)“আমায় যদি মনটি দেবে
রাখিয়া যাও তবে,
দিয়েছ যে সেটা কিন্তু
ভুলে থাকতে হবে।
দুটি চক্ষে বাজবে তোমার
নবরাগের বাঁশি,
কণ্ঠে তোমার উচ্ছ্বসিয়া
উঠবে হাসিরাশি।”
[অসাবধান, ক্ষণিকা]
(৭৪)“তখন পথে লোক ছিল না,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম।
ঝাউশাখাতে উঠতেছিল
শব্দ অবিশ্রাম।
আমি শুধু একলা প্রাণে
অতি সুদূর বাঁশির তানে
গেঁথেছিলেম আকাশ ভ’রে
একটি কাহার নাম।
তখন পথে লোক ছিল না,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম।”
[বিরহ, ক্ষণিকা]
(৭৫)“বসেছে আজ রথের তলায়
স্নানযাত্রার মেলা-
সকাল থেকে বাদল হল,
ফুরিয়ে এল বেলা।
আজকে দিনের মেলামেশা
যত খুশি যতই নেশা
সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি-
এক পয়সায় কিনেছে ও
তালপাতার এক বাঁশি।
বাজে বাঁশি, পাতার বাঁশি
আনন্দস্বরে।
হাজার লোকের হর্ষধ্বনি
সবার উপরে।”
[সুখদুঃখ, ক্ষণিকা]
(৭৬)“বলি নে তো কারে, সকালে বিকালে
তোমার পথের মাঝেতে
বাঁশি বুকে লয়ে বিনা কাজে আসি
বেড়াই ছদ্মসাজেতে।
যাহা মুখে আসে গাই সেই গান
নানা রাগিণীতে দিয়ে নানা তান,
এক গান রাখি গোপনে।
নানা মুখপানে আঁখি মেলি চাই,
তোমা-পানে চাই স্বপনে।”
[অন্তরতম, ক্ষণিকা]
(চলবে)